অণুগল্প- মায়া  । সাদিয়া আফরিন প্রমা 

অণুগল্প- মায়া  । সাদিয়া আফরিন প্রমা 

।সাদিয়া আফরিন প্রমা

বিকেল গড়াতেই বাচ্চারা মহল্লার মাঠ সাদৃশ্য খোলা জায়গায় খেলায় মেতে উঠেছে। পাশ ঘেষেই দোতলা বিল্ডিংটির নীচতলার বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দুটি উৎসুক চোখ অনেকক্ষন ধরে এই খেলার দৃশ্যগুলো নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় অবলোকন করে যাচ্ছিল। এমন সময় খেলার মাঠ থেকে একটি বল বারান্দার সামনে এসে পড়ে। বাচ্চারা মাঠ থেকে ডাক দিয়ে যাচ্ছে “মায়া, মায়া বলটা দাও “
ডাক শুনে মায়া বল দেওয়ার জন্য দৌড়ে যেতেই দেখে দরজা বন্ধ । মূহূর্তেই মায়ার মুখটা ফ্যাকাসে ও মলিন হয়ে যায়। নিজেকে সে চার দেওয়ালে বন্দি আবিষ্কার করে।
মায়া আট বছরের ফুটফুটে এক শিশু। ফরহাদ হোসেন ও লাবনীর তিন সন্তানের মধ্য মায়া সবার ছোট। ইমন,জেরিন আর মায়া তাদের তিন সন্তান। মায়া জন্মের পর থেকেই অটিজম, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। বাবা, মা অনেক চেষ্টা করেছে মায়াকে স্বাভাবিক করতে, কিন্তু যে সমস্যাগুলো নিয়ে মায়া জন্ম নিয়েছে সেগুলো এখনো রয়ে গেছে। মায়ার বুদ্ধি কম, কেউ কিছু বললে কম বুঝে। কারো সাহায্য ছাড়া সে ভালোভাবে চলাফেরা করতে পারেনা। এজন্য বাবা, মা তাকে কোথাও যেতে দেয়না। বাইরের পরিবেশের সাথে মিশতে দেয়না। এমন কি তারা মায়াকে স্কুলে পর্যন্ত দেয় নি! কিন্তু মায়ারও ইচ্ছে হয় আর দশটা বাচ্চার মতো সবার সাথে খেলতে ।
অফিস থেকে এসে ফরহাদ হোসেন লাবনী বেগমকে বলেন-‘লাবনী ‘শোনো, ভাবছি এবার কোরবানীর ঈদটা গ্রামেই করবো। অনেকদিন হয় গ্রামে যাওয়া হয়না।’
লাবনী বেগম : হ্যা ভালো হবে। ঈদের ছুটি টা গ্রামে কাটালে বাচ্চারাও খুশি হবে।
ফরহাদ হোসেন: সব ঠিক আছে, কিন্তু মায়াকে নিয়ে একটু চিন্তায় আছি।গ্রামে গেলে আত্বীয়, বন্ধু বান্ধব সবাই মায়াকে নিয়ে নানারকম প্রশ্ন করবে বলাবলি করবে যেগুলো আমার ভালো লাগবেনা!
লাবনী বেগম : যে যা বলার বলুক তাতে কান দেওয়ার দরকার নেই। মায়া তো আমাদের সন্তান।
‘ঠিক বলছো ‘-দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ফরহাদ হোসেন ।
এমন সময় হঠাৎ কান্নার শব্দে দুজনের আলাপনে ছেদ পড়ে। লাবনী বেগম আর ফরহাদ হোসেন কি হয়েছে দেখার জন্য দৌড়ে যায়….
লাবনী বেগম আর ফরহাদ হোসেন কি হয়েছে দেখার জন্য দৌড়ে যায়। রুমে ঢুকতেই দেখে মায়া এক কোণায় দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কান্না করছে।ইমন আর জেরিন পড়ার টেবিলে বসে আছে।
‘মায়া কান্না করো কেন আম্মু?’- বলেই বুকে জড়িয়ে নেয় লাবনী বেগম। তারপরেও মায়ার কান্না থামেনা। লাবনী বেগম বার বার জিজ্ঞেস করলেও মায়া কিছু বলেনা। শুধু হাতের ইশারায় জেরিন আর ইমনকে দেখিয়ে দেয়।
‘কি হয়েছে মায়া কান্না করে কেন?’-হালকা বকুনির সুরে জেরিন আর ইমনকে উদ্দেশ্য করে বলে লাবনী বেগম। তখন জেরিন বলে উঠে মায়া আমাদের বই খাতা গুলো নিয়ে আঁকাআকি করছিল এবং বার বার আমাদের বইখাতা কেড়ে নিচ্ছিল। আমরা এখান থেকে চলে যেতে বলাতে কান্না শুরু করে দেয়।’
