তওহিদ মাহমুদ
আমার পিঠের নিচের দিকটায় একটা ফুসকুড়ি উঠেছে। খুবই ছোট সাইজের, তবে হাত বোলালে টের পাওয়া যায়। প্রথম দিন নখ দিয়ে খুঁটে দেখতে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, গেঁজের মতোন কিছু একটা হবে, টেনে বের করে আনবো। ওরে বাপ রে বাপ! ছোট্ট জিনিসটার যে এতোটা এলেম, কে জানতো? দুই নখের টানে পড়ে উঠে না আসলেও মাথাটা গেল ছিঁড়ে আর সেই মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে বিতিকিচ্ছিরি একটা অবস্থা।
স্বাভাবিকভাবেই হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছিলাম কিছুক্ষন রক্ত বন্ধ করার জন্য। এর থেকে বড় ক্ষতও এভাবে আটকে ফেলা যায়। এটা কিন্তু হলো না। আঙ্গুলের চাপ সরিয়ে নিতেই আবার রক্ত বেরোনো শুরু করলো। দেখতে না পারলেও বুঝতে পারছি। অগত্যা স্টিকি প্ল্যাস্টার সাঁটিয়ে দিলাম কসরত করে। আগে অয়েনমেন্ট মাখিয়ে নিয়েছি অবশ্য; ওই ইনফেকশান এড়ানোর জন্য আর কি।
তো, ভুলেই গিয়েছিলাম ওটার কথা। পরদিন গোসলের সময় পানি লেগে প্ল্যাস্টার খুলে পড়ে গেল অজান্তেই। রক্ত যেহেতু আর বেরোয়নি, ফলে শরীরের কোথায় কী রয়ে গেল, ততক্ষনে সেটা বেমালুম মুছে গিয়েছে মন থেকে।
২।
আমার স্ত্রী আমার থেকেও অনেক ঝাঁ-চকচকে একটা চাকরি করে একটা আন্তর্জাতিক বায়োটেক ফার্মে। নাহ; এ নিয়ে আমার মধ্যে হীনমন্যতা তো নেই-ই বরং প্রচ্ছন্ন একটা গর্ব আছে। সেই গর্বের উপলক্ষ্য তৈরি হয় নানারকরম গ্যাদারিং এ, যখন মেয়ে-পুরুষ সবাই ঈর্ষাকাতর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। বেশ লাগে তখন। আর তাকাবেই বা না কেন? এরকম ঋষিদের ধ্যান ভঙ্গ করা চেহারা আর ফিগার তো হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় না। তার ওপর সেই স্ত্রী যদি প্রায় পোষা বেড়ালের মতো স্বামীর পাশে পাশে ঘোরে, তাহলে অন্যের বুকটা বড্ড জ্বলে আর নিজের বুকে গর্ব উথলে ওঠে। হাভাতেগুলোর চোখে তো স্পষ্ট পড়তে পারি কী ভাবছে; ‘শালা এই মাল প্রত্যেকদিন বিছানায় পায়। ইশ্! আমি যদি…।’ গর্ব হবে কিনা বলেন?
আমি একজন সাংবাদিক। নামটাম হয়নি তেমন। তবে বলা যায়, প্রথম সারির একটা পত্রিকায় আছি। মোটামুটি ভদ্রস্থ বেতন পেলেও আমাদের যে লাইফস্টাইল, সেটা ওই বেতনে চিন্তা করাও অসম্ভব। ওই যে কথায় আছে না, খোদা যাকে দেন তো ছপ্পড় ফুঁড়েই দেন? নীরা আমার জন্য ওই ছপ্পড় ফুঁড়েই আসা। মাসান্তের বাজার খরচ ছাড়া আর বাকি সব ‘লাক্সারি’ নীরার খাত। বাসাভাড়াটাও নীরা আমার সাথে শেয়ার করে। বলতে নেই, ওর ইনকাম কোন খাতে কীভাবে খরচ হবে, সেটা না চাইতেও কীভাবে যেন আমার মাধ্যমেই কন্ট্রোল হয়ে যায়।
বুঝতেই পারছেন, নীরা আমার স্ত্রীর ডাক নাম। বিয়ের পর নামের শেষে পদবিটাও পালটে নিয়েছে সে – নুসরাত রহমান থেকে নুসরাত মীর। পদবীটা মীর ইলিয়াস থেকে নেওয়া। বলাইবাহুল্য, আমারই নাম মীর ইলিয়াস। নীরা আদর করে ডাকে ইল্লি, কারণ আমার আর অন্য কোন ডাক নাম নেই। ইল্লি শুনলেই কেমন যেন ইল্লিবিল্লি টাইপ মনে হয়। কিন্তু কিছু করার নেই। নীরার নিজেরই বেড়ালস্বভাব। আমাকে বিড়ালের মতো চটকাচটকি করা এবং নিজে বিড়ালের মতো এর দশগুণ আদর খাওয়া নীরার অভ্যাস।
৩।
নীরাকে নিয়ে এতো কিছু বলার কারণ একটাই, আমার শরীরের ওই প্রায় অদৃশ্য আঁচিলটা ও-ই আবিষ্কার করেছিল। যেটাকে প্রথমে যে ফুসকুড়ি ভেবেছিলাম, সেটা আসলে একটা একটা শান্তশিষ্ট আঁচিল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে তিন হপ্তার মধ্যে। কখনও কোন অস্বস্তিকর খোঁচা বা স্পর্শ অনুভব করিনি; টেরই পাইনি। তাই সে হিসেবে আমার আঁচিলত্ব প্রাপ্তির আবিষ্কারের কৃতিত্বটা নীরাই পাবে।
সেদিন আমরা সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। বৃহস্পতিবারের রাত, পরদিন ছুটি ভাবলেই মনটা ফুরফুরে হয়ে থাকে। সব শেষ করে বিছানায় শুয়ে নীরা যখন বেডসাইড ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিল, তখন ঘরে অতি আবছা একটা আলো রয়েছে; বাইরে থেকে ছিটকে আসা স্ট্রিটল্যাম্পের আলো এই রহস্যময় ছায়ার মধ্যেই পরবর্তী ঘন্টাখানেক যেভাবে কাটলো, সেটা কল্পনাতেও আনা সম্ভব নয়। বিছানায় নীরা অসম্ভব স্বতঃস্ফুর্ত, আগ্রাসীও।
সব শেষে যখন বড় বড় শ্বাস নিচ্ছি চিৎ হয়ে তখন খুট করে আলোটা জ্বালালাম। তাকালাম নীরার দিকে। এর মধ্যেই ও নিজেকে একটা নেগলিজিতে ঢেকে নিয়েছে।
নীরার এই এক অভ্যাস। কখনই ওকে আলোতে নিরাবরণ দেখিনি; না দিনে, না রাতে। ওর নাকি লজ্জা লাগে। আমাদের ছ মাসের দাম্পত্য জীবনের এই একটা খাপছাড়া ব্যাপার। অবশ্য সব জানার পরও কিছু একটা অদেখা রয়ে যাওয়া ব্যাপারটা অদ্ভুত ভাবলে অদ্ভুত, অভ্যাস ভাবলে অভ্যাস। আমি একে দাম্পত্যের রহস্যময় অভ্যাস হিসেবেই মেনে নিয়েছি। একটা মেয়েকে, তা-ও আবার নীরার মতো মেয়েকে ছ মাসে কেন, ছ বছরেও পুরোপুরি চেনা অসম্ভব।
আমি উপুড় হয়ে শুয়ে ছিলাম। নীরা আমার কোমরের ওপর চড়ে পিঠটা আস্তে আস্তে মাসাজ করে দিচ্ছিল, যা ও সবসময়ই করে। একই সাথে আরামে আমার চোখ বুঁজেও আসছে আবার উত্তেজনাও আস্তে আস্তে জেগে উঠছে। ব্যাখ্যাতীত একটা অনুভূতি। আমি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিলাম।
৪।
অ্যাই, তোমার কোমরে এটা কী?
আমার চটকা ভাঙ্গলো। মেরুদন্ডের শেষ কশেরুকারও একটু নিচে আঙ্গুলের চাপ অনুভব করছি। চাইলেই উত্তর দিতে পারতাম, ‘তোমার আঙ্গুল।’ কিন্তু নীরা নিশ্চয়ই সেটা জিজ্ঞেস করেনি।
কীসের কী?
এই যে, গোলমতন। কী এটা?
জানি না কীসের কথা বলছো। আমি তো দেখতে পাচ্ছি না।
দাঁড়াও। – বলেই নীরা আমার পাশে অলস হয়ে পড়ে থাকা বাম হাতটাকে ঘুরিয়ে নির্দিষ্ট জায়গাটায় আমার তর্জনিটাকে চেপে ধরে। কয়েক সেকেন্ড লাগলো বুঝতে।
আঁচিল নাকি? নাকি ফোঁড়া?
ব্যাথা পাচ্ছো না? ফোঁড়া হলে তো ব্যাথা লাগার কথা।
আমি আরেকটু চেপেচুপে দেখলাম। নাহ। ব্যাথা লাগছে না।
কত বড়, অ্যাঁ?
নীরা উত্তর দিল না। বুঝলাম, দেখছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। মিনিটখানেক পরে স্বর ফুটলো।
আঁচিলই। বেশি বড় না।
মনে পড়ল এবার। সেদিন এটাকেই খুঁটে ফেলেছিলাম তাহলে।
ও আচ্ছা, ওটা…। ওটা তো ফুসকুড়ি ভেবেছিলাম। আঁচিল মনে হচ্ছে নাকি?
হুঁ।
এক অক্ষরে উত্তর দিয়ে নীরা এবার আমার পুরো শরীর খুঁজতে থাকে আরও কোথাও আঁচিল আছে কিনা, সেটা দেখতে। এরকম রোম্যান্টিক একটা রাতে আঁচিল খুঁজে বেড়ানো স্রেফ সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। আমার চোখ ওর চোখে পড়তেই এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলাম দুজনেই। দুজনের চোখেই এই মুহূর্তে একই বিদ্যুতঝলক।
তারপর…।
৫।
নীরার সাথে আমার বিয়েটা ফ্লুক মনে হতে পারে। একটা সুদর্শন চেহারা আর পেটানো স্বাস্থ্য ছাড়া আমাকে বেছে নেওয়ার কোন দৃষ্টিগ্রাহ্য কারণ কেউ খুঁজে পাবে না। কিন্তু ওই যে চন্ডীদাস বলেছেন না, ‘যেথা যার মজে মন, কিবা হাড়ি কিবা ডোম’ – এ হলো অনেকটা সেই। আমাদের দুজনের ব্যাকগ্রাউন্ড একদম আলাদা। পরিচয়টা হয়েছিল একটা কোর্স করতে গিয়ে। গ্রুপে পাঁচজনের মধ্যে আমরাও ছিলাম।
এরপর ওই সিনেমা-টিনেমায় যা হয় আর কি। সেভাবেই প্রেম, আর সেই থেকে বিয়ে। নীরার বাড়ি থেকে যেমন আপত্তিও আসেনি, সম্মতিও আসেনি। আর আমার তো নেই-ই কেউ তেমন। এক বোন আছে। আছে না বলে ছিল বললেই মানায় ভালো। আমার চার বছরের বড়। বিয়ের পর সেই যে বাড়ির সাথে সম্পর্ক চুকিয়েছে, ব্যাস। এখন তার ধ্যানজ্ঞান ওই পতিদেবতা। ভাইকে পরিচয় দিতে ওর আগ্রহ নেই। আমারও তাই যোগাযোগ নেই। কিন্তু সে কাহিনী বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। আপাতত আমরা দুজন চুটিয়ে বিবাহোত্তর প্রেম করছি।
সেই রাতের পর থেকে আঁচিলের ব্যাপারটা মাথায় ঢুকে রইলো। এমন না যে, আঁচিল নিয়ে আমার কোন প্রেজুডিস আছে। কিন্তু নিজের শরীরকে নিজেই চিনতাম না, এই ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগছে ভাবতে গিয়ে। আঁচিলটা গোলমতন, হাত দিলে বোঝা যায়। আকারে ছোটই, কিন্তু নরম; তুলতুলে যাকে বলে। কোথায় যেন শুনেছিলাম, আঁচিল হচ্ছে শরীরের কোন বিশেষ জায়গার কোষগুলোর অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি। সেটা ভালো-খারাপ দুটোই হতে পারে। তবে সাধারণত আঁচিল নিয়ে খুব বেশি ভাববার নেই। আঁচিল মাত্রই বেনাইন। এরকম আঁচিল সবার শরীরে খুঁজলেই দুচারটে পাওয়া যাবে।
আচ্ছা, নীরার শরীরে কি আঁচিল আছে?
৬।
আঁচিলটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। খেয়াল হলো সেদিন পিঠ চুলকাতে গিয়ে। নখ দিয়ে বেশ ভালোমতোই আঁচড় খেতে মনে হলো, জিনিসটা আরও বড় হয়েছে। মনটা একটু খুঁতখুঁত করে উঠলো। আচমকা আঁচিল গজানো পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু সাইজে বাড়ছে কেন? ডাক্তার দেখানোর মতো কিছু না জানি। কিন্তু…।
সেদিন বাসায় ফিরে দেখি, নীরা আগেই চলে এসেছে। ওকে ব্যাপারটা বললাম। নীরা হেসেই উড়িয়ে দিল ব্যাপারটা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম একবার। কিন্তু এতোটা ঘাড় বাঁকিয়ে কি আর দেখা যায়?
নীরা, অ্যাই নীরা।
কী বলছ? – রান্নাঘর থেকে জবাবটা এলো। মনে পড়লো, এই সময়ে আমরা দু কাপ চা খাই। সেটাই ও বানাচ্ছে।
একবার আসবে প্লিজ?
কেন? চা বানাচ্ছি এখন। আসা যাবে না।
আসোই না একবার।
আমার ডাকাডাকিতে আসতেই হলো নীরাকে। – ‘কী হয়েছে? এরকম ব্যস্ত হয়ে ডাকাডাকি করছ, ব্যাপারটা কী?’
