এবার মরু: চতুর্থ পর্ব

এবার মরু: চতুর্থ পর্ব

গৌতম সরকার

আজ এলাম সাম বালিয়াড়ি থেকে জয়সলমের হয়ে যোধপুর। এটাই আমাদের শেষ গন্তব্য। কয়েকদিন ধরেই বিপ্রতীপে পথ চলা শুরু হয়ে গেছে। ট্যুর শেষ হতে চলেছে ভেবে আমাদের মনটা একটু খারাপ, তবে চেষ্টা করি মনখারাপের আঁচে বেড়ানোর বাকি আনন্দটুকু যেন সঙ্কুচিত না হয়ে পড়ে। তাই সকালে উঠে রোজকার মত বেরিয়ে পড়লাম। আজ যদিও খুব বেশি তাড়াহুড়ো নেই, তবে ৩০০ কিলোমিটারের ওপর রাস্তা পেরোতে হবে, তবে আগেও বলেছি রাজস্থানের মত মাখন-সদৃশ রাস্তা আমি ভারতের আর কোনও রাজ্যে দেখিনি। ওই রাস্তা চার-সাড়ে চার ঘন্টায় সহজেই পেরিয়ে যাওয়া যাবে। সকালে বেরিয়ে কালকের উল্টোদিকে হাঁটা লাগালাম। এদিকে কিন্তু বালিয়াড়ি নেই, শক্ত জমি, কাঁটা গাছ, মাটিতে অবশ্য বালির আধিক্য বেশি। তবে বুকিং করার সময় কোন দিকের টেন্ট বুকিং করছেন সেটা জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাড়ে সাতটায় সূর্য উঠলো। একটা দোকানে চিনি ছাড়া চা খেয়ে অনেকটা পথ হেঁটে গেলাম। এদিকেও বেশ কিছু টেন্ট দেখতে পেলাম, যদিও বালিয়াড়ির স্বাদ পেতে এদের সাম বালিয়াড়িতে যেতে হবে।

এবার মরু: চতুর্থ পর্ব

[উমেদ ভবন প্রাঙ্গন, যোধপুর]

প্রভাতিক ভ্রমণ শেষ করে ব্রেকফাস্ট সেরে পৌনে দশটা নাগাদ বেরোলাম। জয়সলমের শহর আর আমাদের হোটেল মুমলের পাশ দিয়ে গাড়িটা যখন বেরিয়ে যাচ্ছে বুকটা অজান্তেই চিন চিন করছিল, ‘লাঠি’-তে একটা টি ব্রেক নিলাম, তারপর বলাসর, ঢনঢনিয়া পেরিয়ে একটা জায়গায় খেয়ে নিলাম। যোধপুর শহরে ঢোকার মুখেই একটা ছোট লেক পড়লো, কল্যাণা লেক। তখন মাথার উপর সূর্যদেব বলকে বলকে আগুন ঢেলে চলেছে, তাছাড়া এটা আমার কাল বা পরশুর সাইট সিয়িংয়ে আছে, তাই আগে হোটেলে যাওয়া মনস্থ করলাম।
চেক ইন করে আধা ঘন্টা বিশ্রাম নিলাম। পাঁচটায় বেরিয়ে হোটেলের পাশেই উমেদ গার্ডেনে ঘুরে বেড়ালাম। গার্ডেনের মধ্যেই একটা মিউজিয়াম আছে, তবে ওটা পাঁচটায় বন্ধ হয়ে যায়। দেখি, আগামী দুদিনে যদি সময় করতে পারি দেখে নেবো। ওখান থেকে একটা অটো ধরে পৌঁছলাম ‘ঘন্টাঘর মার্কেট’৷ একটু ঘুরে টুকটাক কেনাকাটা সেরে হোটেলে ফিরলাম।

এবার মরু: চতুর্থ পর্ব

[ফোট থেকে নীল শহর]

এবার আসি রাজস্থান গভর্মেন্টের কথায়। সত্যি বলছি, এইরকম এক পর্যটন প্রিয় রাজ্যে এরকম এক অপদার্থ স্টেট ট্যুরিজম আমি কখনও দেখিনি। বেশিরভাগ মানুষই স্টেট গভর্মেন্টের ট্যুরিস্ট লজ বুক করার পক্ষপাতী। কিন্তু দিনদিন রাজস্থানের সরকারি আবাসের সার্ভিস কোয়ালিটি ডিটোরিওরেট করছে। গতবারের নন-ডেজার্ট এলাকার তুলনায় এবারের ডেজার্ট এলাকার হোটেলের সার্বিক ব্যবস্থা আরও খারাপ। রণথম্ভোর থেকে শুরু করে জয়পুর, বিকানের, জয়সলমের, সাম বালিয়াড়ি সব জায়গায় টিভি থাকলেও কোনোটা ওয়ার্কিং ছিলোনা। কিন্তু একটা হোটেলও সততার সাথে জানালো না তাদের টিভি নন-ওয়ার্কিং। যোধপুরে হোটেল এবং ঘর আমাদের পছন্দ হয়েছে। তবে সার্ভিস তথৈবচ। বহু কষ্টে টিভি চললেও, ইন্টারকম কাজ করছে না, বার বার বলার পর দ্বিতীয় রজাই পেলাম। তো! ট্যুরিস্ট কি করবে? জায়গাটি মন দিয়ে ভালোবেসে ঘুরবে, নাকি ট্যুর ভুলে হোটেলের সাথে নিজেদের অধিকার নিয়ে প্রতিমুহূর্তে বচসা করে চলবে। রাজস্থান সরকার, তোমরা যদি সত্বর সচেতন না হও, তোমাদের রাজকীয় প্রাসাদোপম রিসর্টগুলো একসময় সত্যি করেই ভূতের আস্তানা হয়ে দাঁড়াবে, সেটা নিঃসঙ্কোচে বলা যায়।

এবার মরু: চতুর্থ পর্ব

[মেহরানগড়-ফোর্ট-যোধপুর]

জয়সলমিরের রেলওয়ে স্টেশনটি দেখা হয়নি, আক্ষেপ থেকে গেছে। আসলে সেদিন খুব তাড়াহুড়ো ছিল, শহরের সব কিছু দেখে বিয়াল্লিশ কিলোমিটার দূরে বালিয়াড়ি যাওয়ার ব্যাপার ছিল। যাইহোক আজ সকালের ভ্ৰমনে আমার প্রথম গন্তব্য ছিল যোধপুর রেলস্টেশন, নয়া নাম ‘রাই কা বাগ প্যালেস’৷ তবে স্টেশন দেখে হতাশ হলাম। এর আগে দেখা রাজস্থানের সমস্ত রেলওয়ে স্টেশনগুলো এখানকার রাজকীয় স্থাপত্য ধরে রাখার চেষ্টা করেছে, যোধপুরে তার কোনও কিছুই নেই। আর পাঁচটা সাধারণ রেলস্টেশনের মতোই এর মেক আপ। আমি যখন পৌঁছলাম, তখন যাত্রীরা কোনও এক ট্রেনের প্রতিক্ষা করছিল। স্টেশনে ঢুকে ওভারব্রিজ পেরিয়ে অন্যদিকে গেলাম। ঠিক তখনই একটি এক্সপ্রেস ট্রেন এসে থামলো। লাস্ট ডেস্টিনেশন এখানেই, ফলে মুহূর্তের মধ্যে যাত্রী, লোকজন, আত্মীয়-পরিজনে স্টেশন চত্বর ভরে উঠলো। বাইরে অটোওয়ালাদের হাত থেকে মুক্তি পেতে রীতিমতো দ্রুত পায়ে স্টেশন এলাকা ছাড়িয়ে এসে মূল রাস্তায় এসে পড়লাম। এবার মরু: চতুর্থ পর্ব

[যশোবন্ত থাডা, যোধপুর]

