সুমিত রায়
বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে আজ লালবাবা আশ্রমের মাঠে রথযাত্রা উৎসব। একটানা কয়েকদিন ধরে বৃষ্টির মধ্যেই চলছে উৎসবের সাজো সাজো রব। মন্দিরের সামনের ফাঁকা মাঠে চলে রথের দড়ি টানাটানি, আর তাকে ঘিরেই বসে মেলা। কর্দমাক্ত মেলা প্রাঙ্গণে উপচে পড়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা দর্শনার্থীদের ভিড়। মেলায় যদিও বড় মেলার মতন নাগরদোলা, সার্কাস কিছুই আসে না কিন্তু মেলা জমে ওঠে খাবার আর খেলনার দোকানে। আজ সকাল থেকেই কালো কালো মেঘেদের দল সূর্যকে আড়াল করে রেখেছে- যেন সূর্যকে উঁকি দিতেই দেবেনা- আজ। সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ সকলকে এক চিন্তায় ডুবিয়ে রেখেছে। সকলের একই কথা,-‘ কি হবে বিকেলে অর্থাৎ রথ টানার সময়?’
আবার সকলের মনের ইচ্ছা- বৃষ্টি হলেও মেলা যাবে, রথের দড়ি টানবে। সেইরকমই ইচ্ছায় দুপুর পার করলো অরূপ।
এই বছরই কলেজে ভর্তি হয়েছে অরূপ। শরীরে, মনে এক উষ্ণ অনুভুতি। ভরা যৌবনে হাবুডুবু করতে থাকা অরূপ প্রায় সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মত্ত। বাড়িতে শুধু খাবার সময়টুকু আসা। এককথায় খামখেয়ালীপনা অরূপ বাড়ির সকলের কাছে বকুনি খাবার পাত্র। মা রেগে গিয়ে সব সময় বলতে থাকেন,-‘কলেজে ভর্তি হয়ে যেন তার দুটো পাখনা হয়েছে, একমুহূর্ত বাড়িতে থাকতে চায় না।’
বাবা চাকরিসূত্রে বাইরে থাকে তাই বাবার বকুনি থেকে রেহাই।
বিকেল হতেই আকাশ পুরো কালো করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হল। ইতিমধ্যে মেলায় না যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে অরূপের সব বন্ধুরা। তারা সবাই বৃষ্টির মধ্যে বিছানায় অলস চোখে দিবানিদ্রায় মগ্ন, কিন্তু অরূপ মেলা যাবেই।জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে কোনদিন রথের মেলা যাওয়া বাদ দেয়নি, একা হলেও যাবে সে। বৃষ্টির মধ্যেই অরূপ রওনা হয় লাল বাবার আশ্রমের মাঠে। মূল ফটক পার হয়ে সে আস্তে আস্তে ভিড় ঠেলে ভিতরে কোন রকমে প্রবেশ করল এবং একটু ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ালো।অসম্ভব ভিড়ের মধ্যে সকলের মাথা উপেক্ষা করে অরূপের চোখে ধরা দিলো- একটি মেয়ে, যে কাঁদার মধ্যে একটি বস্তার উপর দুটো টমটম গাড়ি রেখে দাঁড়িয়ে আছে -তীর্থের পাখির মত। তার শরীর সম্পূর্ণ ভিজা। বসার জায়গাটা কাঁদায় ভর্তি। মুখে করুণ চিন্তার রেখাপাত।মুখের হাসি যে অনেক দিন আগেই তার বন্ধ হয়ে গেছে, তা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ষোড়শীর যুবতীকে দেখে অরূপের মন কেমন হয়ে গেল।মেয়েটিকে এভাবে কাঁদায় দাঁড়িয়ে- টমটম গাড়ি বিক্রি করতে দেখে, অরূপের মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক করতে লাগলো। একপা-দুপা করে এগোতে এগোতে, একসময় মেয়েটির দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো, অরূপ। সামনে দাঁড়াতেই, মেয়েটি এক টুকরো আশার সাথে বলে উঠলো,-‘নিবে, দাদাভাই টমটম গাড়ি?’