এতক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফরহাদ হোসেন সব অবলোকন করেছিল। জেরিনের কথা শেষ হতেই বলেন ‘লাবনী মায়াকে আর এই রুমে আসতে দিয়ো না। আজকে থেকে মায়া আলাদা রুমে থাকবে। সামনে ইমন আর জেরিনের ফাইনাল পরীক্ষা, মায়া এই রুমে থাকলে তাদের পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটবে’ -কথাগুলো একনাগাড়ে বলে যায় ফরহাদ হোসেন ।
‘আমার মেয়েটাকে একেবারেই একা করে দিবে? আমার মেয়েটা অবুঝ কিছু বুঝেনা তাই বলে তাকে সবাই দূরে সরিয়ে দিবে?’-কথাগুলো বলার সাথে সাথেই লাবনী বেগমের চোখ বেয়ে পানি চলে আসল।
– আহা! লাবনী এত আবেগী হলে চলবেনা আমাদের ইমন আর জেরিনের কথা ভাবতে হবে। আমি সন্তানদের ভালোর জন্যই এটা করতে চাচ্ছি।’
কথা শেষ হওয়ার আগেই লাবনী বেগম মায়াকে নিয়ে অন্য রুমে চলে যায়।
মায়াকে আলাদা একটা রুম দেওয়া হয়েছে। মায়া এখন আর ইমন জেরিনের সাথে খেলা করতে পারে না। খাওয়ার টেবিল আর রুমই যেন মায়ার নিত্যসঙ্গী! মায়া সারাদিন রুমের মধ্য বন্দি অবস্থায় বসে থাকে। বাইরে যাওয়ার জন্য কান্না করলেও লাবনী বেগম তাতে সায় দেয় না। মাঝে মাঝে বারান্দার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে থাকে। লাবনী বেগম কাজ সেরে সুযোগ পেলেই মায়াকে সময় দেয়।আজকেও কাজ সেরে মায়ার রুমে ঢুকে দেখে মায়া খাতায় কিছু একটা আঁকছে। লাবনী বেগম এগিয়ে গিয়ে বলে-‘ মায়া কি আঁকছ আম্মু?’
খাতাটা লাবনী বেগমের দিকে এগিয়ে দিতেই তিনি অবাক ও বাকরুদ্ধ হয়ে যান! একটি বাচ্চা জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে! মায়ার কোমল হাতের আঁচড়ে তার বন্দি দিনযাপন ফুটে উঠেছে! লাবনী বেগম মায়াকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে__
‘তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস মা! আল্লাহ’র কাছে প্রার্থনা করি সবসময় একদিন না একদিন তুই আর দশটা বাচ্চার মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবি।’ মায়া কিছুই বলেনা। অবাক ভঙ্গিতে মায়ের মুখের দিকে শুধু চেয়ে থাকে। মায়ার এই নির্লিপ্ত চাহনি বলে দেয় মায়ের কান্নায় সেও কতটা কষ্ট পেয়েছে … ।
এখন মায়া সারাদিন রুমের মধ্যে বসে বসে ইমন আর জেরিনের পরিত্যক্ত রঙ পেন্সিল আর সাদা কাগজ নিয়ে আঁকাআকি করে। তার আঁকাআকি গুলো দিন শেষে একধরনের এলোমেলো শৈল্পিক রূপ নেয়। লাবনী বেগম কাজ শেষ করে রোজ মায়ার এই আঁকাআকি গুলো দেখে। মায়াও খুশি হয়ে লাবনী বেগমকে কাগজ গুলো দেখায়।
তখন মা,মেয়ে এক অনন্য সুন্দর মমতা আর খুনসুটিতে মেতে উঠে।
আজ ইমনের জন্মদিন। ফরহাদ হোসেন এবার ঘটা করেই ছেলের জন্মদিন পালন করছেন। ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে দুইদিন আগেই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে রেখেছেন। অফিসের সব কলিগ,আত্বীয় স্বজন এবং বন্ধুবান্ধব সবাইকে দাওয়াত করেছেন। দু’হাতে বাজার ভর্তি থলে নিয়ে ক্লান্ত শরীরে বাসায় ঢুকেন ফরহাদ হোসেন। ‘শোনো, আমার কলিগ এবং বন্ধুবান্ধব সবাই আসবে, ভালো করে রান্না করো। রহিমকে বলে দেওয়া হয়েছে ড্রয়িং রুম টা সাজিয়ে রাখতে? ইমন, জেরিন আর মায়া কোথায়?’
