বিলটু আর বলাই ছুটির দিনের ভরদুপুরে ব্যতিব্যস্ত হয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পথে করিম মোল্লার সাথে দেখা,জানতে চাইলেন কোথায় যাচ্ছে। বিলটুর সরল উত্তর একটু হেড স্যারের বাড়ি যাচ্ছি।করিম মোল্লা আর কিছু জানতে চাইলেন না। এমনিতে গ্রামের যেখানে যত অনাসৃষ্টি কান্ড ঘটে সবাই ধরে নেয় এসব একমাত্র বিলটুর কাজ। হেড স্যারের কথা বলায় বুঝলেন আজ সে কিছু করবেনা। বিলটুর হাত প্যান্টের পকেটে। খুব সাবধানে আর যত্ন করে কি যেন রেখেছে পকেটে এমন একটা ভাব। বেশ গম্ভীর মুখে সে হেঁটে যাচ্ছে। বলাই নীরবে তাকে অনুসরণ করছে। বলাই বিলটুর কাকার ছেলে। বছর সাতেক বয়েস হবে। যদিও বলাইয়ের মা একদম চায়না বলাই বিলটুর সাথে মেলামেশা করুক কিন্তু বলাইয়ের আবার বিলটুর সাথেই থাকতে ভালো লাগে। তাইতো বলাইয়ের মা যখন মাছের বড় পেটিটা, দুধ দই ,নাড়ু, কমলা, আপেল ওকে খেতে দেয় আর বিলটুকে খালি ডাল ভাত খেতে দেয় তখন বলাইয়ের মায়ের উপর খুব রাগ হয়। কিন্তু বিলটু দাদা তাকে কিছু বলতে দেয়না। উলটো গাছ থেকে পেয়ারা ,কামরাংগা পেরে এনে সবকটা তাকেই দিয়ে দেয়। সেই বিলটু দাদা আজ যেন কেমন চুপচাপ। অন্যদিন কত গল্প করে। মাছ ধরার গল্প, ঘুড়ির সুতায় মাঞ্জা দেয়ার গল্প আরো কতকি পারে বিলটু দাদা।
গত পনেরো দিন ধরে ওরা সেই উইপোকার ঢিবি থেকে মাটি এনে,সেই মাটি ভালো করে ছেনে গুলি বানিয়ে রোদে শুকিয়েছে। তারপর চুপিচুপি মায়ের রান্নার চুলার আগুনে ফেলে দিয়েছে। মা খেয়েদেয়ে ঘুমানোর পরে নিভে যাওয়া চুলা থেকে গুলিগুলো তুলে এনে একটা কাপড়ের থলিতে রেখেছে। গুলিগুলো আগুনে পুড়ে কি সুন্দর লাল হয়েছে। বলাই ভেবেছে এগুলো দিয়ে তারা গুলি খেলবে। কিন্তু দাদাতো সেই থলেটাই পকেটে রেখেছে। আর একটা জিনিষ দাদা নিয়েছে। দাদা যেটা দিয়ে পাখি শিকার করে আবার এমনি এমনি বনে জঙ্গলে সাথে নিয়ে ঘোরে। দাদা বলে ওটার নাম গুলতিবাস। একখানা দুইহাতওয়ালা গাবগাছের ডাল কেটে কি সুন্দর একটা ইংরেজী ভি অক্ষরের মত করে বানিয়েছে। নীচের দিকটায় আবার একটা হাত। ভি অক্ষরের মত অংশটায় বাবার সাইকেলের রাবারের ফিতা বেঁধেছে। ওই ছোট্ট রাবারের অংশটুকুর মধ্যে কায়দা করে গুলি রেখে দাদা কেমন করে যেন ছুঁড়ে। ঠিক সিনেমায় দেখা বন্দুকের গুলির মত মাটির গুলিটা অনেক দূরে নিশানায় গিয়ে লাগে। দাদার নিশানাও একদম পাকা। কখনো ভুল হয়না। বলাই মনে মনে দাদার মতো হতে চায়।দাদা কতকি পারে।
এখন দাদাকে এরকম গম্ভীর দেখে বলাইর একটুও ভালো লাগছেনা। গতমাসে হেডস্যার বিলটুকে জোড়া বেত দিয়ে খুব মেরেছে। বিলটু নাকি মদন বাবুর পুকুরের মাছ ধরেছে বঁড়শি দিয়ে। তাও রাতের বেলা। আবার রহিম চাচার বাগানের আমড়াগুলো সবে বড় হতে শুরু করেছে,সেখান থেকেও নাকি অনেক আমড়া পেরেছে এবং গাছের ডালপালা ভেঙ্গেছে। হ্যা কাজগুলো বিলটু করেছে কিন্তু কেন করেছে হেডস্যার একবারও তা জানতে চাইলেন না। সেদিন মতলব চাচার বাড়িতে গিয়ে দেখে চাচার ছোট্টমেয়েটা জ্বর থেকে উঠেছে ,খালি কলমিশাক দিয়ে ভাত খাচ্ছে। চাচারতো মাছ কেনার পয়সাও নাই। আবার নিজে মাছ ধরবে যে তারও উপায় নাই। দিনমজুরি করে মদনবাবুর জমিতে। তাই দুটো জিয়ল মাছ ধরে এনে চাচীকে দিয়েছিল। আর আমড়া! সেতো রহিমচাচার ছেলে শহর থেকে এসে রাস্তায় তাকে দেখে ভেংচি কেটেছিল বলে তার রাগ হয়েছিল। গতবছরও সেলিম গ্রামে ছিল। তার সাথে সব জায়গায় যেত। এক বছর হলো শহরে গেছে । সেখানে নাকি বড় স্কুলে পড়ে এখন। তাই বলে এতোদিনের বন্ধুকে এভাবে কেউ অপমান করে!
