গল্প : অচেনা অতিথি

গল্প : অচেনা অতিথি

জোবায়ের রাজু

 

মাগরিবের পর পরই বাবা বৃষ্টির জলে কাকভেজা হয়ে বাসায় ফিরলেন। বিকেলে বের হবার আগে মা কত করে বললেন তিন মাস আগে মারা যাওয়া স্বর্গবাসী দাদাজানের ব্যবহৃত কালো ছাতাটি নিয়ে বের হতে। কিন্তু বাবার এক বাক্য, তিনি তার পিতাজানের ছাতাটি শেষ স্মৃতি হেসেবে রেখে দিবেন, কখনো ব্যবহার করবেন না। শেষমেষ বাবা মায়ের অনুরোধকে গুরুত্ব না দিয়ে বিকেলের গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ছাতা ছাড়া বের হলেন ওই পাড়ার কার যেন শালিসের দরবারি করতে।
সন্ধ্যার পর সেখান থেকে ফিরে এসে বাবা জানালেন বৃষ্টির কারণে শালিসে আমন্ত্রিত গন্যমান্যজনদের কেউ ই আেেসনি।
বাবার শ্বাস কষ্টের সমস্যা আছে। বৃষ্টিতে তার এই ভেজাভিজির ব্যাপারটা মা অন্যদিন হলে বাবাকে জব্দ করে ছাড়তেন। সঙ্গে ছাতা না নেয়ার অপরাধে বাবাকে হেস্তনেস্ত করে মেজাজ বিগড়ে দিতেন। কিন্তু মা আজ তার বিপরীত। কারন বাবার পাশে কাক ভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আরেকজন মাঝবয়সি লোক। কে এই লোক? আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
আমি আমার ঘর থেকে দাঁড়িয়ে বারান্দায় দাঁড়ানো তিনজন লোকের কীর্তিকলাপ দেখছি। মা, বাবা আর অচেনা লোকটা। ফর্সা মুখ। উচ্চতায় বাবার সমান। বৃষ্টি জলে তিনিও বাবার মত কাক ভেজা হয়ে আছেন।
বাবা মাকে বললেন ‘শাহনাজ, একটা তোয়ালে এনে দাও। সোলায়মান ভায়ের বুকে ঠান্ডা লেগে যাবে।’ বাবার কথায় মা তোয়ালের জন্যে ঘরমুখি হলেন। পেছনে পেছনে বাবাও এলেন। আমি দেখলাম অচেনা লোকটি অর্ধভেজা কাপড় নিয়ে বারান্দার চেয়ারে বসে গেলেন। তার পর পরই তুমুল বেগে বাড়তে লাগল বৃষ্টি।

সৌদি আবর থেকে বড় দার পাঠানো লাল তোয়ালেটা আলমারি থেকে বের করতে করতে মা তিক্ত গলায় বাবাকে বললেন ‘কোথাকার কে না কে! এতো দরদ দেখাচ্ছো কেন?’ মায়ের এমন কথায় বাবা অন্যদিন হলে রেগে মেগে আগুন হয়ে যেতেন। কিন্তু কেন জানি বাবা নরম গলায় বললেন, ‘আহা শাহনাজ, লোকটি বিপদে পড়েছে, বিপদে পড়লে মানুষের পাশে তো মানুষকেই দাঁড়াতে হয়…।’ কথা শেষ না করে বাবা তোয়ালে নিয়ে বারান্দায় চলে গেলেন।
মায়ের কাছে বিস্তারিত সব শোনলাম। বাবা একটু আগে বাসায় ফেরার সময় বাড়ির পাশে বটগাছের নিচে লোকটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। লোকটি টেকনাফ থেকে এসেছেন। পাওনা টাকার জন্যে তাকে ফোন করে এখানে আনা হয়েছে। কিন্তু এখানে এসে দেখেন ওপর প্রান্তের ফোন বন্ধ। ভদ্রলোক নিরুপায়। তার উপর বর্ষাকালের সন্ধ্যা। টেকনাফ দূরের জেলা। এখন কি করবেন, বুঝতে পারছেন না তিনি। বাবা বাড়ি ফেরার সময় বটতলায় অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোকের অসুবিধার কথা শুনে তাকে বাড়িতে নিয়ে এলেন। প্রথমে নাকি ভদ্রলোক আসতে নারাজ ছিলেন, পরে বাবা এক রকম টেনে হেঁচড়ে বাড়িতে নিয়ে এলেন।

