আনোয়ার রশীদ সাগর
ধীরে ধীরে আমার জানাজার প্রস্তুতি চলছে। শ’খানিক লোক জানাজায় দাঁড়িয়েছে। সামনে ঈমাম সাহেব,পিছনের লোকগুলো আমার চেয়ে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে ফাঁকা ফাঁকা হয়ে।সে সারিতে আমার আদরের কয়েক জন সন্তানও আছে।
যখন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় তখন আমার অনেক টাকা ছিল। ঢাকা শহরের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও নামকরা হাসপাতালে আমাকে ভর্তি করা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই কিছু ডাক্তার ও নার্সরা করোনা-করোনা বলে চিৎকার করা শুরু করে। ঠিক তখনই আমার প্রিয়তমা স্ত্রী ও সন্তানেরা আমাকে রেখে,তারা হাসপাতালের বাইরে চলে যায়।
আমি বড় একা হয়ে পড়ি। রাতে আইসি ইউতে কিছুক্ষণ সময় রেখে, ছবি উঠায়ে, আবার বের করে পাশেই একটা রুমে আমাকে চিৎ করে শুয়ায়ে রেখে দেয়। সকালে স্ত্রী একটা চিরকুটসহ চেকবই পাঠিয়েছে,নার্সকে দিয়ে। চিরকুটে লেখা ‘প্রতিদিন তোমার তিনলাখ করে টাকা লাগবে। সেই হিসাব করে অনেকগুলো চেকের পাতায় স্বাক্ষর দিও।’
অথচ আমার জন্য কোনো ভালো খাবারও পাঠাইনি।
আমি তো আইসিইউতে নেই,আমাকে তেমন কোনো চিকিৎসাও দেওয়া হচ্ছে না। তাহলে কেন এত টাকা লাগবে?
কিন্তু কেউ আমার কথা শুনতে পায়নি।কতবার হাত ইশারা করেছি,সবাই দূরে সরে গেছে।
তারপর আমাকে প্রশাসণের সহযোগিতায় কবরস্থানে আনা হয়েছে।
জানাজায় যারা এসেছে তারা সবাই পাওনাদার। আমি ওদের কাছ থেকে চাকুরি দেওয়ার নাম করে কোটি কোটি টাকা নিয়েছিলাম। খরচ করেছি আমার সন্তানদের পিছনে। ওদের বাড়ি গাড়ি করে দিয়েছি।
গরুর ফার্ম করে দিয়েছি,মার্কেট করে দিয়েছি,ঢাকা শহরে ফ্লাট কিনে দিয়েছি,বিলাসবহুল জীবন যাপনের জন্য ফার্ণিচার করে দিয়েছি। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেশ কিছু মানুষের জীবিকার ব্যবস্থাও করে দিয়েছি। যাদের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি তারা কেউই আসেনি।
আহা, সারাজীবনের প্রেমভালোবাসা স্ত্রীকে দিয়েছি। তাকেও দেখছি না।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো গুণগুণ করে উঠলো। তারা সকলেই টাকা পাবে। অথচ আমি খাটোয়ায় শুয়ে ওদের বলতে চাচ্ছি, শোন আমি পৃথিবী থেকে কিছুই নিয়ে যাচ্ছি না।সুন্দর গাছগাছালি, স্নিগ্ধভালোবাসা অথবা ভয়ংকর অহংকার সবই রেখে যাচ্ছি।
আমার কথা কেউ শোনছে না।আমার সন্তানরাও অন্যলোকদের মতই অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
মৌলানা সাহেব বললেন, আজ এই মৃতু ব্যক্তি হিংসা-বিদ্বেষ,আদর-ভালোবাসা,স্নেহ-মমতা এবং সকল ধনসম্পদ পৃথিবীতে রেখে চলে গেছে। কিছুই নিয়ে যায়নি,পৃথিবীর মানুষের মধ্যেই রেখে গেছে। আপনারা সকলেই মাপ করে দেন।
এরপর একে একে সবাই চলে গেল।আমার সন্তানেরাও চলে গেল,শুধু প্রশাসণের ছয়জন লোক আমাকে কবরের ধারে নিয়ে গিয়ে রাখলো। তখন আমার এক গরীব বোন এসে দাঁড়ালো। যাকে আমি কোনোদিন দেখতেও যাইনি। বরং ওর ছেলের চাকুরি দেওয়ার কথা বলে,বাড়ির ভিটিটাও বিক্রি করে নিয়ে, আমার ছেলেকে ইউরোপে পাঠিয়েছিলাম। আমার সে ছেলে আমাকে দেখতেও আসেনি।
সামান্য দূরে বোনটি বার বার হুঁহুঁ করে কাঁদছিল এবং ফুপিয়ে ফুপিয়ে চোখ মুছতে ছিল।
প্রশাসণের দু’জন লোক আমার গরীব বোনটিকে সকল প্রকার সাহা্য্য দিতে প্রতিশ্রুতি দিলে, সেও চলে গেল।
আমি অজানা অন্ধকারে অথবা কোনো ঠিকানাহীন পথে ধীরে ধীরে চলে গেলাম।