জোবায়ের রাজু
জ্যামে আটকা পড়ে রিকশায় বসে আছে শিশির আর নাবিলা। নাবিলা শিশিরের হাত শক্ত করে ধরে আছে। এ হাতকে এভাবে সারা জীবনের জন্য শক্ত করে ধরে রাখার জন্য সে বংশে চুনকালি মেখে ঘর ছেড়ে পালিয়ে এসেছে শিশিরের সাথে। দশ ঘন্টা আগে ভোরের ট্রেনে দুজনে চলে এসেছে এই শহরে। শিশির নাবিলাকে নিয়ে তার বন্ধু রাফসানের বাসায় উঠবে। তারপর কাজী ডেকে দুজনের বিয়ে হবে। শিশিরের কাছে আগে এসব গোপন তথ্য শুনে নাবিলার বুকে সেদিন এক আনন্দের শিহরণ উঠেছে। তারপর আজ এভাবে ঘর ছেড়ে দুজনের পালিয়ে আসা।
শিশির ক্লান্ত চোখে নাবিলার দিকে তাকাতেই তার বুকটা ধক করে উঠল। দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবার পরও নাবিলাকে আজ এত সুন্দর লাগছে কেন? যে গোপন উদ্দেশ্যে সে নাবিলাকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে এসেছে, সে কি আজ তা বাস্তবায়ন করতে পারবে? এক বছর ধরে নাবিলার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করে আসা শিশিরের মনে আজ সত্যিকারের ভালোবাসা জেগে উঠেছে। এভাবে সে আগেও তো অনেক মেয়ের সাথে প্রেমের নাটক করে বিয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে ঘর থেকে বের করে এনে তুলে দিয়েছে এই শহরের কুখ্যাত নারী পাচারকারী আমজাদ আলীর হাতে। শিশিরের এনে দেয়া সেসব মেয়েকে কৌশল করে বিদেশে পাচার করে দিত আমজাদ আলী। বিনিময়ে সে যে টাকা পেত, সেখান থেকে একাংশ তুলে দিত শিশিরকে।
সুমি, মিতা, নিপু, রাখি, মিলি সবাইকে একই স্বপ্ন দেখিয়ে বিয়ের নাম করে এভাবে ঘর থেকে বের করে এনে শিশির তুলে দিত আমজাদ আলীর কাছে। কই, তখন তো সে মেয়েগুলির জন্য এভাবে মন গললো না শিশিরের। তাহলে আজ কেন নাবিলার জন্য তার মায়া হচ্ছে! সঙ্গে দয়াও হচ্ছে। না, প্রতারণা করতে গিয়ে শিশিরের এখন মনে হচ্ছে সে নাবিলাকে ঠকাতে পারবে না। এই মায়াবতী মেয়েকে নিয়ে সে সংসার পাতবে। এতদিন সে ভালোবাসার অভিনয় করে এলেও আজ সে নাবিলাকে আমজাদ আলীর কাছে তুলে দিতে পারবে না। প্রেমময় দুটি চোখের উজ্বল দৃষ্টির অভাব ছিল বলে এতদিন শিশির দেখতে পারেনি নাবিলার স্বর্গীয় চেহারার অমৃত মায়া। এই মায়া আজ শিশিরকে বদলে দিয়েছে। সে আজ থেকে কোন মেয়ের সাথে আর প্রতারণা করে সর্বনাশ করবে না। নাবিলাকে বিয়ে করে সংসার সাজাবে। আমজাদ আলীর সাথে কোন সম্পর্ক রাখবে না।
শিশিরকে এভাবে আনমনে কি ভাবতে দেখে নাবিলা বলল-‘কি ভাবছো? কই তোমার বন্ধু রাফসান তো একবারও কল করল না।’ শিশির কিছুক্ষণ চুপ থেকে তরল গলায় বলল-‘রাফসান নামে কেউ নেই। সব ছিল আমার সাজানো নাটক।’ নাবিলা অবাক হয়ে বলল-‘মানে? কি নাটক ছিল?’
না, শিশির নাবিলার কাছে কোন কিছু লুকাবে না। অভিনয় করতে করতে আজ সে বুঝতে পেরেছে নাবিলাকে সে মন থেকে চাইছে। তাই তার কাছে কোন সত্য লুকাবে না শিশির।
শিশিরের মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে আকাশ ভেঙে পড়ল নাবিলার মাথায়। একি হয়ে গেল! এক ভন্ড প্রতারক কিভাবে এক বছর আগে তার জীবনে প্রবেশ করেছে। রাজপুত্রের মত সুন্দর চেহারাখানা দেখে নাবিলা এক বছর আগে শিশিরের ডাকে সাড়া দিয়েছে। কিন্তু তখন বুঝতে পারেনি শিশিরের সেই সুন্দর চেহারার আড়ালে যে লুকিয়ে ছিল একটা কুৎসিত রুপ।
-তুমি আমার মত আরো অনেক মেয়ের সর্বনাশ করেছো? একি শোনালে শিশির?
-হ্যাঁ করেছি। আর নয়। তোমাকেও আমি আমজাদ আলীর হাতে তুলে দিব বলে এ শহরে নিয়ে এসেছি। কিন্তু নাবিলা, আমি তোমার এ সর্বনাশ করতে পারব না। আজ বুঝতে পেরেছি তোমাকে সত্যি আমি ভালোবাসি। এই তোমাকে ছুঁয়ে বলছি নাবিলা, বিশ্বাস করো। চলো আমরা গ্রামে ফিরে যাই।
নাবিলা শিশিরের হাত বিদ্যুৎ গতিতে ঝেড়ে ফেলে দেয়। এই হাত ধরে সে এক পৃথিবী বিশ্বাস নিয়ে শিশিরের সাথে চলে এসেছে। কিন্তু এখন জানলো সেটা ছিল তার জীবনের সব চেয়ে বড় ভুল।
রিকশা থেকে নেমে পড়ল নাবিলা। শিশির বাঁধা দেয়ার আগেই সে প্রতিবাদী গলায় বলল-‘আমাকে ছুঁবে না বলছি। বেশী বাড়াবাড়ি করবে তো পুলিশ ডাকবো।’
শিশির কোন কথা না বলে বোবার মত রিকশায় বসে থাকে। নাবিলা হন হন করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। শিশির তার ভুল বুঝুক আর নাই বুঝুক, অন্তত এ রকম একটা ভন্ডের সাথে জীবন কাটানো যাবে না। দু দিন পর যে সে তার পুরণো স্বভাবে আবার জড়াবে না, তারও কী নিশ্চয়তা আছে! তাছাড়া অনেকগুলি মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে শিশির, নাবিলা এ সত্য মানতে পারছে না।
অবারিত এক রেল লাইনে এসে দাঁড়ায় নাবিলা। স্বপ্ন সাজাতে এসে আজ তার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। এই মুখ নিয়ে সে আর গ্রামে গিয়ে বাবা মায়ের সামনে দাঁড়াবে না। কিছুক্ষণ পর যে ট্রেনটি আসবে, তার তলে নিজেকে উৎসর্গ করে দিবে সে।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।