প্রথমেই টুক করে একটা চুমু খেয়ে নিলাম আমি ওর কানের লতিতে। নীরা শিউরে উঠে চোখটা বন্ধ করে ফেললো। এটা আমি জেনে গিয়েছি যে, ওর কানে চুমু খেলে অটোম্যাটিক চোখ বন্ধ হয়ে যায় ওর। সাথে সাথে অবশ্য নিজেকে সরিয়েও নিল।
মতলব কী, অ্যাঁ? অফিস থেকে ফিরেই উল্টোপাল্টা চিন্তা।
কোন মতলব না। তোমাকে দেখলাম, তাই…।
হুঁ বুঝেছি। ডাকছিলে কেন?
আমার আঁচিলটার একটা ছবি তুলে দাও তো।
কীহ? – নীরা গলার স্বরই বলে দিচ্ছে, আমার কথাটায় ও খুব অবাক হয়েছে। এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। আঁচিলের ছবি তুলতে বলার মধ্যে অবাক হওয়ার কী আছে?
বললাম যে পিঠের আঁচিলটার ছবি তুলে দাও। দেখতে পারছি না।
ছবি দিয়ে কী করবে?
কিছুই না। আঁচিলটা মনে হচ্ছে সাইজে বড় হয়ে গিয়েছে। দেখতাম।
ওহ, তাই বলো।
নীরার ফোন ওর সাথেই ছিল। আমাকে আলোর দিকে দাঁড় করিয়ে ঝটপট দুটো ছবি তুলে ফেললো ও। হোয়্যাটস অ্যাপে পাঠানোর আগেই ফোন। নীরার কথাতেই বুঝলাম, ফোনটা অফিসের। কথা বলতে বলতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল ও। মিনিট পনের পরে টুং শব্দে চটকা ভাঙ্গল আমার। এতক্ষম আঁচিল হাতড়াচ্ছিলাম। নীরা আমার আঁচিলের ছবি পাঠিয়েছে। সেই সাথে দুটো শব্দ – ‘এবার শান্তি?’
আমি খুললাম হোয়াটস অ্যাপ। দুই অ্যাঙ্গেল থেকে তোলা প্রতিটা ছবি বড় করে দেখলাম। নাহ, অস্বাভাবিক কিছু না। আর দশটা আঁচিল যে রকম হয়, সেই রকমই। হালকা মসৃন বাদামী রঙের; কালচে একটা ছাপ আছে । সাইজও এখন ছবি দেখে তেমন কিছু মনে হচ্ছে না।
জীবনে কোন টেনশান না থাকলে মনে হয় লোকে এই-ই করে, নিজের পিঠের আঁচিল নিয়ে গবেষণা।
হাহ!
৭।
আমার বয়স যখন সাড়ে সাত, তখন একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার। মানুষ নাকি চাইলে আড়াই বছর বয়সের স্মৃতিও মনে করতে পারে। সে হিসেবে সাড়ে সাত বছরের একটা শিশুর অনেককিছুই আবছাভাবে হলেও মনে থাকার কথা। ওই ঘটনাটা আমার বেশ স্পষ্ট করে মনে থাকার একটা কারণ অবশ্য আছে। সেটা বলার আগে ঘটনাটা জানা দরকার।
তার আগে একটা ব্যাপার। আমার আয়াট্রোফোবিয়া আছে। আমি কখনও কোন ডাক্তারের কাছে অথবা কোন ধরণের মেডিকেল প্রসিডিওরে যেতে পারি না। আমার প্যানিক অ্যাটাকের মতোন হয়। সাংবাদিক তো, তাই পড়ার অভ্যাসটা আছে। এজন্যই জানা ছিল, আয়াট্রোফোবিয়া কথাটা এসেছে গ্রিক শব্দ আয়াট্রোস মানে উপশমকারী এবং ফোবস, যার মানে ভয়, এই দুটো শব্দ থেকে। অন্য দশটা ফোবিয়ার মতোই এরও কিছু কারণ নিশ্চয়ই আছে। আমি জানি না, অত ভেবেও দেখিনি। তবে আমার ধারণা, শৈশবের ঘটনাটার সাথে এর একটা যোগসূত্র থাকলেও থাকতে পারে।
তো, যা বলছিলাম।
আমার মা মারা যান আমার নয় বছর বয়সে। কাছাকাছি সময়ে বাবাও। আমরা দু ভাইবোন বড় হয়েছি আমার মামার কাছে। সেই মামাও বেঁচে নেই অবশ্য। আমরা থাকতাম ঠাকুরগাঁও এ। শীতকালে বেজায় ঠান্ডা পড়ে ওখানে। মামার বাড়ি থেকে আড়াইমাইলটাক দূরে একটা উঁচু ঢিবিমতোন ছিল। খেলতে যেতাম ওখানে। আমরা বলতাম কালাটিকি। কারণ ঢিবিটার মাটির রঙ ছিল কিছুটা কালো।
এই ঢিবিটার উৎপত্তি সম্পর্কে জানা যায় না। আশেপাশে কোন বড় দীঘিও নেই যে সেটার মাটি জমে এই ঢিবির জন্ম। সমতলভূমিতে এরকম একটা ঢিবি গজানোটাও ঠিক যায় না।
যাই হোক, আমার মামাতো ভাই এখলাস একদিন পা পিছলালো। ঢিবিটা প্রায় চার-পাঁচ তলা উঁচু। বেশ খাড়াইও ছিল। ঢাল গড়িয়ে পড়ে গেলে হাত পা ভাঙ্গাও বিচিত্র ছিল না। এখলাস পড়লো কিন্তু নিচ পর্যন্ত না। ঢিবির যে পাশটাতে সাধারণত যেতাম না, এখলাস পড়েছিল সেদিকটা দিয়ে। ফুট দশেক পিছলিয়ে ওর দু পা ঢুকে গেল একটা গর্তের মতো জায়গায়। এই ঢিবিতে কোন গর্ত ছিল না কোনকালে। থাকলেও আমরা দেখিনি কখনো। এখলাসও আসলে কোন দৃশ্যমান গর্তে পড়েনি বরং যেন ফাঁপা মাটির মধ্যে গেড়ে গেল।
বেশ কসরত করেই এখলাসকে টেনে বের করা হলো আর আমরা আবিষ্কার করলাম দুটো ব্যাপার। কালাটিকির ভেতরের মাটি ঘোর কৃষ্ণবর্ণের এবং সেটা মাটি আর তেলের কেমন একটা মন্ডের মতো। দ্বিতীয় ব্যাপারটা এখলাসের সাথে সম্পর্কীত। পতনের ধাক্কায় ওর দুটো পা-ই ভেঙ্গে গিয়েছে।
ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতাল নামেই হাসপাতাল। একটু গুরুতর কেস হলেই ছুটতে হয় দিনাজপুরে। শীতের ঘন কুয়াশা ভেদ করে ভাড়া করা গাড়িতে করে এখলাসকে যখন দিনাজপুরের হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে, ততক্ষনে ও ব্যাথার চোটে অজ্ঞান।
সৌভাগ্যক্রমে এর পরের চিকিৎসাটা ঠিকমতোই হলো। পায়ে লেগে থাকা মন্ডের মতো কালো মাটি আগেই পরিষ্কার করা হয়েছিল। এবার ডাক্তার আরও ভালোভাবে পরিষ্কার করে প্লাস্টার করে দিলেন। খোলা হবে ঠিক দু মাস পর।
এরপরের কাহিনীটা একই সাথে অদ্ভুত এবং মর্মান্তিকও। দু মাস পর প্লাস্টার কাটা হলে দেখা গেল, এখলাসের পায়ের প্লাস্টার করা অংশটার মাংস দেখতে হয়েছে ওই কালো মাটির মতো থকথকে। এখলাস তো বটেই, ডাক্তার পর্যন্ত ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিলেন। পরেরদিনই জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করে দুটো পা-ই কেটে ফেলতে হলো। যদিও পাল্টার করা অংশ ছাড়া ওগুলো একটুও বাইরে ছড়ায়নি প্লাস্টার খোলার আগে।
সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপারটা ছিল, এই পুরো দুই মাসে এখলাস কিচ্ছু টের পায়নি। না কোন ব্যাথা, না কোন চুলকানি, না কোন অস্বস্তি। আর আমার? মাথায় ঢুকে গেল বাকি জীবনের জন্য একটা ভয়। প্লস্টার, অসুখ, ডাক্তার, হাসপাতাল – সবকিছু নিয়ে।
৮।
আমার আঁচিলটায় হাত বোলাতে গিয়ে খেয়াল করলাম, কী যেন একটা খরখরে লাগছে হাতে। যেন ছোট্ট একটা পিনের মাথার মতো বেরিয়ে আছে। খুব ব্যস্ততার জীবনে আচমকা বাসায় একা বসে থাকার অবস্থা হলে দিনটা লম্বা হয়ে যায়। আমিও সেই লম্বা সময়টাকে কাটানোর জন্য নখ দিয়ে পিনের মাথাটায় আলতো টান দিলাম। সাথেসাথেই মনে পড়ে গেল, এর আগেরবার এই কাজটা করতে গিয়ে কী রক্তারক্তি কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে এবার জিনিসটা বেরিয়ে এলো প্রায় আধ সেন্টিমিটার মতো।
অদ্ভুত ব্যাপার! জিনিসটা এখনও ঝুলে আছে। ছোটবেলায় দেখেছি, চামড়ায় অনেক সময় এরকম ছোট গোটার মতো উঠতো। কিছুদিনের মধ্যেই তার থেকে শিকড়ের মতো একটা ছোট্ট সাদা লম্বামতো জিনিস টেনে বের করে আনতাম। আমার দাদা বলতেন, এ হলো গেঁজ। এই যে বেরিয়ে গেল, এবার ঠিক হয়ে যাবে। যেতোও।
এবারও সেই কথাই মনে পড়লো। তবে এতোটা লম্বা হবে, ভাবিনি। আমি আরেকটু টানলাম। সরু শিকড়ের মতো জিনিসটা আরেকটু বেরিয়ে এলো। পুরো ব্যাপারটাই ঘটছে আমার চোখের আড়ালে, পুরোপুরি হাতের স্পর্শের আন্দাজে।
কেমন একটা অসুস্থ কৌতুহল পেয়ে বসলো আমাকে। আস্তে আস্তে টেনে বের করতে লাগলাম জিনিসটা আঁচিলের ভেতর থেকে। ফুটখানেক বের করার পর যখন হাতটা শরীরের সামনের দিকে চলে এসেছে তখন প্রথমবারের মতো দেখতে পেলাম জিনিসটা। ঠিক সাদা নয়। রঙটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হলুদ। তাতে লালের ছিটা। আকৃতি সুতোর মতো হলেও অনেক বেশি সুক্ষ্ম। নিজের শরীর থেকে টেনে বের করার কারণে গা একটু ঘিনঘিন করছিল। কিন্তু কৌতুহলের কাছে সেটা পরাজিত হলো। খুব সাবধানে বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুল আর তর্জনি দিয়ে সুতোটার গা স্পর্শ করলাম। মসৃন নয় সারফেসটা। খুবই সুক্ষ্ম কাঁটার মতো লাগলো।
আরেকটু টানলাম। জিনিসটা আরেকটু লম্বা হলো। লম্বা হলো অবশ্য আমার চোখে। আমি জানি, আসলে আঁচিলটা থেকে এই শিকড় আরেকটু বের হলো। এতক্ষণে সেটার দৈর্ঘ্য দেড় ফুটে দাঁড়িয়েছে। ডান হাত লম্বা করে ধরে আছে। আর টানতে গেলে এবার অন্য জায়গায় ধরতে হবে। আমি সেটাই করলাম। জিনিসটার গোড়ার কাছটাতে ধরলাম। বাকি অংশটুকু আঙ্গুলের কাছ থেকে ঝুলছিল। আরও কিছুটা টেনে বের করতেই আচমকা জিনিসটা বেরিয়ে এলো পুরোটা। প্রায় মাঝামাঝি দৈর্ঘ্যে এখন ওটা ঝুলছে আমার আঙ্গুলে। বাকিটুকু কখন যেন বাতাসের ধাক্কায় আমার কোমরের নিচটায় সেঁটে গিয়েছে।
এইবারে সত্যিই ঘেন্না হলো খুব। তাড়াতড়ি সরিয়ে নিলাম শরীরের স্পর্শ থেকে। তখনও কিন্তু হাত থেকে ফেলিনি। ওই যে, কৌতুহল। ইচ্ছা হচ্ছিল ভালো করে খুঁটিয়ে দেখি, জিনিসটা কী বেরোলো আমারই শরীরে গজানো আঁচিল থেকে। কিন্তু এতো সরু জিনিস দেখার ক্ষমতা আমার চোখের নেই। নাহ, অনেক হয়েছে। জিনিসটা কমোডে ফ্ল্যাশ করে দিয়ে ভালো করে সাবান দিয়ে তাহ ধুয়ে ফেললাম। আঁচিলটায় আঙ্গুল বুলিয়ে আর কোন স্বাভাবিকতা টের পেলাম না। বড় আঁচিলের বড় গেঁজ। এবারে হয়তো ভালো হয়ে যাবে। শুধু একটা ব্যাপার মনে রয়ে গেল। আঁচিলটা বেশ বড় হয়েছে।
নীরাকে এর কিছুই বলিনি। একটাই ভয়, যদি আমাকে ডাক্তারের কাছে ধরে নিয়ে যেতে চায়। নীরার সাথে এই নিয়ে কোন ঝগড়া হোক, সেটা আমি মোটেই চাই না। আর ব্যাপারটা আলোচনার মতো কিছু নয়ও।
সেদিন গোসলের সময় পুরো শরীর তন্ন তন্ন করে চেক করলাম। নাহ, ওই একটা বৈ আর কোন আঁচিল নেই।
৯।
অফিস থেকে আমাকে একটা অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছে। রাশিয়া – ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধ নিয়ে লিখতে হবে। তবে আঙ্গিকটা একটু অন্যরকমের। এই যুদ্ধের কারণে এই দুই দেশের মানুষদের বিনোদনের মধ্যে কী প্রভাব পড়েছে এবং সেটার ইম্প্যাক্ট কোন দিকে হচ্ছে। জীবনই যেখানে টিকছে না মিসাইল হামলায়, সেখানে বিনোদন নিয়ে লেখাটা নিঃসন্দেহে ইন্টরেস্টিং হবে পাঠকদের কাছে। আমাদের সম্পাদকের মাথায় আইডিয়া আছে, স্বীকার করতেই হবে।
আমার অফিস সেই বিকেল পাঁচটায়। কাজেই সকালের এবেশ বড় একটা সময় বিছানায় শুয়ে আড়মোড় ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে কাটে আমার। তখন শুয়ে শুয়ে নীরাকে অফিসের জন্য তৈরি হতে দেখি। এখনও রাত পোষাক বদলায়নি ও। ওপরে একটা হাউজকোট চাপিয়ে স্কিনের জন্য দিনের শুরুর পরিচর্যাগুলো করে নিচ্ছে। নীরা সাজে না বললেই চলে। সাজার দরকারও নেই। এরকম প্রায়-মডেল মুখশ্রী সাংবাদিক হয়েও আমি যে কটা দেখেছি, তা কড়ে আঙ্গুলে গুনে ফেলা যায়। তবে মেক আপ ছাড়া তারা সলে কেমন, সেটা তো জানা নেই। জানা আছে কেবল নীরাকে।
কী?
নীরার প্রশ্নে একটু সচকিত হয়ে তাকালাম। শুয়ে ছিলাম। দেখলাম, আয়নার মধ্যে দিয়ে নীরা তাকিয়ে আছে ঠোঁটে একটা মুচকি হাসি ঝুলিয়ে।
কী মানে?
কী দেখছ?
উত্তর না দিয়ে হাসলাম আমি। নীরাকে বড্ড লোভনীয় লাগছে এই মুহূর্তে। বসে থাকার ভঙ্গিটাই যে কাউকে উত্তেজিত করার জন্য যথেষ্ঠরও বেশি। আমার দৃষ্টিতে কি তা পড়া যাচ্ছিল?
চোখের সামনে যে আছে, তাকে ছাড়া অন্য কিছু দেখবার সুযোগ আছে?
বাব্বাহ! কথার রাজা একেবারে।
বিশ্বাস হলো না, এই তো?
স্বামীদের সব কথা বিশ্বাস করার কথা? তোমাকে দেখে অবশ্য মনে হচ্ছে, কিছু একটা ভাবছ।
নীরা কিন্তু ঠিকই ধরেছে। ওকে সাজতে দেখতে দেখতেই ভাবছিলাম আমার ওই লেখাটার কথা। কীভাবে শুরু করা যায়, সেটা ঠিক করতে পারছি না। এই সাজগোজটাও কিন্তু এক অর্থে বিনোদনের মধ্যে এনে ফেলা যায়। এই অ্যাঙ্গেল ধরেই শুরু করবো নাকি?
নীরা?
উঁ?
তুমি এত সুন্দর কেন?
রাশান মেয়েরা সুন্দরই হয়, জানো না?
ধাঁ করে মনে পড়ে গেল আমার। আরেহ! নীরা তো এক অর্থে রাশানই। ওর মার দিক থেকে অবশ্য। নীরার মা খাঁটি রাশান আর বাবা বাংলাদেশী। নীরার জন্মও রাশিয়াতে। সেইনর্থে ও অবশ্যই রাশান।
নীরার পরিবার নিয়ে আমার আগ্রহ কখনই ছিল না, নীরারও যেমন আমাকে নিয়ে। এর ওপর নীরার বাবা তো আমাকে সহ্য করতে পারেন না। ওঁর ধারণা, ওনার মেয়েকে আমার মতো চালচুলোহীন একটা ছেলে ভুলিয়েই বিয়ে করেছে বলে। নীরা একদিন বলেছিল কথায় কথায়, আমার সাথে বিয়ে না হলে ওর বাবা ওকে আদৌ বিয়ে দিতেন কিনা, ওর সন্দেহ আছে। আমি হাসতে হাসতে কারণটা জিজ্ঞেস করায় বলেছিল, ওর মা মারা যাওয়ার পর থেকে ওর বাবা সবসময় ওর ব্যাপারে অনেক বেশি পজেসিভ হয়ে গিয়েছিলেন।
নীরা তাই বিয়ের পর ও পাট প্রায় চুকিয়েই দিয়েছে। কদাচিৎ বাবার সাথে ফোনালাপেই সম্পর্কটা এখন সীমাবদ্ধ। আমরা কেউই কারও পরিবার বা অতীত জীবন নিয়ে আগতহী ছিলাম না। কিন্তু আজ হঠাৎ কৌতুহল খোঁচা মারলো।
তুমি রাশিয়ায় কোথায় জন্মেছিলে নীরা?
রাশিয়া না, ইউক্রেন। মা মারা যাওয়ার পর বাবা এখানে চলে আসে আমাকে নিয়ে। আমার তখন দশ বছর বয়স। আমরা কিয়েভে থাকতাম যদিও কিন্তু আমার জন্ম আসলে প্রিপিয়েতে।
আমি জানতাম, নীরার মা মারা গিয়েছিলেন ক্যান্সারে। কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেনের ব্যাপারটা মাথায় ঢুকলো না। নীরাই বুঝিয়ে দিল।
প্রিপিয়েত শহরটা এখন ইউক্রেনের অংশ হলেও আদতে এটা ছিল অবিভক্ত ইউএসএসআর এর অংশ। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে রাশিয়া খন্ডবিখন্ড হয়ে যাওয়ার পর প্রিপিয়েত রাশিয়া থেকে আলাদা হয়ে যায়। অবস্থান হিসেবে এটা এখন রাশিয়া এবং ইউক্রেনের সীমান্তে, বেলারুশ থেকেও খুব বেশি দূরে নয়। নীরার বাবা প্রিপয়েত অ্যামিউজমেন্ট পার্কের দায়িত্ব ছিলেন। ওখানেই নীরার মায়ের সাথে পরিচয় এবং পরিণয়।
প্রিপিয়েত শহরটা এমনিতেই ছবির মতো সুন্দর। তার ওপর আশেপাশে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থাপনাও ছিল। পার্কটা হতে যাচ্ছিল প্রিপিয়েতের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা। উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল ১লা মে, ১৯৮৬। কিন্তু সেটা হওয়ার আগেই একটা অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে যায় ফলে সব বাসিন্দাদের হারিয়ে প্রিপিয়েত পরিণত হয় একটা ভুতুড়ে শহরে। যে অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ছিল প্রিপিয়েতের গর্ব, সেটাই হয়ে দাঁড়ায় অভিশাপ – শুধু প্রিপিয়াতের জন্য নয় বরং পুরো পৃথিবীর জন্য। মানবসৃষ্ট যে দুটো সাত মাত্রার পারমানবিক বিপর্যয় পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটেছে, তার ভয়াবহতম ঘটনাটার আতুড়ঘর এই প্রিপিয়াত নদীর পাশেই। জায়গাটার নাম চেরোনোবিল।
পার্কটার গ্র্যান্ড ওপেনিং এর এক সপ্তাহ আগেই ২৬শে এপ্রিল সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনাটা ঘটে। হিরোশিমার বিষ্ফোরণের থেকেও পাঁচশগুণ বেশি তেজস্ক্রিয় পদার্থ উৎক্ষিপ্ত হয়েছিল আকাশে। তেজস্ক্রিয়তা সবাইকে একই মাত্রায় আক্রান্ত করে না। নীরার বাবা হননি কিন্তু ওর মা যে আক্রান্ত হয়েছিলেন, সেটা টের পাওয়া গেল আরও অনেকদিন পর। তখন নীরা পেটে। সৌভাগ্যক্রমে এবং অবশ্যই অতি আশ্চর্যজনকভাবে নীরা কোন ধরণের সমস্যা ছাড়াই জন্মেছে।
চেরনোবিল ডিজ্যাস্টার নিয়ে জানা থাকলেও পড়াশোনা ছিল না। নীরা অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষন গুগলিং করালাম। এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে যখন লিখতে বসেছি, তখন আমার মাথায় কেন যেন একটা প্রশ্ন বারবার আসছিল।
