ইমন শেখ
পিচ ওঠা লাল খোয়া বেরনো রাস্তাটা যেন আগুনে পুড়ে চামড়া ঝলসানো শরীরের মতোই ধুঁকছে। জরাজীর্ণ সেই রাস্তার ছোট-বড় অগণিত খানাখন্দ এড়িয়ে সাবধানে খালি রিকশাটা টানছিল কুদ্দুস। হঠাৎ উল্টো দিক থেকে জমদূতের মতো শাঁশাঁ করে ছুটে আসে একটি সাদা রঙের পাজেরো কার। কারের ধাক্কায় রিকশা নিয়ে রাস্তা থেকে প্রায় ছিটকেই যাচ্ছিলো কুদ্দুস। কিন্তু না, একটুর জন্য রক্ষা পায় সে। তবে ভয়ে শুকিয়ে যায় তার কলিজা। ধুকপুকানি শুরু হয় বুকে।
ওদিকে ভেঙে খানখান পাজেরোর লুকিং গ্লাস। সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষে গাড়ি থেকে নেমে আসে অল্পবয়সী দুই ছোকরা। ক্লিন শেভ করা ফর্সা গোলগাল মুখ দুটো রাগের চোটে লাল হয়ে গেছে। ভয়ে শিটিয়ে যাওয়া কুদ্দুসের কম্পন থামার আগেই ছোকরা দুটো তার কলার ধরে টেনে আনে গাড়ির কাছে। গাড়ির ভাঙা লুকিং গ্লাস দেখিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে তারা। অবাক হয়ে যায় কুদ্দুস। তার তো কোন দোষ না। দোষ তো ওদের। রং সাইড দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল তো ওরা। আমতা আমতা করে কথাগুলো বলতেই তার লিকলিকে শরীরের ওপর কিল-ঘুষির বন্যা বয়ে যায়। অবশ্য কুদ্দুসও হাত পা ছোড়ার যথেষ্ট চেষ্টা করে। কিন্তু বুনোশুয়োরের মতো ঐ টগবগে ছোকরা দুটোর সাথে কিছুতেই পেরে ওঠে না। কিল-ঘুষির চোটে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কুদ্দুস। তবু রাগ পড়ে না ছোকরা দুটোর। দুজনেই হামলে পড়ে তার নেতিয়ে পড়া শুটকো দেহের ওপর। ” কুত্তার বাচ্চা! তোরে চৌদ্দবার বেইচাও এক লুকিং গ্লাসের দাম উঠবো না। আর তুই রং সাইড চিনাতে আসোস। শালা ফকিন্নির বাচ্চা! ” মুখের সাথে সমানে চলতে থাকে দুই জোড়া হাত-পা।
এ দৃশ্য দেখতে রাস্তায় তখন রীতিমতো ভীড়। ভীড় থেকে দু’একজন এসে অতি কষ্টে নিবৃত্ত করে ছেলে দুটোকে। ওদিকে মারের চোটে কুদ্দুসের তখন আধমরা অবস্থা। তার লম্বা নাকের ফুটো দিয়ে গলগল করে ঝরছে রক্ত। থেঁতলে যাওয়া গালচেয় লেগে আছে রক্তের একটা সরু ধারা। চোখের কোনাটাও বেশ রক্তাক্ত। ওই অবস্থাতেই টলতে টলতে বাড়ি ফেরে কুদ্দুস। অমন কাটা-ফাটা রক্তাক্ত মুখ দেখে চমকে ওঠে তার বউ মিতালি।
” হায় আল্লাহ! আপনের কি অয়ছে? র-র-রক্ত ক্যান্?”
বউয়ের প্রশ্নের জবাব দেয় না কুদ্দুস। মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তার নীরবতা মিতালিকে আরও উতলা করে। এমনিতেই সে একটু ছিচকাঁদুনে স্বভাবের। তারওপর স্বামীর এই রক্তাক্ত বিধস্ত চেহারা। নিজেকে সামলাতে না পেরে ডুকরে কেঁদে ওঠে সে।
এমন সময় দৌড়ে আসে কালু। বাপের এই অবস্থা বছর আটেকের ছোট্ট ছেলেটিকেও বিস্মিত করে। ফ্যালফ্যাল চোখে সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বাপের মুখের দিকে। আর তখনই ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ে কুদ্দুস। তারপর ছেলেকে জাপটে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। বাপকে কাঁদতে দেখে অবাক হয় কালু। দু’চোখে পরম বিস্ময় নিয়ে বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। তারপর পরম মমতায় কুদ্দুসের কাটাফাটা মুখে হাত বুলিয়ে দেয় সে। দুটো ছোট্ট নরম হাতের আলতো পরশে কুদ্দুসের কলিজাটা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। আরামে চোখ বন্ধ হয়ে আসে তার। ব্যাথা-যন্ত্রণা ভুলে পরাণ ভরে সে আস্বাদন করে ছেলের কচি হাতের জাদুর পরশ। তবে পরম প্রশান্তিময় এই লগ্নটুকু বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়না। হঠাৎ কুদ্দুসের কানে প্রতিধ্বনিত হয় সেই দাম্ভিক উক্তি – ‘কুত্তার বাচ্চা! তোরে চৌদ্দবার বেইচাও এক লুকিং গ্লাসের দাম ওঠবে না।’ ক্রমেই তীব্র হতে থাকে সে প্রতিধ্বনি। ছেলের হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরে সে। যে নরম হাতের পরশকে একটু আগে জাদুর পরশ বলে মনে হয়েছিল সেই হাতের কোমলতা-ই শঙ্কিত করে তাকে। নরম হলে তো চলবে না। জগৎ শক্তের ভক্ত। ছেলেকে তাই হুশিয়ার করে দিতে চায় সে। তার কান্না বিগলিত কাঁপা কণ্ঠ হঠাৎ করে দৃঢ় হয়ে ওঠে –
” হাত নরম হলি চলবি নারে বাজান। শক্ত করতি হবি। লুহার মতন শক্ত করতি হবি। “
বাপের কথা শুনে কালু নিজের হাত দুটো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে নেয়। তারপর মুঠো পাকিয়ে সরল চোখ দুটো নিবদ্ধ করে মুষ্টিবদ্ধ হাতের ওপর। ভাঙাগড়ার প্রত্যয়ে মুষ্টিবদ্ধ সে হাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নতুনের আহ্বান।
শিক্ষার্থী, বিএল কলেজ, খুলনা।