মির্জা বাড়ির কবির মির্জা আমাদের মত খেটে খাওয়া মানুষকে মানুষই মনে করেন না। প্রাচুর্যের বড়াই তার চিরকালের। মির্জা বাড়ির সদর দরজায় বিশাল এক লোহার গেট। সেই গেটে ঝুলে থাকে মস্ত এক তালা। মির্জা বাড়িতে গরীবদের প্রবেশ নিষেধ। প্রায়ই ওই বাড়িতে গরু জবাই করে দাওয়াত খাওয়ানো হয়। গরীবদের সেই বাড়িতে কখনো খেতে দেয়া হয়না। গাড়ি ভরে শহর থেকে ধনবান সব মেহমান আসে। সবাই কবির মির্জার বন্ধু।
মির্জা বাড়ির গেট মাঝে মাঝে খোলা দেখা যায়। আট মাস আগে এক সকালে এই বাড়ির গেট খোলা পেয়ে চুপি চুপি ভেতরে ঢুকলাম। বাড়ির পরিবেশ দেখে আমার চোখ বিস্মিত। দুটো দোতলা ঘর, ফুলের বাগান, পোষা খরগোশ, অবারিত উঠোন, বৈঠকখানা, বিশাল কলতলা, লেবুর বাগান এসব দেখে দেখে আমার মুগ্ধতা বাড়ে। কিছুক্ষণ ওখানে থেকে আবার চুপি চুপি বেরিয়ে এলাম। ভাগ্যিস কেউ দেখেনি। দেখলে হয়তো কৈফিয়ত দিতে হতো।
২.
গরম দুপুর। আজো মির্জা বাড়ির গেট খোলা। চুপি চুপি ভীরু পায়ে ভেতরে চলে এলাম। দুপুরের রোদে খাঁ খাঁ করছে গাছের পাতা। এক ঝঁাক রাজহাস ডানা ঝাপটাচ্ছে কঁাঠালতলায়। খরগোশগুলো দৌড়াচ্ছে। বড্ড মায়া হল আমার। দৌড়ে গিয়ে একটি খরগোশকে কোলে নিতেই গিয়ে দেখি কবির মির্জা আগুন চোখে আমার সম্মুখে দঁাড়িয়ে আছেন। ভয়ে সারা শরীর কঁাপছে আমার। কবির মির্জা সিংহ গলায় বললেন, ‘মির্জা বাড়িতে কার অনুমতি নিয়ে ঢুকেছিস? জানিস না তোদের মত ফকিরদের এই বাড়িতে ঢুকার নিয়ম নেই।’ ভয়ে এবার আমার গা ঘামতে থাকল। ভীতু গলায় বললাম, ‘আর কখনো ভুল হবে না স্যার। জীবনেও আর এখানে আসব না। চলে যাই।’
খরগোশটা রেখে দিয়ে কঁাপা পায়ে ফিরে আসতেই কবির মির্জা পিছু ডাকলেন। ভীরু পায়ে আবার তার কাছে গেলাম। কঠিন গলায় বললেন, ‘তোকে ওয়াদা করতে হবে এই মির্জা বাড়িতে আর ঢুকবি না।’ আমি ওয়াদা করলাম। তাতেও তিনি ক্ষান্ত হননি। মির্জা বাড়িতে ঢুকার অপরাধে উঠোনের খঁা খঁা রোদে দঁাড়িয়ে আমাকে দশবার কান ধরে উঠবস করিয়ে ছেড়ে দিলেন। মনটা ভেঙে গেল। মানুষ এতো নিষ্ঠুর হতে পারে জানা ছিল না।
মির্জা বাড়ির আঙিনা মাড়িয়ে ভেজা চোখে সদর দরজার দিকে আসছি। পাশেই মির্জা বাড়ির বিশাল পুকুর। পুকুরে তাকাতেই একটা ভয়াবহ দৃশ্য দেখলাম। এই ভরদুপুরে কবির মির্জার ছেলে কামরুল পুকুরে ডুবে হাবুডুবু খাচ্ছে। ঝঁাপ দিলাম পুকুরে। হাবুডুবু খেতে খেতে তলিয়ে যাওয়া কামরুলকে টেনে তুললাম। এখনো বেঁচে আছে। পুরো মির্জা বাড়িতে আতঙ্ক সৃষ্টি হল। বাড়ির প্রতিটি সদস্য ব্যাকুল হয়ে ছুটে এলো ঘটনাস্থলে। কবির মির্জা ছেলেকে ধরে অঘোরে কাঁদছেন।
৩.
সকাল বেলায় আমাদের বাড়িতে কবির মির্জার আগমন দেখে বাবা উৎসুক গলায় বললেন, ‘আরে, গরীবের বাড়িতে হাতির পা।’
বাবা ঘর থেকে চেয়ার এনে কবির মির্জাকে বসতে দিলেন। চেয়ারে বসতে বসতে কবির মির্জা তরল গলায় বাবাকে বললেন, ‘শোনো জলীল, তোমার পোলা গতকাল আমার ছেলের জীবন বঁাচিয়েছে। ও না দেখলে আমার ছেলে পুকুরে ডুবে মারা যেত।’ বাবা ম্লান হাসলেন। কবির মির্জা আবার বললেন, ‘তোমরা তো অনেক গরীব। দিনে এনে দিনে খাও। তোমার পোলা যেহেতেু আমার ছেলের জীবন বঁাচিয়েছে, আমি তোমার পোলার সব দায়িত্ব নিতে চাই। তোমার পোলা আজ থেকে আমাদের মির্জা বাড়িতে থাকবে। কী বলো!’ বাবা হেসে বললেন, ‘আপনি চাইলে সব হবে।’ কবির মির্জা চেয়ার থেকে ওঠে দঁাড়িয়ে বললেন, ‘ডাকো তোমার পোলাকে।’
আমাকে কবির মির্জার সামনে আনা হল। কবির মির্জা আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘চলো। ব্যাগ গুছিয়ে নাও। আজ থেকে তুমি মির্জা বাড়িতে থাকবে।’ আমি আন্দোলিত গলায় বললাম, ‘না যাব না মির্জা বাড়ি।’ চোখ কপালে তোলে কবির মির্জা জানতে চান, ‘কেন? তুই জানিস মির্জা বাড়ি এক নজর দেখার জন্য কত মানুষ ব্যাকুল?’ প্রতিবাদি গলায় বললাম, ‘আমিও ব্যাকুল ছিলাম। কিন্তু কাল আপনি আমাকে ওয়াদা করিয়েছেন আর যেন ওই বাড়িতে না যাই। দশবার কান ধরে উঠবসও করিয়েছেন। সরি, আমি আমার ওয়াদা ভঙ্গ করতে পারব না।’ কবির মির্জা চুপ হয়ে গেলেন। তারপর চলে যেতে যেতে বললেন, ‘ফকিরদের এতো মেজাজ ভালো নয় কিন্তু।’
কবির মির্জা চলে যাবার পর বাবা আমার কাছে এসে ঝাড়ি মেরে বললেন, ‘তুই মির্জা সাহেবরে এভাবে অপমান করলি?’ বাবার প্রশ্নের পাল্টা জবাব দিয়ে বললাম, ‘যারা অহংকারি, তাদের অপমানই প্রাপ্য।’ বাবা কোনো কিছু না বোঝে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী