অনির্বাণ চক্রবর্তী
নিউমার্কেটের সামনে যে ছেলেটা স্যুট প্যান্টে দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি তানিম আহমেদ। পেশায় একজন প্রাইভেট ব্যাংকার। তবে এখানে তিনি শুধু শুধু দাঁড়ায় নি। সায়মা ইসলামের জন্য অপেক্ষা করছেন। সায়মা ইসলাম তার পারিবারিক ভাবে বাগদত্তা স্ত্রী। গত সপ্তাহে ওদের বাগদান সম্পন্ন হয়েছে। আগামী মাসের প্রথম শুক্রবার বিয়ে। আজ সায়মার কী যেন কিছু ব্যক্তিগত কথা বলার আছে বলেই তানিম এখানে উপস্থিতি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা স্কুটি নিয়ে উপস্থিত সায়মা। স্কুটি রেখে নেমে এসে বললো, চলুন আমরা ক্যাফেস্কাইতে বসি? তানিম মাথা নেড়ে সন্মতি দিল। ওরা ক্যাফেস্কাইর ভিতরে এক কর্ণারে বসলো। দুজনের খাবারের অর্ডার হলো। এরপর কিছুক্ষণ দুজনকে নিশ্চুপ দেখে সায়মা বললো, আপনি কি জানেন, এর আগে কাবিননামা সামনে রেখে আমার একটা বিয়ে ভেঙেছিল?
হ্যাঁ, ঘটকের মুখে শুনেছিলাম এমন কিছু।
গুড। পরিবারের বাইরেও আমার একটা ছোট ভাই আছে। সে খবর কি আপনি জানেন?
না জানি না। নাম কি তার?
সৌরভ সরখেল। আমি প্রথমে তাকে টিউশনি করাতাম। এখন সে আমার রক্তের সাথে মিশে গেছে। আমার পূর্বের বিয়েটা ওই ভাই এবং ওর পরিবারের জন্যই ভেঙেছে। আমি খুশি হয়েছি। কারন আমি ওকে ছাড়া এখনো চলতে পারি না। হয়তো একদিন আস্তে আস্তে ভুলে যাবো, কিন্তু তার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত ওই ছোট ভাইটাকে আপনার মেনে নিতে হবে। অন্যথায় আমি এই বিয়েতেও রাজি নই।
মুল ঘটনাটা খুলে বলা যাবে কি?
সায়মা একটু থেমে বললো, অবশ্যই। শুনুন তাহলে।
তখন আমি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। আব্বা সবেমাত্র রিটারমেন্টে গেছেন। সংসারে ছয় ভাই বোনের মধ্যে তিনজনের বিয়ে যদিও হয়েছে, বাকি তিনজন আমরা তখনও পড়াশুনা করি। বড় ভাই বেকার। তার পরের জন ভার্সিটিতে। আমি কলেজে। বাজারের উর্ধগতি। তখন আব্বার সংসার চালানো দুস্কর হয়ে পরে। আমি টিউশনি খুঁজতে থাকি। হঠাৎ আমাদের এখানের একটা স্থানীয় পত্রিকার বিজ্ঞাপন আমার চোখে পরে। বিজ্ঞাপন টা ছিল এমন “আবশ্যকঃ একজন কর্মমুখী শিক্ষক।” যোগাযোগের ঠিকানা রুপালী ব্যাংক, সদর জেলা শাখা। আমি একটু আগ্রহ দেখিয়ে একদিন রুপালী ব্যাংকে যোগাযোগ করি। আগ্রহটা ছিল এজন্য যে, বাংলা, ইংরেজি, গণিতের শিক্ষক চেয়ে আমি বহু বিজ্ঞাপন পড়েছি। কিন্তু কর্মমুখী শিক্ষকের আবশ্যক আমার জীবনে এই প্রথম দেখা। হয়তো লাস্টও হতে পারে। রুপালী ব্যাংকে ঢোকার পর বিজ্ঞাপনদাতা সেই ভদ্রলোকটাকে আমাকে সবাই দেখিয়ে দিলেন। তারপর কথা হয়।
আপনার নাম কি?
সায়মা ইসলাম।
কি করেন আপনি?
মার্কেটিং নিয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশুনা করি।
আপনি আমার ছেলেকে পড়াতে চাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
কত টাকা মাইনে নেবেন?
আপনি কতটাকা দিতে পারবেন?
আপনি কি অন্য কোথাও টিউশনি করেন?
না।
মুশকিল তো তাহলে। আচ্ছা আপনি একটা কাজ করুন, আগামীদিন শুক্রবার। আপনি দশটার দিকে আমার বাসায় চলে আসুন। এই নিন বাসার ঠিকানা। বলেই একটা ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দিলেন ভদ্রলোক।
আমি কার্ডটা পড়ে নিলাম। দিগন্ত সরখেল। সিনিয়র অফিসার ইন ক্যাশ। রুপালী ব্যাংক লিমিটেট। চারুলতা মঞ্জিল, হাউজ নং তেতাল্লিশ বাই দুই। পিটিআই মোড়। টেলিফোন নাম্বার ইত্যাদি ইত্যাদি। মুখে বললাম, আমি তাহলে উঠি!
তিনি বললেন, আজ সপ্তাহের শেষ দিন তো, আমার হাতে প্রচুর কাজ। আচ্ছা আসুন আপনি।
পরেরদিন সকাল দশটা বাজার কিছু পরেই দরজায় কলিং বেলে টিপ দেই। চল্লিশোর্ধ্ব ভদ্রলোক দিগন্ত শরখেল নিজেই আমাকে দরজা খুলে দিলেন। উনি আমার আপদমস্তক তাকালেন। হয়তো তার আমাকে সেদিন হ্যাংলা গড়নে দেখে ছেলের শিক্ষক হিসেবে পছন্দ হয় নি। তবে আমি ছোটবেলা থেকেই বাকপটু। আমি তার বাসায় ঢুকে বসে পরি একটা সিঙ্গেল সোফায়। উনিও বসলেন আমার বিপরিত পাশে। কিন্তু সরখেল কিছু বলছেন না। বারংবার মাথায় হাত রাখছেন। চুলগুলো টানছেন। লক্ষ্য করলাম খুব চিন্তিত লাগছিল ওনাকে। এক সময় তিনি বললেন,
টিউশন কেন করাবেন?
নিজের পড়াশুনা চালানোর জন্য।
ভাই বোন কতজন?
ছয়জন।
বাবা মা কি করেন?
বাবা একটা হাইস্কুলের মৌলভী ছিলেন। গতমাসে রিটারমেন্টে গেছেন। বর্তমানে শহরে বসবাস করে সংসার চালাতে তাঁর হিমসিম খেতে হচ্ছে। তাই ভাবছি টিউশনি করে নিজেরটা চালিয়ে নেবো। মা গৃহিনী।
মাসে আপনার পড়াশুনা খরচ কত?
সে ঠিক নাই। প্রাইভেট ও খাতা-কলমে এখন তিন হাজারের মতো লেগে যায়। বইকেনা কিংবা ভর্তি অথবা ফর্মফিলাপে তখন আবার অনেক বেড়ে যাবে।
আপনি বসুন। আমি দরজাটা লাগিয় দিয়ে আসি।
দিগন্ত সরখের দরজাটা বন্ধ করে এসে বললেন, আমার ছেলেটার বয়স বারো বছর। পড়াশুনা এখনো শুরু করে নি। ওর শারিরীক একটু দুর্বলতার কারনেই আমরা এখনো তার পড়াশুনা শুরু করতে পারি নি। আমার ছেলেটা একটু ব্যতিক্রমী। কিভাবে যে আপনাকে বোঝাবো! ব্যাতিক্রমী বলতে সে অন্য আর দশটা ছেলের মতো না। বাচ্চাটা এখনো কথা বলতে পারে না। মুখ থেকে প্রায়ই হালকা লালা ঝরে। শরীরের ডান দিকটা বাম দিকের থেকে অনেকটা দূর্বল। প্রায়ই হাত রাখে মুখের উপরে। মাঝে মাঝে উদাস হয়ে বসে থাকে। কখনো উচ্চৈস্বরে হাসে। একটু সামান্য অটিস্টিক বাচ্চাদের মতো বলতে পারেন। তবে প্রচুর শান্ত। আমাকে আর ওর মাকে ছাড়া অন্য কারও কাছে থাকলে সে দুষ্টুমী করে না। প্রচুর বাধ্যগত। দেশ বিদেশ করে বহু দেশে ওর চিকিৎসা করিয়েছি। সবাই বলছে একদিন সে স্বাভাবিক মানুষের মতো হবে। কথাও বলতে পারবে। তবে সময় লাগবে। এজন্য ওর প্রয়োজন শিক্ষা। আর সে শিক্ষা কর্মমুখী শিক্ষা। যত তারাতারি ওকে নিজের বিবেচনাটা বুঝিয়ে দেওয়া যাবে, ততই তাকে স্বাভাবিক হতে সাহায্য করবে। কর্মমুখী শিক্ষাটাই ওকে কথা বলাতে সাহায্য করবে। আপনি কি পারবেন আমার ছেলেটাকে কর্মমুখী শিক্ষায় একটু শিক্ষিত করতে? এর আগেও বহুজনকে বলছিলাম। কিন্তু তারা সবাই আমাকে গালি দিয়ে চলে গেছেন। আমি নাকি তাদের দিয়ে বাচ্চা পোষাবার চেষ্টা করছি। আরও কত কী অপবাদ। আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি ছেলেকে নিয়ে আসছি।
