জোবায়ের রাজু
বাবাকে বললাম এবারের ঈদে আমাকে শার্ট প্যান্ট আর জুতা কিনে দিতেই হবে। অভাবের সাগরে ভাসতে থাকা বাবার মুখটা করুণ দেখাচ্ছিল তখন, তবুও বললেন, ‘অবশ্যই কিনে দেবো বাপ।’ আমি খুশি হলাম। খুশি খুশি আমাকে নিয়ে বাবা চললেন খান বাড়ির দিকে।
আজ শুক্রবার। প্রতি শুক্রবারে বাবাকে খান বাড়িতে আসতে হয়। বাবা প্রতি শুক্রবারে খান সাহেবের অফিসের গাড়ি ধুয়ে দেয়ার চাকরী করেন। প্রথমে পাউডার সাবান দিয়ে পুরো গাড়ি মুছেন। তারপর ব্রাশ দিয়ে সেটা মাজেন। সবশেষে পুকুর থেকে বালতির পর বালতি ভরা পানি এনে সারা গাড়িতে মারতে থাকেন। ব্যস, গাড়ি ঝকঝকে পরিস্কার। খান সাহেব খুশি হয়ে বাবাকে বখশিশ দেন। বাবা বখশিশের সে টাকায় চাল, ডাল, নুন, তেল কিনে আমাদের অভাবের সংসার টিকিয়ে রাখেন।
আজ এই শুক্রবারে বাবা আমাকে নিয়ে এলেন খান বাড়িতে। গাড়ির চারপাশে পাউডার সাবান ছিঁটানো, ব্রাশ দিয়ে মাজা- সব শেষ করে সিলভারের বালতি নিয়ে খান সাহেবদের পুকুরে নেমে বালতির পর বালতি পানি এনে গাড়িতে মারতে লাগলেন। পুকুরের তলা থেকে বালতি ভরা পানি নিয়ে ঘাটলার লম্বা লম্বা সিঁড়ি অতিক্রম করে ওপরে উঠে আসতে আসতে বাবাকে বড্ড ক্লান্ত লাগছিল। হাঁপিয়েও উঠেছেন অনেকখানি। দেখে বুকটা আমার খাঁ খাঁ করে উঠল। বাবাকে বললাম, ‘বালতি আমাকে দিন, আমি পানি এনে দেই।’ মলিন মুখের বাবা ঠোঁটে মরা হাসি এনে বললেন, ‘না রে। পুকুরের তলা থেকে এতগুলি সিঁড়ি পার হয়ে উপরে আসতে পারবি না বাপ।’ আমি আহত চোখে বাবাকে দেখি। অভাবের সংসারে দুটো টাকা জোগাড় করার এই জীবনযুদ্ধে বাবা একজন দুর্বল সৈনিক। আজ এই খান বাড়িতে দুর্বল সৈনিককে দেখে আমার চোখে পানি চলে এলো।
বাবা গাড়িতে বালতির পর বালতি পানি মারছেন। শেষ বালতি পানি মারতেই বিপত্তি ঘটে গেল। সিলভারের বালতির বাড়ি খেয়ে খান সাহেবের গাড়ির ডান দরজার কাঁচের গ্লাসটি ফেটে দুই ভাগ হয়ে গেল। এই দৃশ্য দেখে খান সাহেব তেড়ে এসে রাগে ক্ষোভে বাবার গালে ঠাসঠাস করে কয়েকটি চড় বসিয়ে দিয়ে ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, ‘ছোটলোকের বাচ্চা, এই গ্লাসের দাম কত, জানিস? বের হও বাড়ি থেকে। আর আসার দরকার নেই। শালা ফকির কোথাকার।’
খান বাড়ি থেকে আমরা বেরিয়ে আসি। গাড়ির গ্লাস ভাঙার অপরাধে বাবাকে তার প্রাপ্য বখশিশ দেয়া হয় নি। বাবার গাল দুটো লাল টকটকে হয়ে গেছে। খান সাহেবের পাঁচ আঙুলের দাগ বাবার গালে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমি চোরা চোখে সেই দাগ দেখি আর গোপনে চোখ মুছি।
হাঁটতে হাঁটতে বাপ বেটা চলে এসেছি বাজারে। ঈদের কেনাকাটায় পুরো বাজার ব্যস্ত। ফ্যাশন হাউজগুলিতে কেনাকাটার দুম। খান সাহেব বাবাকে বখশিশ দেন নি। তাই আমার আর ঈদে জামা কেনা হবে না।
২.
বিশ বছর পর। এখন আমি প্রতিষ্ঠিত একজন আইনজীবি। টাকার অভাব নেই আমার। বিলাস বহুল পাঁচতলা বাড়ির মালিক আমি। সুখ, শান্তি, প্রাপ্তি, বান্ডিলে বান্ডিলে টাকা সব আছে। আরো একটি জিনিস আছে। গাড়ি। ১৫ লাখ টাকায় কেনা আমাদের সাদা প্রাইভেট কার। ঠিক এরকম একটি গাড়ি ধুয়ে দিতে আমার দুর্বল সৈনিক বাবা একসময় খান বাড়িতে যেতেন প্রতি শুক্রবারে।
আর কিছুদিন পর ঈদ। আজ শুক্রবারে বাবাকে নিয়ে প্রাইভেট কারে চড়ে শহরের শপিংমলে যাচ্ছি ঈদের কেনাকাটা করতে। ড্রাইভার আমজাদ গাড়ি চালাচ্ছে। আমি আর বাবা পেছনে। জ্যামে আটকে পড়ে আছে আমাদের গাড়ি। হঠাৎ বাবা বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দেখতো বাপ, ওই লোকটাকে চিনতে পারিস?’ তাকিয়ে দেখি খান সাহেব। হুইলচেয়ারে বসে বসে ভিক্ষা করছেন। নিয়তি তাকে আজ পথের ফকির বানিয়ে হুইলচেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে। জীবনভর অবৈধ ব্যবসা করে যে টাকার পাহাড় গড়েছেন, সময় সে টাকার পাহাড় ভেঙে চুরমার করে তাকে পথের ভিক্ষুক বানিয়ে দিয়েছে।
বাবা গাড়ির গ্লাস নামালেন। পকেট থেকে ৫০০ টাকার একটি নোট বের করে ভিক্ষুক বেশের খান সাহেবের ভিক্ষার ভাঙা থালায় দিতেই তিনি টাকাটি জীর্ণ থলিতে ভরে ফেললেন। বাবা আবার গাড়ির কাঁচ উঠিয়ে দিলেন।
সময় বড় আজব পরিণতি। একদিন যে গাড়ির কাঁচ ভাঙার দোষে খান সাহেব বাবাকে তার পরিশ্রমের টাকা না দিয়ে চড় মেরে বের করে দিয়েছেন, আজ সেই গাড়ির কাঁচ নামিয়ে বাবা সেই অহংকারি খান সাহেবের ভিক্ষার ভাঙা থালায় টাকা দিলেন ভিক্ষা হিসেবে। এ যেন জীবনের বিপরীত স্রোত। এ স্রোতে কে কখন ডুবে আবার কে কখন ভাসে, কেউ জানেনা।
জ্যাম কাটিয়ে আমরা চলে এলাম শপিং কমপ্লেক্সে। ন্যাশনাল শপিং কমপ্লেক্স। এটি শহরে বেশ নামকরা। আজ আমরা বাপ বেটা এই নামকরা শপিং কমপ্লেক্স থেকে ঈদের জন্য কেনাকাটা করব। এখন আমাদের সুদিন।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী