“আসমানের তারা সাক্ষী
সাক্ষী এই জমিনের ফুল,
এই নিশিরাইত বাঁশবাগান
বিস্তর জোনাকি সাক্ষী
সাক্ষী এই জারুল জামরুল,
সাক্ষীপূবের পুকুর,
তার ঝাকড়া ডুমুরের পালেস্থিরদৃষ্টি
মাছরাঙা আমাকে চেনে
আমি কোনো অভ্যাগত নই
খোদার কসম আমি ভিনদেশী পথিক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই”
পঞ্চাশ দশকের অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি আহসান হাবীব পিরোজপুরের শংকরপাশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।পিতার নাম হামিজুদ্দীন হাওলাদার৷ মাতা জমিলা খাতুন৷ তাঁর পাঁচ ভাই ও চার বোন৷ পারিবারিক ভাবে আহসান হাবীব সাহিত্য সংস্কৃতির আবহের মধ্যে বড় হয়েছেন৷ সেই সূত্রে বাল্যকাল থেকেই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হন তিনি৷ সেইসময় তাঁর বাড়িতে ছিল আধুনিক সাহিত্যের বইপত্র ও কিছু পুঁথি৷ যেমন আনোয়ারা, মনোয়ারা, মিলন মন্দির প্রভৃতি৷ এসব পড়তে পড়তে একসময় নিজেই কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করেন৷ সাহিত্যের অনুকূল পরিবেশ নিয়ে পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে ১৯৩৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন৷ এরপর তিনি চলে আসেন বরিশালে৷ ভর্তি হন সেখানকার বিখ্যাত বিএম কলেজে৷ কিন্তু তখনকার মানদণ্ডে ম্যাট্রিক পাশের পরে আর লেখাপড়ার কী দরকার আছে এমনটাই মনে হলো পিতা হামিজুদ্দিনের নিকট। তাই তিনি পুত্রকে চাপ দিতে শুরু করলেন চাকরি নেয়ার জন্য। পিতার এই চাপ থেকে সৃষ্ট অভিমান থেকেই বিএম কলেজে দেড় বছর পড়ার পর ১৯৩৬ সালের শেষার্ধে পাড়ি জমালেন কলকাতায়৷ এভাবেই কবি আহসান হাবীবের বরিশাল থেকে তত্কালীন রাজধানী কলকাতায় পদার্পণ৷
১৯৪৭ সালের ২১ জুন বিয়ে করেন বগুড়া শহরের কাটনারপাড়া নিবাসী মহসীন আলী মিয়ার কন্যা সুফিয়া খাতুনকে। আহসান হাবীব দুই কন্যা (কেয়া চৌধুরী ও জোহরা নাসরীন) ও দুই পুত্রের (মঈনুল আহসান সাবের ও মনজুরুল আহসান জাবের) জনক ছিলেন। পুত্র মঈনুল আহসান সাবের একজন স্বনামখ্যাত বাংলা ঔপন্যাসিক। ১২/১৩ বছর বয়সে স্কুলে পড়ার সময়ই ১৯৩৩ সালে স্কুল ম্যাগাজিনে তাঁর একটি প্রবন্ধ ‘ধরম’ প্রকাশিত হয়৷ ১৯৩৪ সালে তাঁর প্রথম কবিতা ‘মায়ের কবর পাড়ে কিশোর’ পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়৷ পরবর্তী সময়ে ছাত্রাবস্থায় কলকাতার কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হলে নিজের সম্পর্কে আস্থা বেড়ে যায়৷ স্কুলে পড়াকালীন তিনি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার বিষয়বস্তুকে কবিতায় উপস্থাপিত করে পুরস্কৃত হয়েছিলেন৷ ততদিনে অবশ্য দেশ, মোহাম্মদী, বিচিত্রার মতো নামি দামি পত্রপত্রিকায় তাঁর বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়ে গেছে৷ কলকাতা গিয়ে শুরু হয় আহসান হাবীবের সংগ্রামমুখর জীবনের পথচলা৷ তিনি কলকাতায় এসে ১৯৩৭ সালে দৈনিক তকবির পত্রিকার সহ-সম্পাদকের কাজে নিযুক্ত হন । বেতন মাত্র ১৭ টাকা৷ পরবর্তীতে তিনি ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার বুলবুল পত্রিকা ও ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত মাসিক সওগাত পত্রিকায় কাজ করেন৷ এছাড়া তিনি আকাশবাণীতে কলকাতা কেন্দ্রের স্টাফ আর্টিস্ট পদে ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত কাজ করেন।
পরে ঢাকায় এসে দৈনিক আজাদ, দৈনিক কৃষক, মাসিক মোহাম্মদী, দৈনিক ইত্তেহাদ, ও সাপ্তাহিক প্রবাহে চাকুরি করেন।
দেশভাগের পরও তিনি সাংবাদিকতায় রত ছিলেন।
আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন আহসান হাবীব। ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রিশেষ’।
তিনি একাধারে লিখেছেন কাব্যগ্রন্থ, বড়দের উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, ছোটদের ছড়া ও কবিতার বই। আহসান হাবীব রচিত বইয়ের মধ্যে কাব্যগ্রন্থ- ছায়াহরিণ (১৯৬২), সারা দুপুর (১৯৬৪), আশায় বসতি (১৯৭৪), উপন্যাস- রাণী খালের সাঁকো (১৯৬৫), আরণ্য নীলিমা (১৯৫২), শিশুসাহিত্য- বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, ছুটির দিন দুপুরে, রেলগাড়ি ঝমামমে উল্লেখযোগ্য। ১৯৮৫ সালের ১০ জুলাই আহসান হাবীব মৃত্যুবরণ করেন।