ইমন শেখ
সকাল থেকে বেশ খাটুনি গেছে শিউলির। দুপুরে রান্না খাওয়ার পাট চুকিয়ে অবসন্ন শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিতেই ঘুমে বুঁজে আসে তার চোখ। কিন্তু ঘুমটা গাঢ় হতে না হতেই হঠাৎ লোডশেডিং। ঘূর্ণনের হাত থেকে রেহাই পেয়ে সিলিংয়ে ঝুলন্ত ফ্যানটি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। ওদিকে গুমোট গরমে বিছানার ওপর হাস পাস করছে শিউলি। নাহ, আর ঘুমানো সম্ভব না। অগত্যা তাকে বিছানা ছাড়তে হয়। ঘুম জড়ানো ভারী চোখ নিয়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়ায় সে। তার কপালে তখন বিন্দু বিন্দু ঘাম। শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘাম মুছে বাইরের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করতেই দূরের কদম গাছের সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। পাতার ফাঁকে উঁকিরত কদমগুচ্ছ যেন তাকে দেখে ফিক ফিক করে হাসছে। সবুজ পাতার সাথে লেপটে আছে সেই সাদা হাসি। দুচোখে অপার বিস্ময় নিয়ে শিউলি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। আর তখনই একটা ঠান্ডা বাতাসের ঝাঁপটায় চাঙা হয়ে ওঠে তার অবসন্ন শরীর। তার মুগ্ধ প্রসন্ন দৃষ্টি এবার প্রসারিত হয় আকাশ পানে। সেখানে তখন গর্জনরত ধূসর কালো মেঘের অবিরাম দৌড়ঝাঁপ। এই মেঘমেদুর পরিবেশে হঠাৎ করে জেগে ওঠে তার কবিসত্তা। তার কল্পনার মানসপটে ভেসে ওঠে একটি ছোট্ট কুঁড়েঘর। তার আঙিনায় এলো চুলে দাঁড়িয়ে আছে এক নাম না জানা মেয়ে। বুকে তার গভীর তৃষ্ণা। ডাগর চোখের জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সে চেয়ে আছে ভাসমান মেঘের পানে। কী জানতে চায় ওই মেয়ে? এই যে মেঘদূত, তার কোন খবর আছে? মেঘদূত কী উত্তর দেয় কে জানে! কিন্তু মেয়েটার চোখে যে জল। তাহলে কি মেঘদূতের কাছে তার জন্য কোন বার্তা নেই? নেই বলেই কি তার বিরহ কাতর চোখ বাধ মানছে না? নাকি বহুদিন পর প্রিয়জনের খবর পেয়ে আনন্দে জল এসেছে তার চোখে? ব্যাপারটা বেশ অস্পষ্ট। তবে সজল নয়ন দেখে মেয়েটার ওপর শিউলির বেশ মায়া হয়। মেঘেদেরও বুঝি মায়া হয় ওর ওপর। তাইতো অঝোরে বৃষ্টি ঝরিয়ে ধুইয়ে দিতে চায় ঐ সজল চোখ। মুক্তো দানার মতো বৃষ্টি ফোঁটা পরম মমতায় এসে মেশে সেই চোখের জলে। হঠাৎ ঠান্ডা শীতল স্পর্শে কল্পনায় ছেদ ঘটে তার। ওমা! এ যে সত্যি সত্যি বৃষ্টি নামলো। এতক্ষণে ইজি চেয়ারটা টেনে নিল সে। গুছিয়ে বসতে না বসতেই শ্বশুরের গলার খিনখিনে চিৎকার ভেসে এলো কানে- অ বউমা। বলি চা-টা কি জুটবে না আজ?
