জোবায়ের রাজু
পড়ন্ত দুপুরে নিনার কল দেখে আমি অনেকটা হকচকিয়ে উঠলাম। আমার মনে হল এই কলটা রিসিভ করলেই নিনার বাবার মৃত্যুর সংবাদ পাবো। নিনা হয়তো হাসপাতাল থেকে গলা ফাটিয়ে বলবেÑ‘আমার বাবা মারা গেছে।’ আমি নিনার বাবার মৃত্যুর সংবাদ শুনতে চাই না। তবুও ভীরু আঙ্গুল দিয়ে ফোন রিসিভ করেই কান পেতে রইলাম ওপারে। না, নিনা কোন খারাপ খবর শোনায়নি। ওর বাবা আগের থেকে বরং সুস্থ। হার্টের যে প্রবলেম ছিল সেটা মোটামুটি শঙ্কামুক্ত। তবে যেটা আসল সমস্যা, সেটা হল নিনা তার বাবাকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে রিলিজ পাচ্ছে না পাঁচ হাজার টাকার অভাবে। নিনার হাতে কোন টাকা নেই। সব টাকা তার বাবার চিকিৎসার পিছনে শেষ। উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে নিনা আমার কাছে কল করেছে টাকা পাবার আশায়।
আমি বেকার মানুষ। পাঁচ হাজার টাকা আমার কাছে লাখ টাকার মত। তবু আমি নিনাকে নিরাশ না করে বললামÑ‘ঠিক আছে আমি এক ঘন্টার মধ্যে টাকা নিয়ে হাসপাতালে আসছি।’
কিন্তু টাকা পাবো কোথায়? পকেটে শ’খানেকের মত টাকা আছে। পাঁচ হাজার টাকার চাপ আমার মাথার উপর। হঠাৎ মনে পড়ল বড় দা’র কথা। বড় দা তার অফিসের বেতন পেয়েছে গতকাল। পুরো দশ হাজার টাকা। তার রুমের টেবিলের ড্রয়ারে ভরে রাখতে দেখেছি আমি। সেখান থেকে পাঁচ হাজার টাকা সরিয়ে ফেলতে হবে। নয়তো নিনার বাবাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিবে না।
না। আমি আর দেরি করব না। বড় দা এখন বাসায় নেই। ছাদে গেছে, নয় তো পুকুর ঘাটে বসে ফেসবুকে ব্যস্ত। যা করার এখনই করতে হবে। হ্যাঁ এখনই।
চুপি চুপি ড্রয়ার খুলে পুরো পাঁচ হাজার টাকা পকেটে ভরে বাসা থেকে বের হয়ে এলাম। তারপর সোজা হাসপাতালে।
২.
টাকাগুলি পেয়ে নিনা আনন্দে কেঁদে দিল। কাঁপা গলায় বললÑ‘আমি তোকে মিথ্যে বলেছি। রিলিজের জন্যে এই টাকা নয়রে। আজ আবার ডাক্তার বাবু বলেছেন বাবার চোখেরও নাকি অপারেশন করাতে হবে। সাত হাজার লাগবে। আমার কাছে আছে মাত্র দুই হাজার।’ নিনা আমার সামনে নত হয়ে আছে মিথ্যে বলার অপরাধে। তাকে সাহস দিয়ে বললামÑ‘তুই সত্যটা বললেও আমি তোর জন্য টাকা নিয়ে আসতাম। পাগলী একটা।’ নিনা মরা হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, কিন্তু চোখে পানি। খুব করুন দৃশ্য।
আমি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসলাম। অত্যন্ত দরিদ্র ঘরের মেয়ে নিনা আমার ক্লাসমেট। কলেজে ওর সাথে আমার দারুণ সখ্যতা ছিল। আমি পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছি। নিনা এখনো স্টাডি নিয়ে আছে। এই মাসে তার অনার্সের ফাইনাল। আমাদের সম্পর্ক এখনো আগের মত মজবুত।
৩.
