শুনশান নিরবতা। রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুর। নির্জন পুকুরপাড়। যেখানে আপনি মার্বেল পাথরের সিঁড়িতে বসে আছেন। আশপাশে কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো লোকালয় নেই। উত্তরের দিকে গহীন শালবন। দক্ষিণদিকে পাগলার বিল। বিল ও বনের মাঝখানে সবুজ মাঠের ভেতরে এক টুকরো জলাশয়। কে কোন খেয়ালে এ পুকুর কেটেছে তা কেউ জানে না। পুকুরের মালিকানা নিয়ে কেউ দাবি পর্যন্ত করে না। তবে পুকুর নিয়ে প্রচলিত ভৌতিক গল্প কেউ অস্বীকার করতে রাজি নয়। অনেক কথা বলে ফেললাম, থাক ওসব পুরনো আলাপ। নিচে দেখুন সবুজাভ স্বচ্ছ জলের পটভূমিতে আপনার ছবি ভেসে উঠেছে। কি চমৎকার স্থিরদৃষ্টিতে আপনি আপনার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। এখানে আনন্দ মুগ্ধতা বিস্ময়কর রাগ অভিমান কিচ্ছু নেই। তবে নিজের প্রতি আপনার আগ্রহ দেখে সত্যিই ভালো লাগছে। মুখ দেখেই বোঝা যায় মনের ভেতর ঘুরপাক খাওয়া কোনো একটি প্রশ্ন প্রকাশ পেতে চায়। আপনার ঠোঁট নড়ে উঠার আগেই একটি ক্ষুদে জলপোকা জল দর্পণের উপর মৃদু ঢেউ তুলে ছুটে গেল বাঁ প্রান্তে। ঘাসের উপর বসা একজোড়া মাকড়সা অনেকগুলো চোখ মেলে পোকাটাকে লক্ষ্য করছে। শিকার উপযুক্ত দূরত্বে আসতেই শিকারিরা ঝাঁপিয়ে পড়লো। মাংসাশী ক্ষুধা মুহূর্তে মিটে গেল। জলপোকাটা নিঃশেষ হয়ে যাবার পরপরই সব স্থির! স্নিগ্ধ দর্পণে স্পষ্ট জলরঙে দৃশ্যমান আপনি। এই সুন্দর প্রতিচ্ছবি হঠাৎ বিকৃত হয়ে যেতে পারে। তাই বলছি, যদি আপনি অবাক হবার ভান না করে সাবধানতা বজায় রেখে আকস্মিক আচরণগুলো এড়িয়ে যান, তবেই মঙ্গল। একটা কথা বলি শুনুন এখানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু না ঘটলেও কিছুক্ষণের মধ্যে একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে, আচমকা পালাবেন না নিরবে চুপচাপ বসে থাকুন। নিরাপত্তা নিয়ে ভাববেন না, নির্জনতা কখনো বিপদ বয়ে আনে না। বরং মানুষের ভেতরের পশুত্ব যত আশঙ্কার কারণ।
সূর্য রশ্মির তেজস্বী বিকিরণ জল শোষণে ব্যস্ত। পূর্ব পাশে ঝোপের ভেতর দণ্ডায়মান দেবদারু গাছটির ডালে দুটো পিচ্চি কাঠবেড়ালি কোত্থেকে একটা পাকা গাব নিয়ে এসে মাত্র বসল। এক অচেনা পাখির ডাকে পুকুরের মাঝখানে খুঁটিতে বসা মাছরাঙ্গাটা চমকে উঠল। পাড় থেকে জলে নেমে যাওয়া হেলে া ডগার পাশে কয়েক ডজন ব্যাঙাচি কথা বলছে। উত্তরের কোণার দিকে গর্ত দেখা যাচ্ছে ওখানে একটা নিরীহ ঢোঁরা সাপ বাস করে। শুধু নিরীহ নয়, সাপটা আলসেমির ওস্তাদ, দিন দিন মাছ খেয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে অকারণে মোটা হচ্ছে। ঘাটের কাছে একদল বাচ্চা চিংড়ি চোখ তুলে এদিকে তাকিয়ে আছে। এই সব দৃশ্য বা পটভূমির কেন্দ্রে আপনি, আর জলের তলে আপনার ছবি। ছবিটা আজ গল্প শোনাবে, অজানা গল্প যা মুছে গেছে অনেক আগে। কালের কালো গহ্বর থেকে টেনে তুলে আনুন সে ঘটনা। স্মৃতি-বিস্মৃতির মিনার থেকে ওঠে আসা সে গল্প আপনার মুখ থেকেই শুনুন। সে এক রাত দুপুরের গল্প। তার আগে রয়ে গেছে অনেক রাত অনেক দুপুর, সেই সব রাত-দুপুরের সন্ধানে চলুন এগিয়ে যাই।
