এবার মরু: শেষ পর্ব

এবার মরু: শেষ পর্ব

গৌতম সরকার

সব শুরুরই শেষ থাকে, নিয়মের নিগড়ে আমাদের ট্যুরও শেষ হল। ট্যুরটা খুব উপভোগ্য হল বলতে ভালো লাগছে, কারণ আমরা বাঙালিরা যেকোনো ট্যুরকে উপভোগ্য করে নিই, তা সে যতই প্রতিবন্ধকতা থাকুক না কেন। রাজস্থান স্টেট ট্যুরিজমের দুর্দশা এবং পুওর সার্ভিসের কথা তো আগেই বলেছি, তার উপর এবারে আমরা যে ড্রাইভার পেয়েছিলাম তিনি একেবারেই ট্যুরিস্ট ফ্রেন্ডলি নয়। প্রথমত ট্যুরিস্টকে একটা জায়গা সম্বন্ধে ন্যূনতম ইনফরমেশন তো দেনই না, উল্টে ট্যুরিস্ট কোনো জায়গায় (কলকাতা RTDC -র চুক্তিমতো) যেতে চাইলে বলেন, “উও জাগা কিউ জায়েঙ্গে? উহা দেখনে কি লিয়ে কুছ খাস নেহি হ্যায়!” অথচ এই গাড়ি অনেক পয়সা দিয়ে কলকাতার RTDC অফিস থেকে বুক করেছি। ভেবেছিলাম সরকারি ব্যবস্থাপনায় সব কিছু সুষ্ঠুভাবে হবে। কিন্তু RTDC একটা বিরাট মুনাফার বিনিময়ে রাস্তা থেকে কোনও এক ড্রাইভারকে ধরে আপনার সঙ্গে জুতে দেবে। প্লিস, কিছু মনে করবেন না, কথাটা বললাম কারণ চুক্তিপত্রে (১০০০০ টাকা অগ্রিমের বিনিময়ে) পরিষ্কার লেখা ছিল ট্যুর শুরুর দুদিন আগেই ড্রাইভারের ডিটেইলস পাওয়া যাবে, কিন্তু বারংবার ফোন করে (কোলকাতা এবং জয়পুরে) ফ্লাইটে ওঠার আগের মুহূর্তে আমরা ড্রাইভারের ফোন নম্বর পেয়েছিলাম। তখনই রাজস্থান স্টেট ট্যুরিজমের প্রফেশনালিজম নিয়ে মনে প্রশ্ন জেগেছিল। সমগ্র ট্যুরে সেটা বেড়েছে বই কমেনি। তাই একথা শপথ করে বলতে পারি, পরে আর কোনওদিন সত্যিই যদি রাজস্থান আসি স্টেট গভর্মেন্টের রিসর্টে থাকবো কিনা সেটা নিয়ে আমাকে পাঁচবার ভাবতে হবে, যেটা অন্য রাজ্যের ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ভাবতে হয় না। এভাবে চললে RTDC-র পক্ষে আগামী দিনে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া মুশকিল হয়ে পড়বে।

এবার মরু: শেষ পর্ব

[ওশিয়ান মাতার মন্দির, যোধপুর]

  আমরা কোনোদিনই হেকটিক ট্যুর করতে পারিনা, তাই আমরা যোধপুরের জন্য তিনদিন রেখেছিলাম। কলকাতার আরটিডিসি অফিসের ছেলেটি বলেছিল, “সবাই যোধপুরে একদিন থাকে, আপনি ওখানে তিনদিন কি করবেন?” আমি ওকে বলেছিলাম, ‘তুমি এখন বুঝবে না, আমাদের বয়সে পৌছাও তখন বুঝবে’। সেইমতো আমাদের আজকের প্রোগ্রামে ছিল দুটি গ্রাম আর একটা লেক ভিজিট। গ্রাম দুটি হল- ওশিয়ান আর বিশনোই, আর কল্যাণা লেক।
যোধপুর সিটি থেকে ওশিয়ান ভিলেজ ষাট কিলোমিটার। ড্রাইভার সাহেব বোধহয় আমাদের দৌলতে জায়গাটির নাম প্রথম শুনলেন, তাই গন্তব্যে পৌঁছে গোল গোল হয়ে জায়গাটি ঘুরতে লাগলেন কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছতে পারলো না। অগত্যা আমাকে দায়িত্ব নিতে হল, একটা জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে একটি রেসিডেন্সিয়াল প্রাইমারি স্কুলে ঢুকে সেখানকার এক শিক্ষকের সাহায্যে গন্তব্যের খবর পেলাম। আমাদের ড্রাইভার সাহেব আবার খুব টেক-স্যাভি।

এবার মরু: শেষ পর্ব

[বিশনই ভিলেজ রিসোর্ট]

