আখেরি চাহার সোম্বা মানে কী?
আখেরী চাহার শোম্বা ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ একটি দিন। আখেরী চাহার শোম্বা আরবী ও ফার্সি ভাষার শব্দসমষ্টি। আখেরী আরবি শব্দ, যার অর্থ শেষ এবং চাহার শব্দটি ফার্সি, যার অর্থ চতুর্থ এবং ফার্সি শোম্বা শব্দটির অর্থ বুধবার। তার মানে, এক কথায় তিনটি শব্দের অর্থ দাড়ায়, শেষ চতুর্থ বুধবার। আখেরি চাহার শোম্বা পালিত হয় শুকরিয়া দিবস হিসেবে হিজরি সনের সফর মাসের শেষ বুধবার মুসলিম বিশ্বে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ স্মারক দিবস হিসেবে পবিত্র আখেরি চাহার শোম্বা পালিত হয়।
কেন পালিত হয় এ দিবস?
সুলুল্লাহ (স.)-এর জীবনের প্রতিটি কথা ও কাজ, তার সব আচরণ, প্রতিটি পদক্ষেপ তথা সমগ্র জীবনই সর্বোত্তম আদর্শ হিসেবে অনুকরণীয় অনুসরণীয়; যা কুরআনুল করিমে নানা আঙ্গিকে ব্যক্ত হয়েছে। তবে নবুওয়াত জীবনের প্রথম অধ্যায় মক্কি জীবনের ১৩ বছর তাকে নির্মম নির্যাতন ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে কাটাতে হয়েছে। হিজরতের পর মদিনায় গিয়েও তাকে ইহুদি-মোনাফেকদের নতুন ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়েছে। মক্কার কাফেররা মদিনার ইহুদি মোনাফেকদের যোগসাজশে তাকে অশান্তিতে রেখেছিল। নানা কৌশলে তার প্রাণনাশের চেষ্টা পর্যন্ত করেছে। ৭ম হিজরিতে হুদায়বিয়ার সন্ধির পর মুহরম মাসে ইহুদিদের একটি চক্র ‘লবিদ ইবনে আসম’ যিনি জাদুবিদ্যায় খুব পারদর্শী ছিলেন, তাকে দিয়ে তারা মুহাম্মদ (স.)-কে জাদু করান। লবিদ কৌশলে নবিজির এক ইহুদি গোলামের মাধ্যমে তার ব্যবহৃত চিরুনি ও চুল সংগ্রহ করে। তারপর মোমের একটি পুতুল বানিয়ে তাতে ১১টি সুচ বিদ্ধ করে একটি সুতায় কুফরি মন্তর পড়ে ১১টি গিট দেয়। সবকিছু পুতুলটির মধ্যে রেখে একটি কূপে পাথরের নিচে চাপা দিয়ে রেখে দেয়। এই জাদুর প্রভাবে রসুলুল্লাহ (স.) শারীরিকভাবে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। অতঃপর হজরত জিবরাইল (আ.) সুরা ফালাক ও সুরা নাস নিয়ে অবতীর্ণ হন। এ দুইটি সুরার আয়াতসংখ্যা ১১। মহান আল্লাহ ওহির মাধ্যমে তার প্রিয় হাবিবকে জানিয়ে দেন—ইহুদি লবিদ আপনাকে জাদু করেছে, আপনি অমুক কূপ থেকে জাদুর সরঞ্জাম তুলে তাতে এই সুরা দুইটির একেকটি আয়াত পাঠ করে ফুঁক দিতে থাকুন। নবিজি হযরত আলী (রাযি.)-এর মাধ্যমে জাদুর সব সরঞ্জাম উদ্ধার করে সুরা ফালাক ও নাসের ১১টি আয়াত পর্যায়ক্রমে পাঠ করালে জাদুর কার্যকরিতা নষ্ট হয়ে যায়, এতে তিনি দ্রুত আরোগ্য লাভ করেন। এরপর নবী (স.) গোসল করেন এবং বলেন আমার শরীরটা এখন অনেক হালকা মনে হচ্ছে, আমি নিজেকে পূর্ণ সুস্থ মনে করছি। এই দিনটি ছিল সফর মাসের শেষ বুধবার।
আখেরী চাহার শোম্বার তাৎপর্য আল্লাহ তা’আলার প্রিয় হাবিব হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই পৃথিবীতে তেষট্টি বছর হায়াত পেয়েছিলেন। এর মধ্যে কখনোই তিনি বড় ধরনের কোনো রোগ-ব্যাধির কবলে পড়েননি। অবিশ্বাসী অংশিবাদীদের শত অত্যাচার ও নির্যাতনের মাঝেও বিশ্বময় প্রতিটি মানুষের কানে তাওহিদের অমীয় বানী ছড়িয়ে দিতে তিনি ছিলেন হিমাদ্রির ন্যায় অটল অবিচল। পার্থিব নিয়ম মেনে আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পাড়ি জমাবেন পরকালের