আর আসছিল একটা নাম – ক্ল্যাডোসপোরিয়াম স্ফ্যায়রোসপার্মাম; এক প্রজাতির ছত্রাক, যারা তেজস্ক্রিয়তাকে শুষে নিতে পারে অবলীলায়।
১০।
আজকের সকালটা আমার অনেক, অনেকদিন মনে থাকবে। ঠিক করে বললে, সকালটা নয়, সকালের ঘটনাটা।
নীরার একটা ট্রেনিং পড়েছে দশদিনের, ইন্দোনেশিয়ায়। কাল রাতে ওর ফ্লাইট ছিল। আমি উঠিয়ে দিয়ে এসে সটান বিছানায়। নীরার সাথে আমিও যেতে পারলে দ্বিতীয় হানিমুনটা সেরে আসা যেত। কিন্তু সংবাদপত্রে চাকরি করে এরকম টানা ছুটি পাওয়া স্বপ্নের মতো ব্যাপার। কাজেই আজ থেকে আমার স্বল্পকালীন ব্যাচেলর জীবন শুরু হচ্ছে। কাকতালীয়ভাবে আজ আমার অফ ডে। তাই যখন পুরোপুরি ঘুম সরিয়েছি চোখ থেকে ততক্ষণে সাড়ে বারোটা পেরিয়েছে ঘড়ির কাঁটা। আড়মোড় ভেঙ্গে উঠে বসতেই খেয়াল হলো ব্যাপারটা।
বিছানার বেশ বড় একটা অংশ জুড়ে চটচটে কী যেন লেগে রয়েছে।
উঠে বসে সরে গেলাম। আরে! কী ব্যাপার? বিছানায় এসব কী? ভাগ্যিস চাদরটা গাঢ় একরঙা কাপড়ের, নইলে বুঝতেই পারতাম না। একটা লার্জ সাইজের পিৎজার আকারের জায়গায় জেলির মতো কিছু একটা ছড়িয়ে আছে। সেটার মধ্যে পড়ে রয়েছে একটা জিনিস।
স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হাতটা কোমরের কাছে চলে গেল। যা আশংকা করেছিলাম, তাই। আঁচিলটা নেই। কোমরের জায়গাটায় একটা ডাবল পাঁচ টাকার কয়েনের সমান গর্ত। আঁচিলটা কোমরের চামড়া থেকে খসে পড়েছে বিছানায় আর সেটায় ঘুমের ঘোরে শরীরের চাপে চেটকে ভেতরের জিনিস ছড়িয়ে দিয়েছে। সেই জিনিসটা আমার আগে দেখা, সুতোর গুঁটলির মতো।
আঁচিল গা থেকে খসে যায় নাকি? জন্মেও শুনিনি। অবশ্য হতেও পারে, কে জানে?
ঘর তখনও আবছা অন্ধকার জানালার পর্দা টানা বলে। পর্দা সরিয়ে আমি চোখ এগিয়ে নিলাম। সেটাই। সেদিন যেরকমটা টেনে বের করেছিলাম আঁচিল থেকে। সম্ভবত সেদিন ছিঁড়ে গিয়েছিল। বাকি অংশটুকু আজ আঁচিল ফেটে বের হয়ে গিয়েছে।
জিনিসটা ভালো করে লক্ষ্য করতে করতে দুটো ব্যাপার আবিষ্কার করলাম। এটা জীবন্ত কারণ এর পুরো অবয়বে হালকা একটা স্পন্দন টের পাওয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয় আবিষ্কারটা ভয়াবহ। আমার কোমর থেকে শুরু করে প্রায় বাম বগল পর্যন্ত নানা আকারের বেশ কয়েকটা ওরকম আঁচিল দেখা যাচ্ছে। প্রতিটার রঙই হালকা কালচে বাদামী। একবার দেখেই বুঝলাম, সেদিন যে জায়গাগুলোয় ওই গেঁজটা স্পর্শ করেছিল, নতুন আঁচিলগুলো জন্মেছেও সেইখানটাতেই।
নিশ্চিতভাবেই আমার কোন একরকমের খারাপ ধরণের চর্মরোগ হয়েছে আর বোঝাই যাচ্ছে, সেটা সংক্রামকও। উকুনের মতো অনেক ধরণের পরজীবিই মানুষের শরীরে বসবাস করে, এইটুকু জানি। গোলকৃমি, যাকে ইংরেজিতে রাউন্ডওয়র্ম বলে, প্রায় তিরিশ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। আমার আঁচিলের মধ্যে যেটা ছিল, সেটাও সম্ভবত এই ধরণেরই কিছু।
ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা এক সেকেন্ডের জন্যও মনে হয়নি। ভাগ্যিস নীরা নেই। থাকলে এই ব্যাপার দেখে যে কী করত, ভাবতেই বরং আমার গা শিউরে উঠল। যেহেতু আঁচিলগুলো আমার আপাতরকমের কোন শারিরীক সমস্যা করছে না বা করেওনি, কাজেই খুব বেশি চিন্তিত হলাম না। সেদিন গায়ে ওই সুতোটা স্পর্শ না করলে নতুন আঁচিলগুলো গজাতো না। ব্যাপারটা শুনতে অস্বাভাবিক হলেও আদতে তা নয়। পক্স বা হাম হলেও গুটিগুলো এরকম শরীরের নানা জায়গায় নিজের স্পর্শের মাধ্যমেই ছড়ায়। আমার সতর্কতার মাশুল হচ্ছে এই আঁচিলের নতুন ঝাঁক।
এসব ক্ষেত্রে আমার চিকিৎসা আমি নিজেই করি। বেঁচে থাকুক গুগল। আর আমার এক সাংবাদিক বন্ধুও জানে অনেককিছু। এসব ছোটখাট চিকিৎসা সম্পর্কীত পরামর্শ ওর কাছ থেকেই নেই। তবে প্রথমে গুগল। আর সবার আগে জানতে হবে, ওই নড়তে থাকা পরজীবিটার নাম। তাহলে ঘরোয়া চিকিৎসার উপায় খুঁজতে সুবিধা হবে।
গতমাসে নীরা আমাকে একটা ফোন উপহার দিয়েছে। জিনিসটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে অস্বীকার করবো না। ক্যামেরাটা বেশ শক্তিশালী। নীরার ড্রেসিং টেবিল থেকে একটা ট্যুজার খুঁজে নিলাম। ওর ভুরু ট্রিম করার ট্যুজার এখন আমার আঁচিল থেকে বেরোনো প্যারাসাইটের গবেষণায় ব্যবহৃত হবে, সেটা জানলে কুরুক্ষেত্র করে ফেলতো নীরা। আমার ক্যামেরার লেন্স কাভার যে কালো ক্যাপটা, ওটাতেই ট্যুজার দিয়ে খুব সাবধানে তুলে রাখলাম জিনিসটা। এরপর আলোতে নিয়ে যথাসম্ভব জুম করে কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম। জিনিসটা এখন আর নড়ছে না। শরীরের বাইরে বেশিক্ষণ বাঁচে না, বোঝাই যাচ্ছে।
জানতাম, ফোনের ক্যামেরাটা অনেক হাই রেজ্যুলিউশনের। তাই বলে এতো ভালো আর এতো সুক্ষ্ম ছবি উঠবে, আশাই করিনি। ইনফ্যাক্ট, জিনিসটা দেখতে বেশ বিদঘুটে টাইপের। আমি গুগলে সার্চ দিলাম ছবিটা দিয়ে। নাম কী এটার, দেখা যাক।
আরিব্বাস! এ কি!!