শ্বশুরের তাগাদায় উঠে পড়ে সে। ভদ্রলোক ভীষণ চা পাগল। ভাত না পেলে আপত্তি নেই। কিন্তু নিয়মমাফিক চা তার চাই-ই চাই। শ্বশুরকে চটজলদি এক কাপ চা করে দেয় শিউলি। তারপর বেলকনিতে গিয়ে আবারও চেয়ারটা টেনে নেয়। বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমলেও আকাশে তখনো ধূসর মেঘের ছুটোছুটি। তার খুব ইচ্ছে হয় মেঘের ভেলায় চড়ে বৃষ্টিস্নাত সতেজ বিকেলের এই অপরূপ শোভায় হারিয়ে যেতে। থেকে থেকে ঠান্ডা বাতাস আর বৃষ্টির ঝাপটায় শিহরিত হয় তার শরীর আর মন। বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতির সাথে ভীষণভাবে একাত্ম হতে চায় সে। কিন্তু এ প্রচেষ্টায় বাধ সাধে তার ছোট দেবর রূপম। এই বৃষ্টিতে ফুটবল খেলে কাঁদা মেখে একেবারে ভূত হয়ে বাড়ি ফিরেছে। গেটে দাড়িয়ে তোয়ালে আর শ্যাম্পুর জন্য চিৎকার করে বাড়িঘর মাথায় করে তুলেছে। অগত্যা তাকে ছুটতে হলো নিচে। ততোক্ষণে বিকাল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা। এদিকে অনেক কাজ বাকী। আবার ওদিকে বৃষ্টির হাতছানি।দোটানায় পড়ে যায় সে। তবে শ্বাশুড়ির কড়া আদেশে তার মাথা থেকে হাওয়া হয়ে যায় বৃষ্টি বিলাশ। রান্নাঘরে ঢুকে তেল গরম করার কাজে লেগে যায় সে। মাজার ব্যাথাটা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় বউমার ওপর এই ফরমান জারি করেছেন মহামান্য শ্বাশুড়ি। ইতিমধ্যে পলাশ মানে তার স্বামী অফিস থেকে ফিরে এসেছে। ছাতা না নিয়ে বের হওয়ায় কাক ভেজা হয়ে ফিরেছে বেচারা। এমনিতে অফিসে আজ কাজের চাপ ছিল বেশি তারপর আবার বাসে সিট না পেয়ে সারা রাস্তা দাড়িয়ে আসতে হয়েছে। তাছাড়া ট্রাফিক জ্যাম তো নতুন কিছু নয়। এক ঘন্টার পথ যেন তিন ঘন্টাতেও শেষ হয় না। সবমিলিয়ে তার মেজাজটা বেশ বিগড়ে ছিল। শিউলিকে দেখা মাত্রই তার গলার স্বর চড়ে গেল। যেন সবকিছুর জন্য শিউলিই দায়ী। ট্রাফিক জ্যাম, বাসে সিট না পাওয়া, বৃষ্টি সবই যেন তার চক্রান্ত। কিছুক্ষণ হম্বিতম্বি করে পলাশ গোসলখানায় ঢুকে গেল। এই অভিজ্ঞতা অবশ্য শিউলির নতুন নয়। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট পেলেও ইদানিং অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেছে। তাছাড়া রেগেমেগে বাদপ্রতিবাদ করা তার স্বভাব বিরুদ্ধ। তাই সে চুপচাপ পলাশের জন্য জল খাবার তৈরীতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর সে যখন লুচি আর হালুয়া নিয়ে ঘরে ঢুকল পলাশ তখন টিভিতে বিপিএল ম্যাচে মগ্ন। নিঃশব্দে লুচির প্লেট তার সামনে রেখে সে আবার গিয়ে বেলকনিতে বসল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর ঠান্ডা হাওয়ার পরশে তার মনটা যেন একটু হালকা হলো। অন্ধকারে শূন্যে দৃষ্টি প্রসারিত করে চুপচাপ বসে থাকতে বেশ ভালো লাগছিল তার। তবু উঠে পড়তে হলো বাপ্পার জন্য। বাপ্পা তার ছেলে। সামনেই ওর পরীক্ষা। আর ও কিনা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে! বাপ্পাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে বই নিয়ে পড়াতে বসল সে। ওদিকে আবার রাতের রান্না বাকী। পলাশ যদি বাপ্পার হোমওয়ার্কটা একটু দেখিয়ে দিত! চিন্তাটা মাথায় উঁকি দিতে না দিতেই মিলিয়ে গেলো। সারাদিন বেচারা অফিসে খেটেছে, এখন শান্তিতে একটু বিশ্রাম নিক। এ কথা ভেবে সে নিজেই ছেলের হোমওয়ার্কটা ঝটপট দেখিয়ে দিয়ে রান্না করতে গেলো।
রান্নাবান্না শেষ করে খাওয়া দাওয়ার পাট চুকাতে বেশ রাত হলো। শ্বশুরকে হাঁপানির ট্যাবলেটটা খাইয়ে দিয়ে বাপ্পার জন্য এক গ্লাস দুধ নিয়ে নিজের ঘরে ফিরল সে। কিন্তু বাপ্পা ততক্ষণে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েছে। ছেলেটা দুধ না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ায় তার আফসোসের আর সীমা রইল না।কাল থেকে সন্ধ্যা বেলাতেই ওকে দুধ দিতে হবে। মনে মনে এ সিদ্ধান্ত স্থির করল সে। তারপর ঘরের লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে বেলকনিতে গিয়ে বসল। যাক এতক্ষণে একটু অবসর পাওয়া গেল। চোখ বন্ধ করে মেডিটেশনের কায়দায় দুহাত প্রসারিত করে লম্বা একটা শ্বাস নিলো সে। বাইরে তখনও বৃষ্টি ঝরছে। বৃষ্টির মতোই শিউলির দুঃখ ক্লান্তি সব যেন ঝরঝর করে ঝরে পড়লো। নিজেকে বেশ নির্ভার মনে হলো তার। আর তখনি গানটি মনে পড়লো। ‘আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে দুয়ার কাপে, ক্ষণে ক্ষণে ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে।’ আস্তে আস্তে লাইন দুটো গুনগুন করলো কিছুক্ষণ।
রাত বাড়ছে, সেই সাথে বৃষ্টিও। চারদিক নিস্তব্ধ। কেবল অঝোরে ঝরতে থাকা বৃষ্টির শব্দ। প্রকৃতি যেন বহুকালের বহু যুগের সঞ্চিত কথা শব্দের পর শব্দ, ছন্দের পর ছন্দ সাজিয়ে অনর্গল বলে যাচ্ছে। সেও মনোযোগী শ্রোতার মতো তন্ময় হয়ে শুনে চলেছে সেই সুর সুধা। তার শরীর এবং মনে এক স্বর্গীয় প্রশান্তি নেমে এলো। নিজেকে তার মনে হলো যেন বোধি বৃক্ষের নিচে ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ। এভাবেই যদি অনন্তকাল কাটানো যেত! হঠাৎ কাঁধের ওপর উষ্ণ বাহুর স্পর্শে তার ধ্যান ভঙ্গ হলো। এই হাতের স্পর্শ তার অচেনা নয়। বিদ্যুতের চমকে পলাশের ফর্সা মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মুহূর্তেই তার মুখের ভাষা পড়ে নিল শিউলি। চেনা মুখের অতি চেনা অভিপ্রায় বুঝে নিতে অসুবিধা হলো না তার। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পালাশের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বিছানার দিকে এগোতে থাকে সে। এদিকে শ্রাবণের অকৃত্রিম আমন্ত্রণে তখনো কেঁপে কেঁপে উঠছে তার অন্তরের দরজা। কিন্তু ঐ দরজা খোলার অবকাশ কোথায় তার? থাক, ও দরজা খুলে কাজ নেই। ওটা বন্ধই থাক।
খুলনা, বাংলাদেশ ।