মায়াভরা মেয়েটির কথায় অরূপের ভেতর এক মায়ার তড়িৎ খেলে গেল। নিশ্চুপ অরূপ একসময় বলল,-‘হ্যাঁ, নিব, কত দাম?’
-‘একটা কুড়ি টাকা।’
‘আমাকে তুমি দুটো গাড়িই দিয়ে দাও।’ বলেই পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে দিলো মেয়েটির হাতে। টমটম গাড়ি সবকটা বিক্রি হয়ে গেল! এটা ভেবেই হয়তো মেয়েটির চোখে মুখে একটু হাসি ফুটল। খামখেয়ালীপনা, দায়িত্বজ্ঞানহীন অরূপ আস্তে আস্তে নিজেকে যেন পাল্টাতে লাগল।
উৎকণ্ঠার সাথে সে জিজ্ঞেস করল,-‘এই টমটম গাড়িগুলো কে তৈরি করে?’
‘আমি আর আমার মা।’ মায়াবী স্বরে বলল,সে।
‘তোমার বাবা নাই?’
‘না, বাবা, আমার মাকে ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে গেছে। মার শরীরও খুব একটা ভালো না।’
দুটা পাঁচ টাকার কয়েন ফেরত দিতেই অরূপ বলে উঠলো,-‘না, না ওটা থাক তোমার কাছে। আমি আবার উল্টো রথে আসবো। তুমি আসবে তো উল্টো রথে?’
‘আসবো।’
অপরূপ মুখশ্রী, মিষ্টি কথা আর তার পরিবারের কষ্টের কথায়- অরূপ, মেয়েটিকে মনের খুব কাছে টেনে ফেলল। বলল,-‘তোমার নাম কি?’
‘রুপসা।’
‘ভারী মিষ্টি নাম তোমার।’
এই কথা শুনে মেয়েটি লাজুক চোখে, ঠোঁটের কোনায় হাসি চেপে, মাথা নিচু করে ভেজা বস্তাগুলো ঠেসে ঠেসে একটা ব্যাগে ঢুকালো। তারপর ছেঁড়া, হাতল ভাঙ্গা ছাতা খুলে মেয়েটি রওনা দিলো রাস্তা ধরে। হাত নেড়ে বলল,-‘আবার দেখা হবে।’
অরূপ তার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো, যতক্ষণ ধরে বৃষ্টি ধারায় সে অদৃশ্য হলো রাস্তার বাকে।
মধ্যবিত্ত পরিবারের অরূপ, দুটা টমটম গাড়ি কিনে বাড়ি এল, মা জিজ্ঞেস করল,-‘দুটা গাড়ি কি করবি?, তোর কি এখনো টমটম গাড়ি খেলার বয়স আছে?, বাচ্চামী স্বভাবটা এখন একটু পাল্টা -বুঝলি। রমার ছেলেদুটা মেলা যাওয়ার জন্য বিকেল থেকে খুব কাঁদছে, বৃষ্টির জন্য যেতে পারে নাই, ওদের টমটম গাড়িগুলো দিয়ে দে।’
‘না,না, এই টমটম গাড়িগুলো কাউকে দেওয়া যাবে না।’
‘কেন? টমটম গাড়ির মধ্যে, এমন কি আছে- যে দেওয়া যাবে না।’
‘এখানে আমার সব আছে। সময় এলে বুঝতে পারবে।’
‘তা তুই যা করবি, কর।’এই বলে মা রান্নাঘরে চলে গেলেন।
অরূপ পড়ার ঘরে টমটম গাড়ি দুটো টেবিলের উপর পরপর রাখতেই, মেয়েটির মায়াবী মুখ বারবার ভেসে উঠছে। কি অপূর্ব মেয়েটির মুখশ্রী, যেমন সুন্দর কথাবার্তা তেমনি সুদৃশ্য তার লাজুক চাওনি। সহজ, সরল মেয়েটি কত তাড়াতাড়ি তাকে একদম কাছে টেনে নিয়েছে। অরূপ ধীরে ধীরে মেয়েটিকে ভালবাসতে শুরু করল। সময় যত যাচ্ছে মেয়েটি যেন অরূপের আরও গভীরে প্রবেশ করছে। দেখতে দেখতে উল্টো রথের সময়ের ঘন্টা বাজতে শুরু করলো। অরূপ আবার উল্টো রথে যাবে, রূপসার সঙ্গে দেখা করার জন্য।
