গৌতম সরকার
খুন দুটো শেষ পর্যন্ত হয়েই গেল, যদিও ‘প্ল্যান-এ’তে কোনও খুনের কথা ছিলনা। কিন্তু ড্রাইভার ফড়েটা এমন তিড়িংবিড়িং শুরু করল, তার ওপর তিনতলার ছাদের দিকে ছুটে গেল, খুন করা ছাড়া ওইসময় আর কিছু করার ছিলনা। ড্রাইভারের পর স্বাভাবিকভাবেই মালিককেও আর বাঁচিয়ে রাখা যায়না। কিন্তু এত কিছু করেও সাকুল্যে পকেট থেকে বেরিয়েছে মাত্র পাঁচহাজার টাকা। শুড্ডাটা কিছু একটা আন্দাজ করেছিল, শালা হাতের আংটি, ঘড়ি, গলার চেন সব খুলে এসেছিল। তারা দলে ছিল চারজন। মা-ছেলে আর দুজন সাগরেদ। মিনতি বালিগঞ্জ স্টেশনে অপেক্ষা করছিল, মেয়েমানুষ অকুস্থলে যায়নি। কাজ শেষ করে সন্তোষ, বাবু আর রহিমকে স্টেশনে পাঠিয়ে নিজে পঞ্চাননতলার হাউসিং ক্যাম্পাসে সিকিউরিটির কাজে চলে গিয়েছিল। কিন্তু মুশকিল বাঁধল দুদিন পর। নিজের রক্তের দাগলাগা জামাকাপড় সন্তোষ বাবুদের হাত দিয়ে মিনতিকে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেই জামাকাপড় তাদের সোনারপুরের বাড়িতে কাচতে গিয়ে বাড়িওয়ালার চোখে পড়ে গেল। তারপর একান-ওকান হতে হতে খুনের চারদিনের মাথায় মিনতি আর বাবু ধরা পড়ল। তখন আর কোনো চান্স না নিয়ে রহিমকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে সন্তোষ। রাত বারোটায় হাওড়া স্টেশন থেকে একটা দূর পাল্লাগামী ট্রেনে উঠে বসেছিল। দুদিন পর তারা চণ্ডীগড়ে পৌছায়। সেখান থেকে বাসে করে চাম্বা।
পৃথিবী যে এত সুন্দর হতে পারে কোনও ধারণাই ছিলনা সন্তোষের। তার সাতাশ বছরের জীবনে এত দূরে আসা এই প্রথম। এ জায়গাটার নামও আগে কখনও শোনেনি। রহিম চট করে জায়গাটার কথা মাথা থেকে বের করে, তার জামাইবাবুর ভাই এখানে একটা হোটেলে কাজ করে। জায়গাটি সবুজ পাহাড়ে ঘেরা, তারা যে ঘরটিতে আছে তার একদম গা দিয়ে চলেছে ছলাৎ ছলাৎ একটা পাহাড়ি নদী। জল বেশি নেই, কিন্তু উদ্দাম স্রোত। কাল বিকেলে দেখেছে সেই দামাল স্রোত কিরকম বড় বড় পাথরের টুকরোগুলোকে গড়গড়িয়ে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে।
এখনও পর্যন্ত দুজনে একজায়গায় আছে। তবে খুব শীঘ্রই আলাদা হয়ে যেতে হবে। নইলে লোকের সন্দেহ হবে। এখানে মানুষজন খুব একটা খবরের কাগজ পড়েনা, তাই রক্ষে। কিন্তু ওরা ঠিক করেছে দিন দুই চুপচাপ ঘরের মধ্যে বসে থাকবে। তারপর রহিম ওর আত্মীয়ের খোঁজ চালাবে। আসলে মূল সমস্যা হল টাকা। তড়িঘড়ি পালিয়ে আসতে হয়েছে, পাঁচহাজারের মধ্যে সন্তোষের ভাগের দু-হাজারের মধ্যে বেঁচে ছিল একহাজার, আর তিনটে মোবাইল বিক্রি করে পেয়েছে সাত হাজার। এই তাদের পুঁজি, রহিম তো পকেটে দুশো টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।
প্রথমদিকে দিনগুলো নিরূপদ্রবে কাটছিল। রহিম ওর জামাইবাবুর ভাইকেই খুঁজে পেলোনা, তার চেষ্টায় দুজনের কাজও জুটে গেল। সন্তোষ পেল একটা হোটেলে নাইটগার্ডের কাজ আর রহিম অন্য এক হোটেলের কিচেনের যোগাড়ে। ওরা প্রথমেই যেটা করল, ওদের প্রথম বাসা ছেড়ে আলাদা আলাদা বাসা নিল। সন্তোষের হোটেলেই থাকার ব্যবস্থা হল, আর রহিম হোটেলের অন্য কর্মীদের সাথে কাছাকাছি একটা বস্তিতে থাকতে শুরু করলো। তবে সুখ বেশিদিন সইলো না। একদিন বেশ রাত্রে সন্তোষের দরজায় বাইরে থেকে কেউ একজন ধাক্কা দিল। সন্তর্পনে দরজা খুলে দেখল অন্ধকারে রহিম দাঁড়িয়ে। কোনো কথা না বলে সন্তোষকে ঠেলে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর জানালো, তার জামাইবাবুর ভাই কিছু সন্দেহ করেছে। সন্ধ্যাবেলা তার হোটেলে এসে শাসিয়ে গেছে, “তোমরা নিশ্চয়ই কিছু একটা লাফড়া করে এখানে এসে জুটেছ। তোমরা এখান থেকে চলে না গেলে আমি নিজে পুলিশে খবর দেব।” ওদের হোটেলে কোনো বাঙালি বোর্ডারের কাছ থেকে ও এই খবর পেয়েছে। পেপারে পুলিশ আমাদের দুজনকে খুঁজছে এটাও নাকি ফলাও করে বেরিয়েছে। এরপর আর অপেক্ষা চলেনা। সুতরাং সেই রাত্রিই চাম্বায় তাদের শেষ রাত্রি হল।
“তুমহারা নাম কেয়া হ্যায়, ভাইয়া?” সন্তোষ চমকে পিছনে তাকায়। কালই এখানে এসেছে। আজ ভোররাতে ঘুম ভেঙে গেল, বিছানায় শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করলোনা। আশপাশ একটু দেখতে ইচ্ছে হল। এখানেও পাশ দিয়ে একটা নদী বয়ে গেছে। পাহাড়ি নদীগুলো কিন্তু একদম সমতলের মত নয়। সমতলের নদী অনেক চওড়া হয়, আর বর্ষাকাল ছাড়া অন্যসময় বেশ শান্তশিষ্ট থাকে। পাহাড়ি নদীর বুঝি গ্রীষ্ম-বর্ষা কিছু নেই! সবসময়ই তড়বড়িয়ে কোথায় যেন ছুটে চলেছে। কি ভীষণ প্রাণবন্ত! চারদিকের বাদামি পাহাড়, সবুজ গাছপালা আর নীল জলের নদী দেখে ভীষণ বাঁচতে ইচ্ছে করছে সঞ্জয়ের। চাম্বায় ঝামেলা হওয়ার পর সারাদিনের বাস জার্নি করে কাল রাতে এখানে পৌঁছেছে। একটা একদম সস্তা হোটেলে উঠেছে। কিন্তু দুদিনের মধ্যে একটা কাজের জোগাড় করতে না পারলে হোটেল ছাড়তে হবে। পয়সাকড়ি তলানিতে এসে ঠেকেছে। তাছাড়া দুজনেই হোটেলের বকেয়া পাওনা না নিয়েই চলে এসেছে। পনেরদিন কাজ করে ছেড়ে চলে যেতে চাইলে সন্দেহের পারা বেড়েই যেত। যদিও না বলে চলে আসায় এতক্ষন নিশ্চয়ই শোরগোল শুরু হয়ে গেছে। ‘তুম কাঁহা সে আ রাহে হো?’ সন্তোষ সম্বিতে ফেরে। একটা দশ-এগারো বছরের বাচ্ছা মেয়ে ডাগর সুন্দর দুটো চোখ তুলে তাকে প্রশ্ন করছে। গায়ে সোয়েটার, মাথায় স্কার্ফ, উলোঝুলো কোঁকড়ানো চুলগুলো স্কার্ফের বাধা না মেনে কপালে, দু গালের ওপর ঝুলঝুল করছে। সন্তোষ আমতা আমতা করে উত্তর দেয়, “বহোত দূর…তুমহে বাংলা কে বারে মে মালুম হ্যায়? ওয়েস্ট বেঙ্গল?” মেয়েটি ঘাড় নাড়ে, মিষ্টি গলায় বলে, “মুঝে পাতা হ্যায়! মেরি পাপা কি পোস্টিং দূর্গাপুর মে হ্যায়! উও উধার পুলিশ মে কাম করতা হ্যায়!” সন্তোষ প্রমাদ গোনে, এ তো ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যে হয়।” সন্তোষকে চুপ থাকতে দেখে মেয়েটি বলে ওঠে, ” আপনে আভিতক আপনা নাম নেহি বাতায়া। মেরি নাম শাবানা।” ইতিমধ্যে সন্তোষকে অনেকগুলো নাম নিতে হয়েছে, কিন্তু এই সকালে এই নির্মল পাহাড়-প্রকৃতির আবহে নিষ্কলুষ অবোধ শিশুমুখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যে কথা বলতে পারলোনা। নিজের নাম বলে সন্তোষ শিশুটির দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তুম ইঁহা পে রহতে হো?” মেয়েটি ঘাড় নাড়ে। সন্তোষ জিজ্ঞাসা করে, “আপকা পিতাজি আভি দূর্গাপুর মে হ্যায়?” মেয়েটি ঘাড় নাড়ে। মুখটা একটু থমথমে হয়ে ওঠে। ঠিক যেন সর্বদিক রাঙিয়ে দিতে দিতেও প্রভাতী সূর্য একখন্ড মেঘের আড়ালে মুখ লুকোলো। সন্তোষ সুধায়, “ইধার তুম আপনি মামিকে সাথ রহতা হো! এবার শুধু মেঘে আটকালো না, বৃষ্টি আসার সম্ভাবনাও তৈরি হল। তারপর বাচ্ছার মুখে শুনলো তার যখন ছয় বছর বয়স, তখন ওর মা কোন এক অসুখে ভুগে মারা গেছে। এখন ও দাদির সাথে এখানে থাকে। বাবা বছরে দু থেকে তিনবার আসে। মেয়েটির নরম চোখে এমন কোনো জাদু ছিল, কখন সে সন্তোষের হাত ধরে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলল আর দুঘন্টার মধ্যে সন্তোষ তল্পিতল্পা গুটিয়ে রহিমকে অন্যকোথাও ব্যবস্থা করতে বলে শাবানা-র বাড়িতে চলে এল, সবকিছু যেন একটা ঘোরের মধ্যে ঘটে গেল। বুড়িমানুষটাকে অনেক মিথ্যে কথা বলতে হল। তারপর বুড়ি তাকে যেটা অফার দিল, সেটা এককথায় লটারির টিকিট পাওয়া। তিনবেলা খাওয়া ও থাকা বাবদ মাত্র আড়াইশো টাকা প্রতিদিন দিতে হবে। রহিমকে পাঁচশো দিয়েও এখনও হাজার দুয়েক পকেটে আছে, যাই হোক একসপ্তার জন্যে নিশ্চিন্তি। শুধু একটা ব্যাপারে মনটা খুঁত খুঁত করছে, সেটা হল শেষমেশ পুলিশের বাড়িতেই ঠেক ফেলতে হল।
“ঘরে ঢুকে গুড়ুম, গুড়ুম করে দুজনকে মেরে ফেলল”। সন্তোষ ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠল। মেয়েটির নীল চোখের মণিতে বালিগঞ্জের বাড়িটা ভেসে উঠল। ড্রাইভারটা এককোপেই সাবাড় হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মালিকটা অনেকক্ষন যুঝেছিল। সন্তোষ একটা মোক্ষম কোপ দিয়ে ভেবেছিল ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে। কিন্তু কি জান মাইরি! তারপরেও মালটাকে সালটাতে বাবু কোপের পর কোপ দিয়ে গিয়েছিল।
“তারপর একদিন যখন চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেছে, ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছের সব পাখিগুলো বাসায় ফিরে এসেছে, সেইসময় সেই দুষ্টু লোকটা একটা বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তারপর রাস্তায় তার সঙ্গে যোগ দিল আরও দুজন দুষ্টু লোক। তিনজনে মিলে একটা বড় বাড়ির দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল।”
সন্তোষ জিজ্ঞাসা করলো, “দরজা ধাক্কাচ্ছে কেন, তাদের কলিং বেল নেই?”
