বছর দশ হল স্বামী অনীশের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই সুরমার। কোনো ঝগড়া বিবাদ নয়, কোর্টের দ্বারস্থ হওয়া নয়। বিয়ের বছর তিনেকের মধ্যেই সুরমার মনে হল, অনীশ চারদেয়ালের মধ্যে নিজেকে এমনভাবে বেঁধে ফেলেছে যে ওই জগৎ থেকে নিজেকে বের করে আনা তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। এমনটা হলেও কোনো অসুবিধা ছিল না। মনকে বোঝানো যেতো মানুষটা নিজেকে নিয়েই সর্বদা ব্যস্ত থাকে কিন্তু অন্য কারও পৃথিবী নিয়ে সে নাড়াচাড়া করতে যায় না। কিন্তু তা তো নয়। নিজের মতো অন্যকেও বেঁধে রাখতে চায় নিজের পৃথিবীতে। সুরমা এমন মানুষকেও কাছে ডেকেছিল। ভেবেছিল ভালোবাসা দিয়ে অনীশের পৃথিবীটাকে কিছুটা হলেও বদলে দিতে পারবে। অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত হার মানতে হলো।
অনীশ চেয়েছিল, তার একার রোজগারেই সংসার চলুক। সুরমা চাকরি ছেড়ে দিয়ে সংসার আর মেয়ে নিয়ে ব্যস্ত থাকুক। সুরমা মানতে পারে নি। কিন্তু তাই বলে সে কোনো বিবাদের মধ্যেও নিজেকে জড়ায় নি। কারণ সে নিজেকে বোঝাতে পেরেছিল, প্রত্যেক মানুষেরই এই পৃথিবীতে স্বাধীন মত প্রকাশের পূর্ণ অধিকার আছে। আবার অন্যদিকে সেই মতকে না মেনে চলারও অধিকার আছে। সুরমার মনে হয়েছিল চাকরি বজায় রেখেও সে অনায়াসে সংসারকে সময় দিতে পারবে। একদিন হঠাৎ করেই অনীশকে অবাক করে দিয়ে দুবছরের শ্রীতপাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল সুরমা। অনীশ অনেকবার ফোন করেছিল কিন্তু সুরমা ফিরে যায় নি। কারণ তার মনে হয়েছিল, এই বিশ্বাস বদলের নয়। চেষ্টা করে কয়েকদিনের জন্যে হয়ত জানলা দরজা খুলে দেবে কিন্তু তা বন্ধ হতেও বেশি সময় নেবে না।
সেদিনের দুবছরের শ্রীতপা আজ বারো বছরের। সব নিজে হাতে করেছে। কাজের লোক রাখে নি। নিজের সংসার নিজের মতো করে গুছিয়েছে সুরমা। রান্না করে দুজনে খেয়ে মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে তবে নিজের স্কুলে পা রেখেছে। অবশ্য একটা সুবিধা পেয়েছে সুরমা, নিজের স্কুল থেকে কয়েক পা হেঁটে গেলেই মেয়ের স্কুল।
যখনই সংসারে হাঁফিয়ে উঠেছে সুরমা তখনই বাড়ির পাশের আমগাছটার নিচে বেশ কিছুক্ষণের জন্যে গিয়ে বসেছে। শ্রীতপা একদিন খেতে বসে মাকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি আমগাছটার কাছে যাও কেন মা ?”
—– ওটা যে আমার বাবা।
—– ধ্যাত! আমগাছ আবার কারও বাবা হয় নাকি ?
—– হয় হয়। ওটা আমার একটা পৃথিবী। যখনই মনে হয় আমাদের সঙ্গে কেউ নেই তখনই আমি ওখানে যাই। বাবার মতো মাথার ওপর ছাতা ধরে থাকে। ও আমাকে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে উৎসাহ দেয়।
—– তুমি কি শুধু ওইখানেই যেতে চাও
—– সেটা আমি ঠিক জানি না মা। আমি ওইখানে পৌঁছে যেদিকে খুশি চলে যেতে পারি। আসলে ওই জায়গাটা আমার অন্য পৃথিবীর মূল প্রবেশ পথ।
ময়নাডাঙা,আশ্রয় অ্যাপার্টমেন্ট, পশ্চিমবঙ্গ,ভারত।