পাগলার বিলের শেষ প্রান্তে বুড়ো মতি মাতুব্বরের বাড়ি। নামের পাশে মাতুব্বর থাকলেও পূর্বপুরুষদের মতো তার মাতুব্বরি করে দিন কাটেনি, বরং কেটেছে দুঃখে কষ্টে। গল্পের ভেতর আমরা যে সময়ে উপস্থিত হয়েছি, সে সময়ে বুড়োর বয়স পঁচাত্তরের উপরে। এর ঠিক পাঁচ বছর আগে বুড়ি মারা গেছে। তারপর থেকে বুড়োর একা জীবন সংসার। এক সময় তিন ছেলে পাঁচ মেয়ে নিয়ে ঘর ভরা থাকত হাসি আনন্দে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে, বছরে কোনো একবার বাপের খোঁজ করতে আসে বা আসে না। আর ছেলেরা শহরে বউ-বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ততার শীর্ষে। বুড়ো বাপের খোঁজ করার মতো ফুরসত পায় না বললেই চলে। মতি মাতুব্বরের মনের ভেতর জমা দুঃখ দেখবার মতো কেউ ছিল না। হঠাৎ একদিন বুড়ো এক কাজ করে বসল। আর হাটে ফাটলো হাড়ি। চায়ের দোকান থেকে গৃহিণীর রান্না ঘর পর্যন্ত সে খবর পৌঁছল। বুড়ো বিয়ে করেছে।
যাক, তবুও তো বুড়োর কথা বলার মতো কেউ একজন সংসারে এল। নতুন বউয়ের নাম রত্না। ছিপছিপে গড়ন, শ্যামলা বর্ণ। টানা টানা চোখ, চিকন ভ্রু, নাকের ডান পাশে স্পষ্ট একটি তিল।
রত্নার বাবা ছিলো নিতান্ত গরিব। আর গরিব বলেই বুড়োর হাতে কোনোক্রমে মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে জান বাঁচালো। মতি মাতুব্বরের অল্প কিছু জমি আছে, তবে নগদ অর্থ বলে তেমন কিছু নেই। তাই সংসারে অভাব কম-বেশি দৃশ্যমান হতো। ঘরের পাশে কিছু জমিতে সবজি ফলায়। ঘরের চাহিদা মিটিয়ে বাকিটা হাট-বাজারে বিক্রি করে। দুটো পয়সা হলে বুড়ো মাছ হাটে পা বাড়ায়। সাধারণত অনেক দরদামের পর, কিছু ছোটো মাছ নিয়ে বুড়ো ঘরে ফিরে। ধানি জমি যা আছে সবই বোরো ফসলের জন্য। বর্গা চাষে জমি থেকে অর্ধেক ধান আসে, তাই বেচে বছরে যা কিছু আয় হয়, তাতে ঘরের চাল-বেড়া মেরামত চলে। ঝড়-তুফানের সাথে তো বিশ্বাস নেই, যখন-তখন চলে এসে ছোবল দেয়।
বিয়ের পর থেকে বুড়ো, নতুন জীবনের স্বাদ পেতে শুরু করে। তাই, হাট থেকে এক জোড়া কবুতর কিনে রত্নাকে উপহার দেয়। বলে, কইতর থাকলে ঘরে সুখ-শান্তি থাকে।
রত্না কবুতরের সাথে হই চই, টই টই করে বাড়ির আশপাশ ঘুরে-ফিরে। এভাবে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কাটায়। কিন্তু রাতে ঘুমের বিছানায় ঘুম নামে না। শরীরে এক অজানা অসুখ আনচান করতে থাকে। পাশের বালিশে বুড়ো দিব্যি নাক ডেকে ঘুমায়। কত রাত রত্না এপাশ-ওপাশ করতে করতে কাটিয়ে দেয়, কত রাত কেটে যায় জানালার পাশে বসে থেকে, অচেনা কারোর অপেক্ষায়।
একদিন বুড়ো ঠিক বুঝতে পারল রত্না রাতে কতটা অস্থিরতায় ভুগে। জীবন যৌবন বলে তো কিছু আছে। নিজের ক্ষমতা যে ফুরিয়ে গেছে অনেক আগে। তাই মতি বুড়ো নানা গল্প বলে বউকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে। জ্বীন-ভূত-সাপ বেদের নানা গল্প-কিসসা। যত কিসসা বুড়ো বলে না কেন, রত্নার মন ভরে না। হাসির ভান করে অথচ ভেতর থেকে হাসির জোয়ার আসে না। কিন্তু একদিনের গল্পে, রত্না ভীষণ ভয় পায়।
