অণুগল্প- পিতৃস্নেহ | আহমেদ সুমন

 অণুগল্প- পিতৃস্নেহ | আহমেদ সুমন

|আহমেদ সুমন

 

 

বিষন্ন মনে, বস্তির পাশে বেড়ে ওঠা বটতলায় বসে আছে মতিন মিয়া। হঠাৎ পাঁচ বছরের মেয়ে লতা এসে, গলায় জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী কন্ঠে বলতে লাগল,”বাবা এহানে বইসা  আছো কেন? বাসায় চলো, আমার খিদে পাইছে। মা আমারে খাওন দিচ্ছে না”।
বড় আদরের মেয়ে লতা। বস্তির  অন্য মেয়েদের চাইতে লতাকে ভিন্ন দেখায়। সবসময়  তার পরনে থাকে নতুন জামা। মা রাহেলা বানু খুব যত্ন করে মেয়ের চুলে ঝুঁটি বেঁধে দেয়। আদর করে খাইয়ে দেয়। এইতো বেশ কিছু দিন আগে ও সে যা চেয়েছে, মতিন মিয়া রিকশা চালিয়ে তার সব চাহিদা পূরণ করেছে।

একদিন বস্তির পাশ দিয়ে গাড়িতে চড়ে এক ভদ্রলোক ও তার পরিবার যাচ্ছিলেন। গাড়ির ভিতরে ছিল তাদের ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটি। তার কোলে ছিল একটি দামী খেলনা পুতুল। লতা তখন রাস্তার পাশে খেলা করছিল। পুতুল দেখে তার ও পুতুল খেলার ইচ্ছা জাগল। দৌড়ে গিয়ে মায়ের কাছে পুতুলের আবদার করল। দুপুরে মতিন মিয়া রিকশা থেকে ফিরলে, রাহেলা বানু মেয়ের ইচ্ছের কথা জানায় তাকে। মতিন মিয়া লতাকে কোলে তুলে আহ্লাদী কন্ঠে বলল, তোমার পুতুল খেলতে ইচ্ছা করতাছে মা? ঠিক আছে বাবা তোমার জইন্যে নিয়া আহুম। মতিন মিয়া মেয়ের গালে চুমু খেল। দুপুরের খাবার খেয়ে আবার সে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। রাতে বাসা ফেরার আগে নিউমার্কেট থেকে মেয়ের জন্য একটি পুতুল কিনে নিল। পুতুল পেয়ে লতা খুব খুশি হয়েছিল। মেয়ের আনন্দ দেখে মতিন মিয়ার চোখে সেদিনও উষ্ণ পানি টলমল করেছিল।

সে  কান্না তো ছিল  সুখের কান্না।
আর আজ মতিন মিয়ার চোখে যে পানি টলমল করছে  সেটা দুঃখের পানি। এত আদরের মেয়ে অতচ আজ খেতে পারছেনা। গত এক মাস থেকে মতিন মিয়ার রোজগার বন্ধ। মহামারীর কারনে সে রিকশা নিয়ে বের হতে পারছেনা। বাসায় তার যা কিছু জমা ছিল, এক মাসেই সব নিঃশেষ হয়ে গেল। আজ দু’দিন উনুনে আগুন জ্বলছেনা। আর তাই শত কষ্ট বুকে নিয়ে মতিন মিয়া বসে আছে বটতলায়।  নিজেকে শান্ত রেখে লতাকে বুকে জড়িয়ে মতিন মিয়া বলে, আমি তোমার মায়েরে বকা দিবো। কেন তোমারে খাইতে দিচ্ছেনা। তুমি এহন তোমার মায়ের কাছে যাও। এই বলে মতিন মিয়া রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। হঠাৎ তার মনে হল শরীরের রক্ত বিক্রি করে মেয়ের জন্য খাবার কিনে আনবে। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলো একটি ক্লিনিকে। কর্মরত ডাক্তার মতিন মিয়াকে হতাশ করে দিলেন। এই মহামারীতে আপাতত তারা ব্লাড কিনছেন না। ব্লাডের মাধ্যমে নাকি এই রোগ অন্যের দেহে ছড়াতে পারে। বিষন্ন মনে বস্তির পথে পা বাড়ালো মতিন মিয়া। পথিমধ্যে দেখা হল তার বাল্য বন্ধু হাফিজের সাথে। হাফিজ একটি কোম্পানীতে ভালো পোস্টে কর্মরত । হাফিজকে দেখে মতিন মিয়ার মনে একটু সুখের হাওয়া দোল খেতে লাগল। হাসি মুখে তার সাথে কুশল বিনিময় করল। মহামারীর কারনে হ্যান্ডশেক কিংবা কোলাকুলি করা সম্ভব হলো না। হাফিজ মতিন মিয়াকে তার বাসার খবর জিজ্ঞেস করতেই মতিন দুঃখের কাহিনী বলা শুরু করল। মতিন মিয়ার করুণ অবস্থা শুনে হাফিজের খুব মায়া হল। আফসোস ছাড়া সে আর কিছুই করতে পারলো না। কয়দিন আগে সে ও চাকরিচ্যুত হয়েছে। বন্ধুর কাছ থেকে কোনো সাহায্য না পেয়ে মলিন হয়ে ওঠল মতিন মিয়ার মুখ। আশার প্রদীপ যেন হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় নিভে গেল। হাফিজের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে মতিন মিয়া আবারো পা বাড়ালো বস্তির পথে। বাসায় এসে রাহেলাকে ডাক দিতেই সে দরজা খুলে দিল । এক বুক আশা নিয়ে সে তাকিয়ে রইল  মতিন মিয়ার  মুখে। মতিন মিয়া রাহেলাকে জিজ্ঞেস করল, লতা কই? রাহেলা বলল, অনেকক্ষণ কান্নাকাটি কইরা এহন ঘুমাইতাছে। মতিন মিয়ার বুকে কে যেন পাথর দিয়ে আঘাত করল। মেয়ের জন্য তার হৃদয় হাহাকার করতে লাগল। স্থির থাকতে না পেরে আবার পা পাড়ালো রাস্তার অভিমুখে। পেছন থেকে রাহেলা বলতে লাগল, কই যাচ্ছ?কোনো কথা না বলে মতিন মিয়া চলতে
লাগল আপন গতিতে। হাঁটতে হাঁটতে সে চলে গেল বস্তির মহাজনের বাড়ির সামনে। হঠাৎ মনে উঁকি দিল তার অন্য চিন্তা। সাবধানে বাসার ভিতর ঢুকে হাতিয়ে নিল একটি সোনার আংটি। প্রচন্ড গতিতে কাঁপছে তার বুক,হাত আর দু’টি পা। এই প্রথম সে এমন কাজ করছে। তড়িঘড়ি করে যখন  ফিরতে লাগল হঠাৎ একটি গর্তে পা আটকে মাটিতে পড়ে যায় মতিন মিয়া। আওয়াজ শুনে বস্তির মহাজন ঘর থেকে বের হয়ে আসল। মতিন মিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। মহাজন বিড়বিড় করে বলতে লাগল, দেখে নেবো আমি। কার এত বড় সাহস।