ওরা হেডস্যারের বাড়ির সামনে এসে গেলো। শান্তিদিদি স্যারের বড়মেয়ে বিলটুকে রাস্তাঘাটে দেখলে বেশ আদর করে হেসে কথা বলে। আর মাসিমাকে দেখলেই কেন যেন মায়ের কথা মনে পরে। মায়ের মুখ ভালো মনে নেই বিলটুর।তবুও মাসিমাকে দেখলেই মনটা যেন কেমন করে। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একেবারে স্যারের ঘরের দাওয়ায় উঠে পরলো। স্যারের বাড়িটা যেন বইয়ে দেখা ছবির মতো। সদর দরজায় কি সুন্দর লতানো ফুলের গাছ । উঠোন একেবারে পরিস্কার। সবকিছু যেন সাজানো। শান্তি দিদিও কি সুন্দর। একেবারে পরীর মতো। ছুটির দিনের দুপুরবেলা বলে সব কেমন শান্ত। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে বিলটু দেখে স্যার অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ঘুমন্ত স্যারকে কেমন সাধুসন্তদের মতো লাগছে। এই স্যারই যখন জোড়া বেত হাতে সামনে দাড়ান তখন মনে হয় শিকারী বাঘ।
বিলটু ফিরে এসে বলাইকে বললো তুই ওই জামরুল গাছটার নীচে গিয়ে দাড়া। আমি একটা কাজ সেরে এক্ষুণি আসছি। ফিরে এসে আবার জানালায় দাঁড়ালো। বাইরে থেকে স্যারের ঘুমন্ত মুখখানা ভালো দেখা যাচ্ছেনা। মাথাটা দেখা যাচ্ছে পরিস্কার। স্যারের যে কগাছি চুল আছে তা প্রায় সবই সাদা। মাঝে সুন্দর তেলচকচকে টাকটিতেই যেন স্যারের সৌন্দর্য্য আরো বেড়ে গেছে। বিলটুর ছোট্ট জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর মানুষ এই হেডস্যার। হঠাৎ বিলটু ব্যস্ত হয়ে পকেটে হাত দিল। পকেট থেকে সযত্নে একটা গুলি বের করে বাম হাতে ধরা গুলতিতে বসিয়ে নিল। তারপর বিলটু সোজা স্যারের সেই চকচকে টাক বরাবর তাক করে গুলি ছুড়তে উদ্যত হলো। কখন যে বিলটু চোখ বুজেছিল নিজেই জানেনা। টের পেল তার হাত কেউ ধরে রেখেছে। চোখ বোজা অবস্থায়ই শুনতে পেল কে যেন বলছে,কিরে বিলটু এই দুপুর বেলা কি করছিস। সারাদিনে কিছু খেয়েছিস? চোখ মেলে দেখে হেডস্যার তার হাত ধরা। মাসিমাকে ডেকে বললেন দেখতো ছেলেটাকে কিছু খেতে দিতে পারো কিনা। সকাল থেকে মনে হয় পেটে কিছু পরেনি। বিলটুকে বললেন আয় ভেতরে আয়। স্নানও তো হয়নি, তা সে কই ? তোর সর্বক্ষণের সাথী বলাই,তাকে ডাক। দুজনে পুকুরে ডুব দিয়ে আয়। তারপরে দেখ তোর মাসিমা কি খেতে দেয়।
বিলটুর চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়তে থাকে মাটিতে,যা মাটি শুষে নেয়। সেদিনের অত মারেও যে বিলটুর চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল পড়েনি আজ তা একখানা হাতের স্পর্শে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত বেরিয়ে এলো।
ঢাকা, বাংলাদেশ ।