ড.গৌতম সরকার
এই করোনাকালের মধ্যে নিঃশব্দে চলে গেলেন বাংলা গানের স্বর্ণযুগের এক কন্ঠশিল্পী। না, আজকের প্রজন্ম নাম শুনলে তাঁকে চিনতে পারবেননা, কিন্তু ষাট-সত্তরের দশকের সংগীতপ্রেমী মানুষের কানে এখনও যাঁর মরমী কণ্ঠস্বর ভাসে তিনি হলেন অরুণ দত্ত। একটা সময় রীতিমতো মান্না দে, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, আরতি মুখোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্লার সঙ্গে তাঁর গানও রেডিওতে ‘অনুরোধের আসর’ মাতাতো; এই সব প্রসিদ্ধ শিল্পীর সাথে পাল্লা দিয়ে বহু চলচ্চিত্রে ‘প্লেব্যাক’ করেছেন, কিন্তু যেটা করতে পারেননি সেটা হল আত্মপ্রচার। আসলে নিজের প্রতিভাকে বাজারজাত করার কোনও কায়দাকানুন তাঁর জানা ছিলনা। এর ফলে রেকর্ড-ডিস্ক-ক্যাসেটের যুগ পেরিয়ে এফএম-ইউ টিউবের যুগে তাঁকে কেউ মনে রাখেনি, বহুদিন আগেই বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে গেছেন। পরবর্তী কালে সবার চোখের আড়ালে সংগীত সাধনা করে গেছেন, আর নিজে যে পরম্পরা বহন করে চলেছিলেন সেই পরম্পরার ব্যাটন ধরিয়ে দিয়েছেন সুপুত্রী মধুরিমা দত্তের হাতে। এই উপেক্ষা শিল্পীর চেয়েও অনেক বেশি আঘাত করে শিল্পকে, আর তার থেকেও বেশি উলঙ্গ করে দেয় বাংলা গান ও শ্রোতাদের দৈন্য দশা।
অরুণ দত্ত মূলত উত্তর বাংলার ছেলে। জলপাইগুড়ির দেশের বাড়িতে গান-বাজনার আবহ ছিল। তাঁর দুই দিদি কাননবালা, কমল দাশগুপ্ত, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গান গাইতেন। ছোট্ট অরুণ দিদিদের পাশে বসে সেইসব গান শুনতেন। এভাবেই শিশু অরুনের মধ্যে গানের প্রতি একটা ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল যেটি পরবর্তীতে তাঁর প্রতিভার স্ফুরণে সাহায্য করেছিল। একসময় উচ্চশিক্ষার জন্য অরুণ দত্ত পাড়ি দিলেন জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতা। কলেজে ভর্তির প্রথম বছরই নাড়া বাঁধলেন বিখ্যাত সুরকার অনুপম ঘটকের কাছে। গানের জগতে তাঁর উত্থান খুব দ্রুত হয়েছিল। কলেজের দ্বিতীয় বর্ষেই একেবারে আকাশবাণীতে গাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলেন। এরপর অল ইন্ডিয়া ট্যালেন্ট সার্চ প্রতিযোগিতাতে আরেক উঠতি সুগায়িকা আরতি মুখোপাধ্যায়ের সাথে যুগ্মভাবে প্রথম হলেন। ছাত্র অবস্থাতেই অল্পবিস্তর নাম হল। সেই সূত্রে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছেও গান শেখার সুযোগ পেলেন।
পড়াশোনা শেষ করে কলকাতা ছাড়লেন, চলে গেলেন বোম্বে। সেখানে বিভিন্ন মাধ্যমে গান গাওয়া ছাড়াও রেডিওতেও অনুষ্ঠান শুরু করেন। কলকাতায় তখন সুরের জগৎ মাতাচ্ছেন কমল দাশগুপ্ত। একবার অরুণ দত্ত আকাশবাণী কলকাতা থেকে অফার পেলেন কমল দাশগুপ্তের কাছে মহড়া নিয়ে রম্যগীতি গাইতে হবে। এই অফার ছিল অরুণ দত্তের কাছের স্বপ্নের সমান। কমল দাশগুপ্তের সুরে তাঁর কাছে তালিম নিয়ে গান গাওয়ার সুযোগ পেয়ে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে সত্বর কলকাতায় ফিরে কমল দাশগুপ্তের সাথে যোগাযোগ করলেন। দুর্ভাগ্যবশত কমল দাশগুপ্তের তাঁকে পছন্দ হল না, তাঁর সামনেই কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই গানের জন্য মানবেন্দ্র বা শ্যামলকে পাওয়া যাবে না!” প্রচন্ড ভেঙে পড়লেন অরুণ দত্ত। সেই সময় মানবেন্দ্র, শ্যামল বাংলা আধুনিক গানের কল্পতরু হলেও, অরুণ দত্তেরও কিছু নামযশ হয়েছিল। কিন্তু ‘স্টারডাম’-এর মোহচক্র থেকে কোনও কালই নিজেকে পুরোপুরি মুক্ত করতে পারেনি। তবে এই ঘটনা তাঁর জেদ বাড়িয়ে দিল, তিনি আরও নিবিড় সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন।