“না নেই! জঙ্গলের মধ্যে বাড়ি তো, তাই কলিং বেল নেই। কলিং বেল তো শহরের বাড়িতে থাকে। দুর্গাপুরে পাপা যেখানে থাকে, সেখানে সব বাড়িতে কলিং বেল আছে। বাবাদের অফিসেও আছে”৷
“তো সেই বদমাশ গুলো তারপর কি করলো?”
“ঘরে ঢুকে গুড়ুম, গুড়ুম করে দুজনকে মেরে ফেলল”। সন্তোষ ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠল। মেয়েটির নীল চোখের মণিতে বালিগঞ্জের বাড়িটা ভেসে উঠল। ড্রাইভারটা এককোপেই সাবাড় হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মালিকটা অনেকক্ষন যুঝেছিল। সন্তোষ একটা মোক্ষম কোপ দিয়ে ভেবেছিল ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে। কিন্তু কি জান মাইরি! তারপরেও মালটাকে সালটাতে বাবু কোপের পর কোপ দিয়ে গিয়েছিল।
বাচ্ছাটা একদৃষ্টিতে সন্তোষের মুখের দিকে চেয়ে আছে। এবাড়িতে আসা ইস্তক বাচ্ছাটা তার গায়ে গায়ে লেগে আছে। কেবল রাত্রে দাদির কাছে শোয়া ছাড়া সবসময় সন্তোষের ঘরেই থাকে। সন্তোষ কে চা করে এনে দেয়, খাবার সময় ডেকে নিয়ে যায়। সন্ধ্যেবেলা তার ঘরে এসে পড়াশোনাও করে। দুর্ভাগ্যবশত তখন মাস্টারিও করতে হয়। তবে সন্তোষ হায়ার সেকেন্ডারি পাস, আর হিন্দি ছিল তার ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ, মাস্টারি করতে তার বেশ ভালোই লাগছে। বাচ্ছাটা হটাৎ প্রশ্ন করে বসে, “আচ্ছা তুমি দুষ্টু লোক নও তো?”
গ্রামটির নাম চৌরি খাস। ছোট্ট একটা হিমাচলি গ্রাম। ট্যুরিস্টরা এখানে আসেনা। পাঠানকোট ছাড়িয়ে ট্যুরিস্টরা ডালহৌসির দিকে চলে যায়। ফলে হোটেল প্রায় নেই বললেই চলে। রহিম ডালহৌসি চলে গেছে, ভালোই করেছে। ওখানে কিছু একটা জুটিয়ে নেবে। এই কদিনে সন্তোষ বুঝে গেছে এখানে কোনো কাজকর্ম পাওয়া সম্ভব নয়। সেটা সে বুড়িমা-কেও বলেছে। বুড়ি মা কিছু বলেনি। সন্তোষ বুঝতে পারে বুড়ির অর্থের চেয়ে একজন শক্তসমর্থ পুরুষমানুষের বেশি দরকার। আসলে নাতনিকে নিয়ে বুড়ি খুব অসহায়। ছেলে মাসে মাসে টাকা পাঠায়। বাড়ির আশেপাশে বেশ কিছু জায়গাজমি আছে। সেখানে মরশুমি ফল সব্জি ফলে। বুড়ি এইবয়সেও সব নিজের হাতে করে। শাবানা সাহায্য করে। শাবানা যখন স্কুলে যেত তখন খুব বেশ কিছু করতে পারতো না, কিন্তু কোভিড শুরু হওয়ায় তাদের স্কুল অনেকদিন হল বন্ধ হয়ে গেছে। এখন সে দাদিকে অনেকটা সাহায্য করতে পারে। দুটোদিন সন্তোষ সবকিছু দেখে নিল, তারপর তৃতীয় দিন সকালে একটা কোদাল নিয়ে জমিতে নেমে পড়ল। বুড়ি কিছু বলল না, যেন এটাই স্বাভাবিক, সবথেকে বেশি মজা পেল শাবানা। ও তো ভাইয়াকে চোখছাড়া করতে চায়না, এখন দাদাকে সব্জিক্ষেতে মেয়ের আনন্দ আর ধরেনা। সারাটা সময় তার কথার ফুলঝুড়িতে সময় কখন কেটে যায় খেয়ালই থাকে না। সাতদিনের মাথায় বুড়ি সন্তোষের কাছ থেকে টাকা নেওয়া বন্ধ করল, দুসপ্তার মধ্যে সে বাড়ির ছেলে হয়ে উঠল।
