জীবনের গল্প – আদিল মাহফুজ রনি
শুক্রবার, বেলা দুপুর দুইটা। জুম্মার নামাজ শেষ করে মফিজ উদ্দিন বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ালো। তার বাড়িটা পড়েছে সৈয়দ পাড়া নামক মহল্লায়। এই মহল্লাটি খুব একটা বড় নয়। এখানে দশটার মতো ঘর হবে। লোকজন সবাই কৃষি কাজ করে। তার মাঝে মফিজ উদ্দিন কিছুটা অবস্থা সম্পন্ন। তিনিই প্রথম এলাকায় টিনের চালের বাড়ি করেছেন। রোদের আলোয় বাড়ির চাল চকচক করে। দেখতেও বেশ লাগে। মফিজ উদ্দিন উঠানে পা রাখা মাত্রই পাশের বাড়ির মালেকের সাথে দেখা হলো। মালেক প্রশ্ন করলো,
“মসজিদ থাইকা কখন আইলা মফিজ ভাই?”
“মাত্রই আইলাম রে। তুই কই যাস?
“ক্ষেতটা দেখতে যাইতাছি। ছাগল, গরু প্রায়ই ঢুকে। তাই নজর রাখি।”
“আচ্ছা। ক্ষেত দেইখা তাড়াতাড়ি আইসা পড়িস। সময় কিন্তু বেশি নাই।”
কথা শুনে মালেক হাসিমুখে মাথা নেড়ে সায় দেয়। এরপর পা বাড়ায় ক্ষেতের দিকে। মফিজ উদ্দিনও দাঁড়িয়ে থাকে না। বাড়িতে প্রবেশ করে। সে তার স্ত্রীকে ডেকে বলে,
“কই গেলা শিউলি। ক্ষিদা লাগছে।”
ডাক শুনে শিউলি খাবার নিয়ে উপস্থিত হয়। একটা মাদুর বিছিয়ে সেখানে খাবার রাখা হয়। মফিজ উদ্দিন মাদুরে বসে হাতটা ধুয়ে নেয়। এরপর খেতে শুরু করে দুপুরের খাবার। খেতে খেতে সে জিজ্ঞেস করে,
“শাপলা কই? ওরে দেখি না যে?”
“ও পাশের বাড়িতে গেছে, কুলসুম রে ডাইকা আনতে।”
উত্তর শুনে মফিজ উদ্দিন আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ খেতে থাকে। শাপলা তার একমাত্র মেয়ে। মেয়েটার বয়স তেরো বছরের মতো হবে। এলাকায় তার সমবয়সী মেয়ে হলো কুলসুম। তার সাথে দেখা করতে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। খাওয়া শেষ হতে মিনিট দশেক লেগে যায়। খাওয়া শেষ করে সে একটা পান মুখে পুরে নেয়। এরপর শিউলিকে বলে,
“তুমিও জলদি কইরা খাইয়া নাও। সময় বেশি নাই। মানুষজন আইসা পড়বো।”
“জে আইচ্ছা।”
কথাটা বলে শিউলি তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। হাতের কাজগুলো দ্রুত শেষ করা দরকার। একটু পরেই মানুষ জন চলে আসবে। তখন কাজ করা যাবে না। এর মাঝে খাবারও খেয়ে নিতে হবে। রান্নাঘরে ঢুকতেই একটা ডাক কানে ভেসে আসে,
“শাপলার মা আছো নাকি?”
“আসেন ভাবি। ঘরে আসেন।”
মুচকি হেসে উত্তর দেয় শিউলি। মাসুমা ভাবি চলে এসেছেন। এভাবে একে একে সবাই চলে আসবে। ভাবি আসাতে অবশ্য ভালোই হলো। গল্প করতে করতে কাজ করা যাবে। মাসুমা ভাবি রান্নাঘরে এসে বসে। শুরু হয় গল্প। সেই সাথে চলতে থাকে কাজ। সময়ও ছুটতে থাকে দূরন্ত গতিতে।
দুপুর তিনটা। মফিজ উদ্দিনের উঠানে এখন মানুষের ভীড়। মহল্লার প্রায় সব মানুষ চলে এসেছে। মহিলা, পুরুষ, ছোট ছেলেমেয়ে কেউ বাদ নেই। সবাই নিজেদের মাঝে কথাবার্তা বলছে। মফিজ উদ্দিন নিজে অবশ্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত। সে পাশের বাড়ির জয়নালকে ডেকে বললো,
“জয়নাল এদিকে আয় তো একটু।”
“জে মিয়া ভাই।”
জয়নাল এগিয়ে আসে। মফিজ উদ্দিন তাকে নিয়ে বাড়ির ভেতর চলে যায়। এরপর দুজন মিলে ধরে একটা টেবিল বের করে আনে। টেবিলটা বসানো হয় বারান্দায়। তবে কাজ এখনো শেষ হয়নি। দুজনে আবার বাড়ির ভেতর চলে যায়। এদিকে শিউলিরও বসে থাকার জো নেই। সে বাড়ির উঠানে মাদুর বিছিয়ে দেয়। এছাড়া মানুষজনের বসার জন্য চেয়ার, মোড়া এসব জোগাড় করে দিতে হচ্ছে তাকে। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায়। মানুষজন বসে পড়ে যার যার জায়গা নিয়ে। মহিলারা একসাথে একটা কোনায় বসেছে। বাচ্চারা বসেছে সবার সামনে। সেখানে শাপলাও আছে। পুরুষ যারা আছে তারা মাদুরের বাকি অংশে বসেছে। সবাই অপেক্ষা করছে। তবে অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হয় না বেশিক্ষণ। ইতোমধ্যে মফিজ উদ্দিন এবং জয়নাল বেরিয়ে এসেছে। তারা দুজনে মিলে একটা টেলিভিশন এনে বসিয়ে দেয় টেবিলের উপর। টেলিভিশন বসানো মাত্রই সবাই নড়েচড়ে বসে। জয়নাল টেলিভিশনের দুইটা তার ব্যাটারির সাথে সংযোগ করে দেয়। এরপরই টেলিভিশনের সাদাকালো পর্দা জীবন্ত হয়ে উঠে। তবে এখনো অপেক্ষার অবসান হয়নি। অপেক্ষার পালা চললো আরও মিনিট দশেক। এরপর কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত । টেলিভিশনে একটা মেয়ের ছবি ভেসে এলো। মেয়েটা সুন্দর করে শাড়ি পড়েছে। কপালে টিপ দিয়েছে। সে হাসি হাসি ভঙ্গিতে বললো,
“এখন আপনারা দেখবেন পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি বেদের মেয়ে জোছনা। অভিনয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন, অঞ্জু ঘোষ………..”
আর কিছু শোনা যায় না। সবাই খুশিতে হাততালি দিচ্ছে। মফিজ উদ্দিন নিজেও হাসিমুখে টেলিভিশনের সামনে বসে আছে। শিউলি বসেছে মহিলাদের মাঝে। মেয়েটার ঘোষণা শেষ হতেই শুরু হলো ছায়াছবি। দেখা গেল নায়ক নায়িকার অভিনয়। এখন আর মজলিসে কোন সাড়াশব্দ নেই। একদম পিন পতন নীরবতা। সবাই যেন এই সাদাকালো পর্দার মাঝে ঢুকে গেছে। প্রতি শুক্রবার এভাবেই মজলিস বসে মফিজ উদ্দিনের উঠানে। সে টেলিভিশন কিনেছে মাস খানেক হয়। মহল্লার মানুষের এই নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই। মফিজ উদ্দিন অবশ্য এতে বিরক্ত হয় না। বরং এভাবে টেলিভিশন দেখেই যেন আনন্দ।
দেখতে দেখতে ত্রিশ মিনিটের মতো ছায়াছবি পার হয়ে যায়। এই সময় মজলিসে যোগ দেয় মালেক। মফিজ উদ্দিন তাকে দেখে বলে,
কী রে, এতো দেরি করলি কেন?
“আর বইলো না। আকবর ভাইয়ের সাথে দেখা হইছিল। আলাপ করতে গিয়া দেরি হইয়া গেছে। ছবি কোন পর্যন্ত গেছে?”
মালেক ছায়াছবির পূর্বের ত্রিশ মিনিটের ঘটনা জানতে চায়। এই শুনে ছেলেমেয়েরা লেগে পড়ে ঘটনা বোঝানোর কাজে। একটা মেয়ে বলে,
“নায়ক বাঁশি বাজাইতেছিল। এর মধ্যে একটা সাপ তারে কামড় দিছে। তখন নায়িকা চইলা আসে। নায়করে নিয়া যায় তার এলাকায়। এহন নায়ক সুস্থ হইছে।”
মেয়েটা থেমেছে। অর্থাৎ কাহিনী এতটুকুই শেষ হয়েছে। কাহিনি বর্ণনার পর সবাই মাথা নেড়ে মেয়েটার সাথে একমত পোষণ করে। ইতোমধ্যে বিজ্ঞাপন শেষ হয়ে গেছে। আবার পর্দার ভেতর থেকে বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসছে। মফিজ উদ্দিনের উঠানে বসে থাকা সব মানুষ এখন নিশ্চুপ। তাদের দৃষ্টি সাদাকালো পর্দার দিকে। এই সাদাকালো পর্দার মাঝে আনন্দ খুঁজে তারা পার করে দেয় তাদের রঙিন জীবনের সাদাকালো সময়। এই আনন্দটুকু সহজ,সাবলীল, নির্ভেজাল। জীবনের জটিলতা এখানে স্থান পায় না। কারণ মানুষগুলোর জীবনের সমীকরণ খুবই সাধারণ। হাসিগুলো সহজলভ্য। গল্পটা নাহয় এখানেই শেষ করি। সৈয়দ পাড়া এলাকার লোকগুলো সাদাকালো পর্দার মাঝে বুঁদ হয়ে থাকুক। তবে যাওয়ার আগে একটা কথা। আমি লেখক হিসেবে এখনো একটা স্বপ্ন লালন করি। মনে হয় কোন একদিন ঘুম ভেঙে উঠে দেখবো আমিও সেই সাদাকালো সময়ে চলে এসেছি। যদি সত্যিই এমন ঘটে তবে কেমন হবে বলুন তো?
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইলঃ [email protected]
[লেখাটি ছাইলিপির শারদ সংখ্যা থেকে সংগ্রহীত ,ছাইলিপির শারদ সংখ্যা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ]