মন্ডল পাড়ার মসজিদ হতে আযানের ধ্বনি কানে আসে নজরুল মুন্সীর। তিনি তখন কলতলায় নিম ডালের মেসওয়াক দিয়ে লালচে দাঁতের উপর সজোরে ঘোরাচ্ছেন। তখন সবে অন্ধকার কেটে বাড়িঘর দৃশ্যমান হচ্ছে।সবাই তাকে নজু মুন্সী বলে ডাকে। পাড়ার সকলে তাকে সন্মান করে। পাড়ার যেকোনো বিচার-সালিশে তার স্থান পাকাপোক্ত। কলতলার পাশে শরিফা গাছটার নিচে তিনি ওযুটা সেরে নিলেন। খয়েরি রঙের দাঁড়িগুলোর উপর হাত ঘুরিয়ে এগিয়ে চললেন মসজিদের দিকে। দু’একটা পাখি ক্ষনে ক্ষনে ডেকে উঠছে।পথঘাট এখনো অস্পষ্ট। তবুও প্রকৃতির খেয়ালে একটু একটু করে মন্ডলপাড়া দৃশ্যমান হচ্ছে।
সবার আগে চোখে পড়ে চেয়ারম্যান আফসার গাজীর বাড়ি। বেশ বড়সড় বাড়ি।গেল বছর ঘরে চুনকাম করা হয়েছে। বেশ উচু করেই সীমানা প্রাচীর দেওয়া। তবুও সবকিছু ছাড়িয়ে সবার চোখ একবার ওবাড়ির দিকে প্রবৃষ্ট হয়। পাড়ার বেশিরভাগ মানুষই মূর্খ,সাধারণ শ্রেণীর। পাড়ার অনেক বাড়িই নড়বড়ে। কেউ কেউ দু’পয়সা খরচ করে উপরে শনের বদলে টিনের ছাপড়া দিয়েছে।শুধু মনসুরের অবস্থাটা সেই আগের মতই।মনসুর আলী দিনমজুরের কাজ করে। সারাদিনে যে সামান্য কিছু টাকা আয় করে তা দিয়ে সংসার কোনো রকমে চললেও জীবন চলে না।
মনসুরের বউ ফুলবানু আবারো পোয়াতি। ভাঙা ঘরে এখন তার পাঁচটা মেয়ে। একটা ছেলের আশায় পাঁচ,পাঁচটা মেয়ে তার। ফুলবানু তার স্বামী মনসুরকে একটা ছেলে সন্তান দিতে গিয়ে এতগুলো মেয়েকে দুনিয়াতে এনেছে। কিন্তুু মনসুরের সংসারের অবস্থাটা ভালো না। দু’এক বেলা খেয়ে,কখনোবা না খেয়ে কোনো রকম চলে ক্ষুধার্থ সংসার। পাড়ার দাদী,চাচীরা বলে,ওলো এবারও তোর মেয়ে হবে দেখিস। তখন ফুলবানুর মুখে গভীর অন্ধোকার নেমে আসে। বড় মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত। অথচো তার হাতে তেমন কোনো টাকা পয়সা নেই যে মেয়েকে বিয়ে দেয়। মনসুরের চোখে জল আসে। সে হাউমাউ করে কাঁদতে চাই। সে যে বাপ।এতগুলো মানুষের দায়িত্ব তার। সে কী করবে?দায়িত্ববোধ আর দারিদ্র তাকে প্রতিনিয়ত দংশন করছে।
মেজ মেয়ে আমেনা মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক আচারণ করে। সবাই বলে জিনে আচড় করেছে। ডাক্তার -কবিরাজ দেখানোর পয়সা যে নেই মনসুরের! দু’বেলা মুখে ভাত তুলে দিয়েই সে তার দায়িত্ববোধ থেকে আপাতত রেহায় পাই। আরো দায়িত্ববোধ সে কী করে পালন করবে?।
গতবার , যেবার ফুলবানু পোয়াতি হলো প্রায় মরার মত অবস্থা, হাতে তখন একটা পয়সাও নেই। ইদ্রিস ব্যাপারির কাছে গিয়েছিলো কিছু টাকা ধার নিতে। ইদ্রিস ব্যাপারি গলা খাকারি দিয়ে বলল,তুই বড্ড জালাতন করিস রে মনসুর। ব্যবসাটা লাটে ওঠার জোগাড়,কি করে টাকা দিই বলতো?। মনসুরের বুকটা ভেঙে যাচ্ছিলো। টাকাটা তার খুব প্রয়োজন। সে তো ফুলবানুকে খুব ভালোবাসে। একটা ছেলের জন্য,তার শখ পুরণ করার জন্যই তো সে মরতে বসেছে। তার চারপাশ অন্ধোকার মনে হতে শুরু করলো। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ব্যাপারি সাব আপনে ছাড়া কে আছে কন? ইদ্রিস ব্যাপারি মনসুরের আর্থিক ও মানবিক দূর্বলতাকে কাজে লাগাতে চাইলো। সে বলল,টাকা তোকে দিতে পারি তুই শুধু তোর বাড়ির দলিলটা প্রমান হিসেবে দিবি। টাকা দিয়ে আবার নিয়ে যাস। সে দলিল বোঝে না,সে বোঝে টাকা। টাকা তার ভিষণ দরকার।
