তওহিদ মাহমুদ
সব গল্প কিন্তু প্রেম দিয়ে শুরু হয়না;
আদরের চাদরে মুড়ে শেষও নয়।
আমি-তুমি, চায়ের কাপে খুনসুটি, রেড ভেলভেট, ভ্যালেন্টাইন কার্ড,
বুফে ডিনারে হৃদয়চিহ্ন এঁকে কাপল ফোটো –
এইসব ছাড়াও কিন্তু গল্প হতে পারে;
একটা মেয়ের গল্প।
কিছু গল্প হয় খুব আটপৌরে জীবনকে জড়িয়ে –
রান্নাঘর, তেলে জবজবে চুল, হোমটাস্কের খোঁজখবর,
আইশ্যাডো, ফ্লোর্যাল ক্যান্ডেল কিংবা ইতালিয়ান শু এর সেল।
জীবনের ভাঁজ খুললে পর এরা একে একে খসে পড়ে
স্যুররিয়েলিস্টিক সিনেমার স্লাইডের মতো।
অযত্নে ভেঙ্গে যাওয়া নখের কোণ,
রাতজাগা চোখ-বালিশের নীলচে ক্লান্তি,
তলপেটে সেলাইয়ের সিলমোহর,
প্রতি রাতের ইচ্ছেহীনতায় নিজেকে বিছিয়ে রাখা –
ছাপ রেখে যাওয়া এসব গল্পগুলো নিয়েও গল্প হয়।
আমরা শুনেছি সুখের গল্প তাদের; দুঃখেরও, যন্ত্রণারও।
জিতেও হেরে যাওয়া, বেঁচে মরে থাকা – গল্প হয়েছে সব নিয়েই।
ফেমিনিজম, জাগো নারী জাগো, গার্ল পাওয়ার,
এসব প্লট নিয়ে মুভিও হয়।
শক্ত মলাটে জায়গাও করে নেয় কোনটা;
আবার কোনটা অন্তর্জালের বাইনারি কোডে।
তারচে’ খুব ফাঁকা একটা গল্প বলি? একদম ‘কিচ্ছু নেই’ এর গল্প।
যেখানে কপালে এবড়ো-থেবড়ো হরফে লিখে দেয়া:
মেয়ে, তোমারটা হলো নিটোল গল্পহীনতার গল্প।
নিখুঁতভাবে স্ক্রিপ্টেড এক তাড়া সাদা কাগজ।
বাবাটা ছিল কিন্তু আদরটা ছিল না।
একটা রাস্তার শুধু ব্যবধান, অথচ যেন অ্যাটল্যান্টিকের থেকেও চওড়া।
দিন, মাস, বছর গড়িয়ে দশকের পর
অবশেষে যুগও কড়া নেড়ে জানালো –
সব বাবা ‘বাবা’ হয় না। কিছু বাবা ‘বাবা’ হতেও চায় না।
একটা মেয়ের গল্পটায় তাই খুব কালচে শৈশব গেঁথে আছে।
ছোট্ট দুকামরার চলটা ওঠা দেয়াল;
তার মধ্যেই মেয়েটা ভালোবাসলো – নিজেকেই।
সারাদিনমান আয়নায় নিজেকেই উল্টেপাল্টে দেখা,
মেয়ে থেকে হুট করে নারী হয়ে ওঠা,
ভালো না বেসে উপায় আছে?