বহুবছর আগে সুখপরী নামে এক জমিদার কন্যা ছিল। দেখতে ভীষণ সুন্দরী! চোখ দুটো হরিণীর মতো! মেয়েটা পুতুল খেলতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করত। জমিদার সুখপরীকে অনেকগুলো পুতুল কিনে দেয়। দেশি-বিদেশি কতশত পুতুল।
বুড়ো গল্প বলার সময়, এক এক করে বহু ধরনের পুতুলের নাম বলতে থাকে। রত্না সেগুলো শোনে এক এক করে গুনতে থাকে। হাতের আঙুলে কড়ায় হিশেব করে সে খেই হারিয়ে ফেলে তবু বুড়োর বলা পুতুলের নাম শেষ হয় না। সোনার পুতুল, রূপার পুতুল, মাটির পুতুল, পাথরের পুতুল, কাঠের পুতুল, টিনের পুতুল, প্লাস্টিকের পুতুল, কাচের পুতুল, কাপড়ের পুতুল, কাগজের পুতুল, জরির পুতুল, মোমের পুতুল, কলের পুতুল, হাতির দাঁতের পুতুল, হাড়ের পুতুল, রাবারের পুতুল, সুঁতোর পুতুল, পাটের পুতুল, পাটকাঠির পুতুল, গাছের ছালের পুতুল, বাঁশের পুতুল, ঝিনুকের পুতুল, শামুকের পুতুল, পাতার পুতুল, বরফের পুতুল, গুড়ের পুতুল, পিঠার পুতুল, মিষ্টির পুতুল, ননীর পুতুল, হাসির পুতুল, গানের পুতুল, কথার পুতুল, নাচের পুতুল প্রভৃতি! এসব পুতুল নিয়ে জমিদার কন্যা হেসে-খেলে বড় হয়। বড় হতে হতে কন্যা শাড়ি পড়তে শেখে। তবুও সুখপরী পুতুল খেলা ছাড়তে পারে না। পুতুলদের ওর ভীষণ ভালো লাগে। যাকে কাছে পায়, তাকেই জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা পৃথিবীতে আর কোন কোন ধরনের পুতুল আছে? কেউ যদি ভিন্ন কোনো পুতুলের সন্ধান দিতে পারত, তখনই মেয়েটা বাবার কাছে আবদার ধরত। এভাবে আরো নানা ধরনের পুতুল সে সংগ্রহ করে।
একদিন সন্ধ্যায় বাগানের শেষ প্রান্তে, মেঠো পথে হাঁটছিল জমিদার কন্যা। তখন সেই পথে এক গেরুয়া পরা এক কাপালিক সন্ন্যাসীকে দেখা যায়। লোকটার হাতে ত্রিশূল, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, মাথায় জটা। কথায় কথায় জমিদার কন্যার সাথে কাপালিক সন্ন্যাসীর আলাপ জমে উঠে। সে আলাপের মাধ্যমেই কাপালিক সন্ন্যাসী জানতে পারে, সুখপরী পুতুল পছন্দ করে।
কাপালিক সন্ন্যাসী জমিদার কন্যাকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, তুমি পুতুলের প্রতি এতো আগ্রহী কেন?
সুখপরী বলে, শখ তাই। পুতুল আমি ভীষণ ভালোবাসি।
তুমি তো অনেক পুতুল দেখেছো! এর মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্য লেগেছে কোন ধরনের পুতুল?
সুখপরী খানিকটা ভেবে বলল, জীব-জন্তুর হাড়ের পুতুল দেখে সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি! ওটা তো মাঝে মধ্যে দেখলে আমি ভয় পেয়ে যাই। তবুও ওটা ভালো লাগে। ধবধবে সাদা হাড়ের পুতুল!
-হুম, বুঝতে পেরেছি। আমি তোমাকে নতুন এক ধরনের পুতুলের সন্ধান দিতে পারি।
-সেটা কিসের পুতুল? ওটা কি আশ্চর্য কোনো পুতুল?