১১।
ফ্লাইটটা দুদিন পিছানোতে নীরা ভালোই অস্থির হয়ে উঠেছিল। বিয়ের পর এই প্রথম এতোটা লম্বা সময় দুজনে আলাদা থাকল। অবশ্য প্রায়ই কথা হয়েছে ইল্লির সাথে। অবশ্য কথা না বলে টেক্সটই বলা উচিৎ। ফোনে কথা বলতে ইল্লির বড্ড আলস্য লাগে। নীরা ভেবেই পায় না একজন সাংবাদিক কীভাবে এতোটা ফোনবিমুখ হতে পারে। কিন্তু ইল্লি ওইরকমই। টেক্সট করবেও মেপে মেপে।
শেষ কথা হয়েছে দুদিন আগে। আচমকা বিদেশবাস দুদিন বেড়ে যাওয়ার কথা জানাচ্ছিল নীরা। ইল্লি হুঁ হাঁ দিয়েই দায়িত্ব সারে সবসময়। সেদিনও ব্যতিক্রম হয়নি। ঠান্ডা লেগে গলাটা ভারি লাগছিল ইলির। নীরা না থাকলে মাথার জানালা খুলে শোবেই। নিশ্চয়ই সেটাই করেছে, যদিও জানে, ঠান্ডার ধাত নীরার থেকে ওরই বেশি।
এয়ারপোর্ট থেকে সোজা বাসায় এসে উঠলো নীরা। গতকাল ইল্লি জানিয়েছিল, ও বাইরে থাকবে, সম্ভবত ঢাকারই বাইরে। হঠাতই একটা কাজ পড়ে গিয়েছে। তাতে সমসয়া নেই। দরজার চাবির একসেট নীরার কাছেও আছে।
ঘরে ঢুকেই নীরা প্রথমে জানালাগুলো খুকে দিল। মাত্র দশ-বারো দিন ছিল না। তাতেই ইল্লি ওর সাজানো ফ্ল্যাটটাকে অগোছালোর চুড়ান্ত করে তুলেছে। লোকটাকে আর শুধরাতে পারলো না ও। এতো অগোছালো মানুষ হয়? ডাইনিং টেবিলে থালাবাসন পড়ে আছে। রান্নাঘরে উঁকি দিয়েই বেরিয়ে এলো। যাচ্ছেতাই অবস্থা সবখানের। বুয়া তো আসবে কাল। কিন্তু ওই পর্যন্ত অপেক্ষা করে এই অবস্থায় থাকা অসম্ভব। জামাকাপড়টা ছেড়ে নিয়েই ঘর পরিষ্কারের যুদ্ধে নামতে হবে – এই জ্বর-ডেকে-আনা-ভাবনাটা ভাবতে ভাবতেই নীরা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এলো।
ওদের বেডরুমের ভেজানো দরজাটা ঠেলতেই অবাক হয়ে গেল নীরা। দরজাটা বন্ধ। হাতল ঘুরছে ঠিকই কিন্তু দরজার পাল্লা অনড়। অদ্ভুত! লক করা নাকি? কেন? এটার চাবি তো সাথে রাখেনি। মনে পড়লো, বড় একগোছা চাবি ঝুলতে দেখেছে কী-র্যাকে। প্রথমদিন থেকেই আছে। ওর মধ্যে এই দরজার চাবি থাকবে – কথাটা ভেবে নীরা ঘুরলো সিঁড়ির দিকে। আর তখন প্রথমবারের মতো খেয়াল করলো ও, দজার সামনের দিকের মেঝেতে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে কী যেন পড়ে আছে। এতক্ষণ ও ওটার ওপরই দাঁড়িয়েছিল। জিনিসটা তরল এবং চটচটে। আর ঘরে ঢুকে এই গন্ধটাই পেয়েছিল ও, এখন বুঝলো। তখন ভেবেছিল বদ্ধ ঘরে খাবারদাবারের ভ্যাপসা গন্ধ।
সরে এসে ভুরু কুঁচকে দেখলো নীরা জায়গাটা। জিনিসটার উৎপত্তি ওদের বেডরুমের ভেতরে; গড়িয়ে দরজার নিচ থেকে বেরিয়ে এসেছে।
আচমকাই অব্যাখ্যাত একটা ভয়ের অনুভূতি হলো নীরার। বেডরুমের দরজা বন্ধ। ভেতর থেকে অদ্ভুত একটা তরল গড়াচ্ছে বাইরের দিকে। মীর কোথায়? ও তো কিছু বলেনি এই ব্যাপারে। অল্প অল্প কাঁপছে শরীরটা এখন। কাঁপা হাতেই বের করে আনল ফোনটা। মীরকে না নিয়ে এই রুমে ঢুকবে না, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ও। যেখানেই থাকুক, পারলে এক্ষুনি চলে আসতে বলবে।
রিং বাজা শুরু হতেই নীরা আরেকবার চমকে উঠলো ভয়ংকরভাবে। কারণ ও দুটো রিংয়ের আওয়াজ শুনছে। একটা ফোনের স্পিকারে আর অন্যটা আসছে দরজার ওপাশ থেকে।
বন্ধ দরজার ওপাশে ওদের বেডরুমে মীরের ফোন বাজছে!