বাসার এসে দেখি মুন্নী কাঁদছে। মুন্নী আমাদের বাসায় কাজ করে। খুব ভালো মেয়ে। এই প্রথম মুন্নীকে কাঁদতে দেখলাম। ‘ছোট দা, শুনছো, বড় দা বলছে আমি নাকি উনার পাঁচ হাজার টাকা চুরি করেছি’,Ñমুন্নীর কথা শোনে আমি হা করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
বড় দা’র ঘরে এসে দেখি বড় দা মন খারাপ করে চেয়ারে বসে আছে আর কিছুক্ষণ পরপর বিশ্রী ভাষায় মুন্নীকে গালি দিচ্ছে। আমি আস্তে করে বললামÑ‘বড় দা।’ আমাকে পাত্তা না দিয়ে বড় দা বললÑ‘এখান থেকে যা তো! আমার মাথা গরম। টাকা বের না করলে ওই হারামজাদীকে আজ বিদায় করব।’ বড় দা’র উচ্চকন্ঠের এই কথাটা পাশের ঘর থেকে শুনে মুন্নী কান্নার শব্দ দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়ে বললÑ‘দোহাই বড় দা, আমাকে বিদায় করবেন না। আমার বাবা মা নেই। কোথায় যাবো?’
কিচেন থেকে মা ছুটে এসে মুন্নীর চুল টেনে ধরে বললÑ‘আমার ছেলের টাকা বের কর বলছি। আমার ছেলের রুজি করা হালাল টাকা।’ মুন্নী পাগলের মত গলা ফাটিয়ে কাঁদছেÑ‘খালাম্মা, আমি টাকা চুরি করিনি। আল্লাহর কসম। আমার মরা বাপ মা’র কসম।’ মুন্নীকে নির্যাতনে যোগ দিতে বড় দাও যখন তেড়ে আসছে, তখনই বাধা দিলাম আমি। বীরের মত বললামÑ‘মা, বড় দা, তোমরা কি শুরু করেছো মুন্নীকে নিয়ে! ও সত্যি চুরি করেনি। আমি টাকা চুরি করেছি।’
আমি যেন পৃথিবীর সব চেয়ে অবাক করা কথাটি বলেছি, এমন ভঙ্গিমায় মা আর বড় দা আমার দিকে তাকিয়ে রইল। মুন্নী দৌড়ে এসে আমার পায়ের উপর পড়ে শিশুর মত কাঁদতে লাগল। বড় দা বললÑ‘তুই সত্যি বলছিস?’ বুকে সাহস নিয়ে বললামÑ‘সত্যি বলছি। আমার ক্লাসমেট নিনার বাবার চিকিৎসার জন্যে পাঁচ হাজার টাকা দরকার পড়েছে। নিনা আমার কাছে টাকা চেয়েছে। আমি তোমার ড্রয়ার থেকে চুরি করে পাঁচ হাজার…!’ কথা শেষ না হতেই মা উল্কার মত ছুটে এসে আমার গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে উচ্চস্বরে বললÑ‘তুই চোর? আমি চোর পেটে ধরেছি?’
বড় দা আমার শার্টের কলার ধরে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভিতর থেকে বললÑ‘তোর মত চোর ভাই আমার দরকার নেই।’ মুন্নী আবারও উচ্চস্বরে কান্না শুরু করে দিল। নির্দোষ মেয়েটা আজ কত না নাজেহাল হল। গরীব হয়ে জন্মালে বুঝি এমনই হয়!
আমি দাঁড়িয়ে আছি আমাদের প্রকান্ড উঠোনে। ঘরের দরজা বন্ধ। টাকা চুরির অপরাধে বড় দা আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। তার সেই অধিকার আছে। কারণ বাবার অবর্তমানে সেÑই এখন এই সংসারের কর্তা। আমি টাকা চুরি করেছি জেনে মাও রাগে ক্ষোভে আমার গায়ে হাত তুলেছে। তারও সেই অধিকার আছে। কারন আমি চোর। কিন্তু এই চোর টাকাগুলি কোন খারাপ কাজে নষ্ট করেনি। বরং একজন দরিদ্র নিনার বাবার চিকিৎসার জন্যে চুরি করা টাকা নিয়ে হাসপাতালে তাদের পাশে দাঁড়াতে গেছে। হোক না সেটা চুরির টাকা।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।