অন্তিম পর্ব- অচিনপুরের দেশে

অন্তিম পর্ব- অচিনপুরের দেশে

গৌতম সরকার

লীলামাসীর মুখ নিঃসৃত সেই অমৃতবানী যে এত তাড়াতাড়ি বাস্তব রূপ নেবে ভাবতে পারিনি। সত্যি কথা বলতে কি, আমফানের রাত্রে যখন মঈদুলের হাত ধরে কটেজে ফিরেছিলাম, তখনও আমার মনে যথেষ্ট শঙ্কা ছিল। সেই মুহূর্তে প্রকৃতির নিষ্ঠুরতায় মানুষ তার নিজ প্রকৃতি সাময়িকভাবে ভুলেছিল, কিন্তু পরের সকালে রৌদ্র- করোজ্জ্বল বাস্তব দুনিয়ায় তাদের মধ্যে থেকে পুনরায় সন্দেহ- উদ্বেগ-ক্রোধ-অবিশ্বাসের নখ-দাঁতগুলো বেরিয়ে আসবে না কে বলতে পারে! কিন্তু না…আমাকে মিথ্যে প্রতিপন্ন করে আমাদের এই কমিউনিটি কটেজে শান্তি আর পুনর্মিলনের খোলতাই হাওয়া বইতে শুরু করলো। আশ্বর্য্যজনক ভাবে কটেজের যে মানুষগুলো এতদিন তাঁদের শহুরে প্রাচুর্য্যময় জীবনের কথা ভুলতে না পেরে অনিশ্চিতপুরের গেঁয়ো মানুষগুলোর সাথে আত্মীয়তার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারতোনা, আজ তাদেরই বাচ্ছারা মঈদুল, নিমাই, আশিকুলের বাচ্ছাদের সাথে সারা উঠোন জুড়ে খেলে বেড়াচ্ছে। শহরের মানুষগুলো এখন অনেক সহজ হয়ে উঠেছে, স্থানীয় যে মানুষগুলো আমাদের প্রতিবেশী হয়েছে তাদের সাথে ওঠা-বসা করছে, এক টেবিলে বসে খাওয়া-দাওয়া করছে। আর এই সব কিছু যত ঘটছে লীলামাসীর মুখের হাঁসি তত চওড়া হচ্ছে, আরোও বেশি নিজেকে দশের সেবায় নিয়োজিত করছেন। সবথেকে বেশি পরিবর্তন হয়েছে আমাদের সঙ্গে আসা ডাক্তার ভদ্রলোকটির। থানায় দেখা করার পরদিন থেকেই ধরাচূড়া পরে আর্তের সেবায় তাঁকে ছুটতে হচ্ছে পাঁচ কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে। সকাল আটটায় গাড়ি এসে নিয়ে যায়, ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে আটটা নটা হয়ে যায়। পার্টির ওই ভদ্রলোক কটেজে এসে বলার পরের দিন থেকেই নিজ দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন। একদিন উনি যখন ফিরছেন গেটের কাছে দেখা, সামনাসামনি খুব বেশি কথা হয়নি। তবুও একদম মুখোমুখি পড়ে যাওয়ায় কিছু না বলা খারাপ দেখায়। জিজ্ঞাসা করলাম, “ফিরলেন?” উনি মৃদু ঘাড় নেড়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। এবার কয়েক পা পিছিয়ে এসে হাতদুটো জড়ো করে বললেন,  “আপনাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আপনারা আমার চোখ খুলে না দিলে আজ দিনের শেষে ক্লান্ত দেহে এই পরিতৃপ্তি নিয়ে ফিরতে পারতামনা। আমি একজন ডাক্তার সেটাই ভুলতে বসেছিলাম। আজ মানুষের এই চরম বিপদের সময় ঘরের চার দেওয়ালের ভরা আশ্রয়ে লুকিয়ে না থেকে আর্তের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারছি, এ যে কতবড় তৃপ্তি! ” আমি বললাম, “আমরাও আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ ডাক্তারবাবু। একজন সেনা যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে নিজ প্রানের তোয়াক্কা না করে লড়াই চালিয়ে যায়, সীমান্তরক্ষীরা যেমন ঝড়-জল-শৈত্য-দাবদাহ উপেক্ষা দেশমাতাকে দিনের পর দিন রক্ষা করে চলে, আপনারাও সেই একইভাবে দেশের মানুষকে রক্ষা করার জন্য প্রাণপাত করছেন। কোনো প্রশংসা, ধন্যবাদ, সাধুবাদ আপনাদের জন্য যথেষ্ট নয়”। উনি শুনে শুধু মাথা নাড়লেন, তারপর ধীর পায়ে নিজের কটেজের দিকে চলে গেলেন।

