জোবায়ের রাজু
নাহ, পৃথিবীটা আসলেই গোলাকার, তা না হলে এই সুদূর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে এসে সাফায়েতের সাথে আজ এতটি বছর পর চৈতীর দেখা হবে কেন? চৈতীই আগে সাফায়েতকে দেখেছে। ডি এস এল আর ক্যামেরায় তীক্ষœ দৃষ্টি ফেলে সাফায়েত দূরের সাগর দেখছিল। পাশে এসে দাঁড়ায় চৈতী।
‘কেমন আছেন আপনি?-অচেনা কণ্ঠস্বরের এমন প্রশ্নে ক্যামেরা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে চৈতীর দিকে তাকায় সাফায়েত। প্রথমে চিনতে পারে না। মৃদু হেসে চৈতী বলে ‘আমি মেড়িপাড়ার চৈতী। চিনতে পেরেছেন?’ বর্ণনা শুনে সাফায়েতের কষ্ট হয় না চৈতীকে চিনতে।
বহু বছর আগের স্মৃতিতে ফিরে গেল সাফায়েত। অফিসের পোষ্টিং নিয়ে সেবার হবিগঞ্জ থেকে নোয়াখালী এসেছে সে। থাকবার জন্য চৈতীদের বাড়িতে ভাড়া উঠে। গ্রাম বাংলার এমন একটি বাড়ির পূর্ব পাশের দুই রুম বিশিষ্ট চৈতীদের খালি ঘরটা ভাড়া পাবে, ধারনা করতে পারেনি। বাড়ির পরিবেশ ভীষণ পছন্দ হল সাফায়েতের। অল্প দিনে চৈতীর সাথে সখ্যতা গাঢ় হল তার। দুজনের বয়সে আকাশ পাতাল ব্যবধান। চৈতী যখন ষোড়শী কন্যা, সাফায়েতের তখন সাতত্রিশ ছুঁই ছুঁই। বয়সের বিস্তর ব্যবধান হবার পরও চৈতী সাফায়েতকে বন্ধু ভাবতে ভালোবাসতো। অফিস থেকে বাড়ি ফিরলেই চৈতী হাজির সাফায়েতের ঘরে। সাফায়েতের ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে চরম কৌতুহল ছিল চৈতীর। দিন দিন সাফায়েত বুঝতে পারে চৈতী তাকে ইনিয়ে বিনিয়ে কিছু একটা বোঝাতে চাইছে। কিন্তু সেটাকে প্রশ্রয় দিতে রাজী ছিল না সাফায়েত।
এক সাত সকালে সাফায়েত যখন খবরের কাগজে চোখ রেখেছে, চৈতী তার পাশে এসে বসে। একটু অন্য রকম লাগছিল সেদিন চৈতীকে। কি ছিল সেই অন্য রকম, খানিকটা টের পেয়েছে সাফায়েত। কণ্ঠে এক রকম আকুলতা এনে সে সাফায়েতের হাত ধরে বলল ‘প্লীজ আমাকে বাঁচান। বাবা রাহুলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আমি রাজী নই।’ সাফায়েত বলল ‘রাজী নও কেন? তোমার কোন বয়ফ্রেন্ড আছে?’ চৈতী কাঁপা গলায় বলল ‘না নেই। আমি আপনাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করব না। আজ সন্ধ্যায় আমরা কি পালিয়ে যেতে পারি না?’ চৈতীর কথায় অবাক হল না সাফায়েত। কারণ সে আগেই জানত চৈতী তাকে একদিন না একদিন এমন প্রস্তাব দেবেই। কিন্তু সেটা ¯্রফে আবেগ ছাড়া আর কিছু নয়। ক্ষণিকের ভালোবাসা তো বটেই। বয়স যেখানে বড় বাঁধা, সেখানে ভালোবাসার কোন জায়গা নেই। অন্ধ আবেগে চৈতী সাফায়েতকে নিয়ে কল্পনায় ভাসছে। সাফায়েত তা বোঝে। সে যে শুধু চৈতীর আবেগকে দোষী ভাবে, তা কেবল নয়। নিজের সুন্দর চেহারাখানাও এখানে দায়ী। এই সুন্দর চেহারা না থাকলে চৈতী অযথা তার মত অসম পুরুষের জীবনে নিজেকে জড়াতে চাইতো না কখনো।
চৈতীকে সান্তনা দিয়ে সাফায়েত বলল ‘আবেগ কন্ট্রোল করো বোকা মেয়ে। এই বয়সে আবেগ বড় বিপদজনক। রাহুলের ঘরে যাও। সে তোমার যোগ্য। আমি নই। আমার স্ত্রী আর দুই ছেলে আছে। তা তো তুমি জানোই।’ নাছোড়বান্দা চৈতী অবুঝের মত অবাধ্য কণ্ঠে বলে ‘আমি এত কিছু মানতে চাই না। আমি আপনাকেই বিয়ে করব, ব্যস।’ সাফায়েত ঘর কাঁপিয়ে হাসলো এবং খেয়াল করলো চৈতীর চোখে পানি। না, চৈতীর এই চোখের পানিকেও প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। এই মেয়ে জীবনের কি বোঝে! হুট করে যাকে তাকে ভালো লাগতে পারে, কিন্তু বিয়ে করা যায় না। বিয়ে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জে কোন হেলা ফেলা নেই।
বিষন্ন গলায় চৈতী বলল ‘কেন আপনি আমার বিষয়টাকে আবেগ বলে অবহেলা করছেন! আপনাকে আমি কতখানি চাই, তা আমি কিভাবে বোঝাই!’ সাফায়েত হো হো করে হেসে বলল ‘সবই তোমার আবেগ মেয়ে। যাও বাস্তবতা মেনে নাও। রাহুলকে গ্রহণ করো। সে-ই তোমার প্রকৃত ভালোবাসা। তোমার যোগ্য। আমাকে ভালো লেগেছে ভালো কথা, আমার বয়সের দিকে তাকিয়েছো? সত্যিকারের চোখ মেলে একবার তাকাও, তখন নিজেকে চিনতে পারবে।’ সাফায়েতের কথা শুনে কেঁদে ফেলল চৈতী।
সেই চৈতী আজ এত বছর পর এই সাগর পাড়ে সাফায়েতের সামনে দাঁড়িয়ে। ‘তুমি এখানে কিভাবে? কার সাথে এসেছো? নিশ্চয় রাহুলের সাথে! রাহুল কই?’ সাফায়েতের কথা শুনে চৈতী চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। বার বার সাফায়েতকে দেখছে সে। এতদিনে বয়সও বেড়েছে অনেক। চুল আর দাঁড়ি গোফ পেকে সামান্য সাদা হয়েছে। কিন্তু আগের মত সেই অদ্ভুত নজর কাড়া রুপের ভান্ডার সাফায়েতের। এই বয়সেও টি শার্ট আর জিন্স পরেছে এবং এ পোশাকে তাকে যথেষ্ঠ সুপুরুষও দেখাচ্ছে।
-কি হল তোমার? কথা বলছো না যে? রাহুল কোথায়? ডাকো!
-আমাদের ডিভোর্স অনেক আগেই হয়েছে।
-বলো কি? কেন?
-সে অনেক কথা। আমি এখন মা বাবার সাথে থাকি। জীবনে আর কাউকে জড়াবো না। একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরী করি। অফিসিয়াল ট্যুরে এখানে তিন দিনের জন্য এসেছি। আজই ফিরে যাবো।
-রাহুলের সাথে সম্পর্কটা টিকল না কেন?
-দুজনের ভাবনা দু রকম বলে। আমাদের বনিবনা হতো না। আচ্ছা এই যে আমাদের বনিবনা না হওয়া, এটাও কী আবেগ?
সাফায়েতের মুখের হাসি চলে গেল। কোন যুক্তিই দাঁড় করাতে পারছে না। তাহলে কি সেদিন সত্যি সত্যি চৈতী তার কাছে ভালোবাসার পশরা নিয়ে এসেছে? সেখানে নিশ্চয় আবেগ ছিল না। ছিল এক তরুণী মেয়ের আশা ভরসা। কিন্তু সেটাও ছিল অসম্ভব। সংসারি সাফায়েত কোনভাবেই চৈতীকে গ্রহণ করতে পারত না।
-কি ভাবছেন? আপনার সংসার কেমন কাটছে?
-সব মিলিয়ে ভালোই। এখানে সাত দিনের জন্য বেড়াতে এসেছি। দু ছেলে কানাডায় পড়ছে। ওদের মা এখন টেলিভিশনের সংবাদ পাঠিকা। গুলশানে থাকি আমরা। সংসারে আমি চিরকালই সুখি।
চৈতী প্রাণহীন হাসি ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মনে মনে বলল ‘আমিও যে আপনার সে সুখের অংশীদার হয়ে সুখি হতে চেয়েছি।’ সাফায়েত তার ডি এস এল আর ক্যামেরা অন করে চৈতীকে বলল ‘একটু পোজ দাও। তোমার কিছু ছবি তুলি। আমার স্ত্রীকে তোমার ছবি দেখাব। তার সাথে প্রায়ই তোমার গল্প করি।’
চৈতী হাসি মুখে সাফায়েতের ক্যামেরায় পোজ দেয়। একটু পর সে কলিকদের সাথে গন্তেব্যে ফিরে যাবে। কলিগেরা ধীরে ধীরে একত্রিত হচ্ছে। সাফায়েত বেশ কয়েকটা ছবি তুলল চৈতীর। দামী ক্যামেরার ছবিতে চৈতীকে কি অসাধারণই না লাগছে।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।