জোবায়ের রাজু
ছোট মামার এক মাত্র মেয়ে প্রজ্ঞার খুব বড় ঘরে বিয়ে ঠিক হয়েছে। ভাই ঝি’র বিয়েতে নেমন্তন্ন পেয়ে মায়ের তো আনন্দে নাচি নাচি অবস্থা। ছোট মামি মামাকে নিয়ে দাওয়াত দিতে এসে ‘হাতে ধরি পায়ে পড়ি’র মত করে বললেন-‘আপা, বিয়েতে কিন্তু আপনারা কোন উপহার না দিলে খুশি হবো। আপনাদের এমনিতে অনেক অভাব।’ মা মামির এমন কথায় নিচের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকলেও রাগে আমার গা জ্বলতে লাগল। ‘আপনাদের এমনিতে অনেক অভাব’-এটা মাকে মামির সুক্ষভাবে এক ধরনের অপমান করা, যা মা বুঝতে পারছেন না। বাবাও সম্ভবত মামির অপমানসূচক কথাটার অর্থ আঁচ করতে পেরে হাস্যজ্বল মুখখানা মলিন করে ফেললেন।
অনেকদিন পর আমাদের গরীবের বাড়িতে মামা আর মামি এসেছেন দেখে শ্যামা আপেল আর ডালিম কেটে মেহমানের সামনে হাজির করতেই মামি বললেন-‘এই, এগুলি আনছো কেন? আমি ফল খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। ফলে ফরমালিন।’ আবারও মামির অপমানের সুক্ষè প্রচেষ্টা। আবারও আমার রাগে গা জ্বলতে থাকল। এই মহিলার শলা পরামর্শ আর কু-মন্ত্রনা ধরে ছোট মামা এখন আমাদেরকে দুই চোখের কিনারেও দেখতে পারেন না। অথচ মামা এক সময় আমাদের কত আপন ছিলেন। সেই কত আপন মানুষটি বদলে গেলেন এই মহিলাকে বিয়ে করার পর।
মামিকে আর কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললাম-‘সমস্যা নেই মামি। আপনার একার জন্যে ফল আনা হয়নি। মামা খাবে তো!’ মামি মরা হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শ্যামা বলল-‘মামি, প্রজ্ঞার বর কি করেন? দেখতে কেমন?’ বেশ ঢং করে মামি বলতে লাগলেন-‘আবিরের কথা বলছো? আবির বিরাট শিক্ষিত। ব্যাংকে চাকরি করে। চল্লিশ হাজার মাইনে। দেখতে তো লাখে একটা। জানিস শ্যামু, আবিরটা রোজ সাত আটবার করে কল করে। প্রজ্ঞার সাথে কি সব গুটুর গুটুর আলাপ। কি কান্ড।’
মামি যে চিরকালের অহংকারি স্বভাবের এবং এই মুহুর্তে নিজের ঢোল নিজে পেটাচ্ছেন দেখে শ্যামা বলল-‘তা শীতকালে যে প্রজ্ঞার হাঁপানি বেড়ে যায়, ছেলে পক্ষ এটা জেনেছে?’ শ্যামা যে এমন একটা প্রশ্ন করবে, এটা সম্ভবত মামি প্রত্যাশা করেননি। নিরস কন্ঠে বললেন-‘ইয়ে, না জানে না মনে হয়।’
আমাদের কথা বলা পর্বের শেষের দিকে বাবলু পাশের বাড়ি থেকে তিনটা টিউশনি শেষ করে ঘরে ঢুকল। বাবলুকে দেখে মামা বললেন-‘তোর একটা গল্প সেদিন পেপারে পড়েছি। তুই খুব ভালো লিখিস।’ বাবলু হো হো করে হেসে উঠল।
সন্ধ্যার আগে আগে মামা মামি চলে যাবার পর বাবলু আর শ্যামা প্রজ্ঞার বিয়ে নিয়ে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিল।
-দেখিস ছোট দা। প্রজ্ঞা শ্বশর বাড়িতে ভালো থাকবে না। এই মেয়ের গায়ে পড়ে অকারনে ঝগড়া করার স্বভাব আছে।
-চুপ থাকতো। প্রজ্ঞা কখন আবার কার সাথে ঝগড়া করেছে?
-সবার সাথে। প্রজ্ঞাটা ভীষণ ঝগড়াটে।
-থাপ্পড় খাবি।
-তোর গায়ে লাগছে কেন? প্রজ্ঞার জন্য এত টান কেন তোর? আচ্ছা প্রজ্ঞাকে নিয়ে যে লেখাটি লিখলি, সেটা পেপারে পাঠাইছিস?
-না। আচ্ছা প্রজ্ঞার কি সত্যি সত্যি বিয়ে হয়ে যাবে?