স্রষ্টা যে পেয়ালা উপচে সাজিয়েছেন ভালবাসা।
মেয়েটার গল্পটা তাই ভালোবাসারও গল্প।
সেই কোন মেয়েবেলায় মা পাখিপড়া করে শিখিয়েছিল –
‘মনে রাখিস, ছেলে মানেই খুব, খুব ভয়। আর পুরুষ হলেই খুব, খুব…।’
মেয়েটা সেইটাই বিশ্বাস করে। মেয়েটা তাই খুব ভয় পায়।
দূরে সরে সরে জানলার শিকগুলোর আড়ালে লুকিয়ে
মেয়েটা এরপরও প্রেমে পড়ে।
নিজের সাথে জুড়তে চায় একটা ছেলেকে; জুড়ে নেয়ও।
অনেকখানি যত্নে আর পুরো অস্তিত্ব নিংড়ানো আশা নিয়ে
কুটো জড়ো করে, বাসা বানাবে বলে।
ভালোবাসার গল্প বাঁক নেয় প্রেমের গল্পে।
কেউ ছিল না বলেই কিনা
মেয়েটা অনেকের মধ্যে সব্বাইকে পেতে চেয়েছিল।
ভাই, বোন, বাবা, মা – জনারণ্যে খুঁজে ফেরা এক খ্যাপা।
অবশেষে স্বামীর সংসারে গিয়ে ভুল ভাঙ্গে;
এরাও তো পুরুষই। মেয়েদের জাতশত্রু তো মেয়েরাই।
মেয়েটাকে নতুন করে তাই লিখতে হয় জীবনের খাতা:
‘মেয়েদের নিজের বলে কিছু থাকতে নেই।
মেয়েদের নিজের সংসার হতে পারে না।’
মেয়েটার গল্পটা তাই পরকে আপন করতে যাওয়ার এবং
বারবার ভুল ভাঙ্গার।
গল্পরা হয় গাছেদের মতো – সময়ের সাথে সাথে বাকল খসায়।
গাছের মতোই গল্পদের শাখা থাকে, প্রশাখা থাকে।
মেয়েটার সংসারের গল্পেও ছিল – আধমরা, পাতাঝরা ডাল।
তাতে আর প্রেমের ফুল ফোটে না, উচ্ছ্বাসের পাতারা বিবর্ণ হলুদ।
গাছটার গায়ে পোকারা উড়ে বসে, কুরে কুরে খায়।
বাবুইয়ের বাসায় জোটে অন্য একটা কোকিল অথবা কাক,
হয়তো অন্য আরেকটা ডালে উঁকিঝুঁকি।
একটা-দুটো ফলই যা বাড়তি পাওনা মেয়েটার।
এরপরও মেয়েটা গল্পকে বাঁচিয়ে রাখে, রাখতে চায়।
গল্পটা আপোষ করে গল্প বানানোর আর বাড়ানোর গল্পও।
মেয়েটা বিষন্ন হয়, বিবর্ণ হয়।
এরপর গুটিয়ে যায়, তারপর হারিয়ে যায় –
দশ তলার বারান্দা থেকে অথবা অন্য কোনভাবে।
আর খুব দুর্ভাগা যারা, ওরা হারায় অন্ধকারে;
মনের অনেকগুলো কানাগলির একটায়।
এই হারিয়ে যাওয়াদের দেখা যায়, ছোঁয়াও যায়।
কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায় না।
স্বপ্নের জীবনের চুষিকাঠিগুলো একটা একটা করে গায়েব হয়ে গেলে পর
মেয়েটা এবার সব-হারানোর গল্প লেখে।
এটাই ডাইরির শেষ পাতা, গল্পেরও।
আজ তোমাদের একটা গল্প শোনালাম;
মেয়েটার ‘মেয়ে’ হয়ে থাকার গল্প।
এ গল্প কোথাও লেখা হবে না, পড়াও হবে না।
গল্পটা কিন্তু তার পরও আছে; মেয়েটাও।
বাসের জানালায়, ঘর মুছছে যে, হেঁটে যায় স্কুল ড্রেসে, ইঁট ভাঙ্গে।
কখনও খুব দামী একটা গাড়িতে চড়ে,
আবার আধময়লা শাড়িটায় জড়িয়েও নেয়।
মেয়েটা কখনও মা অথবা বোন। কখনও সন্তান অথবা বন্ধু।
মেয়েটা হয়তো এই মুহূর্তে পাশের বালিশটায় চুল এলিয়ে
স্বপ্ন দেখছে, হাসছে ঘুমের ঘোরে; প্রশান্তির ঘুম?
মেয়েটা আসলেই অনেক, অনেক বেশি সুখী।
কারণ মেয়েটাকে সুখী হতেই হয়; সুখী-সুখীই হতে হয়ে।
এই একটাই কড়ার যে বেঁচে থাকার।
শুধু জন্মাবধি শুরু হওয়া গল্পটা সে মুছে ফেলতে পারে না।
গল্পটা যে একান্তই মেয়েটার নিজের।