‘ইমন আর জেরিন বাইরে খেলা করে, মায়া রুমে বসে আছে। সেও বায়না ধরেছিলো বাইরে খেলতে যেতে আমি তোমার ভয়ে যেতে দিই নি’ – – বলেই চেহেরা মলিন করে ফেলেন লাবনী বেগম।
‘ভালো করেছো’-বলেই রুমের দিকে অগ্রসর হয় ফরহাদ হোসেন ।
সন্ধ্যে হতেই দাওয়াতি মেহমানরা আসতে শুরু করলো। ইমন আর জেরিনের সাথে মায়াকেও নতুন জামা পরিয়ে দেন লাবনী বেগম। নতুন জামা গায়ে দিয়ে মায়ার চোখে মুখে সে কি হাসি!! তা কোন কিছুর সাথেই তুলনা করা যায়না! জন্মদিন উপলক্ষে ড্রয়িংরুম লাইট দিয়ে সাজানো হয়েছে। জন্মদিন উপলক্ষে ড্রয়িংরুম লাইট দিয়ে সাজানো হয়েছে। ঘরবর্তি মানুষ দেখে মায়া অবুঝ মনে মেহমানদের সাথে আসা বাচ্চাদের সাথে খেলা করতে করতে হঠাৎ ফরহাদ হোসেনের এক কলিগের সাথে ধাক্কা খায়, সাথে সাথেই উনার হাত থেকে চা এর কাপটা গায়ে পড়ে যায় আর চা পড়ে গিয়ে উনার কাপড় নষ্ট হয়ে যায়। ফরহাদ হোসেন দ্রুত এসে মায়াকে সরিয়ে দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে। মায়াকে দেখেই ফরহাদ হোসেনের কলিগরা এবং বন্ধুরা মায়ার ব্যপারে জিজ্ঞেস করতে থাকে। দেখা মাত্রই যে কেউ বুঝে নিতে পারবে সে স্বাভাবিক শিশুদের মতো না । সবাই মায়াকে দেখে নানা কথা বলতে থাকে। এমন সময় ফরহাদ হোসেন মায়াকে নিয়ে অন্য রুমে চলে যায় এবং মায়াকে রুমে রেখে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে চলে আসে। লাবনী বেগম মেহমানদের আপ্যায়নে ব্যাস্ত থাকায় মায়া কোথায় তার খোজ নিতে পারে নি। রাতভর জন্মদিনের পার্টি চলল, সবাই আনন্দ হৈ হুল্লোড় আর খাওয়া-দাওয়া করলো। অনুষ্ঠান শেষে মেহমানরা আস্তে আস্তে চলে যেতে লাগলো এমন সময় লাবনী বেগমের হঠাৎ মায়ার কথা মনে পড়ে।
‘মায়া কোথায়?’- উদ্বেগ ভরা কন্ঠে বলে উঠে লাবনী বেগম। ‘সন্ধ্যা থেকেই মায়াকে কিছু খাওয়াইনি।’
– ‘মায়া আছে রুমে, সবাই তাকে নিয়ে নানারকম প্রশ্ন করছিল, তাই আমি তাকে রুমে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে রেখেছি।’
কথা শেষ না হতেই লাবনী বেগম হাত থেকে চাবিটা কেড়ে নিয়ে দরজা খুলতেই দেখে,রুমে মায়া নেই!
মায়া ! মায়া!- বলে তিনি চিৎকার করতে থাকেন। চিৎকার শুনে সবাই দৌড়ে আসে। লাবনী বেগম এদিক ওদিক তাকাতেই দেখে বাথরুমের দরজা খোলা। দরজা খোলা দেখে বাথরুমে ঢুকেই লাবনী বেগম চমকে উঠেন….
মায়ার ছোট নিথর দেহটি বাথরুমের মেঝেতে পড়ে আছে। লাবনী বেগম দেখেই বাকরুদ্ধ হয়ে যান। কিছু বলতে পারেন না। শুধু হাত দিয়ে ইশারা করে সবাইকে ডাকে, ফরহাদ হোসেন দৌড়ে বাথরুমে ঢুকেই চিৎকার করে উঠে। ছোট্ট নিষ্পাপ নিথর দেহটার পাশে বাথরুমে রাখা একটা স্যাভলনের বোতল পড়ে আছে। টানা ৩ ঘন্টা রুমে বদ্ধ থাকা অবস্থায় ক্ষুধা লাগলে অবুঝ শিশু মায়া কোন কিছু না পেয়ে স্যাভলন খেয়ে ফেলেছে! নিথর পড়ে থাকা মায়ার মুখে স্যাভলন লেগে আছে।
লাবনী বেগম আর ফরহাদ হোসেনের আহাজারিতে পুরো পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
 গল্প - শ্রাবণের আমন্ত্রণ

