জীবনের গল্প – লুনা রাহনুমা
“এই মুরগি আয়। ভাত খা, ডিমের তরকারিটা খা। আয় আয়।“
ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে উঠোনে ভাত ছিটান বিলকিস আক্তার। ডিম আর আলুর তরকারি দিয়ে মাখা ভাত ছিটে দিচ্ছেন উঠানে তিনটি বড় মুরগি ও ডজনখানেক মুরগির বাচ্চার দিকে। হুটপুট করে ককর কক করতে থাকে মোরগ আর মুরগির ঝাঁক। বিলকিস আক্তার মমতার চোখে মুরগির খাওয়া দেখে।
ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে যাবেন আর দুই ঘন্টা পর। একমাত্র ছেলে মিরাজ হাই স্কুলে পড়ে। এই বছর ক্লাস নাইনে উঠেছে। আচরণে এখনো ছেলেমানুষি সরলতা রয়ে গেছে। বিলকিসের প্রাণ এই ছেলে। সারাদিনে চব্বিশ ঘন্টা তিনি ছেলের সাথেই কাটাতে পারেন। বাইরের জগতের সাথে সম্পর্ক নেই বললে চলে। নিজের জন্য আলাদা করে সাধ আল্লাদ বলে যেন কিছুই নেই ভদ্রমহিলার জীবনে।
আজ শনিবার। ভাসুরের ছেলের মুসলমানি হয়েছে চারদিন আগে। গতকাল বাচ্চার মুসলমানি উপলক্ষ্যে মেজবানির আয়োজন করেছিল তাদের বাড়িতে। মেজবানীর বেঁচে যাওয়া খাবার বিলকিসের বড় জা গামলা ভর্তি করে পাঠিয়েছে রাতে। সাথে বিলকিসের জন্য নতুবা শাড়ি, স্বামীর জন্য পাঞ্জাবি, মিরাজের জন্য আড়ংয়ের ফতুয়া। সাথে আরেকটি লাল টি-শার্ট, তাতে একটি বড় স্পাইডারম্যান আঁকা। কাপড়গুলো বিলকিস গুছিয়ে রাখে। লাল টি-শার্টটি একবার জড়িয়ে ধরে বুকে। শোবার ঘরে গিয়ে আলমারির তালা খুললো। চেয়ারের উপরে দাঁড়িয়ে আলমারির সবচেয়ে উপরের তাকে যত্ন করে রেখে দিলো টি-শার্টটি।
জীবনের সব উপহার কেবল বর্তমানের জন্য আসে না। কিছু তুলে রাখা যায় ভবিষ্যতের জন্য আর কিছু রেখে দিতে হয় অতীতের কথা ভেবে। এখন প্রয়োজন নেই, কিন্তু প্রয়োজন হতে পারতো।
গোসল করে জোহরের নামাজ সেরে বিলকিস বেগম ছেলেকে পোলাও আর গোস্ত খাওয়াতে বসলেন।
“আম্মা, আমার একটা নতুন ঘড়ি লাগবো। আগের ঘড়িটার ভিতর পানি ঢুকছে ওযু করার সময়।”ছেলের মুখে ভাত ঠেলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ঘড়ির দাম কত?”
কিছুক্ষণ মুখের ভাত চিবিয়ে মিরাজ বলে, “শিপনের আব্বা ওরে একটা কিনে দিসে কয়দিন আগে। দাম পড়েছে এক হাজার টাকা। একটু ভালো ঘড়ি কিনতে গেলে হাজার টাকার নিচে পাওন যায় না কোনখানেই।”বিলকিস মিরাজের আগের ঘড়িটি বা হাতে উল্টে পাল্টে দেখেন। মাত্র ছয় মাস আগে বায়তুল মোকাররম মার্কেট থেকে তিনি নিজে কিনে এনেছিলেন ঘড়িটি। এরমধ্যেই এই অবস্থা! ব্যবসায়ীদের বিবেক বলে আর কিছু নেই আজকাল। খদ্দের ঠকিয়ে নিজের পকেটে পয়সা ঢোকানোই একমাত্র ধান্দা এদের। ব্যবসায়ী আর মানুষ দুটো যেন পৃথক দুই সম্প্রদায় আজকালকার সমাজে।
হাতের কাছে রাখা মোবাইল ফোনটি বেজে উঠলো। মোবাইলের দিকে মুখ উঁচু করে তাকান বিলকিস। ছোটবোন ইতি ফোন করছে। মোবাইলের স্ক্রিনে ইতির নাম দেখে ঠোঁট বাকান বিলকিস আক্তার। আবার কি চায়? গোসলে যাবার আগেই কথা বলেছে ওর সাথে। একদম ফালতু সময় নষ্ট। সকাল নাই বিকাল নাই – খালি ফোন করে। আজব আজব কথা বলে ফোন করে। বেশিরভাগ কথা রান্না নিয়ে। গতকাল রাত নয়টায় ফোন করে বললো, “জাম্বুরার ভর্তা বানাবো কিভাবে?”