অরুণ দত্তের গানের আসল গুরু ছিলেন অনুপম ঘটক। এই ক্ষণজন্মা অসামান্য সুরকার বাংলা ছায়াছবির গানে নবজাগরণ ঘটিয়েছিলেন। এখানে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়, তাঁর সুরারোপিত ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছায়াছবিতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘গানে মোর ইন্দ্রধনু’ গানটি। এই গানটিতে তিনি যেভাবে ‘ডিমিনিশিং কর্ড’ ব্যবহার করে উৎকর্ষতার মাত্রা এক অসামান্য বলয়ে উৎক্ষিপ্ত করেছিলেন, যেটি এককথায় হয়ে উঠেছিল অনন্য এবং একান্ত নিজস্ব। সেই মহান সুরকার স্নেহ ও যত্নে অরুণ দত্তকে গান শেখাতে শুরু করেন। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে অনুপমবাবুর মৃত্যুর পর ঘটক পরিবারের সাথে অরুনের সম্পর্ক আরও নিবিড় হল। অরুণ নিরুপম ঘটকের মেয়ের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন। অনুপম ঘটকের গানের ধারা সারাজীবন ধরে প্রচারের আড়ালে থেকে তিনি চর্চা করে গেছেন।
বাংলা গানের ভদ্র-সভ্য মানুষটি নিজের প্রচার করতে না পারায় সহগায়কদের সমান প্রতিভাবান হওয়া সত্বেও প্রচারের আলো থেকে পিছিয়ে পড়েছিলেন। আসলে তিনি ছিলেন গানের পূজারী, যিনি গানের মধ্য দিয়ে সাধনা করতে জানতেন কিন্তু নিজের গান কিভাবে বাজারে বিকোতে হয় জানতেন না। বোম্বে থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে বোম্বে ঘুরে ঘুরে তাঁর সংগীত জীবন চলতে লাগল। আধুনিক গানের পাশে পাশে বিভিন্ন চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকের সুযোগ পেতে লাগলেন। সেই সময় উত্তম-সুপ্রিয়ার ‘চিরদিনের’ ছবিতে ইলা বসুর সাথে অরুণের ডুয়েট ‘এক থেকে দুই হয়’ গানটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। এইসময় একদিন অরুণ খবর পেলেন কমল দাশগুপ্ত তাঁকে একবার দেখা করতে বলেছেন। আগের ঘটনাটির পর অরুনের সাথে কমল দাশগুপ্তের আর যোগাযোগ হয়নি। অরুণের বুক দূরদূর করতে লাগল। কমল দাশগুপ্তের বাড়ি মানেই বাংলা গানের তীর্থস্থান। বাড়িতেই আছেন দুই লিজেন্ড- কমল দাশগুপ্ত নিজে এবং স্ত্রী বিখ্যাত কন্ঠশিল্পী ফিরোজা বেগম। বাড়িতে পৌঁছতেই কমল দাশগুপ্ত অরুনকে একেবারে জড়িয়ে ধরলেন। অত বড় মানুষ নিঃসঙ্কোচে স্বীকার করলেন, অরুণকে চিনতে তাঁর ভুল হয়েছিল। তাঁর স্ত্রী ফিরোজা বেগম সেই ভুল ভেঙে দিয়েছেন। এরপর অরুণ দত্তের সংগীত জীবনে অন্য অধ্যায় শুরু হল।