২.
ভদ্রলোককে তোয়ালে দিয়ে এসে বাবা ইনহেলার খুঁজে দেয়ার জন্যে মাকে তাগিদ দিলেন। তার নাকি শ্বাস কষ্ট বেড়েছে।
ইনহেলার ব্যবহারের পর বাবা মাকে উচ্ছাস গলায় বললেন ‘শাহনাজ, সোলায়মান ভাই আজ রাতটা এখানে থাকবেন। ফ্রিজে মাংশ আছে না? চুলোয় বসিয়ে দাও।’ মা চোখ কপালে তুলে বললেন ‘কি বলছো, কোথাকার কে না কে, রাতে এখানে থাকবে মানে?’ মায়ের কথাকে তাচ্ছিল্যে অবহেলা করে বাবা বললেন ‘অযথা তর্ক করো না? যাও মাংশ চুলোয় দাও।’
কিচেনে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে মাংশ রান্না দেখছি। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। বারান্দায় বসে বাবা আর বিপদে পড়া লোকটি গল্পের আসর তুলেছেন। লোকটির গায়ে এখন আর ভেজা কাপড় নেই। বাবা তার লুঙ্গি আর খয়েরি ফুলহাতা শার্টটি তাকে বের করে দিয়েছেন।
যেন দুজন দুজনকে ম্যালা দিন আগ থেকে চিনতেন, এমন ভঙ্গিমায় বাবা আর বিপদে পড়া লোকটি গল্প করছেন। আমি দুজনের গল্পের আসরের এক পাশে বসে আমাদের আজ রাতের অচেনা অতিথির গল্প শুনছি। তিনি বেশ সুমন্দভাষী বলতেই হবে। কথায় দারুণ মাধুর্যতা। আমাদের স্কুলের মোমিন স্যারের মত সুন্দর করে কথা বলেন।
বাইরে বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। বারান্দার টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে এক অন্য রকম অনুভুতি জাগছে। তবুও আমি বৃষ্টি দর্শনে মনোযোগী না হয়ে বাবার পাশে গল্প করা লোকটির জাদুকরি কথা বলার ক্ষমতা দেখে যাচ্ছি।
গল্পের ফাঁকে ফাঁকে তিনি তার ব্যক্তি জীবনেরও নানান প্রসঙ্গ টানলেন। বৈবাহিক জীবনের তেইশ বছর পার হবার পরও সন্তানের বাবা হতে পারলেন না বলে তার আক্ষেপের অন্ত নেই। একটা ছেলেকে নাকি দত্তকও নিয়েছেন। কিন্তু ছেলের বয়স চার পূর্ণ হবার দেড় মাস আগেই খিঁচুনি রোগে সে মারা যায়। আমি আর বাবা স্পষ্ট দেখলাম দত্তক সন্তানের মৃত্যুর শোক তার সমস্ত অবয়ব জুড়ে। বাবা তাকে সান্তনা দেবার আগেই তিনি আমাকে বললেন ‘কি গো বাবু, নাম কি তোমার?’ আমি ছোট্ট করে বললাম ‘বাবলু।’ লোকটি চেহারা বিষন্ন করে বাবাকে বললেন ‘আমার ছেলেটার নাম ছিল বাদল। আপনার ছেলের নামের প্রথম অক্ষরে নাম।’ বাবা শান্ত গলায় বললেন,‘মরনে কারো হাত নেই। মন খারাপ করবেন না।’ এমন সময় বিকট শব্দের এক বজ্রপাত হল। কিচেন থেকে পিলে চমকে উঠলেন মা। বাবা আর লোকটি মনে মনে দোয়া পড়তে লাগলেন। বজ্রপাতে সব চেয়ে আমি ভয় পেয়েছি, সেটা কাউকেই বুঝতে দিইনি।
বারান্দাতে পাটি বিছিয়ে মা রাতের খাবারের আয়োজন করলেন। খুব অল্প সময়েও রান্নার কাজ শেষ হয়ে গেল। আমাদের রাতের অচেনা অতিথি মায়ের রান্নার প্রশংসার বুলি শোনাতে লাগলেন। এমন আহামরি রান্না নাকি আজকাল বড় বড় হোটেলেও পাওয়া দুষ্কর। মায়ের অন্যদিনের তুলনায় আজকের মাংশ রান্না সেভাবে ভালো হয়নি, তবুও লোকটি মাংশ রান্নার গুণকীর্তন গেয়ে গেলেন কি উচ্ছাস গলায় ‘আহা ভাবি সাহেবার রান্নার কোন তুলনা হয় না। আমার বউটা না পারে রান্না না পেরেছে সন্তান জন্ম দিতে। বেচারির জীবন গেল বিউটি পার্লারে গিয়ে ভুত সেজে আর গান গেয়ে।’ খুব অবাক করা কোন কথা বলেননি লোকটা, তবু বাবা অবাক হয়ে বললেন ‘ভাবি সাহেবা গান পারেন?’ অবহেলার সুরে তিনি বললেন ‘গান ছাড়া আর কি বা পেরেছে ওই ধনীর দুলালি! বিয়ের পর থেকে রোজ ভোরে তার গলা সাধার কর্কশ শব্দে ঘুম ভাঙ্গে। টিভিতে প্রায়ই শো করে। কোন কোন ছবিতেও নাকি গান করেছে।’ বাবা আগ্রহের সুরে বলতে লাগলেন ‘বাহ, গান পারা খুব যোগ্যতার কাজ।’
রাতের খাবার শেষে মা খুব আয়োজন করে পানের ব্যবস্থা করলেন। পানদানিতে কাঁচা সুপারি আর শুকনো সুপারিও দেখা গেল।
অনেক রাত পর্যন্ত বাবার আমাদের রাতের অতিথির গল্প পর্ব চলল। রাত প্রায় বারোটার দিকে মা বড় দার শোবার ঘরে লোকটির ঘুমানোর ব্যবস্থা করলেন। বিছানায় নতুন কভারের পাশাপাশি বালিশেও নতুন কভার লাগিয়ে দিলেন। যত্ন করে মশারি টাঙানোর পর মা নিজেই খাটের নিচের বাম পাশে একটি কয়েল জ্বালাবার আয়োজন করলেন।
বাবা যখন লোকটাকে নিয়ে বড় দার ঘরে এলেন, লোকটি তার ঘুমানোর এত সু ব্যবস্থা দেখে বাবাকে জড়িয়ে ধরে আবেগে আপ্লুত হয়ে কাঁপা গলায় বললেন, ‘আপনাদের আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ ভাইজান। আমাকে চিনেন না জানেন না, অথচ এতো আপনের মত আশ্রয় দিয়েছেন। এ ঋণ কিভাবে শোধ করব…!’ বাবা মিহি গলায় হেসে বললেন ‘কি বলছেন ভাইজান, বিপদে পড়লে মানুষের পাশে মানুষকেই তো দাঁড়াতে হয়। চোখ মুছে ফেলেন।’
আমি আর মা পাশের ঘর থেকে বাবা আর লোকটার আলাপ শুনছি। মা বললেন ‘দেখেছিস বাবলু, লোকটার দিল কত্ত নরম। কেঁদে দিয়েছে। আমার তো প্রথমে তাকে কেমন জানি ভালো মানুষ মনে হয়নি। এখন দেখি পুরাই মাটির মানুষ।’ আমি হেসে বললাম, ‘মানুষটা কিন্তু সুন্দর করে কথা বলতে পারেন মা।’ মা হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

৩.
রাত বাড়ার সাথে সাথে আমরা যে যার ঘরে ঘুমোতে চলে গেলাম। মাঝ রাতে আকাশ ভেঙ্গে আবার বৃষ্টি নামলো। কখন যে ঘুমে তলিয়ে গেলাম বুঝতেই পারিনি।
ঘুম ভাঙ্গলো একেবারে পাখি ডাকা ভোরে মায়ের চেঁচামেঁচিতে। মা উচ্চস্বরে বলতে লাগলেন,‘একি, দরজা খোলা কেন! তোমরা রাতে ঘুমোতে যাবার আগে দরজা বন্ধ করোনি? ওমা! আলমারিটাও খোলা কেন? ওগো শুনছো, আলমারিটা খোলা। ভেতরের জিনিসপত্রগুলি এলোমেলো করেছে কে?’ বাবা ঘুম চোখে বিছানা ছেড়ে উঠে এলেন। আলমারির ভেতরে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বাবা দেখলেন গত পরশুদিন তিনি ব্যাংক থেকে যে তিনলাখ টাকা তুলেছেন, সেগুলি নেই। সাথে মায়ের গয়নার বাক্সটিও উদাও।
মা কোন ফাঁকে এক দৌড়ে বড় দার ঘরে গিয়ে দেখেন আমাদের কাল রাতের অতিথি সে ঘরে নেই। না কোথাও নেই। মা আবারও চিৎকার করে ডাকলেন ‘এ্যই দেখে যাও, কাকে রাতে আশ্রয় দিয়েছো? সে এখন কই? সব লুট করে ভাগছে। ও আল্লাহ, এখন কি হবে!’
মায়ের চেঁচামেঁচি শুনে আমি আর বাবা বড় দার ঘরে ছুটে গিয়ে দেখি আমাদের কাল রাতের অচেনা অতিথি নেই। টাকা পয়সা আর স্বর্ণালংকার লুট করে কখন যে পালিয়ে গেছে। বাবা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন ‘আর মানুষকে বিশ্বাস করব না। মানুষকে বিশ্বাস করলে সে ক্ষতি করে।’
তিন লাখ টাকার জন্যে নয়, মা তার অলংকারের জন্যে চিকন সুরে কাঁদতে লাগলেন। কারন এই অলংকারগুলি তিনি বড় দার বউয়ের জন্যে আগে ভাগে কিনে রেখেছেন। আগামী মাসে বড় দা সৌদী আবর থেকে দেশে ফিরলে তার বিয়ের আয়োজন করা হবে।