তিনি কখনোই কোনও মানুষের কাছে জায়গার দিকনির্দেশ জানার প্রয়োজন মনে করেননা, বরঞ্চ মোবাইলে ভয়েস টিউনে গন্তব্যের নাম জানাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। অবশেষে ওই শিক্ষকের নির্দেশমতো গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। এখানে এমন একটি জাগ্রত সচ্চিয়ামাতা মন্দির আছে সেটা আমরা জানতামনা, বা কেউ আমাদের বলেনি৷ তবে মুশকিল হল অন্য জায়গায়। আজ পয়লা জানুয়ারি, স্থানীয় অনেক মানুষ মাতাজীর মন্দিরে পূজা চড়াতে এসেছে। সারা চত্বর জুড়ে মায়ের দর্শনের জন্য খাঁচা তৈরি করে রাখা আছে। সেই খাঁচা বহু সর্পিল পথ অতিক্রম করে মূল মন্দিরে প্রবেশ করেছে। খাঁচায় ঢুকে বিপদে পড়লাম, বেশ কিছুটা যাওয়ার পর সামনে-পিছনে লোক সমাগম দেখে প্রমাদ গণলাম। খাঁচা থেকে বেরোনোর কোনও উপায় নেই, অন্যদিকে সামনে অপেক্ষারত জনতার গতিময়তা দেখে মনে হল ২-৩ ঘন্টার আগে এখান থেকে মুক্তি নেই। তাহলে তো সারাদিনের প্ল্যানটাই গড়বড় হয়ে যাবে।

এবার মরু: শেষ পর্ব

[জৈন মন্দির]

কোনোভাবেই এখানে কোভিড প্রোটোকল মেনে চলা সম্ভব নয়। কোনও মানুষের মুখে মাস্ক নেই, লাইনে সামনের এবং পিছনের লোক গায়ে এসে পড়ছে, কিছু বলার নেই। নিঃশ্বাস বন্ধ করে নিজেদের বোকামিতে নিজেদেরই তিরস্কার করছি। শেষ পর্যন্ত হয়ত মায়েরই আশীর্বাদে পাশের এক বন্ধনী খুলে গেল, আর সেই ফাঁক দিয়ে শয়ে শয়ে মানুষ পাগলের মত সিঁড়ি ভেঙে মায়ের গর্ভগৃহের দিকে ছুটল। আমরাও সেই ফাঁকে মা-কে দূর থেকে নমস্কার জানিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম৷ মন্দির থেকে বেরিয়ে মূল বাজারে ঢুকে একটা গলির মধ্যে দিয়ে কিছুটা এগিয়ে দেখে নিলাম একটি জৈন মন্দির। অপূর্ব স্থাপত্যের কাজ। একে একে ২৪ টি তীর্থঙ্করের ছোট ছোট মন্দির, মূল মন্দিরে মহাবীরের মূর্তি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, অপার একটা শান্তি বিরাজ করছে চত্বর জুড়ে। এখানে আমরা ছাড়া আর কোনো দর্শনার্থী নেই। কয়েকশো মিটার ব্যবধানে দুটি মন্দিরের দুই বিপরীত চেহারা দেখে ওসিয়ান গ্রাম ছাড়লাম।

এবার মরু: শেষ পর্ব

[কল্যানপুর লেক, যোধপুর]

এবার চললাম দ্বিতীয় গ্রামের উদ্দেশ্যে। এই গ্রাম সম্বন্ধে আমাদের ড্রাইভারের জ্ঞান আরও কম। আমাদের পরিচিত ওই বাঙালি পরিবারটি গতকাল ওই গ্রামে গিয়েছিল। মূলত ওই গ্রামের কালচার, আশপাশ, সলমন খানের হিরণ শিকার ইত্যাদি নিয়ে একটা ভিলেজ সাফারি হয়। তাই গুগলে যতবার ‘বিশনোই ভিলেজ’ সার্চ দিই, ততবারই ঘুরে ফিরে ‘ভিলেজ সাফারি’-র পেজটাই খুলতে থাকে। যাই হোক, এখানে যেতে গেলে আবার যোধপুর শহরে ফিরে উল্টোমুখে যেতে হবে। যোধপুরে ফিরে আগে খেয়ে নিলাম, তারপর সন্ধান লাগালাম বিশনোই ভিলেজের। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে মাঠ-ঘাট, খানা-খন্দ পেরিয়ে, প্রচুর বুনো ময়ূর দেখতে দেখতে শেষমেশ যেখানে পৌঁছলাম সেটি হল, বিশনোই ভিলেজ রিসর্ট অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্প। ফাঁকা একটা মাঠের মধ্যে অনেকটা জায়গা জুড়ে মাটির তৈরি কয়েকটা কটেজ, তার সারা অঙ্গে ফুল, লতাপাতা আঁকা। দেখতে বেশ সুন্দর। তাদের কাছ থেকেই শোনা গেল, এটাই বিশনোই গ্রাম। তবে এখান থেকে জিপ সাফারি করে আরও ভিতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রামজীবনের একটা ছবি পর্যটকদের উপহার দেওয়া হয়। তারজন্য ২-৩ ঘন্টা সময় লাগবে, আর দক্ষিণা আড়াই হাজার। আমাদের কাছে সময় আর অর্থ দুটোই অপ্রতুল। তাই কিছুটা সময় ব্যয় করে ওখান থেকেই ফেরা মনস্থ করলাম।

