গৌতম সরকার
যেখানেই যাই না কেন, সেখানকার রেলস্টেশনটা দেখা আমার ট্যুর আইটিনেরারির একদম ওপরের দিকে থাকে; আর রেলস্টেশন যেহেতু সাইট-সিয়িংয়ের লিস্টের মধ্যে পড়েনা তাই ওটা রাখি আমার একক প্রভাতী ভ্রমণে। সেইমতো আজ সকালে আমার প্রথম গন্তব্য ছিল বিকানের রেলস্টেশন। সমস্যা হল এখানে সূর্য আরও দেরিতে ওঠে। আজ বেরোলাম সাড়ে ছটায়, হোটেল থেকে বেরিয়ে একটাও লোক পেলাম না যাকে জিজ্ঞাসা করি স্টেশনটা কোনদিকে। বেশ কিছুক্ষণ পর একজনের দেখা মিলল, সে আমি পায়ে হেঁটে স্টেশন যেতে চাই শুনে বলল, “আঙ্কল, আপনি এক্সারসাইজের জন্যে হাঁটতে চাইলে একটু আগেই একটা বিশাল বড় পার্ক আছে ওখানে চলে যান, ওই পার্কে ভোর চারটে থেকে মানুষ প্রভাতিক কসরত করতে চলে আসে, ওখানে জিমেরও অনেকরকম ইন্সট্রুমেন্টস আছে, ওখানে যেতে পারেন।” আমি তাও বলি, “রেলস্টেশন কি এখান থেকে অনেক দূর?” ছেলেটি বলল, “দূর তো বটেই, তার উপর অনেক ঘুর পথ”। পার্কের কনসেপ্টটা যদিও খারাপ লাগলোনা, তাই পা চালালাম নির্দেশিত পথে। তখনও চারদিক বেশ ঝুঁঝকো অন্ধকার ঘিরে আছে, তবে বহু মানুষ, নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে শরীরসেবায় মেতে উঠেছে, আমিও মুহূর্তের মধ্যে জননিধির সামিল হয়ে গেলাম। আধাঘন্টা কসরত শেষে পার্কের বাইরে এলাম। মনটা খুঁত খুঁত করছে, স্টেশনটা যাওয়া হলোনা, অবশেষে রাস্তার উল্টোদিকে এক জুসওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করে, পথে আরও বেশ কিছু মানুষের সাহায্য নিয়ে শর্টকাট রোডে স্টেশনের পিছন দিকে গিয়ে উঠলাম। এই ভোরেও (সকাল সাড়ে সাতটাতেও এখানে ভোরের আবহ) স্টেশন বেশ সরগরম, একটা দূরপাল্লার ট্রেন এসে ঢুকেছে৷ ফেরার পথে এককাপ চা খেয়ে সোজা হোটেল।
আজ আমাদের বিকানিরের দ্বিতীয় দিন, আগামী কাল এখান থেকে যাবো জয়সলমের। আজকের মধ্যে বিকানিরকে দেখে ফেলতে হবে। চাপ কমানোর জন্যেই কাল করণিমাতা মন্দির করে ফেলতে চেয়েছিলাম। আসলে বৈশালীর শরীরটা ভালো না থাকায় আমি টোটাল লেভারেজটাকে ইভেনলি শেয়ার করতে চাইছিলাম। যাই হোক, আজ ব্রেকফাস্ট সেরে নটা পনের-কুড়িতে বেরিয়ে আগে গেলাম ৩২ কিলোমিটার দূরে করণিমাতা মন্দির। দেশনোক গ্রামে মহারাজা সুরজ সিংয়ের তৈরি এই মন্দির ‘Rat Temple’ নামে অধিক পরিচিত। কারণ হল এই মন্দিরে ইঁদুরের আধিক্য। ইঁদুরদের এখানে পবিত্র মানা হয়। মন্দির কমিটি এদের খাবার ব্যবস্থা করে। সারা মন্দির জুড়ে ইঁদুরের খাবার জন্য ছোলা, দানা শস্য আর সরষে ছড়িয়ে রাখা হয়। মাতার পূজোর প্রসাদ হল নারকেল আর খেজুর। মূল মন্দিরের পাশে আছে আওড়মাতা আর মনুবাঈজি কি মন্দির।
বিকানের শহরের প্রতিষ্ঠা হয় ১৪৮৮ খ্রিস্টাব্দে। এই শহর পত্তন করেছিলেন ভাটিরাজ রাজা রাও বিকাজি। তাঁর নামানুসারেই এই শহরের নামকরণ। তাঁর আমলে ১৫৮৯-১৫৯৩ সালের মধ্যে গড়ে তুলেছিলেন জুনাগড় দূর্গ। করণিমাতা দর্শন করে আমরা এসে পৌঁছলাম ‘জুনাগড় দূর্গ’। পূর্বদিকের করণ পোল গেট দিয়ে ঢুকে তিনটে গেট পেরিয়ে টিকেট কাউন্টারে পৌঁছতে হবে । মাথাপিছু পঞ্চাশ টাকা দক্ষিণায় দেখা যাবে ‘দেওয়ান-ই-আম’ করণ মহল। তারপর পৌঁছবেন অনুপমহল, এই মহলের ঝরোখা আর জালির কাজ পর্যটকদের চোখ টানবে। তবে বাকি মহলগুলো, যেমন, বাদলমহল, চন্দ্রমহল, রাণীমহল, সূর্যমহল, ছত্রমহল এগুলি ঢোকার স্পেশাল টিকিট করোনার কারণে আপাতত বন্ধ। আলাদা করে টিকিট কেটে দেখতে হবে দূর্গের একদম পাশেই ১৯৩৭ সালে মহারাজা গঙ্গা সিংহ নির্মিত গঙ্গা সিং মিউজিয়াম। প্রাক হরপ্পা যুগের স্থাপত্য থেকে শুরু করে গুপ্ত যুগের টেরাকোটা, রাজস্থানি বাদ্যযন্ত্র, চিত্রকলা, কাঁচের কাজ ইত্যাদি নিয়ে মিউজিয়ামটি দেখে ভালো লাগবে। এরপর দুই কিলোমিটার দূরে উপস্থিত হলাম লালগড় প্যালেসে। যেটুকু ছোট অংশ এখনও দর্শকের জন্যে খোলা ( বাকিটা স্টার হোটেলে রূপান্তরিত হয়েছে) সেটাও বন্ধ কারণ কোনও এক ম্যারেজ রিসেপশনের জন্য আজ প্রাসাদ ভাড়া দেওয়া হয়েছে। অগত্যা মিউজিয়াম দেখে আর বাইরে থেকে প্রাসাদের কিছু ছবি তুলে রওয়ানা হলাম ‘দেবী কুন্ড সাগর’-এর উদ্দেশ্যে। এটি একটি সেনোটাফ, রাজপুত বংশীয় রাজা-মহারাজা, রানী, রাজপুত্র, রাজকন্যার সমাধিক্ষেত্র। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে চোখজুড়ানো স্থাপত্যে তৈরি সমাধিফলক গুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে খুব ভালো লাগবে। ওখান থেকে বেরিয়ে বুঝলাম শুধু চোখের তৃপ্তিতেই জগৎসংসার চলবে না, এর সাথে সাথে উদরের তৃপ্তিরও প্রয়োজন। আজ আর একটা স্পট বাকি, ভান্ডাসার জৈন টেম্পল। কিন্তু রাস্তায় একটাও রেস্টুরেন্ট মিললো না, অগত্যা জৈন টেম্পল দেখে রেলস্টেশনের পাশে অসাধারণ আলু পরোটা আর বাজরা কা রোটি কি যে তৃপ্তি করে খেলাম বোঝাতে পারবোনা।
ওখান থেকে বাড়ি ফিরে ঠিক পনের মিনিট বিশ্রাম নিলাম। তারপর বেরিয়ে সকালের পার্কে বৈশালীক নিয়ে একটু ঘুরে একটা অটো ধরে পৌঁছে গেলাম কোর্ট গেট, এখানকার বিখ্যাত মশালা বাজার এবং ভুজিয়ার দোকানে৷ কিছু নমকিন খরিদ করে আজকের মত ইতি টানলাম।
আবার একটা নতুন দিন শুরু হল৷ আজ আমাদের ট্যুর ঠিক মাঝপথে, পাঁচটা দিন কোথা দিয়ে যে কেটে গেল! এবার কাউন্ট ডাউন শুরু হবে। আজ আমরা এলাম বিকানের থেকে জয়সলমের। তবে আজকে সকালবেলায় যে অভিজ্ঞতাটি হল সেটি এককথায় অনবদ্য। প্রতিদিনের মত আজও সাড়ে ছটা নাগাদ বাইরে বেরিয়েই হোঁচট খেলাম। একটা মাখনের মত ঘন সাদা কুয়াশা চরাচর জুড়ে ভেসে আছে, একফুট দুরে কি আছে বোঝা যাচ্ছে না। একটা দুটো গাড়ি বা বাইক যা যাচ্ছে তাও শম্বুক গতিতে, তখনও মাথার উপর হু হু করে কুয়াশার পতন ঘটে চলেছে। একবার ভাবলাম ফিরে যাই, কিন্তু তৈরি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ফিরতে কারই বা ইচ্ছে হয়! তাই ঠিক করলাম রাস্তার বাঁদিক ঘেঁষে একেবারে নাক বরাবর হেঁটে যাবো। তবে জায়গাটির মানচিত্র কতকটা আমাদের সল্টলেকের মত। কিছুটা দূরে দূরেই একটা করে সার্কেল, তাই নাক বরাবর চাইলেও প্রতিটা সার্কেলেই ওই অন্ধ কুয়াশায় বোঁ বোঁ করে কোয়ার্টার সার্কেলে ঘুরতে হচ্ছে, তবুও সেই অন্ধ আবর্তে চেষ্টা করছি দিকটা ঠিক রাখতে। কিন্তু চার-পাঁচটা সার্কেল পেরোনোর পর আর সামনে এগোনোর কোনও রাস্তা পেলামনা, রাস্তাটা এবার ডানদিকে আর বাঁদিকে বেরিয়ে গেছে। সমস্যা যেটা হবে, আমি যদি কোনও একটা দিক নিই এবং ফেরার সময়ও এরকম কুয়াশা থাকে তাহলে এখানে পৌঁছে উল্টোদিকের রাস্তাটা খুঁজে পাবোনা। তাই স্থির করলাম এখান থেকে ফিরে যাওয়াই শ্রেয়। বৈশালীক ফোন লাগালাম, ও ও বললো ফিরে আমাদের হোটেলের পাশের পার্কটায় যেতে, সেখানে হারাবার কোনও ভয় নেই। অগত্যা ফিরতি পথ ধরলাম, পার্কের সার্কলে পৌঁছে বাঁদিক ঘুরে একটু এগিয়ে একটা চায়ের দোকানে টোস্ট বিস্কিটের সাথে গরম চায়ের মৌতাত নিলাম।
তারপর পার্কে না ঢুকে পার্ককে ডানদিকে রেখে রাস্তা ধরে হেঁটে চললাম, এবারও ওই নাক বরাবর। কিন্তু সমস্যা হল, সাতটা বেজে যাওয়া সত্ত্বেও কুয়াশা যেন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আসলে গতকাল একটু ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়েছে, এটা তারই ফলশ্রুতি। বেশ কয়েক কিলোমিটার হেঁটে গেলাম। আজ শহরে কোনও একটা কম্পিটিটিভ এক্সাম আছে, এই কুয়াশাময় সকালে অনেক ছেলেমেয়ে হাতের ফোনের জিপিএস অন করে হেঁটে চলেছে। তাদের মধ্যে অনেকেই আমাকে স্থানীয় মানুষ ভেবে স্কুল বা কলেজের অবস্থান জিজ্ঞাসা করছে। শেষে গিয়ে একটা ট্রাফিক সৌধে বসলাম। তারপর হোটেলে ফিরতে গিয়ে ওই সোজা পথ কোহরার কারণে দু-দুবার হারিয়ে যখন হোটেলে পৌঁছলাম তখন আটটা কুড়ি হয়ে গেছে।
আমাদের আজকের যাত্রা শুরু হল সাড়ে নটার কিছু পর। তখনও আবহাওয়া তথৈবচ….আমাদের গুমান সিং আর যাই হোক, গাড়িটা ব্যাপক চালান। ভেবেছিলাম এই ৩৩০ কিলোমিটার পথ যেতে কত না সময় লাগবে! কিন্তু মোটামুটি নর্মাল টাইম মেনেই পথে ওয়ার মেমোরিয়াল দেখে ছয়ঘন্টার মধ্যে জয়সলমিরের হোটেলে পৌঁছে গেলাম।
“If you ate today, thank a farmer
If you ate in peace, thank a soldier.”
জয়সলমের ওয়ার মিউজিয়াম জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ১৯৬৫-এর ভারত-পাক যুদ্ধ এবং ১৯৭১-এর লাঙ্গেওয়ালা যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন। মিউজিয়ামের মধ্যে একটি অডিও-ভিজ্যুয়াল রুম আছে যেখানে যুদ্ধের মুভি দেখানো হয়, আর আছে তিন থেকে চারটি গ্যালারি যেখানে যুদ্ধে ব্যবহৃত ওয়েপনস, ট্রফিস, ভিন্টেজ ইকুইপমেন্টস, মিলিটারি ভেইকলস ইত্যাদি সাজানো আছে। ওয়ার মিউজিয়াম থেকে হোটেলে ফিরে একটা আধাঘন্টার ব্রেক নিয়েই আবার বেরিয়ে পড়লাম।
আমরা কাল এই হোটেল ছেড়ে দেব। কাল-পরশু আমাদের বুকিং আছে সাম বালিয়াড়ির বুকে আরটিডিসির হোটেল সাম ধনি, তাই একবেলায় জয়সলমের শহরের যাবতীয় কিছু দেখে ৪২ কিলোমিটার দূরে মরুর বুকের আস্তানায় পৌঁছতে হবে। তাই হোটেলে একটু খাইদাই করেই বেরিয়ে পড়লাম, প্রথমে গেলাম গাদিসার লেক। এটি একটি কৃত্রিম লেক হলেও অনিন্দ্যসুন্দর। ১৪০০ সাল নাগাদ জলাধার হিসাবে এটি খনন করা হয়। এর চারদিকে অনেকগুলো মন্দির আছে। এখানে বোটিংয়েরও ব্যবস্থা আছে। আজ এখানে প্রচুর পর্যটকের ভিড়, কাউন্টার থেকে জানাল টিকিট কেটে এক-দেড় ঘন্টা বসে থাকতে হবে টার্ন আসার জন্য। তাছাড়া বোটিং পয়েন্টে প্রচুর মানুষের জমায়েত। কোভিড বিধি মানার কোনো চেষ্টাই নেই, লোকের ঘাড়ের উপরে লোক দাঁড়িয়ে বোটের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা ব্যাপার-স্যাপার দেখে প্রমাদ গনলাম, কিছুক্ষণ ফাঁকায় ফাঁকায় লেকের পাড় বরাবর ঘুরে চলে গেলাম ‘বড়া বাগ’। বাগ বলতে এখানে বাগান বা বাগিচা বুঝলে আপনি আমাদের মত বোকা বনবেন। এটা মূলত রাজ পরিবারের সমাধিক্ষেত্র। এই অঞ্চলের যাবতীয় জমিন রাজার সম্পত্তি। যেটা আশ্চর্য্যজনক সেটি হল শুষ্ক এবং উর্বরতাহীন গোটা রাজস্থানের বুকে এমন এক সবুজ-সরস-উর্বর ভূমি দর্শন। একটা জিনিস দেখে ভালো লাগলো সমগ্র অঞ্চল জুড়ে ‘উইন্ড মিল’-এর আধিক্য। শেষ সূর্যকে সাক্ষী রেখে সেনোটাফের দীর্ঘ ছায়া কাছের মানুষ হারানোর বেদনাকে কিরকম এক বিধুর বেহাগে বাজিয়ে চলেছে।
(চলবে…….)