জহিরুল ইসলাম
বৃষ্টি ভেজা মধ্যরাত!শুনসান নিরবতা আর জমকালো অন্ধকারে গুটি গুটি পায়ে জঙ্গলের পথ ধরে হেঁটে চলছে একদল ক্ষুদে যোদ্ধা।আবীর,অভি,অনল,অনিক আর আদনান পাঁচ তরুণ একসাথে একই স্কুলে পড়াশোনা করে।স্কুলে ওদের সবাই পঞ্চপাণ্ডব বলেই চিনে এবং ডাকে।পাঁচ বন্ধুর মাঝে গলায় গলায় ভাব দেখে অনেকে মনে মনে ওদের ঘৃণার চোখে ও দেখে এতে অবশ্য ওদের সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়ে না।হঠাৎ একদিন স্কুল বন্ধ হয়ে যায় কোন পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই!অবাক হয় ওরা এরপর জানতে পারে দেশে যুদ্ধ লেগেছে। পঁচিশে মার্চ রাতে একদল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী রাজধানীতে ঘুমন্ত মানুষের উপর নির্বিচারে গুলি চালায়।গ্ৰেফতার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।এই ক্ষোভে ফুঁসে উঠছে পুরো বাংলার আমজনতা। আবীর ছুটে যায় অভির বাড়িতে।অভি মন খারাপ করে বসে আছে আম গাছের তলায়। দুইজনে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করে কিছুক্ষণ এরপর ছুটে যায় একে একে অনল অনিক আর আদনান এর কাছে।পাঁচ বন্ধু মিলে স্কুলের জামতলায় বসে সিদ্ধান্ত নেয় ওরা ও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে।যেই ভাবা সেই কাজ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি ও প্রয়োজনীয় যুদ্ধের সরঞ্জামের জন্য ওরা জসিম চাচার শরনাপন্ন হয়।জসিম চাচা প্রথমে ওদের বারণ করে কিন্তু শেষে ওদের আবদার আর জেদের কাছে হার মেনে রাজি হয় জসিম চাচা।ওদের সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিয়ে ভিন্নভাবে যুদ্ধ করার কথা বলে তিনি।ওদের পাঁচজনকে একটি দলে ভাগ করে দিয়ে ওদের কাজ বুঝিয়ে দেন জসিম চাচা।ওদের দলের নাম “পঞ্চপাণ্ডব ক্ষুদে যোদ্ধা।”
১৯ই আগষ্ট পরানপুর হাই স্কুলে পাক হানাদাররা ঘাঁটি স্থাপন করেছে।গ্ৰামের প্রভাবশালী চেয়ারম্যান আমজাদ আলীর সহযোগিতায় গ্ৰামে গ্ৰামে পাক সেনারা হানা দেয়। এলাকার চিহ্নিত মুক্তিযোদ্ধাদের বসত বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়,হাঁস মুরগি গোরু ছাগল যার যা পায় তাই ধরে নিয়ে আসে।মাঝে মধ্যে গ্ৰামের যুবতী নারীদের ধরে নিয়ে এসে অমানবিক নির্যাতন চালায়।পুরো গ্ৰামটি পাক হানাদারদের দখলে জনশূন্য প্রায় গ্ৰামটি।গ্ৰামের বিস্তৃত মাঠে ঘুড়ি উড়াতো আবীর সহ তার চার বন্ধুরা মিলে,গ্ৰামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে গোমতী নদীর অববাহিকা।সেখানে জেলেরা মাছ ধরতো সেই মাছ বাজারে উঠতো গ্ৰামের মানুষে গিজগিজ করতো হাট বাজার।আর এখন পুরো গ্ৰামে কেউ নেই যেনো মৃত্যুপুরী কোন এক ভূতুড়ে গ্ৰাম। আবীরদের সেই চিরচেনা মাঠ,স্কুল,রাস্তা সব কিছুই পাক সেনাদের কব্জায়।