লেখা – আশিক মাহমুদ রিয়াদ
নদীমাতৃক বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা ও সৌন্দর্যের লীলাভূমি বরিশাল। বলা হয়ে থাকে বাংলার প্রাচ্যের ভেনিস নামে খ্যাত বরিশালের নদীনালা, খাল-বিলে যুগ যুগ ধরে সৃষ্টি হয়েছে মানুষের জলধিতরঙ্গের সাথে জীবিকার এক অপার্থিব মেলবন্ধন। আইতে শাল, যাইতে শাল এরই নাম বরিশাল অথবা ধান, নদী, খাল এই তিনে বরিশাল। একসময় বরিশালে বড় বড় শাল গাছ ছিলো বলে, বরিশালের এ নামকরণ করা হয়। আরও কথিত আছে, বড় দানার সল্ট অর্থাৎ লবনের এককালে বেশ উৎপাদন হতো এ অঞ্চলে। এ কারনে বড় দানার বড়ি এবং লবনকে সল্ট বলা হতো। কালের পরিক্রমায় নাম পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল নামকরণ করা হয়। বাংলার চন্দ্রদ্বীপ খ্যাত বরিশালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার্থিব কাব্যকথার সাথে মানুষের জীবিকার সম্পর্ক বহুকাল ধরে।
পেয়ারা বাগানে যেতে হলে বরিশালের চৌমাথা থেকে মাহিন্দ্রা কিংবা সিএনজিতে চেপে আটঘর কুড়িয়ানা কিংবা সরাসরি ভীমরুলি বাজারে যাওয়া উত্তম। ভীমরুলীতে জমে মূল পেয়ারা বাগানের আমদ তাই খরচ কম হলে ভীমরুলিতে গিয়ে একটি নৌকা ভাড়া করে আশেপাশে ঘুরতে পারেন। তবে প্রকৃত পেয়ারা বাগান এবং পেয়ারা বাগানের পার্কের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে আটঘর থেকে নৌকা কিংবা ট্রলার ভাড়া করে ভীমরুলীর উদ্দেশ্যে রওনা করতে পারেন। যেহেতু নিরবিলি নির্ঝঞ্ঝাটভাবে ঘুরতে যাচ্ছেন তাই গ্রামীণ পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে ডিঙি নৌকায় চেপে বসাই উত্তম। ভাড়া সর্বচ্চো হলে ৫০০ থেকে ৭০০ এর মধ্যে হতে পারে। তবে নৌকার মাঝিরা আপনার কাছ থেকে ভীষণ অপ্রত্যাশিত ভাড়া চেয়ে বসতে পারে..সেক্ষেত্রে তাদের সাথে দামাদামি করে নেওয়াটাই ভালো।
নৌকায় ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়বে অপার্থিব জলরাশির গ্রামীণ সবুজ পরিবেশ। এখানকার মানুষদের চলাচলের জন্য স্বাচ্ছন্দ্যের বাহন নৌকা। তাইতো ছোট ছোট খালে দেখা মিলবে ডিঙ্গি নৌকার। বর্ষা মৌসুমে যখন এখানকার খাল পানিতে টইটম্বুর হয় তখন যাতায়াতের জন্য নৌকা ব্যবহার করেন এ অঞ্চলের লোকজন। পর্যটকদের নৌকায় ভ্রমণের জন্য অনেকেই এ মৌসুমী নৌকা বেয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন৷
আটঘর কুরিয়ানা কিংবা ভীমরুলী পেয়ারার জন্য বিখ্যাত হলেও এখানে রয়েছে আমরা ও লেবু সহ দেশী সবজির চাষাবাদ৷ সত্যিই বাংলার উর্বর মাটি যেন খাটি সোনা। তাইতো যুগ যুগ ধরে এ দেশের মানুষের প্রধাণ পেশা কৃষি।
পেয়ারা বাগানের প্রচলিত ইতিহাস থেকে জানা যায়, দুইশ’ বছর আগে আন্দাকুল গ্রামের পূর্ণচন্দ্র মন্ডল নামের একজন ভারতের কাশীতে গিয়েছিলেন তীর্থে। সেখান থেকে ফেরার সময় পেয়ারার বীজ নিয়ে আসেন। সেই বীজ থেকে যেসব গাছ উৎপন্ন হয়েছে এবং ঐ গাছে উৎপাদিত পেয়ারা দিয়েই শুরু হয় পেয়ারা বাগানের যাত্রা। এরপরই আস্তে আস্তে শরু হয় পেয়ারা চাষ।
