ড.গৌতম সরকার
জ্যৈষ্ঠ মাসে যাত্রানুষ্ঠান মিটে যাবার পর এক অনন্ত অপেক্ষা শুরু হতো দূর্গাপূজোর জন্যে৷ ইতিমধ্যে গরমের ছুটি শেষ হয়ে ষান্মাসিক পরীক্ষা শুরু হয়ে যেত, ফলে ঘরে-বাইরে একটু চাপ থাকত৷ কিন্তু পরীক্ষা একবার মিটে গেলে আমরা আবার সবাই মুক্ত বিহঙ্গ৷ কার সাধ্য তখন আমাদেরকে কোনো বাঁধা গন্ডির বন্ধনে বেঁধে রাখে !
তবে প্রতিবছর পূজোর দু -তিনমাস আগে থেকে পূজো হবে কি হবেনা এই এক আতঙ্কের মধ্যে আমাদের ছোটবেলাকার অনেকটা সময় কেটে যেত৷ ওই সময় দিনকাল ছিল খুব কঠিন, আমাদের বৃহত্তর পরিবারে বাবা-কাকা-জ্যেঠাদের দেখতাম বহু কষ্টে দিন গুজরান করতে, নিজের পরিবারের মুখে এক হাঁসি ফোটাতে তাঁরা অমানুষিক পরিশ্রম করতেন৷ তাই ঠাকুরের নামে জমি -পুকুর থাকা সত্ত্বেও সেগুলো সেভাবে দেখাশোনা করা হতনা, ফলে প্রতিবছরই একটা টেনশন তৈরি হত অত বড় একটা পূজো পরিচালনার সাধ্য আর সঙ্গতি নিয়ে৷ এটা আমাদের বাড়ির পূজো, আর আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন এই অঞ্চলের জমিদার৷ আমাদের বাড়িতে আলাদা করে দূর্গাদালান, বাসন্তীমন্ডপ আছে৷ মূল জমিদারের দুজন স্ত্রী ছিলেন৷ জমিদারমশাই বড় গিন্নির জন্য দূর্গাদালান বানিয়ে দিয়েছিলেন জানতে পেরে ছোট গিন্নি বায়না ধরলেন তাঁকে বাসন্তীমন্ডপ বানিয়ে দিতে হবে৷ সেসব প্রায় আট-দশ পুরুষ আগের কথা৷ আমরা ছিলাম বড় তরফের, ছোট তরফের শরিক আমাদের তুলনায় সংখ্যায় অনেক কম ছিল৷ তারমধ্যেও মেয়ে সন্তানের প্রাধান্য থাকায় ছোটবেলায় ও বাড়িতে এক জ্যেঠু, জ্যেঠিমা এবং তাদের বিকৃতমস্তিষ্ক ছেলেকে থাকতে দেখেছি৷ সেই দাদাকে আমরা বাণীদাদা নামে জানতাম৷ পরবর্তীতে ঐ দাদার বিয়েও হয়, তবে তাদের দাম্পত্য জীবন স্বাভাবিক কারণেই স্হায়ী হয়নি৷ মাঝে মাঝে সেই দাদা জন্মগ্রহনের পোশাকে রাস্তায় বেরিয়ে যেত, তখন বড়দের বলতে শুনতাম “বাণীর মাথা গরম হয়ে গেছে৷”
বাসন্তী পূজো অনেকদিন হল বন্ধ হয়ে গেছে, তবে জমিদার বাড়ির দূর্গাপূজোর জন্য শুধু আমরাই নয়, আশেপাশের পাঁচটা গ্রামের লোকও উদগ্রীব অপেক্ষা করত৷ আমাদের বাড়িতে দেবীর পূজা অত্যন্ত নিষ্ঠার সহকারে হয়, তাই নমঃ নমঃ করে পূজো সেরে দেবার কোনো প্রশ্নই ওঠেনা৷ তাই বড়রা স্বাভাবিক কারণেই উদ্বিগ্ন থাকতো৷ আর আমরা ছোটোরা, যাদের জীবনে আনন্দের উৎসগুলো এতটাই হাতে গোনা ছিল, যে বাতাসে পূজো না হওয়ার সম্ভাবনার খবর এলেই ছোটো ছোটো বুকে ধক ধক করে ধাক্কা লাগত৷ ভাবতাম একটা গোটা দূর্গাপূজো এইটুকু আনন্দখনি থেকে হারিয়ে গেলে আর পড়ে থাকলো কি !
