পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় এবং গৌতম সরকার
পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায়
মৃত্যুকে আর ভাবতে ইচ্ছে করেনা “মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান”৷ মৃত্যুর কালো ছায়ার বিস্তার পৃথিবী জুড়ে। তার প্রলম্বিত ছায়া ঘিরে ধরেছে উন্নত, অনুন্নত, উন্নয়নশীল তকমা আঁটা দেশগুলোকে নির্বিশেষে। আশ্চর্যের কথা হল এখন অস্পৃশ্যতার এক অন্যমাত্রায় উত্তরণ। মঈদুল প্রত্যাখ্যান করছে এক সহানুভূতির হাত। সাধারণ জনজীবন স্পর্শ এড়াতে চাইছে উচ্চবর্গের, শুধুমাত্র সংক্রমণের আশঙ্কায় এ বিদ্বেষ এক আরোপিত আত্মরক্ষার মরিয়া প্রয়াস। সাধারণ মানুষ শহরকে দূরে রাখতে চাইছে, শহুরেদের ছোঁয়া তাদের অস্তিত্বকে গুঁড়িয়ে দেবে, বিপন্ন করবে বলে। আন্তর্জাতিক বিপর্যয়- ছায়াচিত্রের ট্রেইলার শুধুমাত্র অনিশ্চিতপুরেই দৃশ্যমান নয়, শহরে তো মুহুর্মুহু এর প্রদর্শন চলছেই। উচ্চবিত্তরা অস্তিত্বের সুরক্ষায় গোয়েন্দার ভূমিকায় অবতীর্ণ। তাঁরা ফেলুদার মতো চোখ রাখছেন অনাবাসী প্রতিবেশী কেউ বিদেশ থেকে ফিরলেন কিনা, ফিরলেও তাঁদের হালহকিকৎ কিরকম। সন্দেহজনক মনে হলেই খবর দাও প্রশাসনকে। তাদের কোয়ারাইন্টিনে পাঠিয়ে তবে স্বস্তির নিঃশ্বাস। না, তাহলেও শান্তি নেই, ডাক্তারের প্রত্যায়িত রোগহীনতার শংসাপত্র দেখেও তাঁরা নিশ্চিন্ত নন। এই দুশ্চিন্তা সংক্রমিত হয়েছে শহর থেকে গ্রামে। অতিমারী যেমন উন্নত দেশ থেকে আমদানি হয়েছে উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশে ঠিক সেইরকম তথাকথিত অভিজাত বিদেশ প্রত্যাগত উচ্চবিত্ত ছড়াচ্ছে সংক্রমণ। আগে কারণ থাকতো অর্ধসচেতনতা যা কিনা অশিক্ষা প্রসূত এখন সুশিক্ষিত আত্মম্ভরী শিক্ষার আলোকে উদ্ধত বেপরোয়া মনোবৃত্তি ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে সংক্রমণের বীজ। ধিক্কার ঐ কুশিক্ষিতদের। নীলকণ্ঠ হয়ে বিষ গলাধকরণ করা ছাড়া আর উপায় নেই। এখন সবকিছুই প্রশাসন নির্ভর হয়ে পরেছে, তাই দ্বারস্থ হতে হল সেই প্রশাসনেরই। মঈদুলদের সামাজিক গণ্ডীতে ওঠাবসা ঐ সুবলের শরণাপন্ন হতে হল। থানাবাবু মাইক্রোফোন নিয়ে সুবলকে সাথে করে বিজ্ঞাপনের ভাষায় জানালেন গ্রামবাসীদের, এই রোগাক্রান্ত সুবল রোগমুক্ত হয়েছে চিকিৎসায়। আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই। শুধু সাবধানে থাকা, মেলামেশা আপাতত বন্ধ। শহুরে বাবুরা অনিশ্চিতপুরে এসেছেন মাসখানেক হয়ে গেল তারা কি ভাবে রোগ বয়ে আনবেন শহর থেকে? কাজেই ঘৃণা বা বিদ্বেষের কোন কারণ নেই। এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। জনরোষের মোকাবিলায় পুলিশী হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হচ্ছে উচ্চবিত্ত শহুরেদের এক সংক্রামক রোগের কারণে। না নিপীড়ন নয়, শোষণ নয়, অত্যাচার নয়, রোগ সন্দেহাতুর করে তুলছে সাধারণকে। সামাজিক গণ্ডীর বাইরে রাখা হত যাদের তারা এখন কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে রাখতে চাইছে তাদেরকে সেই ক্ষমতাসীন উচ্চবর্গকে যেমন কিনা সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া ঘিরে রেখেছে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, রেলপথ, পরিবহন পরিষেবা যা কিছু বিদেশী লেনদেনকে ― এটি তারই ছোট্ট সংস্করণমাত্র। এ প্রত্যাঘাত হয়তো দরকার ছিল আত্মশুদ্ধির জন্যে, শিক্ষা যাদের মনের কালি দূর করতে পারেনি, ডিগ্রি শুধু আমেরিকান ডায়মন্ডের মতো কৃত্রিম উজ্জ্বলতা বাড়িয়েছে আপাত মূল্য যার কিছুমাত্র নেই। শুধু এ ঘটনায় রক্তাক্ত হই অনুভূতিশীল কিছু মানুষ। দেশ হয়ে যায় পরবাস, বিচ্ছেদ মাটি থেকে, প্রাণ থেকে প্রাণে সংক্রমণ ছড়ায় আমরা অসহায় দর্শকের ভূমিকায় তখন। আমরা মানুষ আমরা সভ্যতার রথী মহারথী আমরা যা খুশী তাই করতে পারি আমাদের গতি রোধ করবে কে? অশ্বমেধের ঘোড়ার মত বিজয়ের বার্তা নিয়ে এসে নিজেরাই হলাম বলি।
আমরা “দ্বার বন্ধ করে ভ্রমটারে রুখি, সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?” মনের দরজা বন্ধ রেখে ভুলকে সত্যের আলোয় প্রকশিত হতে দিই না, মনে করি আমার ধ্যানধারণা অবিসংবাদিত, প্রশ্নাতীত, সঠিক। কিন্তু সত্য? সে তো অপ্রকাশিত থাকবেনা। সে যে শাশ্বত, নিত্য, সতত প্রকাশমান। এখন সেটাই প্রমাণিত হতে চলেছে। আমাদের বেপরোয়া আত্মবিশ্বাস, ঔদ্ধত্য, অত্যন্ত সন্দেহজনক শিক্ষার মান তথা বিদ্যার অহমিকাবোধ ঐ “কিস্যু হবেনা” এই আত্মক্ষয়ী মনোবৃত্তির জন্ম দিয়েছে যা বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে আমাদের কাছেই। আর এই যে ভাইরাসের প্রাবল্য অচিরেই এটি একটি কল্পকথায় পরিণতির লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে মনে হয়। সেদিন মনে হয় আর দেরী নেই যেদিন মায়েরা সেই ‘শোলে’র বিখ্যাত সংলাপ “শো যা বেটা গব্বর আ রহা হ্যায়” এর আদলে বলবে, “শিগ্গির চোখ বন্ধ করো সোনা ‘করোনা’ জুজু এলো বলে”৷ অদৃশ্য জুজু তাড়া করে বেড়াচ্ছে আপামর জনতাকে, ধনী দরিদ্র, জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতিকে।
এই অতিমারি বহুমাত্রিক বর্ণময়। দুঃখের রঙ বোধ হয় কালো কারণ তখন আলোর বড়ই অভাব, তাই দুঃখের অন্ধকার এর প্রেক্ষিত, বেঁচে থাকবার আত্মক্ষয়ী জীবনযুদ্ধ এর গতির আবহ, অপরিসীম সম্ভাবনায় ভরা এর মারণাস্ত্র আবিষ্কারের প্রচেষ্টা ― তাই এর উপস্থিতিতে আছে উদ্ভাবনী সম্ভাবনার সবুজ সংকেত। এর কণ্টকসঙ্কুল ভয়াবহ গোলাকৃতি ইতিমধ্যে বিজ্ঞাপনে বিজ্ঞাপিত হয়েছে৷ প্রকৃতিমায়ের অবমাননার ফল এটি এই দৃঢ় প্রত্যয় প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। যেমন গ্রীক নাট্যকার সোফোক্লিসের নাটকে ‘প্লেগ’ অভিশাপের ফল হিসেবে চিহ্নিত অনেকটা সেইরকম। থাক্ সব চুলচেঁড়া বিচার, বাস্তবে ফেরা যাক্ এবার। মঈদুলদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছি, আস্থা, বিশ্বাসের ভিত টলে গেছে, প্রত্যাখ্যান খুব জোরালো, তবে এই প্রত্যাখ্যান বচনেই সীমাবদ্ধ লাঠ্যৌষধে পরিণত হয়নি এই রক্ষে। সাধারণের গ্রহণ ও বর্জন দুটোই খুব আন্তরিক হয়ে থাকে, সেটা পুনরুদ্ধার কিভাবে সম্ভব এটাই এখন ভাববার বিষয় এবং চ্যালেঞ্জ।
