পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় এবং গৌতম সরকার
পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায়
হ্যাঁ, গত সন্ধ্যার রবীন্দ্র স্মরণ শুরু হয়েছিল “আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্ব” দিয়ে তার পরিণাম কি নিদারুণ হতে পারে সেই মুখই দেখালো এখানকার আশ্রিত মধ্যবিত্ত সমাজ৷ গান যদি তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য নিয়ে মরমে না পৌঁছোয় তাহলে সে গানের অর্থ কি? না অবশ্যই শিশুদের ক্ষেত্রে নয়। তারা গান গায় মনের আনন্দে। কিন্তু পরিণত বুদ্ধির মানুষ যখন অপরিণত আচরণ করে তার কি ব্যাখ্যা হয় আমার অন্তত জানা নেই। “বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর সান্ত্বনা―বিপদে আমি না যেন করি ভয়।” এগানের সুর “কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো আকুল করিল মন প্রাণ” তখন তাৎক্ষণিক আবেগে অনেকের চোখ ছলছলিয়ে উঠতেও দেখেছি, অথচ আজকের প্রেক্ষিত সম্পূর্ণ আলাদা। এই বর্ণময় দ্বিচারিতা, আবেগসর্বস্বতা এবং পরমুহূর্তেই নিজের সততা থেকে সরে এসে স্রোতের বিপরীতে হাঁটা এটাই আমাদের মধ্যবিত্ত বাঙালীর যাকে বলে স্ট্যাম্প মারা বৈশিষ্ট। এই অনন্য চারিত্রিক ত্রুটি/পলায়নী মনোবৃত্তিই আমাদের স্বকীয়তা। আমরা আবেগের বল্গাহীন প্রশ্রয়ে চলি, অনেক দুনিয়াদাড়ি দেখাই, পরম ঔদার্যে অনেক কিছু প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই, কিন্তু নিজের স্বার্থচিন্তা যদি কিছুমাত্র বিঘ্নিত হয় তবে বন্য বোধবুদ্ধিহীন পশুর মতোই দাঁত-নখ বের করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত হইনা। অসহায় শিশুর মায়াময় মুখ, সরলা মেয়েটির জলভরা চোখ তখন মধ্যবিত্তের নির্মম বিবেচনার পায়ে মাথা কুটে মরে, বরফ গলেনা। আমরা শিক্ষিত বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া সত্ত্বেও মধ্যযুগের জমিদারের মেজাজে রাজা হয়ে প্রজা শাসন করি, অযৌক্তিকভাবে উচ্ছেদের ব্যবস্থা নিতে তৎপর হই এখন যেমন অনেক সময়ে খবরের কাগজের পাতায় ডাইনী সন্দেহে পিটিয়ে মারার খবর দেখতে পাই অনেকটা সেইরকম। গতকাল কোন গানটা যেন সমবেতকণ্ঠে সবাই চোখ বুজে আবেগ থরথর কণ্ঠে গাইছিলেন? মনে পড়েছে – “মোরা সত্যের পরে মন আজি করিব সমর্পণ। জয় জয় সত্যের জয়।” সেই সত্যের অববোধের জন্যে ডাক্তারকে এই জরুরী পরিস্থিতিতেও ডেকে আনতে হল। পঞ্চায়েত প্রধানের ধিক্কার এবং জাতীয় বিপর্যয়ের বার্তা অন্তঃস্থলে পৌঁছলো কি? জাতির তথা মনুষ্যত্বের উজ্জীবনের মন্ত্র, লীলাদেবীর জীবনাদর্শের উদাহরণ কি আর পর্যালোচনার দরকার ছিল?
এই আনপ্রেডিকটেবল মধ্যবিত্তরা মধ্যম চিন্তাশক্তিতেই রয়ে গেল, মনের বিত্ত তলানিতে ঠেকলো, চিত্ত ভাবনাহীন হতে পারলো কি?
ইতিমধ্যে গোদের ওপর বিষফোঁড়া, বড়গাঙ পারে একদল শহর ফেরত মানুষের মধ্যে একজন অসুস্থ হয়ে পরায় তাকে ফেলে রেখে চলে গেছে সঙ্গীরা। ডাক্তারবাবু চিকিৎসা করছেন, কিন্তু অবস্থা সন্দেহজনক। আবার সকলের কপালে ভাঁজ। অসুস্থ লোকটির স্ত্রী ছিলেন সঙ্গে, তিনিও নাকি পালিয়েছেন। ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’৷ মনে পড়ে গেল সেই দুঃসহ স্মৃতি…. তিস্তার জল বোধকরি লজ্জায় পলিতে ঢেকে রেখে গিয়েছিল অশীতিপর বৃদ্ধাকে। তাঁর ছেলে নিজের নজন ছেলেমেয়েকে সুরক্ষিত আশ্রয়ে নিয়ে গেছে একমাত্র মাকে ছাড়া। করুণস্বরে আকুলভাবে হয়তো ডেকেছিলেন আত্মজকে কিন্তু হায়! শেষে সলিলসমাধি হয়েছে তার৷ অশীতিপর বৃদ্ধা ছিলেন বাদের খাতায়। এইরকম কতকিছু বাতিল আসবাবের মতো পরিত্যক্ত হয়, শুধু স্মৃতি হয় স্বার্থপর অবক্ষয়ের গল্পকথায় ভরপুর ঘুণপোকার আবাস, কুরে কুরে খায় দুর্বল মনকে।
আমাদের শহুরে বাবুদের দলে আছেন হিসেবী বড়বাবু যিনি দিনরাত পরিসংখ্যানে ব্যস্ত। এরপর জাতীয় বিপর্যয়ের ফলে অর্থনীতিতে এবং সামাজিক পরিস্থিতিতে কি বিরাট পরিবর্তন আসতে চলেছে তারই তুলনামূলক পর্যালোচনা চলছেন সঙ্গীদের সাথে। দলে তরুণ তরুণীও আছে বেশকিছু। তারা আগুপিছু চিন্তা করেনা। চলমান দূরাভাষ এখানে টাওয়ারের নাগাল পায়না তাই এই বিচ্ছিন্নতার কারণ সম্বন্ধে তারা সমালোচনায় মুখর। সেই সঙ্গে চটজলদি খাবারের এবং শপিংমলের মোহময় আকর্ষণকেও তারা ক্ষণে ক্ষণে মিস্ করছেন। গিন্নীরাও দূরদর্শনের জনপ্রিয় ধারাবাহিকের কূটকচালের কাণ্ডকারখানাতে মনোনিবেশ করতে পারছেন না, তাই ব্যথাতুর মনে দিন গুণছেন কবে এখান থেকে মুক্তি পাবেন। সদ্য বিবাহিত দম্পতিও আছেন দু চারজন। তারা নিজেদের নিয়ে মশগুল। স্কুল পড়ুয়া উচ্চমাধ্যমিক পরিক্ষার্থীরা ফেলুদার মতো অতিমারির উৎস সন্ধানে তৎপর। খলনায়কের ভূমিকায় কে? চৈনিক গবেষণাগার না বিদেশ প্রত্যাগত পড়ুয়া ভালোছেলের দল যারা আপাতত পরিযায়ী পাখীর মতো নিরাপদ আশ্রয়ে নিজের দেশে? ভালো কথা পরিযায়ী শ্রমিক কথাটি আজকাল খুব শোনা যাচ্ছে। সেদিন পথে সেইরকম একটি দলকে দেখলাম যারা রেলপথ নির্মাণের কাজে এসেছিল। কাজ বন্ধ তাই ঠিকাদার আর তাদের ঠিকা বহন করেননি। ওরা ফিরে চলেছে নিজের দেশে। হাজার মাইল দূরে সুদূর মধ্যপ্রদেশে তাদের ঘর, সেখানে বৌ, ছেলে, বাবা মা আছেন। কেউ কেউ আবার সপরিবারে কাজে এসেছিল, এখন ফিরে চলেছে বৌ বাচ্চা লটবহর নিয়ে, এখন তাদের দায় কারুর নয়। পরিযায়ী পাখী খাদ্য আর সুরক্ষিত নিশ্চিন্ত আশ্রয় খুঁজবার তাগিদে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দেয় ডানায় ভর করে, এইসব পরিযায়ী শ্রমিকদের পথচলার অদম্য অকুতোভয় মনোবৃত্তি কর্মঠ পায়ের পেশীশক্তিতে এগিয়ে চলা যেন এক চিরন্তন প্রেরণার উৎস হয়ে থাকে। শ্রদ্ধাবনত ইতিহাস যেন তাদের মনে রাখে আগামীদিনে দুর্দিন দুঃসময়মুক্ত ভারতবর্ষে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকলে মানুষের আত্মবিশ্বাস অনেকটা বেড়ে যায় যেমন মৃত্যু নিশ্চিত জেনে মানুষ বাঁচবার জন্যে মরিয়া চেষ্টা করে অনেকটা সেইরকম। গেঁড়ি-গুগলির মতো