জাফরিন নূর
আফরিন! এই আফরিন। কোথায় তুই? কী করছিস?
-মা আমি এখানে।
-সারাক্ষণ কী করিস তুই?
-মা আমি আলতা দিচ্ছি।
-তুই আবার এগুলো করছিস! কতদিন বলতে হবে আমার, এইগুলো আর যদি দিতে দেখি তাহলে আমি আলতার বোতলটি ফেলে দিব।
-মা আমিও আফরিনকে বলেছি, কিন্তু আফরিন দিনের পর দিন কারোর কথা শোনে না।
পাশ থেকে তাসনিম কথাগুলো বলে।
আফরিন রেগে বলে, মা বুবুকে চুপ হতে বলো। আর আমি আলতা দিবো নাকি টিপ দিবো, তোকে বলতে হবে!
-মা দেখো আফরিন সবসময় আমার সাথে এ রকম করে! তাসনিম অভিযোগের সুরে কথাটা বলে।
নূরজাহান বেগম রেগে বলেন, এই থাম তোরা, আর জ্বালাস না আমায়।
-তুই যদি আর একবার এ রকম করিস, তাহলে তোকে রাতে পরী উড়িয়ে নিয়ে যাবে, তাসনিম ভেংচি কেটে বলে।
আফরিন বলল, কেন রে পরীর মনে হয় তোর মতো কোনো কাজ নেই যে, আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। এই বলে আফরিন হু-হু করে হাসতে লাগলো। আবারও আলতায় পা রাঙাতে মন দিলো ও। এদিকে তাসনিম আর নূরজাহান বেগম রেগে চলে গেলেন।
নূরজাহান বেগম তার দুই মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় থাকেন। স্বামী মুজাফফর রহমান থাকেন বিদেশে। পুরো তিনতলা বিশিষ্ট বাড়িতে নূরজাহান বেগম তার দু’মেয়েকে নিয়েই থাকেন। দুই মেয়ের প্রতিদিন ঝগড়া-মারামারি, হাসাহাসিতে বাড়িটি মেতে থাকে। তাসনিম স্বভাবে খুব শান্ত আর দেখতে সুন্দরী। অন্যদিকে আফরিন হলো রাগী ও অতিচঞ্চল প্রকৃতির। বোনের সাথে প্রায়ই ঝগড়া হয় আফরিনের। যদিও বোনকে ও খুব ভালোবাসে, কিন্তু আফরিন তা বুঝতে দেয় না।
আফরিন প্রায় রাতে ওর বড় বোনের সাথে গল্প করে ঘুমোয়। তবে আজ আর ঘুম আসছে না আফরিনের। আফরিন প্রায়ই ঘুম না এলে পুরো বাসায় হেঁটে বেড়ায়। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু হলো না। আফরিন গুনগুন স্বরে গান গাইতে গাইতে হাঁটতে লাগলো। অনেকটা সময় কেটে গেল।
হঠাৎ আফরিন দেখল বৈঠক ঘরে একটি অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে হাঁটছে। এই গভীর রাতে ঘরের ভেতর হঠাৎ অচেনা কাউকে দেখেও আফরিন ভয় পেলো না। ও সাহস নিয়ে মেয়েটির সামনে দাঁড়ালো। আফরিন দেখল মেয়েটির লম্বা চুল মাটি ছুঁয়েছে। যেমন মায়াময় মেয়েটির চোখ তেমনি গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট। আফরিনের মনে হচ্ছিল যে মেয়েটির দিকে তাকানো যাচ্ছে না, যেন সূর্যের আলোর মতো চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে।
আফরিন বলল, এই মেয়ে। তুমি কে? এখানে তুমি কী করে এসেছ?
মেয়েটি নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে।
-কথার জবাব দাও! কে তুমি?
-আমি মাওরি। সুন্দরী মেয়েটি বলল।
-বুঝেছি তুমি মাওরি। তবে তুমি এখানে করোটা কী?
-তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছো না?
-তুমি আমার বাসায় এসে আমাকেই ভয় পাওয়ার কথা বলছ?
-এসো আমার সাথে।
-কেন?
-আরে এসো না।
-না, আমি যাব না। আগে আমার কথার জবাব দাও।
আফরিন তখনও বুঝতে পারেনি যে ওদের অন্দরমহলের গেটে তালা দেওয়া। এখানে কারোরই আসা সম্ভব না। মাওরি কিছু না বলেই অন্দরের বারান্দায় পা ফেলল। আফরিন তখনও রাগী দৃষ্টিতে মাওরির দিকে তাকিয়ে আছে।
মাওরি বলল, এখন দেখো ম্যাজিক হবে…..!
-ম্যাজিক! হঠাৎ আফরিন তাকিয়ে দেখল মাওরি সেখানে নেই। আফরিন মাথা ঘুরিয়ে খুঁজতে লাগলো মাওরিকে।
হঠাৎ মাওরির কণ্ঠস্বর এলো বারান্দার বাহির থেকে। মাওরি ডাকছে, আফরিন…. ।
মাথা ঘুরিয়ে আফরিন দেখলো মাওরি শূন্যে ভেসে আছে।
-তুমি? তুমি শূন্যে কীভাবে বলো? অবাক হয়ে আফরিন বলল।
মাওরি রেগে বলল, এই মেয়ে দেখি ভয়ই পায় না।
-আরে বাদ দাও তো। তুমি বাহিরে কী করে….?
