ঋষিপাড়ার খুঁটিনাটি

ঋষিপাড়ার খুঁটিনাটি

|প্রিয় রহমান আতাউর

আমার সঞ্চয়নের বাসার কাছেই ঋষিপাড়া, প্রায় চৌদ্দ পুরুষের বসতি ওদের, এখানে। এ পাড়া ডিঙ্গিয়েই স্কুলে আসতে হতো আমাদের গাঁয়ের বাড়ী থেকে। গুইসাপ আর বনবিড়ালের ভয় ছিলো
ঋষিপাড়ার ঝোপঝাড়ে! কতবার ছাতিমের ডাল ভেঙ্গে হাতে নিয়ে – ভয়ে ভয়ে পৌঁছে গেছি বাড়ী!
আজন্ম সংসপ্তক ওরা- টিকে থাকে জীবন সংগ্রামে।
নগেন, বল্লভ ও বিভূতিরা বনেদী বংশীয়;
যুদ্ধের আগেই চলে গেছে ওপারে, জমিজমা সব ফেলে।
ওদের বাড়ীর মেয়ে গীতাদি – বড় সুশ্রী ছিলো
কী চমৎকার গাইতো-অতুল প্রসাদী!

ঋষিদের আর যাওয়া হয়নি- একে নিম্নজাত,
তার উপর ভিটেমাটির মায়া!
যদি জুটে দুমুঠো ভাত, তাতেই তুষ্ট ওরা –
পেশা ওদের – জুতো সেলাই, চুল ছাঁটা, ধোপাগিরি-
মড়া পোড়ানো, গাঁজা খাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।
মৃত গরুর চামড়া ছাড়ায় কালাচাঁদ, ভাগাড়ে গিয়ে –
কেউবা কামিন খাটে কালে-ভদ্রে, গেরস্ত বাড়ীতে।
যনীল কাজ করে ঝাড়ুদারের।

আমাদের স্কুলের পিয়ন ছিলো মেঘাদা- ভালো নাম
মেঘামোহন ঋষি। নানা কাজেই বড় ঋণী ছিলাম তার কাছে! চুরি করেছি কত তাদের গাছের কলকেফুল!
সেও চিতেয় উঠেছে প্রায় এক যুগ আগে।
হেলেঞ্চা থেকে গোপালপুরের রাস্তা ধরে একটু এগুলেই – ডান দিকে ওদের শ্মশান।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি মেঘামোহনের শবযাত্রা –
অড়হর আর তিলক্ষেত মাড়িয়ে চলে গেছি সেখানে,
খোল করতাল হাতে- ভগৎ, নিমাই আর বলাইচাঁদ!
সেই ভগৎও আজ আর নেই-
খোল করতাল আর গাঁজার ভার হয়তো এখোন
অন্য কারও কাছে!

ওদের নেই সামর্থ- তবু দীপাবলীর পুজো হতো- কার্তিকের অমাবস্যার রাতে। হাঁপানি আর বাতের রোগীরা আসতো শ্যামাচরণ ঋষির কাছে, – বুড়ো বটগাছটির নিচে, তাবিজ নিতে।
তাবিজ বলতে গাছগাছড়ার শেকড় বই আর কিছু নয়। মানুষের ব্যাধিতে যার নিরলস কেঁদেছে প্রাণ,
সে নিজেও মরেছে হাঁপানি রোগে।
শিরীষের পাতার ফাঁকে উঁকি দেয় দিনমণি
গোধূলির রঙে আবির ছড়ায়-
সন্ধ্যা বাতি দিয়ে আরতি করে লক্ষ্মী ও মাধবীরা।
মসজিদে আযান হয় মাগরিবের।

খুক খুক করে কাশে বৃদ্ধ কাশীনাথের স্ত্রী – হরপার্বতী।
যেনো পথের পাঁচালীর জ্বলজ্যান্ত ইন্দির ঠাকুরুন!
হামানদিস্তায় গুড়ো করে তালমিছরির দানা;
জামবাটিতে তুলে নেয় সে তুলশী পাতার রস।
নিমের পাতায় বানায় বটিকা-
কী বিশ্বাস চরকশাস্ত্রীয় ওষুধে!
এভাবে আর কতদিন বেঁচে থাকা?
অঘ্রানের রাতে – নতুন কির্তনের দল আসে ঋষিপাড়ায়- গগনবিদারী সুরে গায় রাধা-গোবিন্দ সম্প্রদায়!

ফজরের নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বেরোই,
আমাদের কাজের মেয়ে লক্ষ্মী  জানায়-
হরপার্বতী আর নেই!
আচমকা নির্বাক হয়ে যাই – বুড়িটার জন্য কেমোন মায়া লাগে! আমিও তো মধুমেহ রোগী! আমিও তো চলে যেতে পারি যেকোনো দিন!
লেখার টেবিলে ফিরে আসি – প্রকাশকের তাড়া-
পাণ্ডুলিপি দিতে হবে নতুন বইয়ের-
কিছুই লিখতে পারিনা আমি…. ভাবি,
বেচারা কাশীনাথ বড় একা হয়ে গেলো!

সঞ্চয়ন, গোপালপুর, জামালপুর।

 

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
শরতের রাণী

শরতের রাণী

সাজিয়া আফরিন গোধূলি লগ্নে সোনারঙে ঝিলমিল শিশির ভেজা শিউলি ঘাসের বুকে হাসে আকাশে মেঘের ভেলায় শুভ্রতার ছোঁয়া দু’ধারে কাশের বন খেলে লুকোচুরি ক্ষণিকের অতিথি হয়ে ...
স্বপ্নভ্রুণ

স্বপ্নভ্রুণ

আদ্যনাথ ঘোষ বোধের প্রান্তর যদি ফেটে পড়ে মিছিলের পেটে তবে কি জন্ম জমিন মুক্তি খোঁজে বাঁচার আশায়? কিম্বা শিশুমুখ ধ্বনি, জন্মজল ফেণামুখ ঢেউ, শুভ্র আঁচলের ...
নগ্নগন্ধ [পর্ব-০৪]

নগ্নগন্ধ [পর্ব-০৪]

আশিক মাহমুদ রিয়াদ [গত পর্বের পর থেকে । গত পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।] ‘স্যার, হোয়্যাট ডু ইউ নিড?’ ‘আ হোয়াইট ইউনিকর্ণ’, জবাব দেয় শ্বেত ...
মতিনের লাল গামছা

মতিনের লাল গামছা

আশিক মাহমুদ রিয়াদ আপনার আশেপাশে চেয়ে দেখুন! সবাই চাবায়, খাচ্ছে, যা খুশি তাই। খাচ্ছে আর ভাবছে। কি অদ্ভুত! এই খাওয়া শহর। আনমনা কিংবা উদাসীন, অথবা ...
রমজানের শুভেচ্ছা বার্তা ২০২৪

রমজানের শুভেচ্ছা বার্তা ২০২৪

এলো রমজান, এলো পবিত্রতার রমজান, আত্মহারা আজ খুশিতে মন-প্রাণ অতীতের সব পাপ মুছে যাবে আজ, রহমতের এই দিনে যদি করি শপথ! রহমতের আলোয় আলোয় আজ ...
তারা ও জোনাক পোকা

তারা ও জোনাক পোকা

বিরহের কবিতা – কাজী সামসুল আলম    সবাই মিলে সন্ধ্যা বেলা সেদিন মাঠে বসে পড়ল দেখি আকাশ থেকে একটি তারা খসে, আকাশ জুড়ে হৈ হুল্লোড় ...