মাঝে মাঝে সন্তোষ নদীর পাড়ে গিয়ে বসে। নিজের জীবনের জন্য আফসোস হয়। পড়াশোনায় সে খারাপ ছিলোনা। কিন্তু মা আর পড়াশোনা চালাতে দেয়নি। পাড়ার একটা অন্য লোকের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় বাবার সঙ্গে সবসময় অশান্তি বেধেই থাকতো। বাবা মানুষটা খারাপ ছিলোনা, পয়সাকড়িও ছিল, কিন্তু ওর পনেরবছর বয়সে মা ওকে নিয়ে ঘর ছেড়ে আলাদা বাসা ভাড়া নেয়। তারপর থেকেই দালালি, টুকটাক তোলাবাজি করে চালাচ্ছিল। মাযেরও এই ধরনের সব লোকেদের সাথেই মেলামেশা ছিল। কিন্তু খুনখারাপি করার কথা সে কখনও ভাবে নি। বালিগঞ্জের এই লোকটার সাথে তাদের অনেকদিনের যোগাযোগ। কড়েয়া রোডে ওনার একটা দোতলা বাড়ি বিক্রি করার এড কাগজে চোখে পড়ায় দালালি করার লোভ সামলাতে পারেনি সন্তোষ। তার নিজের অত পয়সা নেই, তবু প্রথমবার ক্রেতা সেজেই দেখা করেছিল। কিন্তু লোকটা সমানে লেজে খেলাচ্ছিল, দাম যা হাঁকছিল ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তবুও জোঁকের মত লেগে পড়েছিল। যেদিন ঘটনাটা ঘটে সেদিন বাড়ির অরিজিনাল কাগজপত্র দেখানোর কথা ছিল। সন্তোষের মনে মনে রাগ জমছিল। কড়েয়ার বাড়িটা তালাবন্ধ থাকে। কোনো পার্টিকে দেখাতে হলে মালটা একটা দামি গাড়িতে ড্রাইভার নিয়ে একা আসে। সন্তোষ দেখেছিল লোকটার সারা গায়ে অলংকারে মোড়া। হাতে না না করে দুটো হিরের আংটি, আরও কয়েকটা দামি পাথর, গলায় হার, দামি ঘড়ি, দুটো আই ফোন। তাই ঠিক করে রেখেছিল, কথাবার্তা পাকা না হলে একটু চমকে দিয়ে মালগুলো হাতিয়ে দরজা আটকে কেটে পড়বে। বালিগঞ্জ স্টেশনে মা অপেক্ষা করছিল, জিনিসগুলো মায়ের হাতে দিয়ে ভালোমানুষ হয়ে পঞ্চানন তলায় নিজের কাজের জায়গায় ফিরে যাবে। কিন্তু কি ভেবেছিল…আর কি হয়ে গেল! এভাবে কতদিন কাটবে! পালিয়ে পালিয়ে…. ওদিকে মায়ের জেলের মধ্যে দিনগুলো কিভাবে কাটছে! ওরা কি মা-কে মারধর করছে? বিচারে কি মায়ের ফাঁসি হবে? কিন্তু তা তো হওয়ার নয়…মা তো খুনের ব্যাপারে কিছুই জানত না…ফাঁসি হলে তো ওর হওয়ার কথা। বুকটা চিনচিন করে উঠল। মায়ের জন্য কষ্টে চোখে জল চলে এল। ঠিক সেইসময় দুটি কচি হাত তার চোখ চেপে ধরেই চিৎকার করে উঠল…
“একি ভাইয়া! তুমি কাঁদছো কেন?”