 গল্প – শ্রাবণের আমন্ত্রণ

ইমন শেখ সকাল থেকে বেশ খাটুনি গেছে শিউলির। দুপুরে রান্না খাওয়ার পাট চুকিয়ে অবসন্ন শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিতেই ঘুমে বুঁজে আসে তার চোখ। কিন্তু ঘুমটা ...
কবিতা- মানব সমাজ

কবিতা- মানব সমাজ

উম্মে হাবিবা সমাজ!সেতো বন্দী দেখো প্রভাবশালীর হাতে, অত্যাচারী করলো চুরি,মানবতা তাই কাঁদে। অযোগ্যকে আসন দিয়ে পুতুল খেলার মতো, জয়ের মুকুট পড়ে আবার উল্লাসেতে মাতো। সত্যি ...
"আমার দেহখান নিও না শ্মশান" কার জন্য লেখা?

“আমার দেহখান নিও না শ্মশান” কার জন্য লেখা?

আশিক মাহমুদ রিয়াদ “এক দুঃস্বপ্নে ফুঁটেছে ভোর বিলীন হয়েছে নির্ঝর নক্ষত্র নিরবে! যে নক্ষত্রকে খুঁজে পাবে না কেউ গানের প্রতিটা ছন্দে!” “Odd Signeture” ব্যান্ডের ভোকালিস্ট/গিটারিস্ট ...
 অণুগল্প - প্রতিক্ষায় তারামণি | ফারহানা ইয়াসমিন

 অণুগল্প – প্রতিক্ষায় তারামণি | ফারহানা ইয়াসমিন

 | ফারহানা ইয়াসমিন   সকালে ঘুম থেকে উঠে অভ্যাসবশত উত্তরের ঝুলবারান্দায় এসে দাঁড়াতেই চোখ পড়ল রাস্তার ওপারে কৃষ্ণচূড়া গাছটির দিকে। কদিন থেকে খেয়াল করছিলাম গাছটিতে ...
বই পর্যালোচনা- আগুনের পরশমণি- হুমায়ূন আহমেদ

বই পর্যালোচনা- আগুনের পরশমণি- হুমায়ূন আহমেদ

বইঃ আগুনের পরশমণি লেখকঃ হুমায়ূন আহমেদ বইয়ের ধরনঃ উপন্যাস প্রকাশনীঃ হাতেখড়ি প্রকাশকঃ মো: আবু মুসা সরকার প্রচ্ছদ ও অলংকরণঃ সমর মজুমদার পৃষ্ঠাঃ ৮৪ মুদ্রিত মূল্যঃ ৭০ টাকা ...
নগর পিশাচ

নগর পিশাচ

ভুতের গল্প – নাঈমুর রহমান নাহিদ   শহরের মানুষ ঘুমের রাজ্যে হারিয়েছে বেশ খানিকক্ষণ। স্টেশন থেকে বেরিয়ে কোন রিক্সা বা সিএনজি চোখে পড়লনা। এক দুটো ...