 

 পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট করতে গেছি, অনেকেই টেবিলে বসে খাচ্ছেন। লীলামাসীকে দেখছিনা, হয়তো রান্নাঘরের ভিতর বা অন্য কোথাও আছেন। দেখা হলে ভালো হত, কিছু কথা বলার ছিল। কিন্তু খেয়েই আমায় বেরিয়ে পড়তে হবে, মঈদুল, জব্বাররা বাইরে অপেক্ষা করছে। ওদের সাথে একবার কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কে যেতে হবে। সামনেই রবি মরশুম, আলু, সর্ষে, বাঁধাকপি, মুলো, পালং বুনতে হবে। মানুষগুলোর মূলধনের জোর নেই, আর এবছর আমফান এদের একদম নিঃস্ব করে দিয়েছে। তাই লোনের একটা ব্যবস্থা না করলেই নয়। বসে আছি এমন সময় একটি অল্পবয়সী মেয়ে আমার খাবার দিয়ে গেল, মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি মাথায় আধো ঘোমটা, রং ফর্সা, মুখটা যেন ঠিক লক্ষী ঠাকুর। আমি একটু অবাক হলাম , একে তো আগে দেখিনি! আমার অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে নিচু হয়ে আমায় প্রণাম করলো, বাধা দেওয়ারও সময় পেলাম না। মুখ নিচু করে হাঁসি মুখে জানালো, “আমি মঈদুলের বিবি, জাফরিন।” উপলব্ধি করি, আমফান শুধু এদের ভিটেমাটি ছেড়ে বাইরেই বের করে আনেনি, এদের এতদিনকার ধর্ম আর সংস্কারের আরোপিত পর্দার বাইরেও বের হয়ে আসতে শিখিয়েছে। এর আগে বার দুয়েক মঈদুলের বাড়ি গেলেও তার পর্দানসীন বিবিকে চোখে দেখার সুযোগ হয়নি। আমি হাত তুলে বিড়বিড় করে আশীর্বাদ জানালাম। মেয়েটি চলে গেল। কাল আমার স্ত্রী বলছিলেন বটে, এখানে যারা নতুন এসেছে তাদের বউয়েরা সবাই রান্নার কাজে সাহায্য করতে লেগেছে। আমি মনে মনে হাঁসি। এ সবই ওই মহিলার হাত যশ। একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয় লীলামাসীর কাজকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। মহিলার জীবনের ব্রতই মানুষে মানুষে বিভেদ ভুলিয়ে সবাই মিলে হাতে-হাত মিলিয়ে একসাথে থাকার মন্ত্র দান। কি অপূর্ব দক্ষতায় মহিলা একই সঙ্গে শহরের শিক্ষিত ইন্টেলেকচুয়াল আর গ্রাম্য অশিক্ষিত সন্দেহপরায়ন মানুষগুলোকে একই কক্ষপথে নিে এলেন। এই মহিলাকে যত দেখছি, শ্রদ্ধার ঝোলা ততই ভারী হয়ে উঠছে।

 