-না। মিথ্যে মিথ্যে বিয়ে হবে।
ভাই বোনের মিষ্টি গল্পের খুঁনসুটি শুনতে মন্দ লাগছে না।
আমি আমার মায়ের জাতকে এখন আর আগের মত দেখতে না পারলেও বাবলু মামাদের পরিবার নিয়ে সব সময় আগ্রহী। প্রায়ই সে ছোট মামার বাড়িতে যায়। মামি তার সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করেন কিনা, বাবলু কখনো মুখ ফুটে বলে না।
দুই
আজ প্রজ্ঞার বিয়ে। ভেবেছি বাবলু সবার আগে প্রজ্ঞার বিয়েতে যাবার জন্যে সবাইকে তাগিদ দিবে। কিন্তু সে কাল রাতেই জানিয়ে দিযেছে সে প্রজ্ঞার বিয়েতে যাবে না। শ্যামা বলল-‘প্রজ্ঞাকে এত পছন্দ করিস, ওকে নিয়ে এত লিখিস, ওর বিয়েতে যাবি না কেন?’ শ্যামার কথায় বাবলু মলিন হাসি দিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে রইল।
বাবলুটার মন খারাপ নাকি! কাল মধ্যরাতে ওর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি সে মোম জ্বালিয়ে চেয়ারে বসে কি যেন লিখছে। সম্ভবত পত্রিকার জন্যে কোন লেখা লিখছে। কিন্তু আমি যতদ্দুর জানি বাবলুর রাত জাগার অভ্যাস নেই। দশটার পরেই সে মরা ঘুমে তলিয়ে যায়।
বাবা কোথাও যান না। কারন বাবা প্যারালাইসিস রোগী। এই কারনে মা বাবলুকে প্রজ্ঞার বিয়েতে যেতে তেমন একটা জোরাজুরি করেননি। মা শ্যামা আর আমিই প্রজ্ঞার বিয়েতে রওনা হলাম। যাবার সময় মা বললেন-‘বাবলু, তোর বাবাকে সময় মত ঔষুধ দিস। দরকার হলে ফোন করিস। আমরাও করব।’ বাবলু নিরস গলায় বলল-‘আচ্ছা।’
অনেক বছর পর ছোট মামার বাড়িতে এসে আমার চোখ কপালে উঠে গেল। মামা এই বাড়িটা এত সুন্দর করে ফেলেছেন। নাকি অনেক বছর পর এখানে এসেছি বলে সব কিছু এমন নতুন লাগছে। তার উপর বিয়ে বাড়ি।
ধুমধামে বিয়ে হল প্রজ্ঞার। সন্ধ্যার আগেই বর পক্ষ প্রজ্ঞাকে নিয়ে চলে গেল। ছোট মামা আর মামি যখন প্রজ্ঞার জন্যে বিলাপ করে কাঁদছেন, তখনই বাড়ি থেকে বাবার কল এলো। রিসিভ করলাম আমি। বাবা পাগলের মত বলতে লাগলেন-তোরা কইরে সবাই। বাবলু যেন কেমন করছে। আমি কি করব একা একা। তোরা কোথায়?
তিন.
বাড়িতে এসে দেখি বাবলু অজ্ঞানের মত মেঝেতে লুটিয়ে আছে। বাবা অবশ পায়ে কিভাবে যেন বাবলুর কাছে এসে শিয়রে বসে শিশুর মত কাঁদছেন।
ডাক্তার আনা হল। ডাক্তার জানালেন বাবলু নেই। মারা গেছে। ততক্ষনে মা আর শ্যামাও ছোট মামার বাড়ি থেকে এসে হাজির। পরিবেশ ক্রমশ ভারি হয়ে এলো। শোকের মাতমে বাড়তে থাকল রাত।
মা আর শ্যামার কান্না থামানো যাচ্ছে না। বাবা পাগলের মত মাটিতে গড়াগড়ি করছেন। বাবলুর লাশ সাদা কাপড়ে আবৃত রাখা হল। প্রতিবেশীদের আসা যাওয়া চলছে। বাবলুর আকস্মিক এই মৃত্যুতে সকলে হতবাক। কি থেকে কি হয়ে গেল, বুঝতে পারছি না। কোন রোগ বালাই ছাড়া বাবলু এভাবে মারা যাবে কেন? সকালে বাবলুর লাশ দাফন হল।
চার.
বাবলুর শোক নিয়ে আমরা দিন কাটাতে লাগলাম। ওর মৃত্যুর কারন অজানাই থেকে গেল। বাবলুর ঘরটায় আমি মাঝে মাঝে আসি। ওর গল্প লেখার খাতাগুলি বের করে কোন কোন দিন পড়ি। বেশ ভালো ছিল বাবলুর লেখার হাত। সপ্তাহ জুড়ে ওর লেখা পত্রিকায় ছাপা হতো।
একদিন বাবলুর ড্রয়ারে একটা ডায়েরি পেলাম। শুরু থেকে পড়তে পড়তে শেষের দিকে এসে কিছু কথা পড়ে চমকে উঠলাম। শেষ পৃষ্ঠার আগের পৃষ্ঠায় বাবলু লিখেছে-‘আজ ছোট মামা আর মামি এসেছেন প্রজ্ঞার বিয়ের দাওয়াত নিয়ে। প্রজ্ঞার বিয়ে হচ্ছে শুনে আমার বুক ভাঙ্গতে লাগল। আমার ভালোবাসার কি হবে তাহলে! আমি যে প্রজ্ঞাকে ভালোবাসি। ও আল্লাহ, বিয়েটা ভেঙ্গে দাও। না হলে আমার যে আত্মহত্যা ছাড়া পথ থাকবে না। কারন প্রজ্ঞা অন্য কারো বউ হবে, এ ব্যাপারটা আমি সইতে পারব না। আমাকে বিষ কিনতে হবে।’
আমার পৃথিবীটা থর থর করে কাঁপছে। এ কি লিখলো বাবলু! তার মৃত্যু ছিল আত্মহত্যা? আমার আশে পাশের সব কিছু যেন ঘুরছে। আমি এক্ষুণিই মাথা ঘুরে পড়ে যাব। তার আগেই আমার হাত থেকে খসে পড়ল বাবলুর ডায়েরি।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।