আজও সকাল থেকেই প্রচন্ড বৃষ্টি সঙ্গে মেঘের গর্জন অনবরত শোনা যাচ্ছে। মেলার মাঠ কাঁদায় ভরে গেছে। অরূপ কাঁদার মধ্যেই দাঁড়িয়ে খুঁজে চলছে তার প্রিয়তমা রুপসাকে। প্রতিটা দোকানে চোখ রাখছে, কিন্তু কোথাও রুপসাকে দেখা পেল না, অরূপ। ঠিক যতটা আশা নিয়ে এসেছিল আজ, ঠিক ততটাই মনে কষ্ট নিয়ে বাড়ি ফিরছে, অরূপ। বাড়ি ফেরার সময় জগন্নাথ ঠাকুরের কাছে জোড়হাত করে, প্রার্থনা জানায়,-‘মেয়েটির যেন কোনো ক্ষতি না হয়- হে পরম পিতা,তুমি রক্ষা করো- ঠাকুর…..।’
বারবার মনের ভেতর প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে- ‘কি হলো?, সে তো বলেছিল উল্টো রথে আসবে। দেখা হবে। কিন্তু এলো না কেন?’
অরূপ অস্থির হয়ে উঠল। সেদিনের রূপসার প্রতিটা কথা ক্রমশ আরও প্রকট হতে শুরু করল।
সারাটা রাত অরূপ অস্থিরভাবে কাটিয়েছি। অন্যদিনের চাইতে সে আজকে অনেকটাই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছে। মুখটা ভার! একা বারান্দায় বসে চিন্তা করছে আর ভাবছে কালকের ঘটনা। মা টেবিলের উপর চা রেখে চলে গেলেন। চায়ে চুমুক দিতেই আজকের পেপারে থাকা একটি শিরোনাম মোটা অক্ষরে লেখা,-‘আগুন নেভালো বৃষ্টি!’চোখে পড়তেই, অরূপ চমকে ওঠে। তাড়াতাড়ি পেপারটা টেনে পড়তে শুরু করল ঘটনাটা –
” উল্টো রথের মেলায়, এক যুবতি কিছু টমটম গাড়ি বিক্রির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল। অবিরাম বৃষ্টিতে মেয়েটিকে একা একা আসতে দেখে, কয়েকজন মদ্যপ যুবক, অসহায় যুবতীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল- যৌন পিপাসা তৃপ্তির তাগিদে। মেয়েটি কোনরকমে তাদের কাছ থেকে নিজেকে ছিনিয়ে প্রাণপণ দৌঁড়াতে শুরু করেছিল। কিন্তু বেশিদূর দৌড়াতে পারে নাই। ক্লান্ত ফুসফুস মেয়েটিকে থামিয়ে দিয়েছিল- এক প্রতীক্ষালয়ে। মেয়েটি কোনরকমে প্রতীক্ষালয়ে নিজেকে সামলে, একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে -ঠিক তখনই পিছন থেকে ওই মদ্যপ যুবকেরা দানবের মত এসে জোর করে মেয়েটির সারা গায়ে মদ ঢেলে আগুন লাগিয়ে, পালিয়ে যায়। প্রচন্ড যন্ত্রণায় মেয়েটি চিৎকার করতে করতে রাস্তায় চলে আসে। প্রবল বৃষ্টির জলধারায় আগুন নিভে যায়-প্রকৃতির অসীম কৃপায়। জ্ঞানহারা অবস্থায় মেয়েটি পড়ে থাকে রাস্তার উপর।এক ভ্যানচালক মেয়েটিকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে, দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসে। মেয়েটির পরিচয় গতকাল রাত অবধি জানা যায়নি। জ্ঞান ফিরলে তার বয়ান অনুযায়ী পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।”