পুরো গ্ৰামকে দখল মুক্ত করতে তাই বদ্ধপরিকর হয়েছে পাঁচ তরুণ। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক পাঁচ তরুণ স্কুলের পিছনে ঘন জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে দুপুর থেকে। তাদের উদ্দেশ্য মধ্য রাতে তারা পাক হানাদারদের উপর আক্রমণ করবে।তাই আগে থেকেই প্রয়োজনীয় গোলা বারুদ গ্ৰেনেড সহ যুদ্ধের যাবতীয় সরঞ্জাম সংগ্ৰহ করে অপেক্ষা করতে থাকে। সন্ধ্যা হতে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরে আর তাতেই ঝিমিয়ে পড়ে পাক সেনারা।ক্যাম্পে রাজাকার সহ পাক সেনারা প্রায় সাতাশ জন।
রাত দেড়টা বাজে এমন সময় পাঁচ তরুণ পাঁচ দিক হতে এলোপাথাড়ি গুলি চালায় পাক সেনাদের উদ্দেশ্যে। কিছুই বুঝে উঠার আগেই এগারোজন পাক সেনা নিহত হয়।বাকিরা পাল্টে আক্রমণ করে কিন্তু পাঁচ দিক থেকে গুলি আসায় বুঝতে পারছিলো না ওরা। তবুও লড়াই চালিয়ে যায় হঠাৎ করে এক পাক সেনার গুলি এসে লাগে অনলের বুকের বাঁ পাশে। তীব্র চিৎকারে লুটিয়ে পড়ে অনল।হাতের ফিনকি দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে বৃষ্টি ভেজা মাটিতে।অনলের আগুন মাখা রক্তে রঞ্জিত হয় পরানপুর হাই স্কুলের ভেজা মাটি।প্রায় ২৫ মিনিট ধরে চলতে লাগা রণযুদ্ধের অবসান ঘটে।পাঁচ তরুণের এই রণযুদ্ধে নিহত হয় উনিশ পাক সেনা।বাকিরা পালিয়ে যায় রাতের অন্ধকারে।আবীর অভি আদনান অনিক মিলে আটক করে তাদের এলাকার চেয়ারম্যান আমজাদ আলীকে।হঠাৎ অভি বলে উঠে এই অনল কোথায় রে!চমকে উঠে সকলে রাতের অন্ধকারে খুঁজতে থাকে এদিক ওদিক।খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ আদনানের চিৎকারে সকলে একসাথে হয়। তাকিয়ে দেখে অনল সবুজ ঘাস হাতের মুঠোয় ধরে ঘুমিয়ে আছে চিরনিদ্রায় সেই ছুটে বেড়ানো স্কুল মাঠের মাটি আঁকড়ে ধরে।কান্নায় ভেঙে পড়ে আবীর অভি আদনান ও অনিক।
সকালের সূর্যের আলো গাছের ফাঁক দিয়ে এসে পড়ে অনলের বুকের বাঁ পাশে।লেপ্টে থাকা রক্তে সূর্যের আলো পড়তেই দৃশ্যমান হয় আরো একটি নতুন রক্তিম সূর্যের।যেনো সূর্যের আলোয় আলোকিত নতুন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি!পুরানপুর গ্ৰামের নতুন এক সূর্যের সূচনা হয়।পাক হানাদার মুক্ত হয় পরানপুর গ্ৰাম।আস্তে আস্তে মানুষজন ফিরতে শুরু করে।শুধু ফিরে আসে না অনল তার বন্ধুদের মাঝে।ছুটে বেড়ায় না অনল স্কুল মাঠে। আবীর অভি আদনান অনিক ওরা অপেক্ষায় থাকে অনল হয়তো আবার ও ফিরবে। দেশ স্বাধীনের পর অনল যেখানে মারা যায় সেখানেই নির্মিত হয় লাল রক্তিম শহীদ মিনারের স্মৃতিফলক।যার পাশেই লেখা
“ঘুমিয়ে আছে অনল এই চিরসবুজ ঘাসের বুকে!
মুক্তির কাণ্ডারী লাল সূর্য হয়ে থাকুক সে মহাসুখে!”
কুমিল্লা