এবার মরু: শেষ পর্ব

[কল্যাণ্যা লেকে আমরা]

এবার যাবো আজকের এবং ‘এবার মরু’-র শেষ গন্তব্য কল্যাণা লেক। যোধপুরে ঢোকার দিন এই লেক এক ঝলক দেখেছিলাম। এটির অবস্থান শহরের অন্য প্রান্তে। একটি ছোট্ট পাহাড়কে বেড় দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ ধরে গাড়িটা এগিয়ে চলল। ওপর থেকে লেকটিকে দেখতে খুব সুন্দর৷ এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে ছবি তুললাম। তারপর এলাম বোটিং পয়েন্টে। এখানেও যথেষ্ট ভিড়, আসলে বছরের প্রথমদিন সব জায়গাতেই মানুষের ঢল নেমেছে। মূলত স্থানীয় মানুষ, পর্যটকরা বেশিরভাগই আজ ফিরে গেছে। লেকে দুটো মোটর বোট আর দুটো স্পিড বোট চলছে। একটু সময় নিয়ে ভিড়ের আর ফেরির অবস্থাটা মেপে নিলাম। তারপর এক ফাঁকে মোটরবোটে চড়ে বসলাম। সূর্য তখন পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। মোটর বোটে বসে দেখলাম অনুচ্চ পাহাড়ের পিছনে দিনমণি মুখ লুকোলো। যোধপুরে রাজস্থানের অন্যান্য জায়গার তুলনায় ঠান্ডাটা কম হলেও এখন জলের বুকে বেশ শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছে। ফিরে লেকের পাড়ে একটাও চায়ের দোকান চোখে পড়লো না। অগত্যা গুমান সিংয়ের গাড়িতে উঠে বসলাম।
হোটেলে ফিরে একটু ফ্রেশ হয়ে দুজনে শেষবারের মত যোধপুর ওরফে রাজস্থানের রাস্তায় হাঁটতে বেরোলাম। আমি আশপাশ ঘুরলেও, প্রথম দিনের বিকেলবেলা ছাড়া বৈশালীর আর আশপাশ ঘোরা হয়নি। কাল আর মর্নিং ওয়াকেও বেরোনো যাবে না। মনখারাপের মেঘগুলো ফেরার দিন আমাকে ঘিরে থাকে, সকালে বেরোতে দেয় না। আশপাশ একটু ঘুরে দুয়েকটা মন্দির দেখে আটটা নাগাদ হোটেলে ফিরলাম।
( শেষ )

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
যেমন গানের রেওয়াজ, শরীরীর চর্চা, সাঁতার শেখা,  তেমনি নিয়মিত রবীন্দ্র সাহিত্য চর্চা খুবই জরুরী

যেমন গানের রেওয়াজ, শরীরীর চর্চা, সাঁতার শেখা, তেমনি নিয়মিত রবীন্দ্র সাহিত্য চর্চা খুবই জরুরী

 মিরাজুল হক তখন কি হবে? যখন আমাদের নতুন প্রজন্ম চোদ্দ পনের বয়সের ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে কিছু প্রত্যশা করা হবে । বিশেষ করে আশা করা হবে ...
The Ultimate Guide to Stock Market

The Ultimate Guide to Stock Market

Cursus iaculis etiam in In nullam donec sem sed consequat scelerisque nibh amet, massa egestas risus, gravida vel amet, imperdiet volutpat rutrum sociis quis velit, ...
ছোটগল্প- বিশ্বাস

ছোটগল্প- বিশ্বাস

আসিফ আফনান পিয়াল “আব্বা মোগো গরু কেনবা না এবার?” ছেলে রাকিবের প্রশ্নে নিরব তরিকুল! কেননা এই প্রশ্নের উত্তর যে জানা নেই কেয়ারটেকার তরিকুলের। কিনবেই বা ...
শূন্য মন্দির মোর - হুসাইন দিলাওয়ার

শূন্য মন্দির মোর – হুসাইন দিলাওয়ার

 হুসাইন দিলাওয়ার শরতের বৃষ্টিস্নাত সকাল ।  ঘুমের জন্য যুতসই একটা আবহাওয়া ।  অন্যদিন সকাল ছয়-সাতটা নাগাদ রোদ উঠে যায় ।  রোদের তেজও থাকে গা জ্বালানো ...
কবিতা-হে রাষ্ট্র প্রধান

কবিতা-হে রাষ্ট্র প্রধান

সালেহ উদ্দিন সুমন   হে রাষ্ট্র প্রধান ঘোষনা করুন আজ থেকে মানুষে মানুষে, থাকবে না কোন ভেদাভেদ।  যেমন আপনার ঘোষনায় বন্ধ হয়ে যায় বিপনী বিতান, ...