রেডিওতে যত অনুষ্ঠানে কমল দাশগুপ্তের উপস্থিতি থাকতো সেই সব প্রোগ্রামে অরুণ দত্তের গান ছিল অবশ্যম্ভাবী। এছাড়া কমল দাশগুপ্ত চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করতেন, সেখানে কণ্ঠশিল্পী হিসাবে অরুণ দত্তের নাম থাকত। এরকম একটি তৎকালীন জনপ্রিয় সিনেমা হল, দিলীপ নাগের ‘বধুবরণ’। এই সিনেমায় নেপথ্যে কণ্ঠশিল্পী মান্না দে, ফিরোজা বেগম, আরতি মুখোপাধ্যায়ের সাথে অরুণ দত্তও ছিলেন।। এছাড়া অরুণ দত্ত অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরেও বেশ কিছু গান গেয়েছেন।
ষাটের এবং সত্তরের দশকে এই সুদর্শন, মিতভাষী গায়ক অনেক সাড়াজাগানো গান গেয়ে শ্রোতাদের চিত্তহরণ করেছিলেন। তাঁর গানের প্রথম রেকর্ড হয়েছিল স্বনামধন্য শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের হাত ধরে। ১৯৫৮ সালে প্রফুল্ল ভট্টাচার্য্যের সুরে এবং রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের কথায় গাইলেন দুটি গান- ‘কেন গো পরলে আজ’, আর ‘তুমি যদি গো’। হৈমন্তী শুক্লার সাথে গাইলেন ‘পাখি বলে কারে দেব’, গানটি সেসময়ে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। অরুণ দত্তর যে গানগুলো তখন রেডিও মাতাতো সেগুলো হল অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ও সুরে ‘সূর্যে রৌদ্রে পুড়িয়ে নিজেকে’, ‘তোমার ওই সাগর চোখে নাইতে এসে’, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘যদি যাবে চলে যাও’ ইত্যাদি। এছাড়াও তাঁর সুলতিত কণ্ঠে বহু গানের অঞ্জলিতে বাংলা গানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছিলেন এই শিল্পী। ‘ও পাখি উড়ে যা’, ‘কুহুর কবিতা পৃথিবী যে ওই শোনে’, তুমি যদি গো এলে ফিরে’, ‘যখন চাঁদ ঘুমায়’, ‘ও আমার কৃষ্ণকলি’, কতও যে গান শুনিয়েছিলেন তার ইয়ত্তা নেই। আজ সেইসব গান সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা আছে কিনা তাই বা কে জানে! বহুকাল এসব গান রেডিও, গ্রামোফোন, টেলিভিশনে বাজে না।
বলতে বাধা নেই, শুধু গান নয় বাংলা ভাষা, কাব্য, সাহিত্য, সিনেমা, গান, চরিত্র সবকিছুরই অবক্ষয় গত কয়েকদশক ধরে ঘটে চলেছে। একটা সময় খেলার মাঠ থেকে শুরু করে রাজনীতি, শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, অভিনয়ে বাঙালি জাতি দেশের অগ্রগণ্য ছিল, দেশ-বিদেশে শুধু বাঙালি পরিচয়ের সুবাদে মানুষ শ্রদ্ধা-সম্মান পেতেন। রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দের দেশের মানুষকে সবাই অন্য চোখে, ভিন্ন প্রত্যয়ে দেখতেন। আজ সেখানে অধিকাংশ বাঙালি নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দিতে হীনমন্যতায় ভোগে। তাঁদের ভাষা, চিন্তাধারা, জীবনদর্শন সবকিছুতে হিন্দি-ইংরেজি মেশানো খিচুড়ি সংস্কৃতির আমদানি ঘটেছে। যেখানে এই যুগেরই বাঙালিয়ানা লুপ্ত পেতে বসেছে তখন পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে গাওয়া কোন এক অরুণ মিত্রর গানের খবর কে রাখে! সেটা শিল্পীও অনেক আগেই অনুধাবন করেছিলেন, তাই কোনো কিছুর প্রত্যাশা তাঁর ছিলনা। নিজের ভালোলাগায় নিভৃতে গান গেয়ে গেছেন, আর গুরুদের কাছে যতটুকু শিখেছেন সেইসব অতীব যত্নের সাথে নিজের সন্তানেরর মধ্যে সঞ্চারণ করেছেন। লোকচক্ষুর আড়ালে সেই সন্তানের সান্নিধ্যেই গত ৬ নভেম্বর অরুণ মিত্রর ঐকান্তিক সংগীত সাধনার শুভ সমাপ্তি ঘটল।
লেখক: অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক
তথ্যঋণ: ইন্টারনেট