অণুগল্পগল্পজীবনের গল্পপ্রথম পাতাসম্পাদকের লেখাসর্বশেষ

গল্প – ব্যবধান / আশিক মাহমুদ রিয়াদ  

আশিক মাহমুদ রিয়াদ

কালবেলা চাদর গায়ে দিয়ে বারান্দায় চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন আতাহার সাহেব। জানলা থেকে  একফালি রোদ এসে পড়েছে তার কোলে। এখন শীতকাল। দুয়েকদিন বেশ ঠান্ডা পড়ছে ।সকাল হলে ঘন কুয়াশার কারনে কিছু দেখা যায় না।উত্তরদিক থেকে ঠান্ডা বাতাস আসতে শুরু করেছে। তার মধ্যে আবার গুড়িগুড়ি বৃষ্টিও পড়ে৷ এখন পৌষ মাস। শীত বেশি থাকাটাই স্বাভাবিক। আতাহার সাহেব চোখ থেকে চশমা খুললেন। হালকা তন্দ্রার মতো এসেছে। শীতকালে এই এক সমস্যা৷ একটু পর পর কেমন তন্দ্রা লাগে। গা ঝিম ঝিম করে। অবশ্যি বয়স হয়েছে তো তাই হয়ত এমন লাগাটাই স্বাভাবিক। আতাহার সাহেব তন্দ্রাচ্ছন হওয়ার আগেই তার সামনে তার ছেলে রাজু এসে  দাঁড়ালো।

কেমন কাচুমাচু হয়ে বলল,’বাবা! ‘ 

আতাহার সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন,’কিছু বলবি?’ রাজু বলল,’চলার মতো হাত খরচ নেই আমার কাছে৷ ‘ আতাহার সাহেব মৃদূ হাসলেন। পাঞ্জাবীর পকেটে হাত দিলেন। একশো টাকার একটি নোট বের করে রাজুর সামনে ধরে বললেন,’বড় হয়েছিস টাকা চাইতে লজ্জা কিসের? অবশ্যি লজ্জা হওয়া দরকার।তোর মতো বয়সে আমরা বাবার কাছে টাকা চাওয়ার সাহস পেতাম না। বাবা আমাদের যা দিতেন তাই দিয়ে চলতাম। বুঝেছিস?’ রাজু আস্তে করে বলল,’জ্বী বাবা।’ আতাহার সাহেব আবারো মৃদূ হাসলেন, ‘মন খারাপ হয়েছে নাকি? আমি কিন্তু কঠিন কোন কথা বলিনি। আমার বাবা কঠিন কথা বলতেন না। দরকার হলে গালে দুই চারটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিতেন। ‘ একবার হয়েছে কি শোন,’বড় ভাইয়ের বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে যাব। তখন তাড়াহুড়োয় পাঞ্জাবি উল্টো পড়ে বাবার সামনে গেলাম। বাবা আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার তাকিয়ে সোফা থেকে উঠে ধড়াম করে চড় বসিয়ে দিলেন। ‘ রাজু মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে, ‘বাবার এত কথা তার পছন্দ হওয়ার কথা না। তবুও কেন যেন পছন্দ হচ্ছে। ‘ আতাহার সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন,’তোরা হচ্ছিস এই জেনারেশনের। তোদের সাথে আমাদের জেনারেশন মিলবে না এটাই স্বাভাবিক। ‘

২.

আতাহার সাহেব একটি ব্যাংকে চাকরী করেন। তার চাকরী প্রায় শেষ পর্যায়ে৷ দীর্ঘ দিন মানুষের টাকা নিয়ে হিসেব নিকেশ করেছেন। কত টাকা যে নিজের হাত থেকে গুনেছেন তার হিসেব নেই। ছুটির দিনে তার অবসর কাটে পত্রিকা পড়ে। মাঝেমধ্যে সাহিত্য পড়েন। লেখালিখির ঝোক ছিলো একসময়৷ ব্যংকে চাকরি হওয়ার পড়ে লেখালিখিটা আর করেননি। আতাহার সাহেবের ছেলেমেয়ে বলতে শুধু একটি ছেলে। তার নাম রাজু। রাজু এবার ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। মাঝেমধ্যে ছেলেটাকে নিয়ে তার দারুন গর্ব হয়। ছোটবেলা থেকেই সে লেখাপড়ায় দারুন ভালো। অফিস থেকে ফিরে যখন শোনেন তার ছেলে কোন প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হয়েছেন তখন তিনি খুব খুশি হন। খুশি হওয়ারই কথা৷ বাবা মায়ের কাছে সব থেকে বড় খুশি হচ্ছে তার ছেলে-মেয়ের সাফল্য। আতাহার সাহেব রাজুকে বেশ ভালোবাসেন। মাঝেমধ্যে রাজুর জন্য গিফট কিনে নিয়ে আসেন। ছোটবেলা থেকে রাজুর এমন কোন ইচ্ছে নেই যেটা তিনি পূরন করেন নি। 

 

৩.

এক বছর পরের ঘটনা,আতাহার সাহেব রিটায়ার করেছেন মাস খানেক হলো। তার শরীরের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না দেখেই তিনি চাকরী শেষ হওয়ার চার মাস আগেই রিটায়ার্ড করেন। বেশ কিছুদিন হয়েছে তিনি বাসা থেকে বের হন না। শরীরটাও ছেড়ে দিয়েছে। আতাহার সাহেবের স্ত্রী হোসনে আরা বেগম আতাহার সাহেবকে বার বার চিকিৎসার কথা বলছেন। তবে আতাহার সাহেব সেটি নিয়ে চিন্তিত নই। এইতো একটু অসুস্থ হয়েছেন মাত্র। এতেই যদি ডাক্তারের কাছে যান তাহলে কিভাবে হয়? আর তাছাড়ার আজকালকার ডাক্তাররাও হয়েছে ঢের!  খালি কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালতে হয় তাদের৷ একদিন সন্ধ্যায় আতাহার সাহেব বেশ অসুস্থ হয়ে গেলেন। হোসনে-আরা বেগম তার ছেলে রাজুকে  বললেন ডাক্তার নিয়ে আসতে৷ রাজু তাড়াতাড়ি ডাক্তার নিয়ে হাজির হলো। ডাক্তার চেকাপ করে বললেন,’ভয়ের কিছু নেই প্রেসারটা বেড়েছে শুধু মাত্র। ‘ ইদানীং আতাহার সাহেবের শ্বাসকষ্টের সমস্যা শুরু হয়েছে। 

জীবন খুব অল্প সময়। আবার কারো কারো কাছে জীবনটা অনেক বেশি সময়। কারো কারো কাছে জীবন মানে আনন্দ উল্লাস, কারো কাছে সংগ্রাম কারো কাছে জীবন মানে একটুকরো সুখ। কেউ কেউ চিন্তা করে এত লম্বা সময়ের জীবন কিভাবে পার করবো? আবার কেউ কেউ ভাবে জীবন তো খুবই অল্প। হোক না জীবন রঙিন,বর্নিল কিংবা সাদাকালো? জীবনতো একটাই। আতাহার সাহেব বারান্দায় বসে আনমনে চিন্তা করছিলেন এসব কথা। রাজুকে ডাকলেন হাতের ইশারায়।

 

একদিন বিকেলবেলায় আতাহার সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আতাহার সাহেবের এমন অবস্থা দেখে তার স্ত্রী হোসনে আরা বেগম ছুটে গেলেন রাজুর রুমের দিকে।উদ্বিগ্ন গলায় রাজুকে ডাকলেন,’ও রাজু! দরজা খোল। তোর বাবা কেমন যেন করছে। ‘ রাজু তখন অঘোরে ঘুমাচ্ছিলো। ঘুম ভাঙলো তার মায়ের ডাকে। দরজা খুলে বাবার এমন অবস্থা দেখে রাজু ছুটে গেল ডাক্তার আনতে। ডাক্তার এলো। ডাক্তর সাহেব হৃদস্পন্দন মাপার পরে বললেন, ‘ইনহেলার কোথায়?’ হোসনে-আরা বেগম ইনহোলার বের করে দিলেন৷ ডাক্তার বলল,’এটা তো খালি৷ আপনারা দেখছি কিচ্ছু খেয়াল রাখেন না৷। ‘ রাজু ছুঁটে বেরিয়ে গিয়েছিলো ইনহোলার আনতে। ইনহোলার এনে রাজু তার বাবাকে আর জীবিত অবস্থায় পায় না৷ ‘ রাজু কাঁদে। তার বাবা নেই৷ সামান্য সময়ের ব্যবধানে রাজু তার বাবাকে হারায়। সময় বড্ড নিষ্ঠুর৷ 

 

চারবছর পরের ঘটনা,রাজু ঢাকায় থাকে। ঢাকায় একটি অফিসে এক্সিকিউটিভ ম্যানেজার হিসেবে চাকরী করে। রাজু বসে আছে রেলস্টেশনে৷ আর একটু পরেই তার ট্রেন।সে গাইবান্ধায় যাবে। হঠাৎ একটি ছেলে এসে তার সামনে দাঁড়ালো। ছেলেটির জামাকাপড় ছেঁড়া। শীতে থরথর করে কাঁপছে। এসে করুণ গলায় বলল,’ভাইজান! আমার বাপে খুব অসুস্থ। হাতে একটা ইনহেলার দেখিয়ে বলল,’ডাক্তার এইডা কিনতে কইছে৷ রাজু কিছু বলল না৷ ভাবলো কোথার কোন ছেলে। তাৎক্ষনিকভাবে রাজুর মনে পড়লো তার বাবার কথা।রাজুর করুনা হলো ছেলেটার প্রতি। একদিন এই ইনহোলার আনতে গিয়ে ফিরে এসে তার বাবাকে হারিয়েছিলো,সে স্মৃতি ভেসে উঠলো চোখের সামনে। রাজু পকেটে হাত দিলো। পাঁচশো টাকার একটি নোট বের করে দিলো।

ট্রেন ছেড়েছে। আস্তে আস্তে করে ট্রেনের গতি বাড়ছে। হঠাৎ রাজুর চোখ যায় পরিত্যাক্ত একটি ট্রেনের নিচে। সেখানে বসে পলিথিন ফু্ঁকছে একটি ছেলে। রাজু ছেলেটিকে চিনতে পারলো। সে আর কেউ না, সেই ছেলেটি যে একটু আগে রাজুর কাছ থেকে টাকা নিয়েছে।রাজু আনমনে ভাবে,’এ শহরের মানুষ চেনা খুব কঠিন। ‘

 

 হঠাৎ রাজুর সামনে হাতপাতে একজন জীর্ণশীর্ণ  মহিলা। রাজু তাকে বলে, “মাফ করবেন”।মহিলা চলে যায় অন্য কামরায় । 

পরের স্টেশনে রাজু দেখতে পায় সেই মহিলাকে৷ কোলে একটি বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে রেলস্টেশনে।বাচ্চাটি কাঁদছে।মহিলাটি হাত পাতছে মানুষের সামনে। রাজুর বড্ড খারাপ লাগে। সামান্য সময়ের ব্যবধানে সে দুটো মানুষকে চিনতে পারলো না। সময় বড্ড নিষ্ঠুর।সময়ের ব্যবধানে মানুষ চেনা কঠিন৷ 

 

এই লেখাটি শেয়ার করুন
ছাইলিপির ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

ছাইলিপির কথা

লেখালিখি ও সৃজনশীল সাহিত্য রচনার চেষ্টা খুবই সহজাত এবং আবেগের দুর্নিবার আকর্ষণ নিজের গভীরে কাজ করে। পাশাপাশি সম্পাদনা ও প্রকাশনার জন্য বিশেষ তাগিদে অনুভব করি। সেই প্রেরণায় ছাইলিপির সম্পাদনার কাজে মনোনিবেশ এবং ছাইলিপির পথচলা। ছাইলিপিতে লিখেছেন, লিখছেন অনেকেই। তাদের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। এই ওয়েবসাইটের প্রতিটি লেখা মূল্যবান। সেই মূল্যবান লেখাকে সংরক্ষণ করতে লেখকদের কাছে আমরা দায়বদ্ধ। কোন লেখার মধ্যে বানান বিভ্রাট থাকলে সেটির জন্য আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি। ছাইলিপি সম্পর্কিত যে কোন ধরনের মতামত, সমালোচনা জানাতে পারেন আমাদেরকে । ছাইলিপির সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ। ছাইলিপির নতুন সংযোজন ছাইলিপির ইউটিউব চ্যানেল Chailipi Magazine। সাবস্ক্রাইব করার আহ্বান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করা থেকে বিরত থাকুন ! বিশেষ প্রয়োজনে ইমেইল করুন [email protected]