গতকাল দুপুর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মাঝে এক ধরণের উত্তাপ কাজ করছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া, গতকাল দুপুর একটায় রেডিওতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেছেন। তারপর থেকেই এই উত্তাপের সৃষ্টি। সেই ঘোষণার প্রতিবাদে জননেতা শেখ মুজিব মুখ গোমড়া করে হরতাল ডেকেছিলেন। তার ফলস্বরূপ আজ হরতাল পালন হয়েছে। সকাল এগারোটা নাগাদ পূর্ব পাকিস্থান ছাত্রলীগ ও ডাকসুর যৌথ উদ্যোগে বটতলায় হয়েছে বিশেষ মিটিং। ছাত্ররা দলে দলে যোগ দিয়েছে সেই মিটিংয়ে। এক পর্যায়ে সেই জনসভায় ডাকসুর প্রেসিডেন্ট আ. স. ম আবদুর রব স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেছেন। কি সুন্দর সেই পতাকা। সবুজের মাঝে এক লাল বৃত্ত। সেই বৃত্তের মাঝে আবদ্ধ অবস্থায় আছে হলুদ রঙে দীপ্তিমান এক পূর্ব বাংলার ম্যাপ।
এখন রাত নয়টা। একটু আগে রেডিওতে কারফিউ ঘোষণা হয়েছে। সেই ঘোষনার জের ধরে সারাদিন মিটিং মিছিল করে দমে যাওয়া জনতা ফের রাস্তায় নেমছে। লাঠিসোঁটা হাতে যোগ দিয়েছে মিছিলে। তেমনি এক মিছিল শাহবাগ থেকে টি এস সি হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নিউমার্কেটের দিকে। মিছিলে আনুমানিক শ খানেক মানুষ। তার মধ্যে একজনের নাম আনিস৷ পরণে ঢিলেঢালা সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট। শার্টের বুক পকেটে ছোট্ট এক কাগজ। সেই কাগজে আঁকা স্বাধীন বাংলার পতাকা। পতাকাটি সে নিজে আঁকেনি। আঁকিয়েছে তার এক ছাত্রীকে দিয়ে। ছাত্রীর নাম নীলা। আনিস চোখ বন্ধ করে সকালে দেখা নতুন পতাকাটির বিবরণ দিয়েছে নীলার কাছে। আর নীলা হুবুহু তার বাস্তবিক রুপ দিয়েছে সাদা কাগজে।
শ খানেক মানুষের মিছিলটি এখন এসে দাঁড়িয়েছে নিউমার্কেটের সামনে৷ তীব্র কন্ঠে উচ্চারিত স্লোগানে মুখরিত হচ্ছে চারপাশ। তার মাঝে এক নতুন শব্দ যোগ হল। পুলিশের গাড়ির সাইরেনের শব্দ। হঠাৎ আনিসের দৃষ্টি কাড়লো রাস্তার ধারে পড়ে থাকা কয়েকটি লোহার ব্যারিকেড। আনিস তার সঙ্গিদের নিয়ে এগিয়ে গেলো সেখানে। তারপর টেনে হিঁচড়ে ব্যারিকেড গুলোকে দাড় করালো রাস্তার মাঝ বরাবর৷ সেই সাথে উল্লাসে ফেটে পড়লো চারপাশ। তবে সেই উল্লাস দীর্ঘস্থায়ী হল না। আচমকা গুলির শব্দে চিড় ধরল সেই উল্লাসে। শত মানুষের উপস্থিতিতে গড়ে ওঠা সমান্তরাল মিছিলটি হঠাৎই যেন খেই হারিয়ে ফেলল। মিছিলের সম্মুখে থাকা আনিস বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে ব্যারিকেডের ওপারে৷ সেখান থেকে তীব্র গতিতে ছুটে আসছে মানুষখেকো বুলেট। সে কি করবে বুঝে ওঠার আগেই একটি বুলেট এসে বিঁধলো তার বুকে। গুলিবিদ্ধ আনিস মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। তার সাদা শার্ট ভিজে লাল হয়ে গেছে। সে রক্তের এক ভাগ শোষণ করছে বুক পকেটে গচ্ছিত স্বাধীন বাংলার পতাকা। আনিস কি মনে করে যেন পকেট থেকে পতাকাটি বের করল।পতাকাটি মুষ্টিবদ্ধ করে বন্ধ করল তার চোখ দুটি। তার মনে হচ্ছে সে মারা যাচ্ছে। তার আগে কয়েকটি প্রশ্ন বুলেটের মতো তীব্র গতিতে আঘাত হানছে তার মস্তিষ্কে। আচ্ছা দেশ কি সত্যিই স্বাধীন হবে? এই পতাকাটি কি সত্যিই হবে স্বাধীন বাংলার পতাকা? মারা যাবার পর তাকে কি কেউ মনে রাখবে? আচ্ছা মারা যাবার পর কি পৃথিবীর সাথে সত্যিই সব সম্পর্ক চুকে যায়?
যদি তা না হয় তাহলে একদিন এসব গুলো প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।