গৌতম সরকার
অনিশ্চিতপুরের আকাশের রং গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ। পূর্বাভাস ভীষণ জোরে ঝড় আসছে–সাইক্লোন৷ এর আবার একটা নাম দিয়েছে–আমফান। খবর আছে আজ বিকেলে এটি কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকা দিয়ে বয়ে গিয়ে বাংলাদেশে ঢুকবে। এ জায়গা তো কলকাতা শহর থেকে মাত্র ৫০-৬০ কিলোমিটার দূরে, তাই আশঙ্কা করা হচ্ছে ঝড়ের প্রভাব এই অঞ্চলেও যথেষ্ট পড়বে। বেশ কয়েকদিনই ঘরবন্দি হয়েই দিন কাটাচ্ছি। গ্রামের পরিস্থিতি ভালো নয়। স্থানীয় প্রশাসন তাদের মতো করে সামলাচ্ছে। মানুষের মনে যে ভয় ও বিদ্বেষ বাসা বেঁধেছে তার নিরাময় হয়নি। সুবল এখনও একঘরে, সুস্থতার প্রত্যয়িত কপি পাওয়া সত্বেও তার গোটা পরিবার বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে বেরোতে পারছেনা। মঈদুলদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, তারা তাদের মতো করে চাষবাস করছে। আমি একেবারে কাজকর্মহীন অথর্ব জীবন কাটাচ্ছি। দুপুরের দিকে আবার আকাশ ভেঙে বৃষ্টি এলো।
খাওয়া- দাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল, ঠিক তখনই ঝড় উঠলো। প্রথমে ঝড়ের বেগ কম ছিল৷ বৃষ্টির সাথে মাঝে মাঝে বজ্রপাত হচ্ছিল৷ তারপর ঝড়ের বেগ বেশ কয়েকগুণ বেড়ে গেল৷ এতক্ষন আশপাশের গাছপালাগুলো এ ওর গায়ে ঢলে পড়ছিলো, এবার বাতাসের বেগ বেড়ে যাওয়াতে গাছের ডালগুলো গুঁড়িসমেত থরথর করে কাঁপতে শুরু করলো। কি ভীষণ ঝড়ের আওয়াজ ! যেন মনে হচ্ছে সহস্রনাগ ভীষণ ক্রোধে তাদের সহস্র ফনার ভীম গর্জনে কালবিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে পরিপার্শ্ব জুড়ে। ভীষণ নিনাদে কালভৈরবী চতুর্পাশ্ব ছারখার করতে করতে দিগ্বিদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। প্রাণকাঁপানো বাজের কড়কড় আওয়াজ আকাশ-বাতাস বিদীর্ন করছে। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল নটরাজের প্রলয় নৃত্যে টলমল, প্রলয়ঙ্কর সেই ঝড়ের আওয়াজ আর চোখ ধাঁধানো বিদ্যুতের আলোয় চোখে পড়ছে একের পর এক গাছ সমূলে উৎপাটিত হয়ে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে৷ ভয়ে দরজা জানলা বন্ধ করে দিলাম। আমরা দুটি প্রাণী পরস্পর ঘেঁষাঘেঁষি বসে বিড়বিড় করে ঈশ্বরের কাছে ব্যাকুল ভাবে প্রার্থনা করছি, ” রক্ষা করো ঠাকুর, প্রকৃতির এই ভয়ঙ্কর রোষানল থেকে সমগ্র জীবজগতকে রক্ষা করো !” ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাতের আওয়াজ ছাড়িয়ে মাঝে মাঝে কানে আসছে মানুষের অসহায় আর্ত চিৎকার। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছেনা, আমাদের পাকা ঘর যখন ধসে পড়ার উপক্রম করছে, তখন এই গ্রামের গরীব মানুষগুলোর অপলকা ঘরবাড়ি আর একটাও অটুট নেই। কি করবো বুঝতে পারছিনা, আমাদের ঘরের দেওয়ালগুলো এত জোরে কাঁপছে, মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে ধসে পড়বে। নির্বাক দৃষ্টিতে নিশ্চুপ বসে থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। এই ভয়ঙ্কর ঝড়-বিদ্যুৎ আর বৃষ্টির খেলা চলতেই থাকলো, মনে হচ্ছে প্রকৃতির এই উন্মত্ত ধ্বংসলীলার বোধহয় কোনো শেষ নেই, সবকিছু তার করাল গ্রাসে নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত থামবেনা। আমার স্ত্রী আমার ডানহাতের কব্জিটা এত জোরে চেপে ধরেছেন যে জায়গাটা ব্যাথায় টনটন করছে। এত শক্তি ওই দুর্বল হাতে কোথা থেকে পাচ্ছে ভেবে অবাক হলাম। এবার কাছে-দূরে প্রচুর মানুষের কান্নার শব্দ পাচ্ছি, পাশের রাস্তা দিয়ে বহুমানুষের ছুটে যাওয়ার আওয়াজ পাচ্ছি। কিন্তু ঝড়ের তান্ডবে দরজা খুলে দেখতে পারছিনা। একবার উঠে একটা জানালার পাল্লা খোলার চেষ্টা করলাম, ঝোড়ো হাওয়ার দমকায় বেঁকে গেলাম, চোখে ধুলোকাদা ঢুকে গেলো, কোনরকমে দেখতে পেলাম আমার ঘরের সামনে কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া গাছদুটি মূলসমেত উপড়ে গিয়ে আমার ঘরের দরজা আটকে দিয়েছে। তাড়াতাড়ি জানলা বন্ধ করে নিজের জায়গায় ফিরে এলাম। আমার স্ত্রীকে কিছু বললামনা, তাহলে ও আরো ভয় পেয়ে যাবে। এই তান্ডব আরো আধ ঘন্টা চললো। আর এই আধঘন্টার প্রতিটি মিনিট, সেকেন্ড, পল-অনুপল আমাদের উৎকণ্ঠা, ভয়, উদ্বেগ বাড়াতে বাড়াতে জীবনীশক্তির চরম পরীক্ষা নিতে লাগলো।
ঝড়ের প্রকোপ থেমে গেছে অনেকক্ষন, তবে এখনো হালকা ঘূর্ণি হাওয়া, তার সাথে হালকা বৃষ্টি হয়েই চলেছে। তাই ছাতা বন্ধ করে দিয়েছি। এখন আমি গ্রামের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। তবে এটাকে আর গ্রাম বলা বাতুলতার সামিল৷ গ্রামের দুয়েকটা পাকা দালান ছাড়া কোনো কিছু আর মাটির ওপর দাঁড়িয়ে নেই, সব মাটি নিয়েছে। শত শত অসহায় মানুষ ঘর-সংসার-আসবাব, বহু কষ্টে সঞ্চিত সম্পদ হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে চিৎকার করে কাঁদছে, বুক চাপড়াচ্ছে, পাগলের মতো ভিজে মাটির বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তাঁদের অসহায়, বুকফাটা কান্নার অশ্রুজল বৃষ্টির সাথে মিশে গিয়ে মাটির বুকে মুখ লুকোচ্ছে। ধ্বংসের এই বিভৎস চেহারা আমি জীবদ্দশায় দেখিনি। অসহায়ের মতো সেই বুকফাটা কান্নার শব্দে আমি, লীলামাসি, ডাক্তারবাবু, আর কটেজের কয়েকজন নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজে চলেছি। এই মুহূর্তে করোনার আতঙ্ক সবাই ভুলে গেছে, অসহায় মানুষগুলো একে অপরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সব হারানোর যন্ত্রনা ভাগ করে নিতে চাইছে। আমি লীলামাসির মুখের দিকে তাকাই, ডাক্তারবাবুর মুখের দিকে তাকাই, প্রত্যেকেরই একই অভিব্যক্তি, অসহায় ভাবে সেই ধ্বংসলীলার দিকে নির্বাক তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর লীলামাসি মুখ খুললেন, ” আমার সাথে পঞ্চায়েত প্রধানের কথা হয়েছে, উনি স্কুলবাড়ি খুলে দিচ্ছেন, ওখানে বেশ কিছু পরিবারের থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে, আর বাকিদের জন্যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁবুর ব্যবস্থা করা হবে। আপাতত যতক্ষণ সরকার থেকে কোনো সাহায্য না আসছে, ততক্ষণ এটা চলুক, তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা৷ উনি জানালেন এই সব ব্যবস্থা করেই এখানে চলে আসবেন।” তারপর কিছুটা থেমে বললেন, “আর আমার কটেজে পাঁচটা ঘর খালি আছে, আমি ওগুলো শহর থেকে যদি কেউ আসে, তাদের জন্যে রেখেছিলাম। এখন আমি এই পাঁচটা ঘর গ্রামের মানুষদের জন্যে খুলে দেব৷” আমি একটু ইতস্তত করে বলি, “কিন্তু ওরা কি রাজি হবে !” একটা প্রশান্তির হালকা হাঁসি খেলে গেল স্নিগ্ধ, সুন্দর প্রৌঢ়ার মুখে, আলগা হেঁসে যে উত্তরটা দিলেন সেটা আমি কোনো প্রাজ্ঞ পন্ডিতের মুখেই আশা করতে পারি। ঝড়বৃষ্টির আওয়াজ পেরিয়ে জোর গলায় দৃঢ় স্বরে বললেন, “একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয় মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে, সন্দিহান করে, আরেকটা বিপর্যয় আবার তাদের কাছাকাছি আনে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম।” শোনামাত্র চোখ বুজে বৃষ্টির ধারায় চোখের জল লুকোলাম। এত গভীর বিশ্বাস আর ভরসা কোথা থেকে পেলেন স্বল্প শিক্ষিতা, গ্রাম্য ওই মহিলা! ইচ্ছে হলো মাথাটা ওনার পায়ে নত করি, কিন্তু জানি উনি সেটা করতে দেবেননা, তাই মনে মনে ওনাকে প্রণাম জানালাম। বেশ কিছুক্ষণ আগেই চোখে পড়েছে, একটু দূরে চোখে পড়লো মঈদুল উবু হয়ে দুহাতে মাথাটা চেপে ধরে মুখ নিচু করে বসে আসে। দুয়েকবার চোখ তুলে আমাকে দেখে আবার মাথা নিচু করেছে। ওর পাশে ওর স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। আমার বুঝতে কিছু অসুবিধা হলোনা। আমি এগিয়ে গিয়ে মঈদুলের মাথায় হাত রাখলাম। হাতের ছোঁয়ায় কি ছিল জানিনা! মঈদুল চোখ তুলে তাকালো, ঘন লাল চোখে সব হারিয়ে যাওয়ার বুকফাটা কান্না জমাট বেঁধে আছে। হাত ধরে দাড় করালাম, একটু কাছে টানতেই পুরুষ মানুষের বুকফাটা কান্নায় আশপাশের সবাই এমনকি পাগলা হাওয়াও যেন মুহূর্তকাল থমকে গেল৷ অসহায় মানুষটি আমার বুকের আশ্রয়ে মুখ লুকিয়ে চোখের জল লুকালো। ওর শরীরটা থরথর করে কাঁপছে৷ আমি ওকে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম। ওর পিঠে পরম মমতায় হাত বোলাতে লাগলাম। একটু সামলে উঠে আমার হাত দুটো ধরে কান্নাভরা গলায় কি যেন বলতে চেষ্টা করলো। আমি বাধা দিলাম, আমি ওর হাত ধরে কোনোদিকে না তাকিয়ে কটেজের পথ ধরলাম। আমি জানি লীলামাসি হাঁসি মুখে আমাদের চলার পথের দিকে তাকিয়ে আছেন।
(ক্রমশঃ….)