-হ্যাঁ, ভীষণ আশ্চর্যজনক পুতুল!
সেটা দেখতে কেমন?
তুমি কেবল হাড়ের পুতুল দেখেছো। আর ওটা মাংশের পুতুল! শুকনো বা মৃত মাংশ নয়! তাজা মাংশ, দেখতে জীবন্ত! সে পুতুলের শরীরে নেই কোনো হাড়, আছে রক্ত-মাংশ-চামড়ার কারুকাজ, অথচ পাথুরে শক্ত!
-সেটা কোথায় পাওয়া যায়?
-ওটা অনেক কষ্ট-ত্যাগ সাধনা করে লাভ করতে হয়! পূর্ণিমার রাতে যেতে হবে মহাযজ্ঞ সাধনায়!
জমিদার কন্যা সুখপরী বিস্ময়ে চুপ হয়ে গেল। কথায় কথায় সন্ধ্যে নেমে আসে।
এবার কাপালিক সন্ন্যাসী বলে, ওই পুতুল কি তুমি লাভ করতে চাও? যদি ওটা হাতে পাও, তুমি পাবে অনেক ক্ষমতা! তুমি হবে পুতুলের দেবী! আমার সাথে চলো। আমরা তোমাকে সে পুতুলের সন্ধান দেবো! কারণ, তোমার মতো কুমারী নারীই পুতুলের দেবী হবার যোগ্য!
এবার জমিদার কন্যা সুখপরী ভয় পেয়ে যায়। মনের ভেতর সন্দেহ জাগে। আর দৌড়াতে থাকে বাড়ির পথে। কাপালিক সন্ন্যাসীও সুখপরীকে ধরতে পিছু পিছু ছুটতে থাকে। এক সময় সম্মোহনী জাদুমন্ত্রের পানি ছিটিয়ে জমিদার কন্যাকে বন্দি করে। তারপর আস্তানাতে নিয়ে কাপালিক সন্ন্যাসী অপেক্ষা করতে থাকে পূর্ণিমা রাতের জন্য। অবশেষে পূর্ণিমা রাত নেমে আসে বনের ভেতর। আরো অনেক কাপালিক সন্ন্যাসীরা এসে হাজির হয় সেখানে। শুরু হয় মহাযজ্ঞ! আগুন জ্বালিয়ে, সুগন্ধি চন্দন পুড়িয়ে চারদিক মাতাল করে তোলা হয়!
প্রতিটি কাপালিক সন্ন্যাসীর হাতে দেখা যায় একটি করে পুতুল! সত্যিই রক্ত-মাংস-চামড়ায় গড়া পুতুল! দেখতে টগবগে জীবন্ত! সন্ন্যাসীরা নিজেদের পুতুলগুলো হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে। এতো পুতুল একসাথে দেখে ভয় পেয়ে যায় জমিদার কন্যা! সে চিৎকার করতে থাকে। নিদারুণ আর্ত চিৎকার কাপালিক সন্ন্যাসীদের হল্লা ভেদ করে বাইরে বেরুতে পারে না। সবাই সুখপরীর দিকে পুতুল ছুঁড়ে মারে। পুতুলের আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত জর্জরিত হয়ে প্রাণ হারায় জমিদার কন্যা!
গল্প শুনে ভয়ে কুঁকড়ে মরে রত্না! মনের ভেতর কান্না বাধ মানতে চায় না। রত্না তখন জানতো না, এ গল্পটার মতো তারও একটি গল্প রচিত হবে। আর সে গল্প আপনার মতো কোনো শ্রোতাকে নির্জন পুকুর পাড়ে বসে শুনতে হবে, আপন প্রতিচ্ছবির মুখ থেকে। কি কোথাও হারিয়ে গিয়েছিলেন, গল্পের ভেতরেই থাকুন। আর আশপাশে একটু নজর রাখুন বিষাক্ত কোনো সাপ যেন আপনাকে না কামড়ায়! কারণ মতি বুড়ো যখন জোয়ান ছিল তখন এই পুকুরপাড়ে অনেক পদ্মগোখরার বসত ছিল, এখনো দুয়েকটা সর্প পরিবার থাকতে পারে।
বুড়ো মতি অনেক ভেবে-চিন্তে একটা আয়ের উপায় করল। ধান বিক্রি করে চমৎকার একটা ঝাঁকি জাল কিনল। সেই জোয়ান বয়সের মতো আবারো নিজেকে জাগিয়ে তুলতে চাইলো। বউয়ের সাথে পুরনো দিনের মাছ ধরার একগাদা গল্পও শুনিয়েছে। গল্প বলতে বলতেই ইচ্ছেটাও কেমন উথলে উঠতে চাইছে।
বর্ষা আসতেই বুড়ো জাল নিয়ে মাছ ধরতে শুরু করল, গাঁয়ের পূর্বপাশে ঘুঘুরি নদীতে। বাড়ি থেকে খানিকা উত্তর-পশ্চিমে শালবনের ভেতরে কিছুটা পথ, তারপর নদীর বাঁক। বুড়ো সহকারি হিশেবে সাথে নিয়ে গেল পাশের পাড়ার মিস্ত্রির ছেলে বোকা রাজুকে। রাজুকে সবাই বোকা বলত, কারণ সে কাজে-কথায় যথেষ্ট বোকাটে স্বভাবের। পাঁচ টাকা আর পাঁচশ টাকা ছিলো এক সমান ওর কাছে। দু’টাকার বিনিময়ে সে দিনরাত খাটতে রাজি। যারা ভালো মনের তারা ঠিকই ইনসাফ করে মজুরি দিতো। ঠকবাজরা তাকে ঠকিয়ে যেত সবসময়।
রাজু আর বুড়ো মতি নওয়াজ শেখের নৌকা ভাড়া নিয়ে একদিন সারা রাত মাছ ধরল। নৌকা বোঝাই হলো চকচকে চিতল, চাপিলা মাছে। এতসব মাছ দেখে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠে রত্না। এভাবে আনন্দে সুন্দর লাবণ্যে দিন যেতে শুরু করে। মাছ বিক্রির টাকায় বুড়ো একটা নৌকাও কিনে ফেলল।
শেষ রাতে মাছধরা সেরে ঘরে ওরা ফিরত। বুড়োর সাথে বোকা রাজুও কাজে-কর্মে দক্ষতার পরিচয় দিতে থাকে। তাই রাতে মাছ ধরা শেষে বুড়োর বাড়িতেই সে থাকত, সকালে মাছ নিয়ে বুড়োর সাথে হাটে যেত। জাল সেলাই করার মতো বিভিন্ন কাজের কারণে দিনের বেলাও সে বুড়োর বাড়িতে থাকত, কাজের ফাঁকে ঘুমাতো, একসাথে খেতো। এভাবে প্রায় দিন-রাত পুরো সময়টা এখানেই থাকত বোকা রাজু। কখনো কখনো রত্নাও বুড়োর সাথে মাছ ধরতে যাবার আবদার ধরতো। বুড়ো বারণ করতো না, বরং মনে মনে খুশি হয়ে নদীতে নিয়ে যেত। সারারাত ঝাঁকি জাল ফেলে, টেনে তুলে, মাছ ছাড়িয়ে, মাছের লাফালাফি দেখে সবার চোখ চকচক করে উঠত। রাতে ঘুম না আসার ব্যথা কিছু দিনের জন্য ভুলে যায় রত্না।
ঘুঘুরি নদীতে এক সময় নৌকা চুরির মতো ঘটনা ঘটতে থাকে। নদীর ধারে ঝোপের ভেতর চোরেরা উৎ পেতে থাকত, কখন সুযোগ পাবে নৌকা হস্তগত করার। ভোররাতে যখন প্রায় সবাই ঘুমের ঘোরে ডুবে যায় তখন ওরা হাত বাড়ায়। তাই বুড়ো বাধ্য হয়ে নৌকা বনের ঘাটে নিয়ে পাহারা দিয়ে রাখত। কখনো নিজেই পাহারা দিতো, আবার কখনো বোকা রাজুকে দিয়ে পাহারার ব্যবস্থা করত। যে রাতে বুড়ো নিজেই নদীতে থাকত, সে রাতে রত্না বোকা রাজুর মধ্যে পুরুষত্বকে জাগিয়ে তুলতো। বোকা আনন্দের অনুসন্ধান পেয়ে বিগলিত হয়ে উঠতো। তারপর থেকে রত্নার পুরনো অস্থিরতা আর দেখা যায়নি।
ওদের এই গোপনীয়তা কখনো কখনো বুড়োও বুঝতে পারত। তবু মেনে নিতো সহজ ভাবনায়, সুখ ও সন্তোষের উদ্দেশ্যে। বরং কখনো কখনো রাতে বোকা রাজুকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতো, রত্নাকে সোহাগের উদ্দেশ্যে।
একরাতে রত্না বুড়োর সাথে নদীতে মাছ ধরতে যায়। মাঝরাত পর্যন্ত চলে মাছ শিকার। তারপর বুড়ো রত্না ও বোকা রাজুকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে, নৌকা খালের ভেতর লুকিয়ে, পাটাতনে বিছানা পেতে শুয়ে পড়ে।
স্কুল মাঠ পেরিয়ে, খেতের আল পেরিয়ে, বনের অন্ধকার পেরিয়ে পথ পেরুতে থাকে রত্না ও বোকা রাজু। সেই রাতে স্কুল মাঠে, ঈদগা মিনারের পাশে একদল হায়েনা তাস খেলা ও নেশায় মগ্ন ছিল। চোখের সামনে থেকে নারী মাংসের ঘ্রাণ ওদের নাকে যায়। সেই থেকে ওরা পিছু নেবার ভাবনায় প্রবেশ করে। আর ওরা বিকল্প পথে রত্নার পিছু নেয়। বোকা রাজু ও রত্না বন পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠতেই হায়েনারা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ওর মুখ চেপে ধরে নিয়ে যায় মাঠের মাঝখানে পুকুরপাড়ে। বোকা রাজুকে বেধে রাখে বটগাছের সাথে।
আপনি যে ঘাটে বসে আছেন, এই এখানেই মুখ চেপে নিয়ে আসা হয় রত্নাকে। ওর বাঁচার আকুতি চিৎকার চেঁচামেচি লোকালয় অবধি পৌঁছার সুযোগ পায় না, অনায়াসে প্রতিধ্বনি তোলে মিলিয়ে যায়। শকুনেরা ধারালো নখের আঁচড়ে খুবলে খায় রত্নার গোটা শরীর! জিপারের তল থেকে বেরিয়ে আসে আঠারোটা জীবন্ত হিংস্র ধারালো পুতুল! চামড়ার পুতুল! মাংশের পুতুল! মাংশাসী পুতুল! আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে তোলে রত্নার উরু সন্ধি! চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে রত্নার স্তন ছেঁড়া মাংস! যোনী ছেঁড়া রক্ত পুকুরের মার্বেল পাথরের ঘাট থেকে এঁকেবেকে নেমে যায় জলের ভেতর! ভোরের আলোয় দেখা যায় ক্ষত-বিক্ষত রত্নার বিকৃত মুখ, যেখানে কেবল হায়েনার দাঁতের কামড়! ঘাটের এপাশ থেকে ওপাশ পাথরের গায়ে রক্তাক্ত মাংস লেপ্টে থাকে চিরকালের জন্য! আর পরদিন বুড়ো রাগের বশে বোকা রাজুকে কুপিয়ে খুন করে। এই গল্প আমি আপনাকে কেন শুনতে বলেছি জানি না। তবে ঘাটের জলে তাকিয়ে দেখুন, সন্ন্যাসীদের মতো ঐ আঠারো জনের প্রতিচ্ছবি পুকুরের জলে ভেসে উঠেছে। ওখানে কেউ আপনার ভাই, পুত্র, বন্ধু, শ্যালক, সমন্ধী, শ্বশুর, চাচা, মামা, নানা, দাদা, ফুপা, খালু, তালৈ, পিতা, কিংবা আপনি নিজেও আছেন। আর আমিও কেন বাদ যাবো? আমিও তো, ওদের মতো সেই পুরুষ পরিচয় নিয়েই পৃথিবীতে আছি, ধারণ করেছি মাংসের পুতুল। ভবসংসারে কালের ধারাবাহিকায় নানা রূপে বিচিত্র প্রতিনিধিত্ব আমাদের কাঁধে চাপে। আর ধর্ষক কিংবা হায়েনা তকমাটাও এসব প্রতিনিধিত্বের বাইরে নয়, লুকিয়ে থাকা পাথুরে মাংসের মাংসাশী পুতুল হিংস্র হলে নারীর জন্য কতটা দুঃসহ, তা পুরুষ জাতি কবে বুঝবে? আমরা কবে বুঝবো? যে পুরুষত্ব মনুষ্যত্বকে গলা টিপে খুন করে, তা কেবলই পশুত্ব। আসুন এই পশুত্বকে বলি দেই..!