গৌতম সরকার এবং পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায়
(পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায়)
এই অনিশ্চিত ভবিষ্যত, দোলায়মান ভাগ্যের দড়িতে ঝুলতে ঝুলতে জীবনের রোপওয়েতে পরিভ্রমণ – কখন কি ঘটবে এই জিজ্ঞাসা পরতে পরতে ঢেকে রাখে মানুষের অস্তিত্বকে, শুধু ব্যাপ্তি এবার বিশ্ব জুড়ে, এইমাত্র। সেই বিগত শতকের আটষট্টিতে প্রাকৃতিক জলাশয়ের এক নদীসমান জল তিস্তা হয়ে রাতারাতি ভাসিয়ে নিয়ে গেল খড়কুটোর মতো ডুয়ার্সের আপামর জনতাকে, রেয়াত করলোনা ধনী গরীব কাউকেই। বিগত শতকের একেবারে শেষে সেই সুপার সাইক্লোন সেও তো চোখে দেখা। ভুবনেশ্বর শহরে নারকেল গাছ ছাড়া একটি গাছও দাঁড়িয়ে ছিলনা সেদিন। শুধু নারকেল গাছ, ওরা নাকি ওপরে যতটা উদ্যতগ্রীবা আবার মূলও ততটাই গভীরে বিস্তৃত। মাঝে মাঝে মনে হয় পর জন্মে যেন নারকেল গাছ হয়ে জন্মাই, তাহলে অন্তত অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়তে হবেনা। কি সব যা তা ভাবছি ! এখন দুঃসময়ে এ কি আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা? বিপন্নতার আবহে যাদের যাপন সেই কীটপতঙ্গ সমতুল মানুষ এর থেকে বড় চিন্তায় মগ্ন হবে কিভাবে? এই বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিই। এই যে ধান থেকে চাল বের করবার প্রক্রিয়া, এ কি সর্বদাই ফলপ্রসূ হয়? কত ধানে কত চাল একথা বলে তাহলে মানুষ ভয় দেখায় কেন? কত ধানতো বন্ধ্যা নিষ্ফলা হয়ে যায় নিষ্পেশনে? বলিরেখায় জীবনের প্রতিটি রেখা আঁকিবুকি কেটে গেছে এইরকম মুখ চিরকালই আকর্ষণ করে আমায়। সমীহের সুরে বৃদ্ধের কাছে জানতে চাইলাম তাঁর খবরের উৎসটা কি? তিনি এগিয়ে দিলেন একটি ছেঁড়াপাতা, তাতে ছবি একটি হাসপাতালের, যেখানে কাজ করছেন নভশ্চারীর মতো বেশে নার্স আর চিকিৎসকেরা। অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আপাদমস্তক প্লাসটিকে আচ্ছাদিত হয়ে যুদ্ধ করছেন তাঁরা মারণরোগের সঙ্গে। যুদ্ধ এক অসম যুদ্ধ, প্রতিপক্ষ ক্রমশ বিধ্বংসী চেহারা নিচ্ছে। তাও মানুষের শক্তিতো অসীম। ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’। যে প্লাসটিক বিদ্বেষের বিষবাষ্পে জর্জরিত ছিল সেও আজ সাদরে আমন্ত্রিত এই লড়াইয়ে। বিকল্প কোথায়? কিন্তু সম্বিত ফিরে পেলাম বৃদ্ধের “অ রিফিউজি !” এই তাচ্ছিল্যে। স্বেচ্ছা নির্বাসিত আর উদ্বাস্তু বোধহয় সমার্থক নয়। আমার পরিচয়জ্ঞাপনে হয়তো অসঙ্গতি আছে তাই চুপ করেই রইলাম। বড় অর্থে ঐ চরম শত্রু আমাদের ভিটে থেকে উৎখাত করেছেতো বটেই তবে অনুষঙ্গে আছে নিজের খামখেয়ালী মনোবৃত্তি আর কল্লোলিনীর প্ররোচনা। আদ্যিকালের বদ্যিবুড়োদের গল্প কিন্তু খুব আকর্ষণীয় হয়। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল এক বদ্যিবুড়ির উদ্বেগের কথা। তখন ষাটের দশকে চিন ভারত যুদ্ধ চলছে। যে কোন দিনই নাকি বম্বিং হতে পারে উত্তরবঙ্গে। এমত অবস্থায় ঠাকুমার এক বান্ধবীর গভীর উদ্বেগ এবং একটি পরম নিশ্চিন্ত সমাধান – এই বর্ষার বৃষ্টিতে আকাশ থেকে পড়তে পড়তে নেতিয়ে যাবেনা !