মূলত ভীমরুলী নামক জায়গাটিতে বসে পেয়ার কেনা বেঁচার হাট। চাষীরা এখানে পেয়ারা নিয়ে আসেন এবং খদ্দেররা চেষ্টা করেন সর্বপেক্ষা কম দামে পেয়ারা কেনার। চাষীরাও চান তারা যেন তাদের প্রাপ্য দামটুকু পান। ভীমরুলীতে ভাসমান পেয়ারার হাট জমে ওঠে বেলা বাড়ার সাথে সাথে। পাইকেরী ক্রেতারা এই পেয়ারা কিনে পাঠিয়ে দেন রাজধানী সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। শুধু পেয়ারার সিজনে পর্যটকের আনাগোনা থাকলেও বছরের বাকি মৌসুম বসে কাটাতে হয় এ এলাকার ব্যবসায়ী দের। তাই তো তাদের ব্যস্ততা থাকে এ মাস জুড়ে। আগষ্টের মাঝামাঝি সময়ে পেয়ারা বাগান ভ্রমণের সময়কাল শেষ হয়ে যায়। তারপর পেয়ারা বাগানে পর্যটকের সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকে।
পদ্মা সেতুর কল্যাণে দুই দিনের যাত্রা শেষ করা যাবে একদিনেই, যা কিছুদিন আগেও প্রতিকূল আবহাওয়া ও নদী পারাপারের বিপদশঙ্কা আর সময়সাপেক্ষতা এত দ্রুত ফেরি পারাপারকে করে তুলেছিল অচিন্তনীয়। এখন মাত্র ৬ থেকে ৮ ঘণ্টার বাস যাত্রায় যাওয়া যাবে পিরোজপুরে। অর্থাৎ, খুব ভোরে রওয়ানা দিলে দুপুরের মধ্যেই দেখা যাবে বাজারের জমজমাট পরিবেশ। সারাদিন বাজার ঘুরে আবার রাতেই ফিরে আসা যাবে চিরচেনা রাজধানীতে।
পেয়ারার সিজন শেষ হলে শুরু হয় আমরার সিজন!
পিরোজপুর এবং ঝালকাঠিকে বলা হয় আমড়ার জেলা। এখানকার সুস্বাদু আমড়া পৌছে যায় রাজধানী ঢাকা সহ দেশের আনাচে কানাচে। পুষ্টিগুনে পেয়ারার জুড়ি নেই! ভিটামিন সি সমৃদ্ধ পেয়ারাকে বলা হয় বাংলার আপেল।
ভীমরুলী ভাসমান পেয়ারা বাজার সম্পর্কে আমাদের ভিডিওটি দেখুন –
জুলাই মাস থেকে পিরোজপুর, বরিশাল ও ঝালকাঠি জেলার পেয়ারা চাষিরা শত শত ছোট-বড় নৌকা নিয়ে হাজির হয় ভাসমান বাজারে। বাগানের সেরা পেয়ারাগুলো দিয়ে ভর্তি থাকে প্রতিটি নৌকা। পেয়ারা বাজার ভ্রমণের শুরুটা করা যেতে পারে সেখানকার পাশের বাগানগুলো থেকে, যেখানে পর্যটকদের জন্য রাখা হয়েছে আপ্যায়ন ব্যবস্থা। ভিমরুলিতে পৌঁছানোর পর ভাসমান বাজারের দৃশ্যটিই সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ে। আঁকাবাঁকা নদী, পেয়ারা ভর্তি নৌকা, খালের দু’ধারের সবুজাভ পরিবেশ সবকিছু একত্রে স্বর্গীয় অনুভূতি দেয়। বছরের আর্দ্র সময়টাতেও চিত্রটি ব্যতিক্রম নয়।
কীর্তিপাশা খাল দিয়ে ভাসমান বাজারে প্রবেশের অনুভূতি সত্যিই অসাধারণ, ‘খাল থেকে ভাসমান বাজারের সুন্দর দৃশ্য, দুই পাশের সারি সারি গাছ এত মনোমুগ্ধকর রাস্তা সৃষ্টি করেছে যে মনে হবে আপনি আমাজন বনে আছেন! এই দৃশ্য অবলোকন করতে হলে একটি ছোট নৌকা করে যাওয়া যেতে পারে খালের ভেতরের দিকে। তাহলে ধীরপথে যেতে যেতে উপভোগ করা যাবে বাজারের ব্যস্তময় নির্মল পরিবেশ।
জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর মাস পেয়ারার মৌসুম। এই সময়েই পেয়ারার ঐতিহ্যবাহী এই ভাসমান বাজারে ঘুরতে যাওয়ার উপযুক্ত সময়। বিগত কয়েক বছরে স্বরূপকাঠির ভিমরুলি গ্রামে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়েই চলেছে। যারা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে থাকা অসাধারণ স্থানগুলো ঘুরে দেখতে চায় তাদের জন্য এই ভাসমান বাজার একটি আদর্শ জায়গা।
২০০ বছরের ঐতিহ্য ঝালকাঠি পেয়ারা রাজ্যের সাথে মানুষের জীবন সংগ্রামের এক বাস্তব চিত্র। আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে পেয়ারার ভরা মৌসুম থাকে। আপনি যদি কোনো অনিন্দ্য সুন্দর স্থানের দেখা পেতে চান তাহলে ঘুরে আসতে পারেন ভিমরুলি ভাসমান পেয়ারা বাজার! আপনার আমন্ত্রণ রইলো.