 সময়ের সাথে জীবন জীবনের মতো চলতে লাগলো। কাজ-বিশ্রাম, বিশ্রাম-কাজের যুগ্ম চক্রে একটার পর একটা দিন কেটে যেতে লাগলো। মাঝে মাঝে বিকেলের দিকে ডাক্তারবাবুর চেম্বারে গিয়ে বসি, দেশ-বিদেশের খবর পাই। রোগ আস্তে আস্তে তার তীব্রতা হারাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা রাত-দিন এক করে অবশেষে প্রতিষেধক ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে পেরেছে। বিশ্বের দেশে দেশে সেই ভ্যাকসিন ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষ আবার বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। খুব ভালো কথা, কিন্তু ভয় হয়, কালো রাতি ঘুচে গিয়ে যেদিন আলোর ঝলকানিতে চারদিক উজ্জ্বল হয়ে উঠবে তখন অবিমৃষ্যকারতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে মানবজাতি আবার আত্মোৎল্লাসে মেতে উঠবেনা তো! যদি তাই হয় তাহলে কটা করোনাকে আমরা ঠেকাতে পারবো! আমরা যদি পরিবেশ-প্রকৃতিকে পুনরায় ভোগের নেশায় বিষাক্ত করে তুলি, আমাদের সন্তানসন্ততিরা সুস্থ ভাবে শ্বাস নেওয়ার অধিকার থেকেও বঞ্চিত হবে। তাই আমাদের অনেক বেশি সংযমী, চিন্তাশীল, সংবেদনশীল হতে হবে। আর যেন কোনোভাবেই মানুষের জীবনে এই অভিশাপ নেমে না আসে।

     আজ অচিনপুরের আকাশ একেবারে ঝকঝকে নীল। এই উজ্জ্বল আকাশের নিচের পৃথিবীতে কোনো দুঃখ থাকতে পারেনা, থাকার কথা নয়। তবুও কোথায় যেন মাঝে মাঝে একটা বেহালায় করুন সুরে বেহাগ বেজে চলেছে। আজ থেকে প্রায় একবছর আগে অসহায় মানুষগুলোর যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, আজ প্রতিযাত্রার শুভ মুহূর্ত সমাগম। শুভই তো বলবো, কারণ মানুষগুলো একদিন ঘরবাড়ি ছেড়ে, বাঁচার আশায় দিগ্বিদিক চিন্তা না করে অনির্দিষ্টের পানে ছুটে এসেছিল, আজ তারা আবার নিজ নিজ ঘরে ফিরে যাবে। এ তো মিলনান্তক নাটকের শেষ দৃশ্য হওয়া উচিত, তবু কেন যেন সবকটা মানুষের মুখে ঝোলানো হাঁসি মাঝে মাঝে কৃত্রিম মনে হচ্ছে। লীলামাসী আজ নিজের হাতে মানুষগুলোর জন্য রান্না করছেন, সকাল থেকে তাঁর নিশ্বাস ফেলার সময় নেই। আমি মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছি ধোঁয়া, ঝুল, কালি, ঘাম, দীর্ঘশ্বাসের আড়ালে মানুষটা চোখের জল লুকিয়ে ফেলতে চাইছেন। লীলামাসীর মতো মানুষেরা সর্বসমক্ষে চোখের জল ফেলেননা, কিন্তু তাঁরাও তো মানুষ- মানবিক নরম স্পর্শের অনুভূতিগুলো তো তাদের মধ্যে হারিয়ে যায়নি। আর কিছুক্ষণ পর খাওয়া-দাওয়া সেরে সবাই স্টেশনের দিকে রওয়ানা দেবে, গোছগাছ সারা হয়ে গেছে। স্টেশনে প্রস্তুত গাড়ি, সেই গাড়ি যে গাড়িতে করে এসে একদিন তারা অনিশ্চিতপুরের মাটি স্পর্শ করেছিল। শুধু আমার সারা শরীর জুড়ে অসীম ক্লান্তি। আমার স্ত্রী সকাল থেকে লীলামাসীকে রান্নাঘরে সাহায্য করছেন। লীলামাসী আজ তাঁকে একাজ থেকে বিরত করতে চেয়েছিলেন, সে শোনেনি। তাহলে আমারই দায়িত্ব থেকে যায় গোছগাছ করার। কিন্তু আমি সকাল থেকে শুয়েই আছি, বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছা করছেনা। আজ মঈদুলরাও সকালে আমাকে না ডেকে মাঠে চলে গেছে। জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি আমফানে উপরে পড়া কৃষ্ণচূড়া গাছটা থেকে নতুন চারা গজিয়েছে। কাল দেখে এসেছি সারা মাঠ জুড়ে হলুদ ধানের শীষগুলি হেমন্তের আদুরে হাওয়ায় একে অপরের গায়ে ষোড়শী কিশোরীদের মতো ঢলে ঢলে পড়ছে। এ যে কি চোখের আরাম, আত্মার শান্তি! এইসব ছেড়ে কোথায় যাবো! কি করে যাবো! কাউকে বলিনি, আমি লুকিয়ে একটা কাজ করেছি। সরকারের লিখিত নির্দেশ আসার পর আমি একদিন সদর অফিসে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে আইনি স্বীকৃতিপত্র পেয়ে গেছি এই অনিশ্চিতপুরে পাকাপাকি থাকার অধিকারনামা। লীলামাসী জানেননা, আমার স্ত্রীও জানেনা। আমি দেখতে চাই, যখন সবাই একে এসে বিদায় নেবে, আর উনি প্রত্যেককে মিথ্যে হাঁসি দিয়ে বিদায় জানাবেন, তখন একেবারে শেষে আমি ওনার হাতে কাগজটা ধরিয়ে সোজাসুজি চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবো। একবার সবার সামনে ওনাকে কাঁদাবার আমার বড় ইচ্ছে। আমার স্থির বিশ্বাস আমি সফল হবই।

