অণুগল্প-অবেলায় | আশিক মাহমুদ রিয়াদ

অণুগল্প-অবেলায় | আশিক মাহমুদ রিয়াদ

I আশিক মাহমুদ রিয়াদ 

সেবার মিনুর মা মারা গেলেন হঠাৎ করেই। মিনুর বার্ষিক পরিক্ষার ফলফল প্রকাশ হয়েছে, মিনু ক্লাস নাইনে প্রথম হয়েছে। মিনুর মনে কি আনন্দ! খুশি যেন উছলে পড়ে৷মাকে খবরটি জানালে কেমন হবে? খুশি হবেন হয়ত৷ মিনুকে বলবেন,’তোকে আরো বড় হতে হবে৷ বড় হয়ে ডাক্তার হবি। ‘ মিনু বাড়িতে আসলো লাফাতে লাফাতে৷ ‘এসে দেখলো সবার মুখ কালো। কেউ কেউ কাঁদছে! মিনু কেমন গম্ভীর হয়ে গেলো৷ছোট চাচিকে জিজ্ঞেস করলো,’ কি হয়েছে চাচি?’ ছোট চাচি শাড়ির আচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল,’শান্ত হ মা!’ বলে ভেউ ভেউ করে কান্না শুরু করে দিলো। মিনু বলল,’মা কোথায়?’ মিনু মা মা বলতে বলতে ছুটে গেল ঘরের ভিতর৷ ভিতরে কোরআন শরীফ পাঠ করা হচ্ছে৷ মিনু ঘরের ভিতর ঢুকতেই আর্তনাদের স্বরে চিৎকার দিয়ে উঠলো। মিনু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলো।
মিনুর মায়ের মৃত্যুর একমাসের মাথায় মিনুর বাবা বিয়ে করে নতুন বৌ ঘরে আনেন৷ প্রথম প্রথম মিনু তার সৎ মাকে সহ্য করতে পারতো না৷ মিনুর বাবার সাথে কথা বলত না। মিনুর ছোট চাচি মিনুর কাছে আসলে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতো। মিনুর সৎ মা মিনুকে আদর যত্ন করতো। মিনুর মন গললো একদিন৷ সৎমাকে সই মা বলে ডাকত সে৷ সৎ মায়ের বয়স বেশি না, মিনুর থেকে বয়সে পাঁচ-ছয় বছরের বড় হবেন।
কেঁটে গেলো কতদিন। মিনুর সৎমা মিনুকে আদর যত্নের বিপরিতে অসহ্য করতে লাগলো৷ মিনুর সাথে কথা বলতো তুচ্ছতাচ্ছিল্য  করে৷ মিনুর সাথে ইচ্ছে করে ঝগড়া বাধাতো৷ মিনুও কথায় ছাড়তো না৷ একদিন মিনুর বাবা এসে দেখলেন মিনু তার সৎ মাকে উদ্দ্যেশ্য করে কথা বলছ। ততক্ষনে সৎ মা থেমে গিয়েছে৷ মিনুর বাবা রহমত মিয়া মিনুকে ধমকালেন। মারতে এগিয়ে গেলেন। মিনুর ছোট চাচী এসে মিনুকে বাঁচালো
২.
বছর দুই পরের কথা,মিনুর ছোট একটি ভাই হয়েছে৷ সেই ভাইকে সে দেখাশোনা করে৷ ভাইকে নিয়ে তার যত হুটিপুটি৷ কলেজ থেকে ফিরে ভাইকে নিয়ে বসে পড়তো সে৷ ছোট ভাইটি তখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদছিলো৷ মিনুর সৎ মা রান্না ঘরে ব্যস্ত। মিনু ভেজা কাঁথা পাল্টিয়ে ভাইটিকে নিয়ে হুটিপুটি শুরু করলো। আহা রে!  কাঁদে না আমার লক্ষী ময়না-টিয়া। কাঁদিস কেন এত? ছেলেদের এত কাঁদতে হয় নাকি? ছোট্ট ফুটফুটে শিশুটি কাঁদা বন্ধ করে ছোট ছোট মার্বেলের মতো দুটি চোখ দিয়ে মিনুর দিকে তাকিয়ে রইলো৷ মিনু চোখ বড় করে হঠাৎ বলে উঠলো ‘ভাউ’ শিশুটি হাসলো খিল খিল করে৷
ছেলেটির নাম রাখা হলো টুনু। সে হামাগুড়ি দিতে শিখেছে৷ তার মধ্যে আছে চঞ্চলতা! সারাদিন তিড়িং বিড়িং করে এখানে ওখানে হামাগুড়ি দিয়ে চলে যায়। একবার হামগুড়ি দিতে দিতে চুলার পাশে চলে গেলো৷ তার চোখেমুখে কেমন কৌতূহল। চুলায় আগুন জ্বলছে! ভাত ফুটতে শুরু করেছে৷ সৎমা তখন পুকুরে থালা-বাসন ধোয়ায় ব্যস্ত। টুনু তার ছোট্ট হাত বাড়িয়ে দিলো চুলার দিকে৷
দুপুরবেলা কলেজ থেকে ফিরছিলো মিনু। বাড়িতে ঢোকার পথটা জুড়ে সপ্তপর্ণা গাছের  সারি। বাড়িতে ঢুকেই মিনুর চোখ যায় রান্না ঘরে। ততক্ষনে টুনু হাত বাড়িয়ে দিয়েছে পাতিলের দিকে। ব্যগ ফেলে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে এলো মিনু! টুনু কেঁদে দিলো। সৎমা ছুটে এলো।পার হলো আরো তিন বছর।একদিন মিনুর সৎ মা মারা গেলো। পুকুর ঘাটে থালা বাসন ধুচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ নারকেল গাছ থেকে কাঁচা ডাব পড়ে তার মাথার উপর। সেখানেই অজ্ঞান হয়ে যায় সে। মাথা ফেটে রক্তপাত শুরু হয়। অজ্ঞান হওয়ার আগে চিৎকার দেয় গলা ফাঁটিয়ে। ছুটে আসে মিনুর ছোট চাচী। সে ও চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়।মিনু তখন রান্নাঘরে সবজি কাটছিলো বাড়ির আরো কয়েকজন ছুটে আসে চিৎকার শুনে। ততক্ষণে মিনুর সৎ মায়ের দেহটি নিথর হয়ে গিয়েছ। মিনু সেদিন কেঁদেছিলো গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করে।