হাঁপাতে হাঁপাতে রাস্তার পাশে এসে স্থির হল মতিন মিয়া। তারপর চলে গেল জুয়েলারি দোকানে। খুব অল্প দামেই বিক্রি করে দিলো সোনার আংটি । নগদ টাকার গন্ধ পেয়ে মতিন মিয়ার চোখ আনন্দে নেচে উঠলো। সকল কষ্ট তার নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে গেল। তার চোখে ভেসে ওঠল মেয়ের হাসি ভরা মুখ। মতিন মিয়ার মনে হলো, আজ সে জীবনের শ্রেষ্টতম কাজটি করতে পেরেছে। জীবন বাজি রেখে মেয়ের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। অতঃপর,  দোকান থেকে মেয়ের পছন্দের সব খাবার কিনে নিয়ে, বস্তির পথে পা বাড়ালো মতিন মিয়া। চোখে তার আনন্দ অশ্রু আর চলার গতিতে যেন বিদ্যুৎ চমকায়।

 

 

ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ
সলিমুল্লাহ মুসলিম হল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
 প্রিন্সেস । অণুগল্প ।সুমন্ত আশরাফ

 প্রিন্সেস । অণুগল্প ।সুমন্ত আশরাফ

।সুমন্ত আশরাফ   “এক্সকিউজ  মি?  হ্যালো?” আমি রাস্তার একপাশে দাড়িয়ে কয়েকজন বন্ধু মিলে কি যেন একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করছি। হঠাৎ শুনতে পেলাম কথাটা। অজান্তেই ...
সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায় ; মনের বিকাশের বড় একটি  মৌলিক উপাদান

সৌমিত্র চট্টাোপাধ্যায় ; মনের বিকাশের বড় একটি  মৌলিক উপাদান

মিরাজুল হক   ভাষা যদিও একটি মাধ্যম । তবুও বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা সিনেমা নাটক   এবং  বাঙালীর একটি বিশেষ বিশিষ্টতা আছে —  সৃষ্টিশীলতা । মানব ...
খারাপ মেয়ের গল্প

খারাপ মেয়ের গল্প

তসলিমা নাসরিন এখানেই আমার দাঁড়াবার কথা ছিল। ইঞ্জিনিয়ারস ইন্সটিটিউটের ঠিক উলটো দিকের গেট দিয়ে ঢুকে হাতের ডান দিকে প্রথম যে নারকেল গাছটি পড়বে, সেই গাছের ...
লুঙ্গি পড়েছেন বিয়ার গ্রিলস? কি বলছেন বাঙালি নেটিজেনরা?

লুঙ্গি পড়েছেন বিয়ার গ্রিলস? কি বলছেন বাঙালি নেটিজেনরা?

ছাইলিপি.কম ডেস্ক / ২৮.০৮.২০২২ উপমহাদেশের সবথেকে স্বাচ্ছন্দের পোশাক লুঙ্গি। বাংলাদেশের কচি-কাচা থেকে শুরু করে বয়জেষ্ঠ মানুষ লুঙ্গি পড়ে থাকেন। গবেষণায় দেখা গেছে, এর সূচনা হয়েছে ...
রতনতনু ঘোষ’র শেষ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত

রতনতনু ঘোষ’র শেষ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত

শফিক হাসান রতনতনু ঘোষ ছিলেন অকালপ্রয়াত প্রতিভা। প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গবেষণা, সাক্ষাৎকার, কলাম থেকে কবিতা সব ধরনের লেখাজোকাতেই সিদ্ধহস্ত। ২০১৬ সালে সড়কে চলাচল অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া ...
Byomkesh: দূর্গ্যরহস্য গল্পে ভিন্ন মাঠে মুখোমুখি দেব-অনির্বাণ

Byomkesh: দূর্গ্যরহস্য গল্পে ভিন্ন মাঠে মুখোমুখি দেব-অনির্বাণ

আশিক মাহমুদ রিয়াদ  শহরে নতুন টিকটিকি! পালাবি কোথায় বল? দেব কে ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, এখনো দেখছি। আগেই একটা পোস্টে লিখেছিলাম দেব সময়ের সাথে নিজেকে ...