আমেনা চেয়ারম্যানের বাড়িতে কাজ করে। দু’বেলা খেতে দেয় আর মাঝে মাঝে বাড়ির পুরানো দু’একটা কাপড় তাতেই সে খুশি। যেদিন আমেনা প্রথম এসেছিলো চেয়ারম্যান তার শরীরের দিকে তাকিয়েছিলো। এ তাকানোর মানে সে বোঝে না। সে বোঝে দু’বেলা ভাতের গন্ধ আর পুরোনো কাপড়ের মলিন ঘ্রান।
মনসুরের ছোট তিনটা মেয়ের বয়স খুব কম। একেবারে ছোট মেয়েটার বয়স দুবছর। সে ওদের দিকে তাকাতে পারে না।কষ্ট হয়, প্রচন্ড মায়া হয়। ওদের জন্য কিছুই করতে পারে না সে।
নজু মুন্সীর ক্ষেতে সকাল থেকে কাজ করছে মনসুর।মাথার উপর কড়া রোদ। ঘামে শরীর ভেজা। অলসতায় হাত দুইটা ভেঙে আসে, ক্লান্তিতে চোখ দুটা বুজে আসে।তবুও থামে না সে। সবার মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে হবে। সে ভাবে! জীবনের সময়টাকে খুব বেশি বড় মনে হয় তার। মাঝে মাঝে পৃথিবীটা তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। সে নিজেকে অপরাধী ভাবে।
সেদিন ভরদুপুরে পাশের বাড়ির মনু মিয়ার বউ হটাৎ বলে ওঠে, ওলো, আমেনার পেটটা অমন বড় হচ্ছে কেন? ফুলবানু পাটিতে শুয়ে ছিলো। আমেনার দিকে তাকিয়ে তার শরীর কেপে উঠলো। বিকালে মনসুর ঘরে ফিরলে সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,আমেনার কে সর্বনাশ করেছে!আমার আমেনা বলেই কেঁদে ফেলল ফুলবানু। মনসুরের বুঝতে বাকি রইল না। কিন্তুু সে গরীর। সে পারবে না এই বিচার চাইতে। সে কার কাছে বিচার চাইবে? তার মাথা ঘুরতে লাগল।
পরদিন সে দুপুর পর্য়ন্ত ঘুমালো।ক্লান্তি আর অবসাদে শরীর উঠতে চাই না তবুও তাকে কাজে যেতে হবে।দু’মুঠো ভাতের জন্য, পরিবারের জন্য। আধপেট খেয়ে সে বেরিয়ে পড়লো।
চারিদিকে সন্ধ্যা নেমে গ্যাছে। পাখিরা ফিরে যাচ্ছে ঘরে।ঝি ঝি পোকাগুলো আজ বড্ড বেশি ডাকছে। কখন সন্ধ্যা হয়েছে সে খেয়াল করেনি। সে যখন দিগন্তের ওপারে কালো মেঘগুলো দেখছিলো হাশেম আলী পেছন থেকে ডাকলো, মনসুর বাড়িত যা তোর পোলা হয়েছে। সে ক্লান্ত পায়ে হেটে চলল বাড়ির দিকে।পাজোড়া উঠতে চাইনা, পথও যেন শেষ হয় না। সে যখন বাড়িতে পৌছালো নজু মুন্সী উঠানে দাঁড়িয়ে। তাকে দেখতে পেয়ে হাশেম আলীর বউ বলে উঠল,মনসুর রে……..। তরপর হাউমাউ করে কান্না।মনসুর কি করবে বুঝতে পারছে না। ভেতর থেকে চাপা কান্না বের হয়ে আসছে।সে থামিয়ে রাখতে পারছে না।
ঘরের বারান্দায় ফুলবানুকে শাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। পাশে মনসুরের ছেলে হাত পা নাড়ছে। তার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে ফুলবানু নেই।সে তো এমন চাই নি! সে আজো বিচার চাইবে না। সে জানে সে বিচার পাবে না। কারন সে গরীব,দিনমজুর। তার চোখে দু’ফোটা জল যেন এখনি ঢলে পড়বে। পাশে থাকা প্রদীপটা ধপ করে নিভে গেল। মনসুর চোখের জল মুছে নিলো।
যাত্রাবাড়ি, ঢাকা।