বেঁচে থাকা পরজীবী মানুষগুলো এদের দেখেও কি শেখে না? অপরিসীম কষ্টে মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। রাস্তায় নামা বারণ, যানবাহন নিষিদ্ধ কেউ কেউ আশ্রয় নিয়েছে রেলপথ ধরে হাঁটবার। সেখানেও নজরদারি। পণ্যবাহী ট্রেনে কাটা পড়লো কজন সেদিন। চলার পথে দ্রুতগামী মালবাহী ট্রাক পিষে দিল চলমান একটি স্রোতকে। অন্তঃসত্ত্বা মহিলা প্রসববেদনা নিয়ে হাঁটছেন, পথে নবজাতকের জন্ম দিয়ে ঘণ্টা দুয়েক বিশ্রাম নিয়ে ‘আবার চল মুসাফির’। আমরা সভ্য সমাজ কি এ কষ্টের কথা চিন্তা করতে পারি? না ওতে আমরা অভ্যস্ত নই। কিন্তু ওদের কষ্ট লাঘবের দায়, পথশ্রমে মদত দেবার মানবিক মুখ কিন্তু সেই মধ্যবিত্তের। এখানেই মধ্যবিত্তের ঔদার্য, সমবেদনার প্লাবন কিন্তু প্রথম নাড়া দেয় তাদেরই। তাই দেখলাম পথে অস্থায়ী রান্নাঘর, খাবার বণ্টনের ব্যবস্থা। গ্রামবাসীরা সাধ্যমত ভাঁড়ারের উদ্বৃত্তটুকু দিয়ে চলমান জনস্রোতের কিছু লোকের উদরপূর্তির ব্যবস্থা করছেন।
গৌতম সরকার
দেশের তথা বিশ্বের অবস্থা ক্রমশঃ খারাপ থেকে খারাপতর দিকে যাচ্ছে। প্রথম দিকে মানুষ যথেষ্ট আতঙ্কিত হয়ে পড়ে সাময়িকভাবে গৃহকোনকে আশ্রয় হিসাবে মেনে নিয়েছিলো এই ভেবে যে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির রমরমা বাজারে সমস্যার আশু সমাধান মিলেই যাবে, কিন্তু আজ প্রায় আড়াই মাস পরে মানুষকে চরম ভাবে মৃত্যুভয় গ্রাস করেছে। বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশে মারণ রোগে বলির সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। চিকিৎসা শাস্ত্রে অতি বলীয়ান দেশগুলো আপ্রাণ চেষ্টা করেও বাঁচার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছেনা। সেখানে আমাদের মতো গরীব দেশ কি করবে ! সবথেকে ভয়ের ব্যাপার হল আমাদের দেশের জনসংখ্যা আর জনঘনত্ব; একবার কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হলে মুহূর্তের মধ্যে কোটি কোটি মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। অনিশ্চিতপুর কোলকাতা থেকে দূরে হলেও স্বাভাবিক নিয়মে সব খবরই আসে, সংক্রামিত এলাকায় সরকার লকডাউন শিথিল করতে বাধ্য হয়েছে; মানুষ খেতে পাচ্ছেনা, কাজ নেই, ইনকাম নেই৷ ছেলেমেয়ে, পরিবার-পরিজন নিয়ে ভিক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই; কিন্তু ভিক্ষাই বা কে দেবে ! পরিস্থিতি তাদের অবাধ বিচরণ স্বাধীনতাও কেড়ে নিয়েছে, দূরে যেতে পারেনা আর আশপাশের সবাইয়েরই অবস্থা একই ধরণের, কে কার কাছে সাহায্য চাইবে ! এত নিরন্ন মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের দেশের সরকারের নেই, তাই এই লকডাউনের শৃঙ্খল শিথিল করতেই হতো, আর সেটাই হয়েছে। আর এরই ফলশ্রুতিতে মারণ ভাইরাসের সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সরকারের অবস্থা আরও বেশি কোণঠাসা হয়ে গেছে সম্প্রতি পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুতে। সভ্য জগতে এইরকম মৃত্যুর কথা ভাবলে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। এই আপদকালীন সময়েও গোটা বিশ্বের মানবজাতির কাছে আমাদের এই লজ্জা সারাজীবন আচ্ছন্ন করে রাখবে। অসহায় লক্ষ লক্ষ মানুষ যাদের জীবনে কোনো কিছুই স্থায়ী নয়-না বাড়ি-ঘর, সামাজিক কৌলিন্য, জীবন-জীবিকা কিছুই নয়। তাই তাদের প্রতি কারখানার মালিক, সরকার, সমাজের মানুষ কারোরই দায়বদ্ধতা থাকতে পারেনা। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ট্যুইটারে একটু হা-হুতাশ আর দারুন দারুন কিছু ছবি পোস্ট করে হাত ধুয়ে ফেলেছে। আমরা কেউই রোদে-জলে-দিনে-রাত্রে খালি পায়ে, খালি পেটে পরিবারের লোকজনকে নিয়ে, অথবা সহস্র মাইল দূরে ঘরে আকুল অপেক্ষায় থাকা বউ, ছেলে-মেয়ের ছবি বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে কর্দমাক্ত, ফালি-ফালি হয়ে যাওয়া, রক্তাক্ত পায়ে হেঁটে যাওয়া মানুষগুলোর মুখে একমুঠো খাবারও তুলে দিতে পারিনি। তাই সব কষ্ট, মান-অভিমান, প্রেম-ভালোবাসা, ঘাম-রক্ত মেখে তারা শুয়ে পড়ে রেল লাইনে খোয়া বিছানো অন্তিম শয্যায়। এই সব খবর কিন্তু একটু দেরিতে হলেও অনিশ্চিতপুরকে ছুঁয়ে যায়। প্রথম প্রথম এসে দেখেছিলাম জগতের সার্বিক সমস্যার ব্যাপারে এখানকার বেশিরভাগ মানুষ সচেতন নয়, আর যারা অবগত তারা ব্যাপারটাকে একদম শহুরে সমস্যা ভেবে পাত্তাই দিচ্ছেনা। কিন্তু দিনের পর দিন পরিস্থিতি যেভাবে বদল হয়ে চলেছে, এখানকার মানুষরাও এখন রোগ সম্পর্কে নিস্পৃহ থাকতে পারছেনা। তারা সচেতন হোক, প্রয়োজনীয় সতর্কতা নিক –সেটা তো কাম্য, কিন্তু ভয় হচ্ছে অন্য জায়গায়। এই রোগের কারণ এবং ফল সম্পর্কে তারা নিজেদের মতো করে একটা ধারণা তৈরি করে নিচ্ছে, আর আমি দেখতে পাচ্ছি এই প্রথম শহর থেকে উঠে আসা মানুষগুলোর প্রতি তাদের আস্তে আস্তে বিদ্বেষের মনোভাব তৈরি হচ্ছে।
দিনে দিনে অনিশ্চিতপুরের শান্ত আকাশ অশান্তির ভয়ংকর মেঘে ছেয়ে গেল। কয়েকদিনের মধ্যেই সেই অসন্তোষ ফুলে-ফলে পল্লবিত হয়ে তীব্র আক্রোশে দাবানলের মতো সারা গ্রামে ফেটে পড়লো। এখন গ্রামের সেই আপাত শান্ত মানুষজন সোচ্চারে বলে ফিরতে লাগলো, “শহর থেকে আসা মানুষগুলোই এই মারণ রোগের বাহক, অচিরেই সারা গ্রামে মড়ক লাগবে তাই সত্বর এখান থেকে ওদের বিতাড়িত করা হোক”। আর এই আন্দোলনে প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিতে লাগলো আমার প্রিয় চাষী বন্ধুরা- মঈদুল, জাকির, মোক্তার, পরান, নিমাই, আশিকুল-যাদের সাথে এই কটা মাস হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছি। সমস্যাটা শুরু হয়েছে কটেজে যেদিন এখানকার ডাক্তারবাবু এসেছিলেন তার পরেরদিন থেকেই। ওদের মধ্যে ভুল ধারণা তৈরি হয়ে গেছে, ভেবে নিয়েছে ডাক্তারবাবু কোনো করোনা আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা করতে এসেছিলেন। আর সেই সব রোগী বা রোগীরা এই কটেজে লুকিয়ে আছে। এই ধারণা আরো বলবৎ হয়েছে সম্প্রতি শহর থেকে আসা দলটি তাদের দলে জ্বরে আক্রান্ত ওই সঙ্গীকে ফেলে যাবার পর। প্রথম দিকে আমি ব্যাপারটা পাত্তা দিইনি। ভেবেছিলাম একটু বুঝিয়ে বললেই ওদের ভুল ভেঙে যাবে। কিন্তু পরে দেখলাম ওরা আমাকেও এড়িয়ে যেতে শুরু করেছে। চাষের কাজের সময় দুদিন পরপর জমিতে গিয়ে কোনো চাষিভাইয়ের দেখা পেলামনা; একটু অবাক হয়ে অগত্যা একদিন বিকেলে মঈদুলের বাড়ি গেলাম। উঠোনে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকবার ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া পেলামনা। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভিতরে মানুষজনের অস্তিত্ব টের পেলাম কিন্তু কেউ বেরিয়ে এলোনা। আরেকবার ডাকতে দরজাটা একটুখানি খুলে সম্ভবত মঈদুলের স্ত্রীই জানালো, মঈদুল বাড়ি নেই, বলেই সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ করে দরজা বন্ধ করে দিলো। মনে মনে ভাবলাম, এরাই সেই মানুষ যারা কিছুদিন আগেই আমাকে একটু খাওয়ানোর জন্যে আত্মীয়তার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিল। ফিরে এসে গ্রামের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে লীলামাসীর সাথে আলোচনা হলো। ভদ্রমহিলাও ঘটে চলা অশান্তিজনক পরিস্হিতি নিয়ে ভীষণভাবে চিন্তিত। উনি আমাকে শলা দিলেন ডাক্তারবাবুর সাথে দেখা করে আলোচনা করতে। সেইমতো পরের দিন ডাক্তারবাবুর সাথে দেখা করলাম। শত ব্যস্ততার মধ্যেও ভদ্রলোক আমাকে সময় দিলেন। গ্রামে ঘটে চলা সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা হলো। কথা বলে যেটুকু বুঝলাম, এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলের পূর্ণ সাহায্য পাওয়া যাবেনা। আর যাই হোক এই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পায়ের নিচের মাটি হারাতে চায়না। ভোটের রাজনীতিকে সম্পূর্ণ ভাবে নিষ্কণ্টক রেখেই ওরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে, অন্যথায় নয়।
দিন কাটানো একপ্রকার অসম্ভব হয়ে উঠতে লাগলো। শহর ছেড়ে আসার সময় চোখে অন্ধকার দেখেছিলাম, মনে হয়েছিল জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছে গিয়েছি। তারপর এই জায়গা, এখানকার জল-বাতাস-মাটি, সর্বোপরি এখানকার সরল-সাধারণ, খেটে খাওয়া মানুষগুলো তাদের আত্মীয়তার প্রশস্ত হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমাদের আপন করে নিয়েছিল, আর আজ কোন এক অজানা-অচেনা মারণ ভাইরাস মানুষে-মানুষে বিশ্বাস-ভালোবাসা-ভ্রাতৃত্ব-নির্ভরতার বন্ধন ছিঁড়ে-খুঁড়ে ছারখার করে দিচ্ছে। অসহায়ের মতো ঘরের মধ্যে গুমরে গুমরে মরি। আমার স্ত্রী ব্যাপারটা ভালো হচ্ছেনা বুঝে জোর করে একদিন মাঠে পাঠিয়ে দিলো। বেরিয়ে পড়লাম, সেই এক জমি, এক মাটি, এক রাস্তা , এক আলপথ, এক পুকুর, কিন্তু নিজেকে কেন যেন পরদেশী মনে হতে লাগলো। আর সেই বোধ শরীরের রক্ত, অস্থি, মজ্জা পেরিয়ে হৃদয়ে বিশ্বাস হয়ে গেঁথে গেল যখন ওই উদার প্রান্তরে আকাশ-বাতাস-জল-গাছ-পাখিকে সাক্ষী রেখে মঈদুলরা সম্মিলীত ভাবে আমাকে বর্জন করলো। দ্বিতীয়বারের জন্যে আবার ঘর হারালাম। কষ্ট-যন্ত্রনা-দুঃখে মাথা ছিঁড়ে যেতে লাগলো। ভয় পেয়ে ঘরের দিকে দৌড়োতে লাগলাম, ওদের কথাগুলো ভয়ংকর ভাবে তাড়া করতে লাগলো—“আপনি আর কোনোদিন মাঠে আসবেনা না বাবু, কারোর বাড়িতেও যাবেননা। আপনারা চলে যান, এই গ্রাম ছেড়ে চলে যান, চলে যান, এক্ষুনি চলে যান”৷
(ক্রমশঃ……)