পুজো নিয়ে এই দোদুল্যমানতা বেশ কিছুদিন ধরে চলত ; আমরা বুঝতে পারতামনা কি করবো৷ বিশ্বাস করে আনন্দ স্রোতে গা ভাসাবো না অবিশ্বাস করে হতাশের দলে নাম লেখাবো৷ প্রচন্ড দ্বন্দ্ব আর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনগুলো কাটত; অবশেষে প্রতিবছরই মায়ের অসীম কৃপা আর আশীর্বাদে ‘মাটি-ওঠা’ অনুষ্ঠান হত৷ আমাদের বাড়ির নিত্য পুরোহিত একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে একতাল মাটি তুলে এনে পূজো করতেন, পরবর্তীতে সেই মাটি মূর্তি নির্মাণে ব্যবহার করা হত৷ ছেলেবুড়ো নির্বিশেষে আমরা এই দিনটির অপেক্ষায় থাকতাম কারণ এই দিনটি আমাদের মতো আপামর বাঙালীর জীবনের সবচেয়ে বড় উৎসবের পূণ্য সূচনা ঘটাত৷
তখন আগমনী গানের জন্য আমাদের মহালয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতনা; আগমনী গানের প্রথম কলিটা গেয়ে উঠতাম যেদিন শুনতাম মিস্ত্রীরা প্রতিমা গড়তে এসেছে৷ খবরটা পেয়ে যে যেখানে থাকতাম চোখ-কান বুজে প্রাণপণে দৌড়তাম ঠাকুরদালানের দিকে, গিয়ে দেখতাম আমাদের প্রিয় কুমোরকাকু তার দলবল নিয়ে ইতিমধ্যেই কাজে লেগে পড়েছে৷ কেউ খড় কাটছে, কেউ মাটি চালছে, কেউ দড়ি কাটছে, আবার কেউ কেউ কাদা মাখছে৷ প্রথমবার ঠাকুর এক মেটে হবে; অর্থাৎ পুরনো কাঠামোর ওপর নতুন করে খড়ের বুনোট পড়বে, সেই খড় দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হবে, তারপর তার ওপর এক প্রস্থ মাটির প্রলেপ, তাই এই পর্বের নাম একমেটে৷ যতক্ষণ ঠাকুর তৈরি হত ততদিন আমাদের ঘরবাড়ি সব এই ঠাকুরদালান, পারলে খাবারটাও বাড়ির লোককে অর্ডার করি এখানে দিয়ে যেতে৷ বকেঝকে কোনরকমে ইস্কুলটা পাঠাতে পারত৷ বাদবাকি সময়টা আমরা ওই দালানেই বডি ফেলে দিতাম৷
একমেটে করে মিস্ত্রীরা চলে যেত, তারপর শুরু হত আমাদের কাজ, ঠাকুরকে খটখটে করে শুকোতে হবে৷ আমাদের ঠাকুর হয় একচালার, খুব ভারী৷ তখন আবার হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি খুব সমস্যা সৃষ্টি করত৷ আমরা ছোটরা প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করতে না পারলেও সবসময় ঠাকুরের গায়ে গায়ে লেগে থাকতাম৷ এরপর দিন পনের-কুড়ি পর মূর্তি ঠিকঠাক শুকিয়ে গেলে মিস্ত্রীকাকু আবার তার দলবল নিয়ে আসত৷ তখন ঠাকুর দুমেটে হত, দুমেটে মানে মূর্তির ওপর দ্বিতীয় বার মাটি চাপানো হত৷ এবার মূর্তি স্বয়ংসম্পূর্ণ হত, মূর্তিগুলো তাদের তাদের মুণ্ডু পেত, হাত-পায়ের আঙুল তৈরী হত৷ নতুন মাটি দিয়ে মূর্তিগুলোর হাত, পা, দেহ আরও সুডৌল করা হত৷ আর শেষে দেখতাম পাতলা কাপড় কাদা জলে ডুবিয়ে মিস্ত্রিকাকু মূর্তিগুলোর শরীরে তাপ্পির মতো লাগিয়ে দিত, যাতে করে শুকানোর সময় মূর্তি ফেটে না যায়৷
বছরের এই সময়টা ছিল বড় মনোরম, তখন ওই সময় থেকেই একটু একটু হিম পড়তে শুরু করত, মাঠে মাঠে সাদা কাশফুলের হিল্লোল জানান দিত পূজো আসছে, ভোরের শিশির ভেজা শিউলি ফুলের গন্ধ বুকে নিয়ে পূজোর শাঁখ ঘণ্টার আওয়াজ শুনতে পেতাম৷ স্কুলেও ওই সময় কেমন যেন পড়াশোনা, নিয়ম শৃঙ্খলায় একটা হালকা ছাড় থাকত, ছাত্র শিক্ষক সকলেই যেন শারদ নেশায় আবিষ্ট হয়ে পড়ত৷ দেওয়ালে অনেক আগে থেকেই দাগ টেনে রাখতাম, একটা করে দিন যেত আর একটা করে দাগ মুছতাম৷ এইভাবে আস্তে আস্তে সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটা পায়ে পায়ে এগিয়ে আসত৷ ইতিমধ্যে একদিন মিস্ত্রীকাকু এসে মুর্তিগুলোর ওপর রং চাপাতো, চক্ষু দান করত, আস্তে আস্তে মহামায়া তাঁর সন্তানসন্ততি নিয়ে আমাদের চোখের সামনে মূর্ত হয়ে উঠত৷ আমাদের বাঁধভাঙা আনন্দের দিনগুলো চোখের পলক ফেলতে কেটে যেত৷ ওই বয়সেই বুঝতে পারতাম সুখের সময় বড়ই তাড়াতাড়ি অতিবাহিত হয়৷ এমনি করেই এক ভোররাতে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত গলা দেবীকে আবাহন করতো৷ আমাদের স্কুলে ঠিক তখনই ছুটি পড়ত, আর আমরা ষোলআনার ওপরে আঠারো আনা আনন্দনাড়ুর স্বাদ কুড়িয়ে বেড়াতাম৷ শৈশবের সেই শর্তহীন, স্বার্থহীন আনন্দের স্বাদ বড় হয়ে আর কখনও পাইনি৷
আমাদের ঠাকুরের ডাকের সাজ, পঞ্চমীর দিন বোধনের সাথে সাথে পরেশদা (আমাদের মালী ) আসত ঠাকুর সাজাতে৷ ষষ্ঠীর সকালে আমাদের সকলের প্রিয় ঠাকুরমশাই এসে পৌঁছতেন আর সঙ্গে সঙ্গে দুর্গাদালান ঘিরে আমাদের পারিবারিক পূজোর প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হয়ে উঠতো৷ সপ্তমীর ভোরে ঢাকের আওয়াজে ঘুম ভাঙত; এত সুন্দর সকাল আমার জীবনে আর কখনো আসেনি৷ ঢাকের আওয়াজের সাথে, কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ শৈশবে আনন্দের অসংখ্য হট্টমেলার দরজা জানালা নিমেষে খুলে দিত৷
আমাদের বাড়ির এক অলিখিত নিয়ম ছিল পূজোয় বাড়ির বিবাহিত মেয়েরা বাপের বাড়ি আসবে, আর বাড়ির কোনো বউ বাপের বাড়ি যেতে পারবে না৷ ব্যাপারটার মধ্যে একটা সামন্ততান্ত্রিক গন্ধ থাকলেও ছোটবেলা থেকে বড়বেলা অবধি দেখেছি সবপক্ষই এটা হাঁসিমুখেই মেনে নিত৷ আসলে আমাদের বাড়ির পূজোয় এমন একটা প্রাণ ছিল, সম্মেলন ছিল, বনেদিয়ানা আর নিষ্ঠার সংযত মাত্রাবিন্যাস ঘরে-বাইরের সমস্ত মানুষকেই আন্তরিক আমন্ত্রণ জানাতো৷ সপ্তমীর সন্ধ্যের নিয়নের আলোয় পরিচিতি-অপরিচিতির ঘেরাটোপ পেরিয়ে অষ্টমীর সকালে সবাই শুভ্র শাড়ি-ধুতি-পাজামা-পাঞ্জাবী শোভিত হয়ে পুষ্পাঞ্জলী দিত৷ তখন যতদূর মনে পড়ে সন্ধিপূজো হত মধ্যরাতে৷ ঘুমভাঙা চোখ নিয়ে পূজো, আরতি আর শেষরাতে মায়ের বলি আড়াইশো বছরের সাবেক জমিদারিয়ানায় একটা অলীক আবহ সৃষ্টি করত৷
নবমীর সকালে না হলেও বিকেল থেকেই মনখারাপের মেদুর মেঘ মনের আকাশ ভারি করে তুলত৷ ওইদিন রাতে ঠাকুরমশাই দেড়-দুঘন্টা ধরে মায়ের আরতি করতেন; তখন ওঁর বয়স ষাট ছুঁয়েছে, আমাদের নারায়ণ পূজার নিত্যপূজারী ওনার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট হওয়া সত্ত্বেও আগেই রণে ভঙ্গ দিয়ে অনেক আগেই বসে পড়তেন৷নবমী নিশি উদযাপনে দেবীর ফেরার প্রস্তুতি শুরু হত৷ যেকোনো পূজোর দধিকর্মা যতই সুস্বাদু হোক, আমি কোনোদিন শান্তি করে খেতে পারিনি কারণ চিঁড়ে-দুধ-দই-কলায় বিসর্জনের মনখারাপের গন্ধ লেগে থাকত৷ রাত্রে মা-কাকিমা-দিদি-বৌদির বরণ সাঙ্গ হলে আমাদের একচালার প্রতিমাকে কাঁধে করে প্রায় হাফ কিলোমিটার দূরের পুকুরে মূর্তি বিসর্জন দিতে যেতাম৷ বিসর্জন শেষে একরাশ মনখারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরে দেখতাম ধূসর আঁকিবুকি ঘরের সম্মিলিত দেওয়ালে তিনশো পঁয়ষট্টিটি আঁচড় কাটার কোনও জায়গা নেই৷