নীরার এবার অন্য একটা কথা মনে এলো। মীর কি অসুস্থ্য হয়ে ঘরে পড়ে আছে? মীরের আয়াট্রোফোবিয়ার কথা খুব ভালো করেই জানা আছে ওর। হয়তো এইজন্যই নীরাকেও কিছু বলেনি। দুমদাম করে এবার দরজায় ধাক্কানো শুরু করলো নীরা। সাথে সাথে চিৎকার ডাকছে মীরের নাম ধরে। বাজতে বাজতে রিংও থেমে গিয়েছে এতক্ষণে। নীরা আর অপেক্ষা করলো না। এক দৌড়ে নিচ থেকে চাবির গোছাটা নিয়ে ফিরে এলো দরজার সামনে। পাগলের মতো ব্যস্ত হাতে একেরপর এক চাবি ঢোকানোর চেষ্টা করছে কীহোলে। অবশেষে লেগে গেল একটা চাবি। দরজাটা প্রায় ধাক্কা দিয়ে খুলে ঘরে ঢুকেই পা দুটো যেন কংক্রিটে জমে যাওয়ার মতো শক্ত হয়ে গেল। থমকে দাঁড়াল নীরা। দুচোখে অবিশ্বাস্য বিস্ময়।
পুরো রুমে একটা ভয়াবহ কটু গন্ধ। বিছানার ওপর থেকে দরজা পর্যন্ত সেই অদ্ভুত আঠালো তরল লেপ্টে আছে। মীরের কোন চিহ্নমাত্রও নেই কোথাও। ফোনটা পড়ে আছে বিছানার একপাশে। তরলটা কালচে বাদামী রঙের। আর তাতে ময়লাটে হলুদ কী যেন মেখে আছে।
সেদিনের পর থেকে মীরের চুলের ডগাটার খোঁজও পায়নি নীরা, পায়নি পুলিশও। মানুষটা স্রেফ যেন উবে গিয়েছে বদ্ধ কামরার বাতাসে।
১২।
চার মাস পর সাংবাদিক মীর ইলিয়াসের অন্তর্ধান কেস আনসলভড মিস্ট্রি হিসেবে বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। একমাত্র পিই (ফিজিক্যাল এভিডেন্স) হিসেবে ছিল ফোনটা আর ফরেনসিক বিশ্লেষণের জন্য নেওয়া ওই তরলের স্যাম্পল।
ফোনের কললিস্টে শেষ কদিনের কথাবার্তা হয়েছে অফিসের লোকের সাথে আর নীরার সাথে। এখানে সন্দেহজনক কিছুই নেই। টেক্সটও তাই। নির্দোষ কথাবার্তা। গ্যালারিতে তোলা সর্বশেষ ছবিটা নিয়ে পুলিশ নীরাকে জিজ্ঞেস করেছিল। নীরার ধারণাই নেই সেটা কী।
ফরেনসিক বিশ্লেষণে তরলটা মানুষের দেহের প্লাজমার সাথে কিছুটা মিলে যায়। ডিএনএ টেস্ট করা হয়েছিল কিন্তু ইলিয়াস মীরের সাথে মিল পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ এই তরল তার দেহাবশেষ নয়। তবে জিনিসটার সাথে এক ধরণের পরজীবির কিছুটা মিল পাওয়া গেল। এর নাম ববিট ওয়র্ম। অস্বাভাবিক ব্যাপারটা হলো, এই পরজীবিটা কোন প্রাণীর শরীরে বসবাস করে না, করে না কোন মানবসৃষ্ট পরিবেশেও। একে দেখা যায় সাগরের অগভীর তলদেশে। অমনিভোরাস টাইপের এই কীটটি লম্বা হয় প্রায় দশ ফিট পর্যন্ত। একে একবারই কৃত্রিম পরিবেশে দেখা গিয়েছিল। একটা সামুদ্রিক অ্যাকুইরিয়ামে একবার একটা ববিট ওয়র্ম পাওয়া গিয়েছিল ২০০৯ সালে। সেই ট্যাংকে থাকা সব মাছ অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল; ববিট ওয়র্মের কীর্তি।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, ঢাকা শহরের একটা বদ্ধ ফ্ল্যাটের থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া একজন মানুষের সাথে সমুদ্রবাসী এক প্রজাতির ভয়াবহ কীটের সংশ্লিষ্টতা কী? এই উত্তর কারও জানা নেই। জানা যায়ওনি কোনদিন।
শেষ কথা
নীরা বাড়িটা ছেড়ে দিয়েছে। ইলিয়াসের অন্তর্ধানের পর ওর বাবা আবার মেয়ের সাথে অনেকটা জোর করেই যোগাযোগ তৈরি করেন। নীরা এখন বাবার সাথে থাকে। ঠিক বাবার সাথে নয়। ওর নামে যে ফ্ল্যাটটা, সেখানে একজন দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়াকে নিয়ে থাকে ও।
একটা কথা নীরার মনে পড়ে মাঝে মাঝে। ওর মার কথা। ক্যান্সারে মারা গিয়েছিলেন, সেটাই এতোদিন জানতো ও। মায়ের মৃত্যুর সময়ে নীরার বয়স ছিল সাড়ে ছয়। ওর স্মৃতিতে মা তেমনভাবে নেই। কেবল একদিনের স্মৃতিতে আছে যন্ত্রণাকাতর একটা মানুষের চেহারা, যার সারা শরীরে ঘা। এতো বছর পর নীরা ওর বাবার কাছ থেকে জেনেছে ওর মায়ের মৃত্যুর ঠিক কারণটা। অবশ্য কারণ হুসেবে কিছুই চিহ্নিত করা যায়নি। যেটা জেনেছে সেটা হলো, ওর মা কীভাবে মারা গিয়েছিল।
জন্মস্থান ছেড়ে চলে আসার পর ওর মার একটা অদ্ভুত রোগ হয়। রাশান মেয়েরা অদ্ভুত সুন্দর হয় সাধারণত। নীরার মা-ও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। একদিন সেই সুন্দর মানুষটির সারা শরীর স্ফোটকে ভরে যেতে লাগলো। অদ্ভুত সেই ফোড়ার ধরণ। কোন ব্যাথা নেই, নরম তুলতুলে, যেন পানি ভরা বল একেকটা। এরপর একদিন আচমকা ফোড়াগুলো ফেটে যেতে শুরু করলো। একদিনের ব্যবধানে সারা শরীরে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়ে গেল। সেই গর্তে এক ধরণের সাদা কৃমির মতো খুব ছোট্ট পরজীবি ছিল, মাংসখেকো পরজীবি।
নিজের কামরায় নীরা দাঁড়িয়ে আছে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে কিছুক্ষন সময় কাটায় আয়নার সামনে। আজও একটা আকাশী নীল সিল্কের নাইটি পরে দাঁড়িয়ে আছে। আস্তে করে হাত উঠে গেল কাঁধের কাছে। স্ট্র্যাপদুটো সরিয়ে দিতেই পালকের মতো নিঃশব্দে খসে পড়লো পোষাকটা পায়ের কাছে। অনিন্দ্য রূপসী একটা অবয়ব প্রতিবিম্বিত হচ্ছে আয়নায়। নির্নিমেষে তাকিয়ে রয়েছে নীরা নিজের দিকে।
নিটোল স্তনদুটো জ্বলজ্বল করছে যেন। হালকা কালচে বেগুনি একটা আভা চামড়ায়। মসৃন, নরম, তুলতুলে দুটো বল। নীরা কয়েকবার হালকা চাপ দিতেই লম্বামতোন দুটো শিরা জেগে উঠলো দুই স্তনে। না, শিরা নয়, কিন্তু শিরার মতোই দেখতে। নীরা হালকা চাপ দেয় এবার শিরাদুটোর ওপরে। সাথেসাথেই চামড়ার নিচে শিরাদুটো যেন জ্যান্ত হয়ে উঠলো। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে জিনিসদুটো কিলবিল করতে করতে স্থান পরিবর্তন করছে। ভালো করে তাকালে দেখা যায় যৌবনোদ্ধত স্তনবৃন্তদুটোর ঠিক মাঝখানটায় একটা করে দানাদার বিন্দু।
ঠিক যেন দুটো আঁচিল আর সেটা থেকে বেরিয়ে আছে আলপিনের মাথা, যা নীরা ওর জনন্ম থেকেই দেখছে।
(শেষ)