 

আমিশাপাড়া, নোয়াখালী, বাংলাদেশ ।

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
ভালোবাসি বাবা [ কবিতা ]

ভালোবাসি বাবা [ কবিতা ]

তানভীর আহমেদ তপু হয়নি বলা কিছু কথা বাবা, হয়নি বলা ভালোবাসি। বাবা তুমি মানুষ নও! তুমি আমার জীবন ডায়েরির পাতায় রটানো অসংখ্য ভালোবাসায় জড়ানো মহান ...
How I Learned to Stop Worrying and Love Stock Market

How I Learned to Stop Worrying and Love Stock Market

Cursus iaculis etiam in In nullam donec sem sed consequat scelerisque nibh amet, massa egestas risus, gravida vel amet, imperdiet volutpat rutrum sociis quis velit, ...
খুন | অগ্নি কল্লোল

খুন | অগ্নি কল্লোল

| অগ্নি কল্লোল   নবীন আজাদ একজন খুনি? খুন। অসুন্দর। খুন। মিথ্যা। খুন। পৈশাচিক। খুন। অ-শৈল্পিক। খুন। অন্যায়। শহরের রাস্তায় হাঁটতে থাকে নবীন আজাদ। মগজে ...
জন্মদিনের শুভেচ্ছা (২০২৪)

জন্মদিনের শুভেচ্ছা (২০২৪)

শুভেচ্ছা। নিশ্চয়ই আপনার প্রিয় মানুষ প্রিয় বন্ধু কিংবা প্রিয়জনের জন্মদিন আজ? তাকে উইশ করতে চাচ্ছেন ভালো একটি শুভেচ্ছা বার্তা? চিন্তা কিসের? ছাইলিপি তো আপনাদের সাথেই ...
ছোটগল্প -  ত্রিকালের চাকা

ছোটগল্প – ত্রিকালের চাকা

পার্থসারথি স্যার, আসসালামু আলাইকুম। কন্ঠটা বেশ পরিচিত মনে হলো। পেছন ফিরে তাকাতেই রিক্সাওয়ালা রফিক মিষ্টি হেসে জিজ্ঞ্যেস করলো- কেমন আছেন স্যার?- মুখে মাস্ক পরে থাকায় ...
ছোটগল্প- চশমা

ছোটগল্প- চশমা

শুভাঞ্জন  চট্টোপাধ্যায় লেন্স খুলে পড়া চশমার ফ্রেমটা নিয়ে কিছুক্ষণ নিবিষ্ট মনে খুটুরখাটুর করার পর শেষমেশ মুখটা ব্যাজার করে ভদ্রলোক বললেন, ‘ না দাদা, এ জিনিস মিউজিয়ামে ...