কিছুক্ষণ পর দিগন্ত শরখেল বাচ্চাকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করলেন। একদম সাদামাটা ছেলে। সে এসেই আমাকে বাম হাতে প্রণাম করলো। বসলো আমার পাশে। আমার হাত ধরলো। এমনকি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কীসব বলতে শুরু করলো। সেদিন আমি ওর কথার আদ্যপান্থ কিছুই বুঝতে পারি নি। সরখেল সাহেবের ছেলের নামই সৌরভ সরখেল। একদম প্রাণবন্ত একটা ছেলে। দুধে আলতা ফর্সা। মাথাটা ভর্তি কালো চুলে। চোখ দুটো টানা টানা। মুখে তার লেগে থাকতো মায়াবি হাসি।
সরখেল আমাকে আবারও বললেন, এখন বলুন আপনি কি পারবেন আমার ছেলেকে পড়াতে? ওকে আপনার প্রতিদিন দুই ঘন্টা সময় দিতে হবে। আপনার কাজ হচ্ছে, আপনি ওর সাথে গল্প করবেন, হাটবেন, খেলবেন। সাথে ওকে নিজেকে বুঝাতে চেষ্টা করবেন। আপনি ওর প্রতি উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারলে আমি আপনাকে চার হাজার টাকা টিউশন দিব।
বললাম, আমি পারবো ওর দায়িত্ব নিতে।
তাহলে আপনি আজ থেকেই শুরু করুন।
ঠিক আছে।
আমি টিউশনিটা নিয়ে নিলাম। কারন এই দুর্মূল্যের বাজারে চার হাজার টাকা কম নয়। তাছাড়া তখন মাসে আমার তিন হাজার টাকা খরচ হোত না। নিজের পড়ার জন্য দুইটা প্রাইভেটে লাগতো একহাজার টাকা। মাসিক কলম কাগজ পাঁচশ টাকা। তারপরও আড়াই হাজার টাকা। এর মধ্যে বাড়তি খরচ যা জুটলো তা শুধু আসা যাওয়ায় রিক্সাভাড়া ছয়শত টাকা। তা কিছু পেতে গেলে, কিছু তো দিতে হবে। নির্ঝঞ্জাল ফ্যামিলি। কথায় বলে বিনা টাকায় নাকি মথুরাও পার হওয়া যায় না।
আমি প্রতিদিন বেলা তিনটায় যেতে শুরু করি দিগন্ত সরখেলের বাড়ি। পাঁচটা শোয়া পাঁচটায় বেরিয়ে আসি। দিগন্ত সরখেলের বাড়িতে সার্বক্ষণিক ভাবে তার স্ত্রী আছেন। স্ত্রীর নাম চারুলতা বর্মণ। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। তিনি এর আগে একটা কলেজে অধ্যাপনা করতেন। কিন্তু ছেলের এই জটিল অবস্থায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। অত্যান্ত ভদ্র মহিলা। খুব কম কথা বলেন। দিগন্ত আর চারুলতার এই একটাই সন্তান। তাদের অন্ধের যষ্ঠির মতোই চোখের উপর খেলা করতো।
দিগন্ত সরখেল আর তার স্ত্রী আমার সাচ্ছন্দ পড়াশুনার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। এই দুই ঘন্টায় তার ছেলে যা কিছুই খাওয়া দাওয়া করে তার সব কিছুরই তার স্ত্রী দুই প্রকস্থ আয়োজন করতো। ছেলের খাবারের পরিমান যতটুকু, আমার জন্য খাবারের পরিমান ছিল তার থেকে দুইগুন। কোথাও কোথাও আরও বেশি। যেমন ধরুণ তার ছেলে একপিচ আপেল খেলে বাকিটা আমার জন্য নিয়ে আসতো ভিন্ন প্লেটে। একটা আনারের জুস ছেলেকে দিলে, আস্ত দুইটা নিয়ে আসতো আমার জন্য। আমার কর্তব্য ও নৈতিকতায় যেমন কোন ঘাটতি ছিল না, ঠিক তেমনি চারুলতা দেবীরও আমার প্রতি কোন কার্পণ্য করতেন না। তারা উভয়েই তাদের ছেলের সাথে আস্তে আস্তে আমার দায়িত্বটাও বাড়িয়ে নিলেন।
টিউশনের দুইমাস পর আমার সাথে তৃতীয় বার মুখোমুখি দেখা হয় সরখেল সাহেবের সাথে। তিনি আমাকে বললেন, আপনার আসা যাওয়ায় তো প্রচুর টাকা ব্যয় হয়। আপনি কি স্কুটি চালতে পারেন?
বললাম, না।
এই চাবি নিন। এটা চারুর স্কুটি। মাস ছয়েক আগে ওকে কিনে দিয়েছিলাম। আস্তে আস্তে চালানো শিখে এটাতেই আপনি আসা যাওয়া করতে পারবেন।
আমি চাবিটা নিলাম। আর এখন চালিয়ে আসা এই স্কুটিটাই সেই চারুলতা দেবীর।
প্রথম অবস্থায় সৌরভ ঠিকমতো হাটতে পারতো না। মাস চারেকের মধ্যেই সে সোজা হয়ে হাটতে শিখেছে। মুখ থেকেও আর তার লালা ঝড়ে না। হাতের ব্যায়াম করাতে করাতে সে তখন দুই হাতেই সমান ধরতে শিখেছে। সে আমার জন্য ওর বাবা মায়ের জন্য অপেক্ষা করতে শিখেছে। হঠাৎ একদিন আমি ওদের বাসায় যাই নি। পরের দিন গিয়ে শুনি সে রাতে সৌরভ একটুও ঘুমায় নি। সারারাত কান্না করছে আর জানালা খুলে আমার জন্য পথের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করেছে। সেদিন অফিসের কাজ ফেলে চারটার দিকে সরখেল সাহেব বাসায় আসেন। এসে আমাকে বললেন, কাল আসেন নি কেন? কোন সমস্যা ছিল?
বলছিলাম, আমার ফর্ম ফিলাপ ছিল। বাসায় আসতেই সন্ধ্যা নেমেছে।
কতটাকা লেগেছে আপনার ফর্মফিলাপে?
পাঁচ হাজার দুইশত।
সেদিন সরখেল সাহেব আর কোন কথা না বাড়িয়ে ভেতরের রুম থেকে এক হাজার টাকার ছয়টা নোট আমার সামনে রেখে বললেন, ফর্মফিলাপ, বই ও ভর্তিতে আপনার কত টাকা লাগে আমাকে জানাবেন। সেদিন থেকে শুরু করে আমার মাস্টার্স শেষ বর্ষ পর্যন্ত সব খরচ তিনিই বহন করেছেন।
এদিকে আমি আস্তে আস্তে সৌরভের মায়ায় আটকে যেতে থাকি। মনে হতে লাগলো সৌরভও আমার রক্তের একজন অংশিদার। আর আমিও মনে করছি ওদের আদর স্নেহ টাকা ভালোবাসায় ওদের সাথে মিশে যাচ্ছি। তখন আমারও ওদের পরিবারের জন্য কষ্ট হতো। সৌরভকে না দেখতে পেলে আমিও সুস্থ থাকতে পারতাম না। এবং আস্তে আস্তে আমি ওদের পরিবারের একজন হয়ে যাই। কখনো আমার কিংবা তাদের মনে হয় নি আমরা হিন্দু মুসলমান। আমরা দ্বি-জাতি।
আরেক দিনের একটা ঘটনা শুনুন। আমি চলে আসার সময় সৌরভ কান্না করছিল। সে আমাকে আসতে দেবে না। বায়না আমার হাতে ভাত খাবে। কিন্তু চারুলতা দেবীর শরীরটা ভালো ছিল না বলে তখনও সে রান্না করতে যেতে পারেন নি। আমি বললাম, ওকে আমি আমার বাসায় নিয়ে যাই, খাবার খাইয়ে আবার দিয়ে যাচ্ছি। আমার কথায় চারুলতা দেবী একবারে রাজি হয়ে গেলেন। মুখে বললেন, তুমি নিয়ে যেতে পারো। তবে তুমি তো জানো, ওর মুখে তুমি যা কিছু তুলে দিবে, তাই সৌরভ খাবে। কিন্তু এমন কোন খাবার তুমি ওকে তুলে দিও না, যে খাবারটা আমরা পরিবারে খাই না। এমনকি তোমরা যে জিনিসগুলি খাও না, তাও কিন্তু আমি কোনদিন তোমার সামনে উপস্থাপন করি নি। এমন যদি হয় এই তোমার দুর্ভাগা চারুলতার বিশ্বাস ভেঙে যাবে।
আমি সেদিন চারুলতা দেবীর কথায় কোন উত্তর দিতে পারি নি। কেন পারি নি সে নিজেও জানি না।
সৌরভকে পড়ানোর ছয় মাস পর আমার বেতন বেড়ে যায়। তখন আমার মাসিক বেতন ধরা হয় পাঁচ হাজার টাকা। চারুলতা দেবী আমার বই খাতা কলম সব কিনে দিতেন। ইদ, কোরবানিতে দ্বিগুন বেতন দিতেন। এমনকি দূর্গাপূজায় তাদের কেনাকাটার সাথে আমার জন্যও বাজারের নিত্য নতুন ড্রেস কিনতেন। আমি চারুলতা দেবীর পরিবারে প্রবেশ করে অর্থনৈতিক দিক থেকে সুখী হয়েছি। মানসিক দিক দিয়েও সুখী হয়েছি। আস্তে আস্তে আমার বেতনের সমূদয় টাকা আব্বার হাতে তুলে দিয়ে সংসারে সাচ্ছন্দ ফিরিয়ে এনেছি।
করোনাকালীন সময়ে আমার বেতন এক টাকাও তো কমে নি, বরংচ সরখেল সাহেব রুপালী ব্যাংকের সাহায্য তহবিল থেকে আমাকে সহায়তা করেছেন। এক বছর পর্যন্ত রুপালী ব্যাংক থেকে নগদ পাঁচ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। আমার সংসার সুন্দর ভাবে চলছে। আমার বড় ভাইয়ের স্টান্ডার্ড ব্যাংকে চাকরির পিছনে সরখেল সাহেবের সুপারিশ ছিল।
করোনার পরে আমার মাস্টার্স শেষ হয়। সিদ্ধান্ত নিলাম আমি চারুলতা মঞ্জিল থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকায় কোন জব কোচিংয়ে ভর্তি হবো। সৌরভকে মিস করবো। এই কথাগুলো ভেবে চলে আসার দিন সৌরভকে ঘরে বসে বোঝালাম, আমি চলে যাচ্ছি। তুমি তোমার মায়ের কথা শুনবে। দুষ্টুমী করবে না। সৌরভ তখনও কথা বলতে পারে না সত্য, কিন্তু সে সব বুঝতো। সৌরভ আমার কথা শুনে কান্না করতে আরম্ভ করলো। ওর কান্না দেখে আমার কন্ঠ ভারী হয়ে আসলো। চোখ পানিভেজা। চোখ মুছে ব্যাগ থেকে চকলেট বের করে সৌরভের হাতে দিলাম। চারুলতা দেবী ছেলের পিছনে দাড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু সৌরভ সেদিন আমার হাত থেকে চকলেট নেয় নি। কারন ও বুঝে গেছে চকলেট নিলেই সে আমাকে হারিয়ে ফেলবে। সৌরভ আরও জোরে কান্না শুরু করল। আমরা তো মায়েরই জাত। ওর কান্নায় আমিও তখন কাঁদছি। এতগুলো বছরের বিদায় বেলায় কান্নাটা স্বাভাবিক। আমার সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ওকে কান্না অবস্থায় রেখে আমিও কাঁদতে কাঁদতে বেড়িয়ে পরি ওদের বাসা থেকে। স্কুটিতে উঠি। সৌরভ দৌড়ে আসে আমার পিছনে পিছনে। আমি স্কুটিতে স্টার্ট দেই। কিন্তু সৌরভ স্কুটি রাখা জায়গাটায় এসে লুটিয়ে পরে মাটিতে। স্কুটির আয়নায় আমি ওর লুটিয়ে পড়া দেখে থেমে যাই। সৌরভ মাটি থেকে উঠে দাড়ায়, মুখে বলে দিদি…। আমি কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরি সৌরভকে। আর চারুলতা দেবী কান্না চোখে জড়িয়ে ধরে আমাকে। সেদিন থেকে দিদি হয়ে গেলাম আমি সৌরভের।
তানিম সাহেব চুপ করে আছেন কেন? বলুন, আপনি কি মেনে নিতে পারবেন এই সৌরভকে?
আর কাঁদে না সায়মা। সৌরভ কথা বলতে শিখেছে। এখন আমাদের আনন্দের দিন। চলো, আমরা সৌরভকে দেখে আসি।
শিকারপুর, পিরোজপুর