পথে। মিলিত হবেন মহান মালিকের সান্নিধ্যে। এটাই আল্লাহ পাকের ফয়সালা। তিনি তাঁর প্রিয় হাবিব মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তুলে নিবেন পৃথিবী থেকে। তার আগে রোগাক্রান্ত হলেন আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অসুস্থতা ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকলে উম্মুহাতুল মু’মিনীনগনসহ, সাহাবা আজমাইনগণ খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়েন। অসুস্থাবস্থা বৃদ্ধির একপর্যায়ে সফর মাসের বুধবার আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছুটা সুস্থতা অনুভব করেন।
উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা সিদ্দিকা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহাকে ডেকে বললেন, ‘আয়িশা, আমার কাছে এসো ও আমার কথা শোনো।’
হযরত আয়িশা সিদ্দিকা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহা দৌড়ে চলে এলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমার বাবা-মা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক! বলুন, আমাকে কি জন্য ডেকেছেন।’
মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আয়িশা, আমার মাথাব্যথা চলে যাচ্ছে এবং আমি সুস্থতা অনুভব করছি। হাসান, হোসাইন ও মা ফাতিমাকে আমার কাছে ডেকে নিয়ে এসো।’
হযরত আয়িশা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহা তাই করলেন। রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর মাথায় পানি ঢাললেন। তাঁকে সুন্দরভাবে গোসল করালেন। এই খবর মদীনার সকল স্থানে ছাড়িয়ে পড়লো। অনেক সাহাবী এই খবর পেয়ে আনন্দে আত্মাহারা হয়ে গেলেন। কেউবা দাস মুক্ত করে দিলেন। কেউবা উট দান করলেন। কেউবা বহু দান-সাদকা করলেন। সাহাবীরাও অনেকে রাব্বুল আলামীনের কাছে শুকরিয়ার নামাজ ও দুআ করলেন।
‘আখেরী চাহার সোম্বা’ কথাটি ফার্সী। এর অর্থ ছফর মাসের শেষ বুধবার। ইরান, ইরাক, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এটি দিবস হিসাবে পালিত হয়ে থাকে।
এর ভিত্তি হ’ল- মৃত্যুর পাঁচদিন পূর্বে বুধবার রাসূল (ছাঃ)-এর দেহের উত্তাপ ও মাথাব্যথা খুব বৃদ্ধি পায়। তাতে তিনি বারবার বেহুঁশ হয়ে পড়তে থাকেন। অতঃপর তাঁর মাথার উপরে পানি ঢালা হ’লে তিনি একটু হালকা বোধ করলে মসজিদে গিয়ে যোহরের ছালাত আদায় করেন এবং মুছল্লীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন’ (বুখারী হা/৪৪৪২; ইবনু হিশাম ২/৬৪৯)।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে উক্ত দিবস ঘটা করে পালন করা হয় এবং সরকারী ছুটি ঘোষণা করা হয়। অথচ এটি সম্পূর্ণরূপে বিদ‘আতী প্রথা। ছাহাবায়ে কেরামের যামানায় এরূপ প্রথার কোন অস্তিত্ব ছিল না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘কেউ যদি এমন কোন আমল করে, যার প্রতি আমাদের নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত’ (বুখারী হা/২৬৯৭; মুসলিম হা/১৭১৮; মিশকাত হা/১৪০)
আখেরী চাহার সোম্বা ২০২৪