আফরিন বাকিটা বলার আগেই অজ্ঞান হয়ে নিচে পড়ে গেলো।
সকালে আফরিন নিজেকে ওর বিছানায় আবিষ্কার করলো। আফরিন আশপাশে কাউকে না দেখে, মা মা বলে চিৎকার দিতে লাগলো।
নূরজাহান বেগম দৌড়ে এসে বললেন, কী হয়েছে? গরুর মতো ম্যা ম্যা করছিস কেন?
মা কালকে আমি পরী দেখেছি মা। আমাদের বৈঠক ঘরে পরীটি হেঁটে বেড়াচ্ছিল মা। আফরিনকে ধমক দিয়ে নূরজাহান বেগম বলেন, অনেক মজা করেছিস, এই তো? আমার তোর সাথে মজা করার এতো সময় নেই।
এই বলে নূরজাহান বেগম হন হন করে চলে গেলেন।
আফরিন মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো। আফরিন একা একাই গুনগুন করতে লাগলো। হঠাৎ আফরিনের সামনে সেই মাওরি এলো।
আফরিন বলল, তুমি….! তুমি আবার এসেছো কেন?
আফরিনের এই অবস্থা দেখে মাওরির খুব হাসি পাচ্ছিল তবে, খুব কষ্টে হাসি চেপে রাখলো। মাওরি বলল, আমাকে ভয় পেয়ো না। আমি ভিন্ গ্রহের। আমি পৃথিবীর কথা শুনেছি তাই এইখানে এসেছি। আমি তোমাকে অনেক আগেই দেখেছি। আমি ভেবেছিলাম তুমি অনেক সাহসী। কিন্তু পরে তো……!
-না মানে তোমাকে শূন্যে ভাসতে দেখে আমি অবাক হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, আফরিন বলল।এই কথা শুনে মাওরি খিলখিল স্বরে হাসতে লাগলো। গতকালের মতো আফরিন আর ভয় পেলো না। মাওরির পৃথিবীতে ভ্রমণ ইচ্ছেটা জেনে ওর ভয়গুলো উড়ে গেলো।
-তুমি আমার বন্ধু হবে? মাওরি আফরিনকে বলল।
-হ্যাঁ তবে আমিও আকাশে উড়তে চাই..!
এই থেকেই মাওরি ও আফরিনের বন্ধুত্বের পথচলা। সারাদিন মাওরির সাথে ছোটাছুটি করে আফরিন। মাওরিকেও আফরিন নিজের মতো করে আলতা দিয়ে দেয়। চোখে দিয়ে দেয় কাজল। এতে মাওরিকে যেন আরো বেশি সুন্দর দেখায়। রাতে সবার ঘুমানোর পর আফরিন এবং মাওরি ছাদে যায়। মাওরির নরম হাতটি ধরে আফরিন আকাশে উড়ে বেড়ায়। তখন আকাশ যেন শুধু ওদের জন্যই সাজে। কাচের চুড়ির টুংটাং শব্দ আরো বেশি ভালো লাগে মাওরির। আফরিন অবাক হয়ে দেখে রাতের আকাশ।
এভাবে হাসি, খেলাধুলায় দিন যেতে লাগলো, মাওরি ও আফরিনের। মাওরি আফরিনকে পড়ালেখাতেও সাহায্য করে। কখনো অঙ্কের সূত্রগুলো ভুলে গেলে মনে করিয়ে দেয়। কখনো ছবিও এঁকে দেয়। কখনো ইংরেজি প্যারাগ্রাফটাও মুখস্থ বলে দেয়।
হঠাৎ একদিন যখন মাওরি এবং আফরিন আকাশে উড়ছিল তখন একজন নারী মাওরির সামনে এসে দাঁড়ালো। দেখতে ঠিক মাওরির মতোই লম্বা জামা গায়ে।
নারীটি বলল, মাওরি তোকে আমার সাথে যেতে হবে।
-না আমি এখন যাবো না, মাওরি বলল।
নারীটি বলল, রাজা আমাদের ওপর রেগে আছেন। এখনই যেতে হবে। না গেলে আমাদেরকে বের করে দিবে সেই দেশ থেকে। কথাগুলো আফরিন অবাক হয়ে শুনছে।
মাওরি আফরিনকে বলল, আমার যেতে হবে আফরিন। তুমি অনেক ভালো একটি মেয়ে। একদম কাঁদবে না। আমি চলি…।
আফরিনকে শেষ বারের মতো জড়িয়ে ধরে হাওয়ায় মিসে গেল মাওরি। সেই নারীটিও। শীতল বাতাস আফরিনের গায়ে লাগছে। পাথরের মতো আফরিন দাঁড়িয়ে রয়েছে। গাল বেয়ে চোখের অশ্রু মাটিতে পড়লো।
আফরিন নিজেকে নিজেই বলল, মাওরি আবার আসবে। মাওরি চাঁদের আলো হয়ে আমার কাছে ফিরে আসবে।
শিক্ষার্থী,
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ,
ঢাকা, বাংলাদেশ।