টুনুর তখন ছ’ বছর। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলো সবার দিকে। তার মাথায় রাজ্যের চিন্তা,’সবাই এত কাঁদছে কেন? কি হয়েছে?
৩.
পনেরো বছর পরের ঘটনা,মিনুর বিয়ে হয়েছে দশ বছর আগে। আট বছর আগে মিনুর বাবা রহমত মিয়া একদিন স্ট্রোক করে মারা গেলো। টুনু বড় হয়েছে,সে এখন থাকে মিনুর সংসারে। মিনুর স্বামী পুলিশ অফিসার। মিনুর একটি সন্তান আছে। তার নাম শিমুল। শিমুলের বয়স পাঁচ বছর।
রহমত মিয়া মারা যাওয়ার পরে টুনু মিনুর সাথে থাকে। এতে মিনুর স্বামী রফিক কখনো আপত্তি করেনি৷ রফিককে ডিউটি করতে বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকতে হয়। টুনু কলেজে পড়ে। মাঝেমধ্যে মিনু টুনুর দিকে তাকিয়ে থাকে! এইতো সেদিন তাকে কোলে করে হুটিপুটি করে সুজি খাইয়েছে। সেই টুনু আজ কত্ত বড় হয়ে গেছে। মুখজুড়ে তার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। টুনুর জন্য তার কত মায়া। কে বলবে টুনু তার সৎ ভাই? টুনুকে সে সব সময় সে নিজের ভাইয়ের মতো দেখেছে। মিনু গালে হাত দিয়ে ভাবছে,টুনুকে বিয়ে দিতে হবে।
টুনুর জন্য দেখে শুনে সুন্দর একটি বউ আনতে হবে। আচ্ছা বউ পেয়ে টুনু বোনকে ভুলে যাবে না তো? কে জানে! মিনুর আজকাল এসব কথা ভাবতে ভালো লাগে।
টনু আজকাল মিনুকে এড়িয়ে চলেতার রুমে আসে কয়েকজন তরুন।
তারা ফিসফিস করে কি সব বলে! মিনু কখনোই তাদের কথা শুনতে চায়নি। দরজার ওপাশ থেকে টুনুকে বলেছে, ‘টুনি চা নিয়ে যা! ‘ টুনু কখনো কখনো চা নিয়েছে। আবার কখনো বলেছে,’চা লাগবে না বুবু!
 তুমি এখন যাও তো। ‘
মাঝেমধ্যে রাতে ঘরে ফেরে না টুনু। মিনু উকি দেয় টুনুর ঘরে। সেখান থেকে কেমন বিদঘুটে ঘ্রান আসে। একদিন টুনুর টেবিলে একটি কাচের শিশি পায় মিনু। টুনুর কাশি হয়েছে বোধয়। তাই ওষুধ খায়। কিন্তু এতগুলো ওষুধের শিশি কেন? টুনুর কাশি কি বেশি হয়েছে?
শীত পড়েছে বেশ! কুয়াশায় পথঘাট ঢাকা পড়েছে। বাইরে তাকালে কিছু দেখা যায় না। গাছগাছিলির দিকে তাকালে মনে হয় বড় কোন পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে৷ রাত হলে ট্যাপড় ট্যাপড় শিশির ফোটার শব্দ। নিস্তব্ধ রাত! মাঝেমাঝে শোনা যায় শেয়ালের ডাক। কুকুর কাঁদে। রাতটা বুঝি বড় বিষণ্য।
রাত তিনটার দিকে কড়া নাড়ে রফিক।মিনুর কাঁচা ঘুমটা ভাঙে। গেট খুলে। ভিতরে ঢোকে রফিক। লাইটের আলোতে মিনু অবাক হয়ে বলে,’এই! তোমার হাতে কি হয়েছে। ‘ রফিক বলে,’সব বলব। আগে হাতমুখ ধুয়ে আসি। ‘
রফিক ভাত মুখে দিতে দিতে বলে,’আজ একটা অপারেশন ছিলো! মাদক চালানের।।সেখানে গোলাগুলি হয়। একটা গুলি এসে লাগে আমার হাতে। আরেকটা গুলি লেগে যায় আমার সহকর্মী আফজাল সাহেবের বুকে। তাকে আর বাঁচানো যায়নি। গোলাগুলিতে মারা যায় ঐ দলের সব।আমাকে স্যার নির্দেশ দেন, আমি হাসপাতালে চলে যাই। ‘
গত রাতে বাড়ি ফেরেনি টুনু মিনু রফিককে বলে খোঁজ নিতে। রফিক খোঁজ নেয়। এখন সময় দুপুর দুইটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট! মাথার উপরে সূর্য। শরীর ঘামছে। সে ঘামে ভেজা শরীর শীত শীত লাগছে। ঠোট শুকিয়ে আসছে বার বার। মিনু এখন দাড়িয়ে আছে মর্গের বাইরে। টুনুর খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। টুনু আর বেঁচে নেই। গত রাতে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় সে।
মিনু কাঁদে! রফিক মিনুকে সান্তনা দেয় মিনুকে।