সেই শুনে পাহাড়ি নদী খলখল করতে করতে মুখ বাঁকিয়ে উৎরাইয়ের দিকে ছুটতে ছুটতে চলে গেল।
এই অঞ্চলে সর্ষে খুব ভালো ফলে, তার সাথে বাঁধাকপি আর মুলো। একদিকে একচিলতে জমিতে সন্তোষ পালং শাকের বীজ বুনেছিল। তার লকলকে পাতাগুলো এখন বাতাসে শন শন পাতা দোলাচ্ছে। সারা জমি জুড়ে হলুদ সরষে ফুল এই পাহাড়ি অঞ্চলের রঙের সার্সি আরও রঙিন করে তুলেছে। বাঁধাকপি, মুলো, বিনস সবই বেশ পুরুষ্ট হয়ে উঠেছে। সন্তোষ ছোটবেলায় টুকটাক ফুলের গাছ বসিয়েছে, তাতে যখন ফুল ফুটেছে তখন খুব আনন্দ পেয়েছে। কিন্তু মাঠভরা ফসল ফলানোর যে আনন্দ, এতদিনকার ব্যর্থ এবং নষ্ট হয়ে যাওয়া জীবনের মরুতে একটুকরো মরুদ্যান বলে মনে হচ্ছে। এরমধ্যে সন্তোষ পুরোপুরি বাড়ির একজন হয়ে পড়েছে। বুড়িমার সত্যিই বয়েস হয়েছে, এতদিন শরীরটা কোনোমতে টেনে টেনে কাজকর্ম করে গেছে। ওইটুকু বাচ্ছা নিয়ে বাড়ির কাজ, জমির কাজ একা হাতে আর টানতে পারছিল না। সন্তোষকে যেন আল্লাই পাঠিয়ে দিয়েছে। এরমধ্যে ফোনে ছেলেকেও সন্তোষের কথা বলেছে। ছেলে শুনে খুশি। সে-ও বিদেশ বিভুঁইয়ে থেকে চাকরি করে। মাথার মধ্যে সর্বদা মায়ের আর মেয়ের চিন্তা থাকে। তাই একটা নির্ভরযোগ্য কর্মঠ লোক পাওয়ার কথা শুনে সে খুশিই হয়েছে। তবে পুলিশে চাকরি করে মনটা সবকিছু যাচাই করে নিতে চায়। তাছাড়া বিদেশি মানুষ, ভিতরে কোনো মতলব আছে কিনা তাইবা কে জানে। মনে মনে ঠিক করে কিছুদিনের ছুটি ম্যানেজ করে একবার দেশে গিয়ে নিজের চোখে সব দেখে আসবে। কিন্তু করোনা যেরকম একটার পর একটা খেল দেখাতে শুরু করেছে, ছুটি পাওয়া খুব দুষ্কর।
সিরাজ তার মাকে বলছে, ‘তুমি বুঝছো না, এই লোকটা একজন ফেরারি। কলকাতায় দু-দুটো খুন করে পালিয়ে এসেছে। বহুদিন ওর ছবি ওখানকার খবরের কাগজে বেরিয়েছে। ওকে আমি দেখেই চিনেছি”। বুড়িমা তার শ্লেষ্মা জড়ানো গলায় কি যেন বলার চেষ্টা করল। ছেলে বলল, “মা আমি আইনের রক্ষক, আমি কোনো বেআইনি কাজ করতে পারবো না। জেনেশুনে একজন খুনিকে বাড়িতে পুষতে পারবো না।
এই অঞ্চলে খুব বড় একটা মেলা বসে, ‘সুহি মাতা মেলা’। আজ শাবানাকে নিয়ে সন্তোষ মেলায় এসেছে। এই মেলার পিছনের ইতিহাস কাল রাত্রে বুড়িমায়ের মুখে শুনছিল। এই অঞ্চলের একদা রাজা সাহিল ভর্মনের মহারানীর আত্ম বলিদানের কাহিনী। একসময় এখানকার মানুষেরা খুব জলকষ্টে ভুগত। একদিন রাতে রানী স্বপ্নে আদেশ পেলেন, এলাকার জলকষ্ট দূর করতে হলে রানী বা রানীর একমাত্র পুত্রকে আত্মাহুতি দিতে হবে। সেই আদেশ শুনে দ্বিরুক্তি না করে রানী নিজের জীবন উৎসর্গ করে নিজ সন্তান এবং এলাকার সমস্ত মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে তোলেন। রানীর স্মৃতিতে এখানে একটা মন্দির বানানো হয়েছে, আর সেই মন্দির ঘিরে এপ্রিল মাসে এক পূর্ণিমায় এই মেলা বসে। খুব বড় মেলা হয়। দূর দূর পাহাড় থেকে মানুষেরা কেনা-বেচা