চাঁদ দেখার ভিত্তিতে ৭-অগাস্ট-২০২৪ থেকে পবিত্র সফর মাস শুরু হয়। সে হিসাব অনুযায়ী ২৯ সফর, ১৪৪৬ হিজরী, ৪ ই সেপ্টেম্বর, রোজ বুধবার পবিত্র আখেরি চাহার সোম্বা পালিত হবে। সফর মাসের চাঁদ দেখার সময় বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন আখেরি চাহার সোম্বা কবে নাগাদ পালিত হবে সেই ঘোষণা প্রদান করেন। বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর, মহাকাশ গবেষণা ইত্যাদি সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই ইসলামিক ফাউন্ডেশন আখেরি চাহার সোম্বার দিনক্ষণ ঠিক করেন।
আখেরি চাহার সোম্বার দিনটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ৪ সেপ্টেম্বর রোজ বুধবার দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি অফিস আদালত বন্ধ থাকবে। দিনটির তাৎপর্য সকলের নিকট তুলে ধরতে সরকারের এই দিনটিকে ছুটি ঘোষণা করা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
এটা ছিল সফর মাসের শেষ বুধবার। এজন্য এই দিনটিকে আখেরী চাহার শোম্বা বলা হয়। আখেরী অর্থ শেষ আর চাহার সোম্বা হলো বুধবার। এটাই ছিল রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর জীবনের শেষ বুধবার। এরপর বৃহস্পতিবার হতে আবার অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকেন আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিপূর্বেই তাঁর পরম বন্ধু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার সান্নিধ্যে পৌঁছানোর জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন। একজন মুসাফির যেমন দূরবর্তী সফরে বের হওয়ার আগে সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়, সব কিছু গুছিয়ে নেয়- যা দেখে অনুভব করা যায় যে, উনি কোনো সফরে বের হবেন। ঠিক তদ্রূপ মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তিকালের আগেই তাঁর বিদায় যাত্রার প্রস্তুতি দেখে নিকটতম সাহাবীরা অনুভব করতে পেরেছিলেন যে, রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বোধ হয় আমাদের মাঝে আর বেশি দিন থাকবেন না। উদাহরণস্বরূপ, রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক রমজানের শেষ দশ দিন ই’তিকাফ পালন করতেন। প্রত্যেকবার রমজানে মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কাছে জিব্রাইল আলাইহিসসালাম আসতেন এবং একবার সমস্ত কুরআন মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শুনাতেন। আর মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও সমস্ত কুরআন শরীফ জিব্রাইল আলাইহিসসালামকে একবার শুনাতেন। কিন্তু ইন্তেকালের বছর জিব্রাইল আলাইহিসসালাম রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পূর্ন কুরআন দু’বার শোনালেন। রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও জিব্রাইল আলাইহিসসালামকে পুরো কুরআন দু’বার শোনালেন। এর পর বিদায় হজ্বের ভাষণের মাঝে তিনি বললেন, ‘আজকের দিন যেসময় তোমাদের মাঝে আমি একত্রিত হয়েছি। আর হয়তো তোমাদের মাঝে আমি এখানে একত্রিত হতে পারবো না।’
প্রিয় নবি (স.)-এর প্রিয় উম্মতের প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবে—জীবনের সবকিছুর চেয়ে যেন আমরা নবিজিকে ভালোবাসি, তার অনুসৃত পথে নিজেদের জীবন সাজাই। যেহেতু নবি (স.)-এর রোগমুক্তির দিনটি ছিল সমগ্র জগতের জন্য খুশির দিন, তাই এ দিনে আল্লাহর কাছে আমাদের ফরিয়াদ থাকবে, তিনি যেন যাবতীয় অকল্যাণ থেকে দূরে রেখে আমাদেরকে সুস্থ সুন্দর জীবন দান করেন। আমিন!