যোধপুরে এসে একটা নতুন উপলব্ধি হলো, এখানে সারাদিন-সারারাত গাড়ি চলে। কাল আমি সারারাত গাড়ির আওয়াজ পেয়েছি, তারপর রাস্তার ঠিক পাশ দিয়েই সমান্তরাল ভাবে চলে গেছে রেললাইন। স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে আরও কিছুটা পথ এগিয়ে গেলাম। মূল রাস্তা খুব জঙ্গম, তাই বাঁদিকে অপেক্ষাকৃত একটা ছোট রাস্তায় ঢুকলাম। এদিকে একটা বিশাল বড় এলাকা জুড়ে আদালত থেকে শুরু করে সমস্ত সরকারি অফিস। কিন্তু যেটা চোখ টানে সেটা গোটা এলাকাটিকে একটি পার্কের চেহারা দেওয়া হয়েছে। এদিকটা মূলত রেসিডেন্সিয়াল এলাকা, কয়েকটা মন্দিরও আছে। আশপাশ ঘুরে সওয়া আটটা নাগাদ ফিরলাম।
আজ আমরা যোধপুর শহরের চারটি গর্বের জায়গা দেখবো- মেহরানগড় ফোর্ট, যশোবন্ত থাডা, মান্ডোর গার্ডেন আর উমেদ ভবন। পৌনে দশটায় ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে প্রথমে গেলাম মেহরানগড় দুর্গ বা যোধপুর ফোর্ট। ১২৫ মিটার উঁচু টিলার উপর নির্মিত এই দুর্গ রাজপুতানার শিল্প ও শৌর্যের প্রতীক। মূল শহর থেকে দূর্গের অবস্থান পাঁচ কিলোমিটার। বৃত্তাকার পথ ধরে সাতটি গেট পেরিয়ে পৌঁছতে হবে দূর্গের মূল মহলে। দ্বিতীয় গেটে এখনও কামানের গোলার দাগ স্পষ্ট দেখা যায়। মূল বাড়িতে আছে, শিশমহল, মোতিমহল, ফুলমহল, আর বিভিন্ন মহলের গ্যালারিতে শোভা পাচ্ছে রাজপোশাক, হাতির হাওদা, পালকি, দোলনা, অস্ত্র, পেন্টিংস, ইত্যাদি। যোধপুরকে ‘নীল সিটি’ বললেও একমাত্র দূর্গের ছাদ থেকেই শহরের একটা অংশে নীল বাড়িঘরের প্রাধান্য দেখা যায়।

এবার মরু: চতুর্থ পর্ব

[যোধপুর মিউজিয়াম]

দূর্গের ঠিক নিচেই দ্বিতীয় দ্রষ্টব্য ছিল- যশোবন্ত থাডা, ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রস্তুত রাজা যশোবন্ত সিংয়ের এই স্মৃতিসৌধ পর্যটকমহলে খুব জনপ্রিয়। এই সৌধের দেখভালের দায়িত্বে আছেন মেহরানগড় মিউজিয়াম ট্রাস্ট, এখানেও বিভিন্ন মারোয়াড়ি রাজাদের প্রতিকৃতি আছে। এই জায়গাটি ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্টিভাল, এবং ওয়ার্ল্ড স্যাকরেড স্পিরিট ফেস্টিভ্যালে ভেন্যু হিসাবে কাজ করে। এরপর আমরা খেয়ে নিলাম। খাওয়ার পর গেলাম ‘মান্ডোর গার্ডেন’৷ মান্ডোর হল রাজস্থানের প্রাচীন রাজধানী শহর। গিয়ে দেখলাম বাগান সংলগ্ন বেশ কিছু সৌধ ভেঙেচুরে ঠিকঠাক করা হচ্ছে। এই গার্ডেনে আছে ‘হল অফ হিরোজ’, যেখানে বিভিন্ন বীর রাজার মূর্তি শোভা পাচ্ছে। সত্যি কথা বলতে আমার কাজগুলো খুব মোটা দাগের মনে হল। এছাড়া আছে একগুচ্ছ দেব-দেবীর মন্দির। সবকিছু দেখে আমরা চললাম আজকের শেষ দ্রষ্টব্য শহরের উল্টোদিকে অবস্থিত উমেদ ভবন। এই প্রাসাদটি যোধপুর শহরের সর্বোচ্চ বিন্দুতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে। বিশাল প্রাসাদটিতে ৩৪৭টি কামরা আছে। একটি ছোট মিউজিয়াম আর মহলের একটি অংশ পর্যটকদের জন্য খুলে রাখা হয়েছে, বেশির ভাগ অংশটি ব্যবসাসূত্রে বিলাসবহুল হোটেলে রূপান্তরিত হয়েছে। ‘ভিন্টেজ কার গ্যালারি’ দেখতে ভালো লাগবে। তবে একেবারে শেষে কুলপি বরফ খেতে খেতে যখন দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলাম, সন্ধ্যেবেলা উমেদ ভবনে কখন আলো জ্বলে উঠবে, তখন উনি বললেন, যখন আলো জ্বলবে তখন আপনি-আমি কাউকে এলাকায় থাকতে দেবে না, সন্ধ্যে এবং রাত্রি শুধুমাত্র এখানকার হোটেল বাসীর জন্য।
ফিরে এসে বৈশালী আর বেরোতে চাইলো না, আমি একটু ফ্রেশ হয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবার ঘন্টাঘর মার্কেটে পৌঁছলাম। এককাপ চা খেয়ে কয়েকটি জলের বোতল কিনে একটি অটো করে হোটেলে ফিরলাম।