ফাজিলের ফাজিল। জাম্বুরার ভর্তা বানাতে বড় বোনকে ফোন করতে হয়! আম জাম চালতা বরই সব ভর্তা বানানোর একই পদ্ধতি। রাগ চেপে বিলকিস বলেছেন, “গুগল কর। আমারে ফোন দিছিস কেন?” বিলকিসের রাগ দেখে হেসে লুটিয়ে পড়ে ইতি। বলে, “না বুবু, তোমার মুখেরটা শুনে বানালে জাম্বুরার ভর্তা বেশি মজা হয় খেতে …… ” ইতির হাসি যেন আর থামেই না। অদ্ভুত হয়েছে মেয়েটা।
আবার গতকাল দুপুরে যখন সোফায় বসে চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন সেইসময় ইতির ফোন এলো। উত্তেজিত স্বরে বললো, “বুবু, মুরগির মাংস রান্না শেষে একটা লেবু চিপে দিয়ে নামলে কেমন হয়? ফ্রেশ একটা গন্ধ আসবে তাই না? ভাত খাবার সময় কষ্ট করে আর লেবু চিপতে হবে না। কি বলো?”বিলকিসের মনে হচ্ছিলো কাছে পেলে একটা চড় দিতেন বোনের গালে। মাংসে লেবু দিতে মন চাইলে তুই লেবু দে। লেবুতে যথেষ্ট টক না হলে তেতুল গুলে দে। টক দইয়ের বাটি ঢেলে মেখে দে। আমি কি জানি! আমি কি দিন রাত তোর মতো রান্না ঘরে বসে থাকি? বিলকিস বেগম বোনকে বলেন, “বাগানের লেবুগাছটারে গোড়া থিকা কাইটা আইনা মাংসের পাতিলে দিয়া দে। খুব স্বাদ হইবো। মনে হইবো লেবু গাছের পাশে বইসা মুরগি দিয়া ভাত খাইতেসিস।”হি হি করে হাসতে থাকে ইতি। বোনের রাগ ওকে স্পর্শ করে না। দিনের ভেতর অন্তত চার থেকে ছয়বার ফোন করে বিলকিস আপার খোঁজ নেয় ইতি। প্রতিবার এটা সেটা রান্নার কথা বলে বিরক্ত করে। কিন্তু আপার সাথে তার কথা বলতে হয়। আপার মনটাকে স্বাভাবিক রাখার সব রকম চেষ্টা সে করে, খুব ভালোবেসে। বড় বোনটি ছাড়া তার আপন আর কেউ নেই সংসারে। বুবুর যদি কিছু হয়ে যায়! মরেই যাবে ইতি। ইতি হবে ইতির জীবনের।
পরদিন সকালে স্কুলে যাবার সময় মিরাজকে দুই হাজার টাকা দিলেন বিলকিস। নতুন ঘড়ি কিনতে। মিরাজ স্কুল শেষে বাজারে খবির চাচার ঘড়ির দোকান থেকে দুইটি হাত ঘড়ি কিনে আনে। মিরাজেরটা নীল আর অন্যটা লাল। মিরাজ জানে লাল ঘড়িটা বছরের পর বছর আলমারিতে বাক্স বন্দি হয়ে থাকবে। শুধু মা কিছুদিন পর পর বের করে ঘড়িটি মুছে রাখবে। চুমু খাবে। আর অনেক বছর পর হয়তো খুব দরিদ্র কোন ছেলেকে রাস্তা থেকে ধরে এনে হাতে পরিয়ে দিবে।
অজানা লোকের ভিড়ে শোকার্ত মায়ের দ্বিখণ্ডিত মন খুঁজে ফেরে প্রিয় কারো মুখের সাথে মিল যুক্ত একটি মুখের আদল। দুই কোটির উপরে লোকের বাস ঢাকা শহরে। কারো না কারো মুখের সাথে নিশ্চয়ই একটু হলেও মিল হবে সেই মুখের। বিলকিস আক্তার অবশ্য প্রায়ই পেয়ে যান তেমন মুখের দেখা।বিলকিসদের পাশের বাড়িতে থাকে কবিরুল ইসলাম। স্বামী ও স্ত্রী। কোন ছেলে মেয়ে নেই। তারা এই বাড়িটি কিনেছে মাত্র তিন মাস হলো। পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে কি শুনেছে কে জানে, সারাক্ষণ তারা বিলকিসকে বাড়ির দিকেই চেয়ে থাকে। বিলকিস আক্তার যথাসম্ভব নিজেকে তাদের চক্ষুর আড়ালে রাখার চেষ্টা করেন। কবিরুল ইসলামের স্ত্রী রুবীর চাহনি দেখলে মনে হয় সে বিলকিসকে দেখছে না, পাগল দেখছে সামনে। কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে মহিলা। অসহ্য লাগে বিলকিসের। গায়ে পড়া প্রতিবেশী খুব জঘন্য জিনিস। কিন্তু তারা নাছোড় পরিবার। বিলকিসের সাথে মেলামেশা করবার জন্য এতো উদগ্রীব কেন কে জানে। প্রতি বিকেলে পেঁয়াজু, না হয় ছোলা, না হয় পাকোড়া, নয়তো হালিমের বাটি কাজের মেয়েটিকে দিয়ে পাঠাবে এই বাড়িতে। দরজায় এসে কড়া নাড়া মেয়েটির হাত থেকে খাবারের বাটি না রাখলে খুব অসভ্যতা দেখায় বলেই সেগুলোকে গ্রহণ করে বিলকিস।
এই যাহ, “যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়!” বিলকিসকে রিক্সা দেখে নামতে দেখে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে রুবি, জিজ্ঞেস করে, “কেমন আছেন আজ আপা?”
বিরক্তিতে মনে হচ্ছে মহিলার কথার কোন জবাব না দিয়ে হেঁটে চলে যায়। কিন্তু প্রতিবেশী হচ্ছে মানুষের বিপদের সহায়। তাই তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা অত্যাবশ্যক। মুখে যথা সম্ভব আনন্দের ভাব ফুটিয়ে বিলকিস বলেন, “আমি ভালো আছি রুবি, তুমি কেমন আছো?”
মেয়েটির মুখে যেন বিলকিসের প্রতি মায়া মমতা গলে পড়ছে একেবারে। আগামাথা কিছুই বুঝতে পারে না বিলকিস আক্তার। কিন্তু তার খুব অসহনীয় লাগে মীরার এই অযাচিত আগ্রহ। ওর সামনে থেকে পালতে পারলেই খুশি হয় এখন।দ্রুত পায়ে হেঁটে বাড়ির গেটের কাছে চলে যায় বিলকিস। মীরাও ছুটে আসে সাথে সাথে। ইতস্তত করে বলে, “আপা, আসছেন তো আজ রাতে?”
অবাক হয় বিলকিস, “আজ রাতে? কোথায়?”
মীরাও অবাক হয়, “কেন আমাদের বাসায়। আমার হাসব্যান্ড তো গত সপ্তাহে ভাইকে দাওয়াত করেছে। ভাই বলেছে আসবে। আপনি জানেন না আপা?”
নিজের স্বামীর প্রতি অসন্তুষ্ট হলেন বিলকিস আক্তার। কিন্তু মীরাকে সেটা বুঝতেন দিয়ে বলেন, “ও হ্যাঁ। তোমার ভাইয়া বলেছে আমাকে। আমি হঠাৎ করে ভাবলাম কী না কী!”
– “আসবেন কিন্তু আপা। শুধু আপনাদেরকেই বলেছি। আর কেউ না।!
– “আসবো মীরা, আসবো। যাই এখন!”
মীরাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জলদি করে গেটের ভেতর ঢুকে তালা লাগিয়ে দিলেন ভেতর থেকে। কারো সাথে কথা বলার সময় নেই এখন তার। রমনার পাশে রাস্তা পার হবার সময় দেখলেন ছয় সাত বছরের বাচ্চা একটি ছেলে ক্ষুধায় কাঁদছে। বাচ্চাটির মুখের দিকে তাকিয়ে পাথর হয়ে যান বিলকিস আক্তার। এই মুখ তিনি কিভাবে ভুলবেন! বুকের ভেতরটা তার ব্যাথার ভারে ভেঙে পড়লো। নিজের হাতে টঙের দোকান থেকে পাউরুটি, কলা, পটেটো চিপস, আর কোকের বোতল কিনে রাস্তার পাশে বসে খাওয়ালেন ছেলেটিকে। ইচ্ছে হচ্ছিলো বুকের সাথে মাথাটি চেপে ধরে আদর করেন মায়ের মতো। কিন্তু মনের ভেতর কেউ সতর্ক করে দেয় বিলকিসকে। আশেপাশে মানুষজন তাকে ছেলে ধরা ভেবে ভুল করতে পারে। বাচ্চাছেলেটি গোগ্রাসে সব খাওয়া শেষ করলে বিলকিস তাকে বলে, “তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারবে এখানে এক ঘন্টা?”
– “কেন?”
– “আমি তোমার জন্য ভালো শার্ট প্যান্ট আর ঘড়ি নিয়ে আসতেছি।”
– “আইচ্ছা।”
– “চলে যেও না কিন্তু। আমি যাব আর আসবো।”
রাতে মীরাদের বাড়ি যেতে আটটা বেজে গেলো। অনেক রকমের রান্না করে হুলুস্থুল কান্ড করে ফেলেছে মেয়েটা। রান্নার চেয়েও আপ্যায়নের আন্তরিকতাটি বিলকিস আক্তারের বেশি ভালো লাগলো। মেয়েটা খুব আগ্রহ নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে বিলকিসকে। অন্যকারো প্রতি যেন তার কোন খেয়ালই নেই।
কথা বলার কিছু খুঁজে পান না বিলকিস অনেকক্ষণ। তবুও কিছু বলতে হয় বলেই বলেন, “তোমাদের বিয়ে হয়েছে কত দিন আগে?”
কাঁচের জগে ট্যাংগো গুলতে থাকে মীরা, বলে, “আপা এই মার্চে এগারো বছর হবে।”
– “তোমাদের বাচ্চারা কই?” মুখ ফস্কে বেরিয়ে যায় কথাটি বিলকিস আক্তারের মুখ থেকে।
মীরাকে দেখে মনে হলো প্রশ্নটি তাকে কোনরকম অপ্রস্তুত করলো না। খুব স্বাভাবিকভাবেই বললো, “আমাদের একটি ছোট্ট মেয়ে হয়েছিল আপা নয় বছর আগে। দুই বছর বয়সে সে আমাদেরকে ছেড়ে আল্লাহর কাছে চলে গেছে। এখন আমাদের আর কোন সন্তান নেই।”
বিলকিস কেমন বিপর্যস্ত বোধ করেন। কিছুক্ষন পর ব্যগ্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, “মীরা, তুমি কি তোমার মেয়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারো? দেখতে পাও ওকে কখনো? আল্লাহর কাছে বসে ও কি তোমাকে কিছু বলে?”
ট্যাংগোর শরবত বানানো হয়ে গিয়েছে। এখন গ্লাসে গ্লাসে ট্যাংগো ঢেলে টেবিলের উপর একটি ট্রেতে রাখে মীরা। বিলকিস আক্তারকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আমার পিয়ানা সব সময় আমার সাথেই থাকে আপা। আমি ওকে কখনো আমার মন থেকে মুছে যেতে দেই না।”
“পিয়ানা”, বিড়বিড় করে নামটি বার কয়েক উচ্চারণ করে বিলকিস। অনেকক্ষণ কোন কথা বলেনা তারা দুইজনের একজনও। দুইটি নারী পাশাপাশি ডাইনিংরুমে টেবিলে খাবার সাজায়। হাতে হাতে এগিয়ে দেয় মাংসের বাটি, ইলিশের পাতুরি, দই বড়ার প্লেট। দূর থেকে দেখে মনে হয় দুইটি যন্ত্র মানবী পায়ে হেঁটে, দুই হাত নেড়ে এটা সেটা করে যাচ্ছে। তাদের মুখে ভাষা নেই। তাদের চোখে আলো নেই। তাদের বুকের ভেতরে নেই আনন্দের উচ্ছলতার রেশমাত্র।খাবার টেবিলে কাজের মেয়েটি জনপ্রতি একটি করে ভাতের প্লেট সাজিয়ে দিয়েছে। বিলকিসের পরিবার তিনজন আর রুবীরা দুইজন। বিলকিসের স্বামী মেয়েটির কাছে আরেকটি ভাতের প্লেট চাইলো। মেয়েটি প্লেট আনতে সেটিকে তিনি বিলকিসের প্লেটের পাশে রাখলেন। দুইটি ভাতের প্লেটের কি কাজ সেটা তারা না বুঝলেও কেউ কোন প্রশ্ন করে না এই নিয়ে। চামচে করে সাদা ভাত উঠতে থাকে ছয়টি প্লেটেই। খাসির গোশত, পাতুরি, সালাদ সবকিছুই অল্প অল্প করে উঠতে থাকে ছয়টি প্লেটেই। বিলকিসের সামনে ছয় নাম্বার প্লেটটিতে খাবারের পরিমান খুব সামান্য। যেন কোন বাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্য মায়ের সাজানো ভাতের থালা। এই ঘরে কোন বাচ্চা নেই। সেই থালার খাবারটুকু বিলকিস আক্তার নিজেই খেয়ে নিলেন ধীরে ধীরে অন্য সবার সাথে টুকিটাকি কথা বলতে বলতে।
আশ্চর্যের একটি অনুভূতি নিয়েও কবির সাহেব ও রুবী স্বাভাবিকভাবে নিতে চাইলো বিলকিসের আচরণটুকু। খাবার টেবিলে গল্প করে পরিবেশের তারল্য বজায় রাখতে চেষ্টা করে। কৌতুক বলে হাসানোর চেষ্টা কেমন বৃথা প্রমাণিত হলো আজ এই বাড়ির টেবিলে। সবার খাওয়া শেষ হলে ড্রয়িংরুমে বসে তারা টিভিতে রাত দশটা ইংরেজি সংবাদ শুনছে। মতিঝিলে পাইপের মধ্যে কে বা করা যেন একটি সদ্য ভূমিষ্ট শিশুকে পুরোনো পেপারে মুড়ে ফেলে রেখে গেছে। টিভির সামনে বসা চারজন বয়স্ক লোকই বিরক্ত হলো এই সংবাদটি দেখে। রিপোর্টারদের মাথার ঘিলু গোবর হয়ে গিয়েছে আজকাল। জাতীয় চ্যানেলের সংবাদে কী কী খবর প্রচার করার যোগ্য, সেই সম্পর্কে তাদের কোন বুদ্ধি বিচারই নেই। অপদার্থের দল।
রাত আরো বাড়লে উঠে দাঁড়ায় বিলকিস। এবার তাদের বাড়ি ফিরতে হবে। মীরা রঙিন কাগজে মোড়ানো কয়েকটি গিফট নিয়ে এলো। বিলকিসের স্বামীর জন্য একটি। বিলকিসের ছেলে মিরাজের জন্য একটি। আর বিলকিসের হাতে দিলো দুইটি প্যাকেট। কথা না বাড়িয়ে বিলকিস ধন্যবাদ জানায় মীরাকে।
বারো বছর আগে বিলকিস আক্তারের চার বছরের ছোট্ট ছেলেটি যখন মাত্র তিন দিনের জ্বরে পরে সোজা চলে গেলো আল্লাহর কাছে, তখন থেকে এখনো বিলকিস তার ছেলেকে ছাড়া একটি দানাও মুখে তুলে না। টেবলে গরম ভাত বেড়ে মিরাজকে যখন ডাকেন সশব্দে তখন প্রতিটি বেলায় সিরাজকেও ডাকেন – নিঃশব্দে। মিরাজের জন্য এক প্লেটে খাবার নিলে অন্য আরেকটি প্লেটে খাবার নেন সিরাজের জন্যও। সিরাজের খাবারটুকু কখনো বাড়ির বিলকিস আক্তার নিজেই খেয়ে নেন। কখনো সেই খাবারটি বাড়ির হাঁস-মুরগি, কিংবা বাগানের পাখিরা পায়। এরা সবাই তো বেহেস্তের প্রাণী। যেখানে এখন খেলা করছে বিলকিস আক্তারের হারিয়ে যাওয়া সন্তান সিরাজ মিয়া।
পৃথিবীতে কোন মা সন্তান হারানোর ব্যথা বুকে লুকিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করে। আবার কোন মা হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে বুকের ভেতর স্বাভাবিকভাবেই ধরে রেখে অস্বাভাবিক রকমের জীবন যাপন করে। সন্তান মৃত হয়না কখনো কোন মায়ের কাছে। তারা কেবল না দেখা এক বেহেস্তের বাগানে বসে থাকে প্রিয় মায়ের বুকের উষ্ণতা আবার কবে পাবে সেই অপেক্ষায় ।