জোবায়ের রাজু
সেনাপাড়া বাজারের মোড়ে ডান হাত কাটা যে বয়স্ক মহিলাটি বসে বসে গলা ফাটানো আর্তনাদ করে ভিক্ষা করছে, তাকে দেখে আমার বুক ধক করে উঠল। এর চেহারা অনেকটা হাসি খালার মত। হাসি খালা নয়তো! হ্যাঁ হাসি খালাই তো। কিন্তু তার এই হাল কেন! দু পয়সা পাবার আশায় বিরামহীন গলায় অবিরত বলে যাচ্ছেন-‘দুটো টাকা ভিক্ষা দেন গো!’ তার পাশে গিয়ে ঠায় দাঁড়ালাম। ভুল দেখছি না তো! ইনি হাসি খালা হলে এখানে কেন? এ মহিলার মাথার সমস্ত চুল পেকে গেছে। হাসি খালার চুল সাদা ছিল। তাছাড়া এ মহিলার ডান হাত কাটা। হাসি খালার দু হাত ছিল। আমার কোথাও ভুল হচ্ছে না তো! ভুল না শুদ্ধ, সেটা যাচাই করতে ছোট্ট করে বললাম-‘কে, হাসি খালা?’ চোখ বড় বড় করে বিস্মিত চোখে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে কৌতুহলী গলায় বলল-‘হ্যাঁ, তুমি কে বাবা? আমায় চিনো?’
না। আমার অনুমান ভুল নয়। এ হাসি খালাই। কিন্তু তার হাতের এই হাল কেন? পথেও বা বসে গেলেন কেন? দশ বছর আগে এই হাসি খালা আমাদের বাড়িতে কাজ করতেন। সবাই তাকে বুয়া বলে ডাকলেও আমি তাকে হাসি খালা ডাকতাম। হাসি তার নাম কি না!
এই হাসি খালার প্রতি আমার মায়ের ছিল অগাধ বিশ্বাস। যে কারণে আমার বিশাল পরিবারের সবাই হাসি খালাকে ‘বুয়া’ ডাকলেও মা তাকে ‘আপা’ ডাকতেন। আমাদের স্বচ্ছল পরিবারে কাজের বিনিময়ে একটুখানি মাথা নোয়াবার ঠাঁই খুঁজতে অসহায় হাসি খালা সকাল সন্ধ্যা কি নিরন্তর পরিশ্রমই না করতেন। আজো সেটা মনে আছে। মা তাকে এমন সব শাড়ি কিনে দিতেন যে সেগুলি পরলে হাসি খালাকে কখনোই আমাদের ঘরের বুয়া মনে হতো না। মনে হতো আমাদের পরিবারের একজন। দক্ষ হাতে পুরো সংসার সামলে নেয়ার কি আপ্রাণ চেষ্টাই না থাকত তার। নদী ভাঙনে ঘর বাড়ি হারাবার পর বৃদ্ধ বাবা মাও মারা গেলেন হাসি খালার। ভাগ্যের পরিহাসে আমাদের পরিবারের ঠিকানা পেয়ে গেলেন।
আমাদের পরিবারে হাসি খালার বসবাস যখন সাড়ে চার বছর, তখনই এক সকালে হাসি খালা নিখোঁজ। সারা বাড়িতে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। বাবা আবিষ্কার করলেন কাল রাতে আলমারিতে তুলে রাখা তার বেতনের পুরো পনের হাজারের বান্ডিলটা নেই, যা আলমারিতে ভরে রাখতে হাসি খালার চোখে পড়েছে বলে বাবা স্বয়ং নিজেই দেখেছেন। ধীরে ধীরে আমরা জানলাম হাসি খালা সেই পনের হাজার টাকা নিয়ে রাতের অন্ধকারে উদাও। বাবা রাগী গলায় মাকে বললেন-‘আমি আগেই টের পেয়েছি এই মেয়ের হাত খারাপ। তুমি ওকে বিদায় করে দাও। আমার কথা শুনলে না। এবার শিক্ষা পেলে তো?’ মা কোন কথা না বলে মলিন মুখে নিরব ভূমিকা পালন করতে লাগলেন। হাসি খালার এমন কর্মকান্ড আমার মত মাও হয়তো প্রত্যাশা করেননি।
কিন্তু আজ এত বছর পর সেই মানুষটার সাথে এই অচেনা সেনাপাড়া বাজারে দেখা হয়ে যাবে, জানতাম না। অফিসের পোষ্টিং নিয়ে আমি এখানে এসেছি। হাসি খালা জিজ্ঞাসু সুরে বললেন-‘তুমি কে গো? আমার নাম জানো দেখছি।’ জবাব দিলাম-‘আমি শুভ। নয়নপুরের শুভ। চিনেছো?’ হাসি খালা হা করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎ তিনি বসা থেকে উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে উঁচু গলায় কাঁদতে লাগলেন। এমন একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হবো, ভাবিনি।
-তোমার এ হাল কেন খালা?
-শাস্তি। আল্লাহ আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন।
-শাস্তি?
-হ্যাঁ। দশ বছর আগে তোমাদের আলমারি থেকে পনের হাজার টাকা চুরি করে রাতের অন্ধকারে রেল স্টেশনে ছুটে গেলাম পালিয়ে যেতে। ভোরের ট্রেনে চেপে বসলাম। যে বগিতে আমি উঠলাম, সেখানে তিনটি মাস্তান আমার কাছে এতগুলি টাকা দেখে তারা লোভি হয়ে উঠে। আমি শক্ত করে টাকাগুলি চেপে ধরি। কিন্তু ওদের সাথে পেরে উঠি না। ওরা জোর করে টাকাগুলি ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে চলন্ত ট্রেনের বগি থেকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দেয়। ট্রেনের চাকায় কাটা পড়ল আমার ডান হাত। জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি হাসপাতালে। কে সেখানে নিয়েছে আমায়, আজো জানি না।
-তোমার জীবনে এত বড় ঘটনা ঘটে গেল?
-হ্যাঁ। সেদিন রাতে টাকাগুলি চুরি করে যে তোমাদের ক্ষতি করেছি, আল্লাহ সে একই ক্ষতি আমার করেছেন। আমার ডান হাত..।
গভীর বেদনায় কাঁদতে লাগলেন হাসি খালা। পৃথিবী গোলাকারই। তা না হলে আজ এত বছর পর হাসি খালাকে এখানে দেখব কেন? যে হাসি খালাকে সব দেখতাম ভিক্ষা বৃত্তিকে ঘৃণা করতে, ভাগ্যের নির্মম পর্যায়ে এসে সে হাসি খালাই আজ বাজারের মোড়ে বসে থাকা অসহায় ভিখারি। পনের হাজার টাকা হারিয়ে গেছে বলে আমাদের সেভাবে বড় কোন ক্ষতি হয়নি, কিন্তু এ চুরির বিচার আল্লাহ এমনভাবে করেছেন যে হাসি খালার জীবনে সব চেয়ে বড় ক্ষতি হয়ে গেল। হাত ছাড়া একজন মানুষ কতটা অসহায়, হাসি খালা তার প্রমাণ।
কান্না মাখা গলায় হাসি খালা বললেন-‘তোমার মা কেমন আছে? ভাবী সাহেবারে প্রায়ই স্বপ্নে দেখি। এখনও কী উনার কোমরে বাতের ব্যথা উঠে?’ জবাব না দিয়ে আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। এক বছর আগে আমার মা যে ক্যান্সারের কাছে হার মেনে আকাশের তারা হয়ে গেছেন, এ খবরটি হাসি খালাকে দিতে ইচ্ছে করল না।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।