কিশোর পন্ডিত
পানি ছাড়া যেমন মাছ বাঁচে না টেকা ছাড়া তেমনি পুরুষ বাঁচে না বাজান। টেকা অইল পুরুষ মানুষের প্রাণ। আবার মুরুব্বিরা কইয়া গেছে টেকার অভাব কোনদিন যায়না। গাঁও গেরামে একখান কথা আছে “যত টেকা তত ঠেকা।” কথাগুলি বলছিল হোসেন আলী তার সতের বছরের ছেলে ইব্রাহিমকে। রিক্সার ড্রাইভার হোসেন আলী তার ছেলেটাকে একই শিক্ষা দিয়েছে। রিক্সা চালিয়ে সংসার চলে না। কারণ এবার তার মা দুরারোগ্য ব্যধিতে মারা গেছে। বাপ -বেটার অতি কষ্টের রোজগার নিমিষেই ফুরিয়ে যায়। তারপর সংসারে দেনার পরিমাণ বেড়ে যায়। ঋণ পরিশোধের জন্য হোসেন আলী দিনের পর দিন ডবল পরিশ্রম করে। এদিকে ইব্রাহিমের বিয়ের বয়স হয়েছে তাই হোসেন আলী ঘটকের মাধ্যমে ছেলের বিয়ে দেন সুন্দরী কুলসুমের সাথে।
সময়ের চাকায় দিন ফুরিয়ে আসে হোসেন আলীর। সংসারের ঘানি টানতে টানতে শরীর ভেঙে যায় আর সাথে আসে বার্ধক্য। ছেলের ঘরে নাতি-নাতনি আসে। ছেলের কাছে তার আদর কমতে থাকে সন্তানদের বাড়তে থাকে।
হোসেন আলীর মনে পরে একদিন গ্রীস্মের দুপুরে খেলারস্হলে টিনের ঘরের চালে উঠেছিল। সেদিন তার বাপ কত বকাবকি করেছিল। সে তার বাপরে বলেছিল, আমি চালে উঠছি এতে যুদি আমার পাও পোড়ে তাতে তোমার কি? উত্তরে তাঁর বাপ বলেছিল,এহন বুঝবিনা যেদিন বাপ অইবি হেইদিন বুঝবি আমার কি? হোসেন আলী মনে মনে ভাবে, হেদিন বুঝি নাই আইজ বুঝি। পোলাপাইনের জন্য বাপদের কত মায়া। “আসলে পোলাপাইনের জন্যে বাপদের যত মায়া পোলাপাইনের কিন্তু বাপদের জন্যে তত মায়া থাকে না।”
নতুন নতুন কুলসুম কন্যার মত আদর দিলেও আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে তার আসল রূপ। ইব্রাহিমকে সব সময় অশান্তিতে রাখে। বাপের বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ দেয় সে। প্রথম প্রথম অভিযোগ কানে নেয়নি ইব্রাহিম। বুইড়া মানুষ হারাদিন ঘরে বইয়া থাকে একটু কেটর কেটর তো করবই। একটু সবুর কর, আর কয়দিন?
বাজানের তো বয়স কম অয় নাই,বলে ইব্রাহিম। একদিন বৈশাখ মাসের দিনের শেষ বেলা পশ্চিম আকাশে মেঘ। কামাই রোজগার তেমন হয় নাই।গরমের দিন অনেক পরিশ্রম গেছে। সচরাচর যেমন বাড়ি ফিরে আজ তার আগেই রিক্সা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে ইব্রাহিম। চাহিদা মতো সংসারের সকল বাজার ঘরে আসে নাই। বাজারের ব্যাগ খুলে দেখে আর জ্বলে ওঠে কুলসুম। বাড়ি আসতে না আসতেই তার বাবার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে। এমনিতেই মন খারাপ তার উপর কুলসুমের অত্যাচার। ক্ষেপে যায় ইব্রাহিম। বাপেরে গালি দিয়ে বলে, হালার বুইড়া,আইজ দেখাইমু তোরে, সুখে থাকতে ভুতে কিলায়। বইয়া বইয়া খাইতে বালো নাগে না, বলেই হোসেন আলীর ঘাড়ে ধরে টেনে হিচরে নিয়ে বাইর বাড়ির ক্ষেতের কোণায় ফেলে রেখে আসে।
সন্ধ্যা হয়ে আসে আকাশের মেঘ ঘন কালো হয়ে আসে। ইব্রাহিমের স্কুল পড়ুয়া দশ বছরের ছেলে বলে, “বাবা আমাদের স্যার কইছে ছোটরা বড়দের দেখে শিখে, আমিও তো তোমারে দেইখা শিখুম।” বৃষ্টি আইতাছে দাদারে ঘরে নিয়ে আহো। ইব্রাহিম ছেলের মুখের দিকে তাকায়, বাপের কথা মনে পড়ে। দৌড়ে বাপেরে ঘরে আনতে যায়। হোসেন আলী বলে,আমারে ঘরে নিয়া যাইতে আইজস যামু, তয় আমার আর একটা উপকার করতে অইবো। এইহানে না, তুই আমারে আরেকবার ঘাড়ে ধইরা ওই খেজইল গাছের তলায় রাইখ্যা আয়। আমিও তোর মায়ের কথায় আমার বাপেরে ঘাড় ধইরা ওই খেজইল গাছের তলায় রাইখা আইছিলাম।
আমারে পাপি কইরা তোমার গুনাহ কুমাইবার চাইছ বাজান? বলে ইব্রাহিম । তুই পাপি অইবি কেন, আমিতো তরে মাপ কইরাই দিছি। আমারে কেরায় মাপ করব? হোসেন আলী কান্নায় ভেঙ্গে পরে। ইব্রাহিম তার বাপকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে যায়। কুলসুম তার ঘরে খাবার দিয়া যায়। “অবুঝ শিশু বাপকেও লাথি মারে তাতে বাপের জাত যায় না”। কিন্তু বোঝমান সন্তানেরা যদি জন্মদাতা বাপকে বেজ্জতি করে তবে সে বাপের বেঁচে থাকার আশা বা অধিকার কোথায়? হোসেন আলী বুঝেছিল পরপারে পথ হাঁটাই এখন তার উত্তম সময়।
রাতে ভারী বৃষ্টি হয় কিন্তু তেমন ঝড় হয় নাই। সকালে ইব্রাহিম দেখে তার বাপ ঘরে নেই। রাতের খাবার পড়েই আছে। খেজুর গাছের কাছে মানুষের কোলাহল শুনে সে সেখানে যায়। গিয়ে দেখে খেজুর গাছটি মূল সহ উপরে পড়ে গেছে। তার নিচে হোসেন আলীর নিথর দেহ।