(গৌতম সরকার)
কতক্ষণ এইসব চিন্তায় নিজের মধ্যে ওলটপালট চলেছে টের পাইনি। বুড়ো মানুষটাও আমার সাময়িক হৃত চেতনা ফেরানোর চেষ্টা করেনি। বাস্তবে ফিরলাম একটা কচি গলার নরম ডাকে, “আপনার চা, মা পাঠিয়ে দিলো।” তাকিয়ে দেখি একটি দশ-বারো বছরের মেয়ে, একটা চটা ওঠা কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি ওর হাত থেকে কাপটা নিয়ে, হেসে ওর মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দিলাম। লজ্জা পেয়ে বাচ্চাটি দৌড়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলো। চায়ে চুমুক দিলাম, বেশ ভালো চা। বুড়োর মুখের দিকে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকালাম, এই সময়ের মধ্যেই আমাকে জানতে না দিয়ে ইশারা-ইঙ্গিতে অন্দরমহলে অতিথি সৎকারের নির্দেশ পাঠিয়েছে। যতক্ষণ আমার চা খাওয়া শেষ করলাম বুড়ো আমার মুখের দিকে একভাবে চেয়ে রইল। ভীষণ ঘোলা দৃষ্টি, ভ্রম হয় যেন দুচোখেই মস্ত বড় ছানি পেকে জমে আছে, যেকোনো মুহুর্তেই পুঁজ হয়ে ফেটে পড়বে। চা শেষ করে আমি বুড়োর দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি এনে জিজ্ঞাসা করি, “এবার আপনার কথা বলুন।” বুড়ো নড়েচড়ে বসল, বেশ অবাক হয়ে গেছে। ভাবতে পারেনি কেউ কোনোদিন তার মতো একজন সাধারণ গ্রাম্য, দিন-আনি-দিন-খাই মানুষের গল্প শুনতে চাইবে। ফোকলা মুখে একগাল হাসি এনে বেশ লজ্জা পেয়ে বুড়ো বলে, “আমি আবার একটা মানুষ বাবু ! আমাদের আর কি গল্প আছে ?” আমার তখন ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলছে বুড়োর জীবনে গল্প আছে, কিন্তু লজ্জা পাচ্ছে। আমি ওকে সহজ করার জন্যে বলি, ” দেখুন, আমরা ভাগ্যের তাড়নায় আজ এই গ্রামে এসে পৌঁছেছি। আপনারা যারা আগে থেকে এই গ্রামে আছেন তারাই আমাদের অভিভাবক। তাই আপনাদের সব কথা যেমন আমাদের শোনা দরকার, তেমনি আমরাও আমাদের সব কথা আপনাদের জানাবো। তবেই আমরা পরস্পরের উপযুক্ত প্রতিবেশী হয়ে উঠবো। আপনি এই গ্রামের প্রবীণ মানুষ, আপনাকে আমার জিজ্ঞাসা, এই অনিশ্চিতপুরের কি এমন বিশেষত্ব আছে যেকারণে সরকার এই নিরুপায়, অসহায় মানুষগুলোকে এখানে পাঠিয়ে দিল?” আমার দীর্ঘ প্রশ্ন শুনে বৃদ্ধ মানুষটা বেশ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইলো, তারপর মুখ তুলে তার ঘোলা চোখের গভীর স্থির দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা করলো, “শুনতে চাও, এ গ্রামের সত্যি ইতিহাস শুনতে চাও?”
আমি আগ্রহ সহকারে একটু এগিয়ে বসি।
প্রায় দেড়শো বছর আগে এই গ্রামের পত্তন। আমার বাবার বাবা এই গ্রামে আসেন তখন তাঁর বয়স তিরিশ, আর আমার বাবার বয়স ছিল আট। আমার পিতামহ ছিল প্রথম জীবনে ডাকাত। তখন ইংরেজ আমল, ডাকাতির ন্যূনতম সাজা ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ঠাকুরদাদের একটা খুব শক্তিশালী ডাকাতের দল ছিল; জমিদার, সরকার, ইংরেজ সবাইয়ের চোখে ধুলো দিয়ে একের পর এক ডাকাতি চালিয়ে যেতো। কিন্তু একবার তারা ধরা পড়ে গেল। বিচার হলো, বিচারে সশ্রম কারাদণ্ড সাব্যস্ত হল। তখন ব্রিটিশ সরকারের যিনি প্রতিভূ ছিলেন তিনি একটু অন্য রকমের মানুষ ছিলেন৷ তিনি ডাকাতির সাজা হিসেবে অভিনব এক শাস্তির ব্যবস্থা করলেন। সবকটি ডাকাতকে চালান করলেন নাগরিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থেকে বহু দূরে এই অনিশ্চিতপুরে। সবাইকে দিলেন একফালি করে জমি আর প্রতিজ্ঞা করালেন ভবিষ্যতে ডাকাতি-রাহাজানি ছেড়ে আগামী দিনে পরিশ্রম দিয়ে তারা নিজেদের এবং পরিবারের ভাত-কাপড় জোটাবে। অন্যথায় তাদের ভীষণ শাস্তি পেতে হবে। আর এরই সাথে আদেশ দিলেন, তাদের পরিবার-পরিজনকেও সঙ্গে নিয়ে এই অচিনপুরীতে যেতে হবে। এই হলো এই অনিশ্চিতপুর সৃষ্টির ইতিহাস। তখনকার অনিশ্চিতপুর আর এখনকার অনিশ্চিতপুরে আকাশপাতাল তফাৎ। চারিদিকে কাঁকুরে, পাথুরে জমি, হাজার-দেড়হাজার ফুট মাটি খুঁড়েও জলের সন্ধান পাওয়া যায়না, ধূসর, বাদামি প্রকৃতিতে সবুজের চিহ্ন নেই বললেই চলে। বছরের পর বছর, একপুরুষ থেকে আরেক পুরুষের কঠোর পরিশ্রম আর ঘামে তৈরি হয়েছে আজকের এই অনিশ্চিতপুর। আমার বাবা ছিলেন আরোও পরিশ্রমী কৃষক। একটু বড় হতেই সংসারের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম। বুড়ো বাবাকে আর পরিশ্রমের কাজ করতে দিইনি। আজও মনে পড়ে ছোটবেলা থেকে ঠাকুরদা সবসময় নিজের উদাহরণ টেনে শিক্ষা দিতেন সৎ হতে। তিনি বলতেন -পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। বলতেন, নিজের ঘামঝরা ফসলে নিজের আর পরিবারের খিদে মেটানোর মতো আনন্দের সাথে পার্থিব আর কোনো আনন্দের তুলনা হয়না। সেই থেকে এই গ্রামের প্রতিটি পরিবার, প্রতিটি মানুষ এটাই জীবনের মূলমন্ত্র করে নিয়েছে। আজ এই অনিশ্চিতপুরে কি নেই! -মাঠ ভরা ফসল আছে, দীঘি ভরা জল আছে, ঘর ভরা সন্তান-সন্ততি আছে। এখানে বাতাসে কোনো দূষণ নেই , জল বিশুদ্ধ, জমিতে জৈব সার ব্যবহার করা হয়, সৌরশক্তির সাহায্যে ন্যূনতম আলো জ্বালানো হয়। বৈদ্যুতিক পাখার দরকার হয়না, ঠান্ডা মেশিন তো দুরস্ত ! সর্বোপরি এখানে মানুষে মানুষে হানাহানি নেই, হিংসা নেই, খুন-মারামারি-ধর্ষণ নেই। এখানে নারীকে পুজো করা হয়, বাড়িতে কন্যাসন্তান জন্মালে উৎসব করা হয়। এখানে স্কুল আছে, পোস্ট অফিস আছে, ব্যাঙ্ক আছে, সরকারি অফিস আছে, কিন্তু কোনো ফাঁকি নেই, শোষণ নেই, অসম্মান নেই, চালাকি নেই। এখানে মানুষ মানুষকে ভালোবাসে, সম্মান করে, একে অপরের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এখানে কোনো জাত নেই, সবাইয়ের একটাই জাত- মানুষ। এই পর্যন্ত একটানা বলে বৃদ্ধ মানুষটি হাঁফাতে লাগলেন। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম, রূপকথার গল্পেও এমন কোনো দেশের সন্ধান পাইনি। আর আজ সেই দেশের মাটিতে বসে, কুঁড়েঘরের রাজপ্রাসাদে ইতিহাসের ‘দোবরু পান্নার’ মুখ থেকে সেই রূপকথার রাজ্য সৃষ্টির ইতিহাস শুনতে শুনতে নিজেদের শিক্ষিত-নাগরিক জীবনকে খুব ঠুনকো মনে হতে লাগলো। কিছুটা স্থিত হয়ে আবার সেই ঘোলাটে গভীর চোখ তুলে বৃদ্ধ আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, ” পেলে ! উত্তর পেলে ! কেন তোমাদের এখানে পাঠানো হয়েছে?” তারপর অন্যদিকে চেয়ে আক্ষেপের সাথে বললেন, জানিনা জীবদ্দশায় আর কত মানুষকে এই ভাবে উদ্বাস্তু হয়ে এই গ্রামে আসতে দেখবো৷ হয়তো আমার মৃত্যুর পরও বহু বহু বহুকাল ধরে এই লাভাস্রোত চলতেই থাকবে। কারণ মানুষতো কোনোদিনই শিখবেনা, তার লোভ, মোহ, মাৎসর্য তাকে আবার সব ভুলিয়ে দেবে। এই দুর্যোগ কাটলেই আবার সব অমানুষ হয়ে উঠবে। নিজের সুখ, নিজের স্বার্থ, নিজের আনন্দের জন্যে এই পৃথিবীর সমস্ত সম্পদকে রাক্ষসের মতো লুটেপুটে নেবে। পৃথিবীতে আবার অন্ধকার নেমে আসবে। আবার দলে দলে মানুষ এখানে এসে জুটবে। এই বলে বুড়ো একেবারে চুপ করে গেলেন। নিজের দুই হাঁটুর ওপর মুখটা রেখে দূরের সবুজের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে অবশেষে চোখ বুজলেন। আমি আর ওনাকে বিরক্ত করতে সাহস পেলামনা। এইমাত্র এই গ্রাম্য অশিক্ষিত, একদা ডাকাতের বংশধর প্রবীণ মানুষটার কাছ থেকে যে শিক্ষা পেলাম তার নিরিখে এতদিন ধরে অর্জিত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা লহমায় মিথ্যে হয়ে গেল। আমি চুপি চুপি উঠে আমার বর্তমান বাসস্থানের উদ্দেশ্যে ফিরে চললাম।
(….চলবে)