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
পাখির ডানা- শ্রী রাজীব দত্ত

পাখির ডানা- শ্রী রাজীব দত্ত

শ্রী রাজীব দত্ত   সারাটা দিন  এখান ওখান  মেলে ধরেছিস ডানা   নেই কোন বাঁধন  নেই তো কোন মানা।    কিচিরমিচির মিষ্টি কুহুতান সারাটা দিন ঘুরেই ...
How Health Businesses Can Survive in a Post Coronaconomy

How Health Businesses Can Survive in a Post Coronaconomy

Cursus iaculis etiam in In nullam donec sem sed consequat scelerisque nibh amet, massa egestas risus, gravida vel amet, imperdiet volutpat rutrum sociis quis velit, ...
Shah Rukh Khan কে হত্যার হুমকি মাফিয়াদের

Shah Rukh Khan কে হত্যার হুমকি মাফিয়াদের

ছাইলিপি ইউটিউব ডেস্ক T-Series এর মালিক যেভাবে খুন হয়েছিলেন | শাহরুখ খানও আছেন ঝুঁকিতে? | SRK দিনটি ১২ অগাস্ট ১৯৯৭ ।মন্দিরে পূজারত অবস্থাতেই গুলিতে ঝাঁঝরা ...
অন্তিম পর্ব- অচিনপুরের দেশে

অন্তিম পর্ব- অচিনপুরের দেশে

গৌতম সরকার লীলামাসীর মুখ নিঃসৃত সেই অমৃতবানী যে এত তাড়াতাড়ি বাস্তব রূপ নেবে ভাবতে পারিনি। সত্যি কথা বলতে কি, আমফানের রাত্রে যখন মঈদুলের হাত ধরে ...
শরৎ এলো

শরৎ এলো

ফেরদৌসী খানম রীনা শরৎ এলো প্রকৃতির মাঝে যেন রানীর বেশে, স্নিগ্ধ আবেশ ছড়ালো সোনার বাংলাদেশে। ভোর বেলা শিশির কণার মুক্ত ঝড়ানো হাসি, কি যে অপরূপ ...
তোমাকে | কামরান চৌধুরী

তোমাকে | কামরান চৌধুরী

| কামরান চৌধুরী  তোমাকে ভীষন অপছন্দ আমার, অথচ,গেলো কয়েকটি বছর তুমি আমারই পছন্দের ছিলে! তোমাকে ভীষন ঘেন্না লাগে আমার, তুমি মিথ্যে অভিনয়ের মঞ্চ কাঁপানো প্রেমিকা! ...