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
রফিকুল নাজিমের গুচ্ছ কবিতা

রফিকুল নাজিমের গুচ্ছ কবিতা

কবিতাঃ ০১ প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত তুমি চলে যাওয়ার পর আমার হাতের তালু থেকে নেমে গেছে মহাসড়ক, আমাদের পাড়ার রাস্তায় উঠে এসেছে তোমাদের ঘরদোর, বিছানাপত্র, সীমানা প্রাচীর ...
মুক্তিযুদ্ধের গল্প: পুঁটিজানীর স্বাধীনতা 

মুক্তিযুদ্ধের গল্প: পুঁটিজানীর স্বাধীনতা 

আশরাফ আলী চারু  পুঁটিজানী বিলের পাড়ে শ্যামল সরকার  নতুন বাড়ি গড়েছেন। আশে পাশে আর কোন বাড়ি ঘর নেই। নিরব নিস্তব্ধ পরিবেশ নিয়ে বিলের পাড়ে শোভাবর্ধণ ...
ধানসিঁড়িটির তীরে ছন্দের যত কথা

ধানসিঁড়িটির তীরে ছন্দের যত কথা

আশিক মাহমুদ রিয়াদ সন্ধ্যে রাতে ডিঙি নৌকার টিমটিমে আলো, মাগরিবের আজান,গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। কত দৃশ্যপট চোখে ভাসে, কত মানুষ কত গল্প, কেউ মন্দ কিংবা ভালো। ...
রবীন্দ্রনাথ  বাঙালী মুসলমান সমাজ [পর্ব – ২ ]

রবীন্দ্রনাথ বাঙালী মুসলমান সমাজ [পর্ব – ২ ]

 |মিরাজুল  হক    পর্ব – ২ :   ( রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি তে বাঙালী মুসলমানদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান )    এটা ঠিক যে রবীন্দ্রনাথের জন্ম ...
পথিক- শঙ্খ মিত্র

পথিক- শঙ্খ মিত্র

  শঙ্খ মিত্র হাজার বছর ধরে হেঁটে চলে আসা ক্লান্ত পথিক সহসা থমকে যায় এই কার্তিকের ভোরে আধো অন্ধকারে জেগে উঠে স্বপ্নের অতীত এক অসহ্য বোধ ...
রক্তকান্না

রক্তকান্না

সৌর শাইন অরণ্যের বুক চিরে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছে সম্রাট পরিবহন! জানালার পাশে বসে নিশ্বাস নিচ্ছে সৌরুদ্র! সবুজের সাম্রাজ্য ভাওয়ালগড়, শালবৃক্ষের সমারোহ চোখে স্নিগ্ধতার ঝাপ্টা ...