খবরটি পড়ে অরূপ এক মুহূর্ত দেরি না করে, ঘর থেকে বই কেনার জন্য রাখা টাকা নিয়ে- ছুটে যায় হাসপাতালে। হাসপাতালে পা রাখতেই দেখে সামনের বেডে একটি মেয়ে শুয়ে আছে। স্যালাইন চলছে। মুখে ঘন করে ওষুধ লাগানো। মেয়েটির পরনের জামা দেখে অরূপের চিনতে অসুবিধা হলো না, সে রথের মেলায় টমটম গাড়ির বিক্রেতা রুপসা। ওষুধের আবরণে মুখটা একেবারে চেনা যাচ্ছে না, তার। অরূপ ছুটে গেল ডাক্তারের কাছে।
‘স্যার,স্যার কেমন আছে কালকে আসা আগুনে দগ্ধ রুপসা।’
‘ও, তুমি এখন এসেছো। কালকের থেকে মেয়েটির কোন পরিচয় আমরা পারছি না। ঠিক আছে আমার সাথে চেম্বারে আসো, কিছু তথ্য নিতে হবে।’
মেয়েটির নাম ছাড়া কোন তথ্য তার জানা নেই, এমনকি টাইটেল তার অজানা। সাহস করে অরূপ চেম্বারে গেল। ডাক্তারবাবু বললেন,-‘মেয়েটির নাম কি?’
‘রুপসা।’
‘টাইটেল।’
অরূপ চিন্তিত হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয়বার ‘টাইটেল’ শব্দটি ডাক্তারবাবু একটু জোরে বলতেই, অরূপ কোন চিন্তা না করে নিজের টাইটেল জুড়ে দিয়ে বলল,-‘ রূপসা সরকার।’
‘বাবার নাম কি? তাড়াতাড়ি বল।’ ডাক্তারবাবু একটু রেগে প্রশ্নটা করলেন।
অরূপ তো কিছুই জানে না, তাই তার উত্তর দিতে দেরি হচ্ছে। পরিস্থিতি সামলাতে নিজের বাবার নাম বলে ফেলল,-‘অনিমেশ সরকার।’
তারপর ডাক্তারবাবুর একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে, অরূপ অপেক্ষা করতে থাকে- ভিজিটিং আওয়ারের।
ভিজিটিং আওয়ারে মেয়েটির কাছে দেখা করতে গেল, অরূপ। সে মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে বলল,-‘ রুপসা, আমি এসেছি-তাকাও আমার দিকে।’
‘রুপসা’ ডাক শুনেই মেয়েটি তার চোখ খুলল। আবছা আবছা ভাবে দেখল-রথের মেলায় আসা, সে, যে দুটো টমটম গাড়ি কিনেছিল এবং দশ টাকা বেশি দিয়েছিল। সে তাকে কথা দিয়েছিল উল্টো রথে আসবে এবং দেখা করবে।…….. এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মেয়েটির চোখ ছল ছল হয়ে উঠলো। এক সময় রুপসা তার হাতটা বাড়িয়ে অরূপের হাত চেপে ধরলো। অরূপ নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,-‘তুমি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো, রুপসা। কোন চিন্তা করবে না। আমি তোমার সাথেই আছি।’
এই কথাগুলো শোনার পর রুপসা, অরূপের হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরল। দুজনের চোখের বৃষ্টিধারা অনেক না বলা কথা, বলতে লাগলো …।
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ।