গল্প- ফিরে দেখা- আব্দুল্লাহ অপু 

গল্প- ফিরে দেখা- আব্দুল্লাহ অপু 

পুরনো ঢাকায় একটা রেস্টুরেন্ট আছে। সাইনবোর্ডে রেস্টুরেন্টের নাম পরিস্কার বোঝা যায় না তবে তাতে কাস্টমারদের খুব একটা সমস্যা হয় না। যেকোনো রিকশাওয়ালাকে বললেই হবে, আলি ভাইয়ের হোটেলে নিয়ে চল। রিকশাওয়ালা ভাড়া নিয়ে মূলামুলি করে না আবার বিরক্তি ভাব নিয়ে বলেও না, ওইদিকে যামু না। মধ্যবয়স্ক একজন লোক এখন বংশাল রোডে এসে আলি ভাইয়ের রেস্টুরেন্ট খুঁজে বেড়াচ্ছেন কিন্তু খুঁজে পাচ্ছেন না। ভদ্রলোক আলি ভাই নামটা ভুলে গেছেন! সবাইকে জিজ্ঞেস করছেন, আলাল ভাইয়ের হোটেল কোথায়?

ভদ্রলোক আলি ভাইয়ের রেস্টুরেন্ট খুঁজতে থাকুক, এখন তাঁর পরিচয় দেয়া যাক। ডঃ গোপাল কৃষ্ণ সাহা। আজ থেকে প্রায় বাইশ বছর আগে তিনি ঢাকা ছেড়েছেন। দেশে থাকতে শিক্ষকতা করতেন লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে। এখানে তিনি পলিমার কেমিস্ট্রি পড়াতেন, পরে উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনে চলে যান। সেখানে লীডস ইউনিভার্সিটিতে পিএচডি করেন পলিমার কেমিস্ট্রিতে। উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরবেন এমন সময় বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে। লন্ডনে বসেই তখন তিনি খবর পেতেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নির্যাতন হচ্ছে প্রতিনিয়ত তবে তিনি মন থেকে মানতে পারতেন না, কিছুকিছু ক্ষেত্রে তাঁর মনে হতো পত্রিকায় অতিরঞ্জিত খবর প্রচার করা হচ্ছে। দেশে থাকতে কখনই তাঁর নিজেকে সংখ্যালঘু মনে হয়নি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে তিনি তখন গর্ব করতেন ভারতের বন্ধুদের কাছে। যাই হোক, স্ত্রীর অনুরোধে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধুর পরামর্শে ডঃ সাহা থেকে গেলেন লন্ডনে। লীডস ইউনিভার্সিটিতেই যোগ দিলেন গবেষক হিসেবে, এভাবে এক বছর দুই বছর করতে করতে প্রায় বাইশ বছর কেটে গেল। এতবছর পর তিনি এবার ঢাকায় এলেন দুর্গাপূজা করতে। শৈশব কৈশোর কেটেছে পুরনো ঢাকায়, এখানকার পূজা মানে স্বার্বজনীন উৎসব। কেনাকাটা, আলোকসজ্জা, খাবার বিতরন করা দেখে বোঝার উপায় নাই এটা হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এখানে হিন্দু মুসলমান সবাই উৎসব পালন করে। বলা চলে কাপড় চোপড় কেনাকাটা মুসলমানরাই বেশি করে থাকে! ছেলেমেয়েরা লন্ডনে পূজা দেখে মজা পায় না যখন তারা টিভিতে দেখে পুরনো ঢাকার পূজার খবর, আর ডঃ সাহার তো দমবন্ধ অবস্থা হয়ে যায় এই সময়টাতে। এবার তিনি এসেছেন সবাইকে নিয়ে ঢাকার পূজা দেখাতে। গত বাইশ বছরে শহরের অনেক পরিবর্তন হয়েছে যদিও পরিবর্তনের হাওয়া পুরনো ঢাকায় খুব একটা লাগেনি।
শেষমেশ অনেক খোঁজাখুঁজি করার পর ডঃ সাহা সন্ধান পেয়েছেন আলি ভাইয়ের রেস্টুরেন্টের। সাইনবোর্ড সেই আগের মতই জীর্ণশীর্ণ, দেখে বোঝার উপায় নাই প্রতিদিন গড়ে এখানে লাখ খানেক টাকার বেচাকেনা হয়! মোরগ পোলাও খেতে খেতে তাঁর মনে হচ্ছে সেই আগের স্বাদ, সবকিছু যেন আগের মতই আছে। পোলাও খাওয়া শেষে ডঃ সাহা যখন বোরহানিতে চুমুক দিতে যাবেন তখন ক্যাশ কাউন্টার থেকে ছুটে আসেন ম্যানেজার সাহেব। বয়স চল্লিশের বেশি হবেনা তবে সারাক্ষণ পান খেয়ে মুখ লাল করে রাখেন বলে বয়স কিছুটা বেশি মনে হয়। ক্যাশে বসে থাকতে থাকতে ওজনও বেড়ে গেছে অনেকটা, সাদা লুঙ্গি পরে থাকেন, বুক পকেটে একটা চিরুনি রাখা আছে। সব মিলিয়ে তাঁর চেহারায় বাড়তি বয়সের ছাপ এসে গেছে।
স্যার, ভাল আছেন? পরিস্কার বাংলায় প্রশ্ন করেন ম্যানেজার সাহেব। সচরাচর তিনি উর্দু বাংলা মিলিয়ে কথা বলেন আর বাংলা যা বলেন তা প্রমিত বাংলা না, পুরনো ঢাকার ভাষায় কথা বলেন।
জি ভাল আছি। আপনি এই রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার?
জি স্যার, আপনাদের দোয়ায়। আমারে চিনছেন স্যার?
একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন ডঃ সাহা। তিনি চিনতে পারছেন না ম্যানেজার সাহেবকে। স্যরি, আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না। আই এম এক্সট্রিমলি স্যরি।
না, না। ঠিক আছে স্যার। স্যরি কওনের কিছু নাইক্কা। আমি এই হোটেলের ম্যানেজার। আপনেরে আমি চিনি। ঢাকা ভার্সিটিতে আপনে ছিলেন। বিদেশ গিয়া ভাগছেন, আর আহেন নাই। হা হা হা…..
ডঃ সাহা বেশ মজা পাচ্ছেন ম্যানেজার সাহেবের কথায়। আন্তরিক ভঙ্গিতে বেচারা কথা বলে যাচ্ছেন অথচ তিনি এই লোককে চিনতেই পারছেন না। এক সময় তিনি প্রচুর আসতেন এই রেস্টুরেন্টে। হতে পারে ম্যানেজার সাহেব তখন এখানেই বয়গিরি করেছে। সে সময় আলি ভাই নিজেই বসতেন ক্যাশ কাউন্টারে। এখন হয়তো তাঁর ছেলেরা নতুন ঢাকায় শিকড় গেড়েছে।
ম্যানেজার সাহেব! অনেক বছর দেশে ছিলাম না তো, তাই ভুলে গেছি অনেক কিছুই। আপনি কিছু মনে করবেন না।
আরে, কি যে কন স্যার? আপনে মনে কইরা আইছেন, আমি চরম খুছি হইছি।
জি, ধন্যবাদ। রেস্টুরেন্টে ভীড় তো দেখছি ভালই, ডেকোরেশন পাল্টান নাই কেন?
এডি আপনে বুঝবেন না স্যার। ঘছামাজা করবার গেলে বরকত কইমা যাইব। বেচাবিক্রি কইমা যাইব স্যার। আপনেরা এডি বুঝবার পারবেন না।
আচ্ছা, আচ্ছা। ম্যানেজারের কথায় বেশ মজা পান ডঃ সাহা। এটা মূলত পুরনো ঢাকার মানুষের একটা বদ্ধমূল ধারণা, ডেকোরেশন চেইঞ্জ করলে ব্যবসা নষ্ট হয়ে যাবে।
এত বছর পর কী মনে কইরা আইলেন স্যার?
তেমন কিছু না, ছেলেমেয়েদের পূজা দেখাতে নিয়ে এলাম। ঢাকার পূজা বলে কথা!
আর কইয়েন না স্যার। অহন আর সেই আগের দিন নাইক্কা। আগের সেই মজা আর নাই স্যার। অহন ছবকিছু ডিজিটাল হইয়া গেছেগা। হোটেলে খাইতে আইয়া পুলাপান সেল্ফি তুলে, ফেসবুক চালাচালি করে, কেউ কারো লগে কথা ভি কয় না। অর্ধেক খাইয়া, না খাইয়া বিল দিয়া যায় গা। বুঝেন অবস্থা! পূজার অনুষ্ঠানেও সেল্ফি তুলব পুলাপান, কেউ কারুর লগে কথা কয় না, মুরুব্বিগো আদাব সালাম কিছু দেয় না। নষ্ট হইয়া গেল স্যার, ছব নষ্ট হইয়া গেল গা।
.
.
ঢাকা,বাংলাদেশ ।

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
This Will Fundamentally Change the Way You Look at Technology

This Will Fundamentally Change the Way You Look at Technology

Cursus iaculis etiam in In nullam donec sem sed consequat scelerisque nibh amet, massa egestas risus, gravida vel amet, imperdiet volutpat rutrum sociis quis velit, ...
ছাইলিপি ই-শারদ সংখ্যা-২০২০

ছাইলিপি ই-শারদ সংখ্যা-২০২০

প্রিয় পাঠক, শারদীয়ার শুভেচ্ছা গ্রহন করুন! আশাকরি বিশ্বের এই খারাপ পরিস্থিতি আপনি এবং আপনার পরিবারের সবাই ভালো আছেন কিংবা ভালো থাকার চেষ্টা করছেন।  এসেছে শারদোৎসব। ...
আজ ফাগুনে

আজ ফাগুনে

হামিদা আনজুমান একটা চিঠি লিখব তোমায় বলে কত ফাগুন দোল দিয়ে যায় চলে। কিশলয়ের সবুজ ছুঁয়ে ছুঁয়ে ভ্রমর যখন ভালোবাসায় নুয়ে বলে কথা ফুলের কানে ...
হারাবো যেদিন

হারাবো যেদিন

জিয়াউল মোস্তফা জিসান কেন জানি খুব ভয় হয় আমার দিনশেষে, যদি হুট করে হারিয়ে যায় না ফেরার দেশে! ভয় হয় খুব যদি হারায় দূরে আর ...
ভোরের আজান ও আশা পূরণের কাব‍্য

ভোরের আজান ও আশা পূরণের কাব‍্য

মহীতোষ গায়েন ভোরের আজান সেরে আব্বাজান বলেছিল– দেখে নিস খুকি,এবারের খাল ধারের ঐ চিলতে জমি টুক্ আমরা সরকারের কাছ থেকে পাট্টা পাব… আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই ...
ভ্রমণকাহিনী- সুন্দরবনের জলে জঙ্গলে- ডঃ গৌতম সরকার

ভ্রমণকাহিনী- সুন্দরবনের জলে জঙ্গলে- ডঃ গৌতম সরকার

ডঃ গৌতম সরকার   ” বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে  বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে  দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা  দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু ;  দেখা ...