করতে আসে। জায়গাটা তাদের বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে হওয়ায় বুড়িমা শাবানাকে নিয়ে আসতে পারেনা। বেশ কয়েকবছর আগে সিরাজ একবার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। এইবার ভাইয়ার হাত ধরে মেলায় আসতে পেরে খুব খুশি শাবানা। ভাইয়া তাকে কত কি কিনে দিচ্ছে- কাঁচের চুড়ি, রঙিন ফিতে, চিরুনি, একটা কি সুন্দর আয়না। এছাড়া বুড়িমার জন্যেও বাড়ির কাজের টুকটাক জিনিস কেনা হতে লাগল। একগাদা খাবার-দাবার খেয়ে হাতভর্তি জিনিস নিয়ে তারা বাড়ি ফিরল।
বাড়ি ফিরে শাবানার জন্যে দিনের মধুরতম বিস্ময়টি অপেক্ষা করছিল। কোনো খবর ছিলোনা আসার। সিরাজ মেয়েকে অবাক করে দিতেই ফোনে কিছু না জানিয়ে হাজির হয়েছে। ওর মাথার মধ্যে ‘সুহি মাতা’-র মেলার ব্যাপারটাও ছিল। মেয়ে তো বাবাকে দেখে আনন্দে কেঁদেই ফেলল। প্রথমে অভিমানে দাদির ঘরের বিছানায় বালিশে মুখ লুকোলো। তারপর সিরাজ অনেক সাধ্যসাধনা করে মান ভাঙালো। ছেলের আসা উপলক্ষে বুড়িমা রাত্রে অনেককিছু রান্না করলো। সন্তোষ সবকিছুতেই অংশ নিল, সিরাজের সাথে অনেক কথা হল। কিন্তু প্রতিটা মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, কেউ যেন তাকে আতশ কাঁচের আঁচে ফেলে মেপে যাচ্ছে। রাত্রে যখন শুতে গেল, তখনও বুকের মধ্যে একটা ভয়ের ডেলা আটকে ছিল।
সন্তোষ ঘুমিয়ে পড়েছিল। এবাড়িতে দুটো ঘর আর একটা রান্নাঘর। কাঠের প্যানেল দেওয়া দেওয়াল। দুটো ঘরের মধ্যে কোনো প্রাইভেসি নেই। এতদিন তার দরকারও পড়েনি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতে পাশের ঘরের ফিসফিসানি কানে এল। সিরাজ তার মাকে বলছে, ‘তুমি বুঝছো না, এই লোকটা একজন ফেরারি। কলকাতায় দু-দুটো খুন করে পালিয়ে এসেছে। বহুদিন ওর ছবি ওখানকার খবরের কাগজে বেরিয়েছে। ওকে আমি দেখেই চিনেছি”। বুড়িমা তার শ্লেষ্মা জড়ানো গলায় কি যেন বলার চেষ্টা করল। ছেলে বলল, “মা আমি আইনের রক্ষক, আমি কোনো বেআইনি কাজ করতে পারবো না। জেনেশুনে একজন খুনিকে বাড়িতে পুষতে পারবো না। কালকেই……” সন্তোষ স্তব্ধ হয়ে শুনতে লাগল।
তখন ঘর অন্ধকার। পাইন গাছের পাতা থেকে শিশির ঝরে পড়ার অবিরাম টুপুর টুপুর শব্দ। পূব আকাশে ক্ষয়াটে চাঁদ অস্ত যাচ্ছে। সন্তোষ সন্তর্পনে দরজা খুলে বেরোলো। গরীব মানুষের বাড়ির এই সুবিধা, দরদালানের বালাই নেই। দরজা খুললেই প্রশস্ত রাস্তা আর প্রসারিত আকাশ স্বাগত জানাবে। শুধু চলার সময় পায়ের নিচে শুকনো পাতাগুলো খসখস আওয়াজ তোলে। সম্বল বলতে একটা কাঁধের ব্যাগ। বেরোবার সময় বিছানাটা পরিপাটি করে গুছনোর চেষ্টা করেছে, তবে শাবানার মত হয়নি। দরজার ফাঁক দিয়ে অন্ধকারে এখন চোখে পড়বে না, তবে বিছানার উপর বই চাপা দেওয়া ‘একটুকরো কাগজ’- তাতে লেখা, “বহিন, আমি সত্যিই একজন দুষ্টু লোক, তবে আজ থেকে ভালো হওয়ার চেষ্টা করবো।”