 (সমাপ্ত)

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
মধ্যবিত্ত

মধ্যবিত্ত

জিহাদ হোসাইন মধ্যবিত্ত তুমি প্রেয়সীর কাঠ গোলাপের মাঝে লুকানো। মধ্যবিত্ত তুমি শেষ বাসে হ্যান্ডেল ধরে ঝুলানো। মধ্যবিত্ত তুমি ছোঁট মায়ের মুখে চেয়ে। মধ্যবিত্ত তুমি বন্ধুর ...
আমার বনস্পতি সময় ও চটি দুঃখ

আমার বনস্পতি সময় ও চটি দুঃখ

I দ্বীপ সরকার   আমার কোন দুঃখ দেখাবার মানুষ নাই ভেতরকার ক্ষত বরং অক্ষতই থেকে যাক চুলচেরা বিশ্লেষণ করে শরীরকে জানতে চেয়েছি শরীর শুধু বিনয়ী ...
জীবনানন্দের সিনেপসিস

জীবনানন্দের সিনেপসিস

আশিক মাহমুদ রিয়াদ  বরিশালে বৃষ্টি মানেই সৃষ্টির অন্য রূপ এসে ধরা দেয় প্রকৃতিতে। সারাদিনের ব্যস্ত সময়, বৃষ্টিস্নাত ভরদুপুরে এসে ঝিমিয়ে পড়ে নিছক কোন অযুহাতে। সেরকমই ...
The Top 11 Traits Health Ceos Have in Common

The Top 11 Traits Health Ceos Have in Common

Cursus iaculis etiam in In nullam donec sem sed consequat scelerisque nibh amet, massa egestas risus, gravida vel amet, imperdiet volutpat rutrum sociis quis velit, ...
স্বাধীনতার মান

স্বাধীনতার মান

রবীন বসু অক্ষত ডানা, মুক্ত আকাশ… স্বাধীনতার মানে জানে। পেটভর্তি অন্ন, শ্বাস নিয়ে বাঁচা, তাকে স্বাধীনতা বলে। পায়ে শিকল, হাতে বেড়ি পরাধীনতার কালো আঁধার। রক্তচক্ষু ...
ঈদের শুভেচ্ছা ভিডিও ২০২৪

ঈদের শুভেচ্ছা ভিডিও ২০২৪

ঈদ মোবারক! ঈদের অগ্রিম অথবা ঈদের শুভেচ্ছা বার্তা ভিডিও নিয়ে আমাদের এই বিশেষ আয়োজন। এই আয়োজনে আপনারা পাবেন সেরা ঈদের শুভেচ্ছা বার্তা ভিডিও এর দুর্দান্ত ...