অণুগল্পগল্পছোট গল্প

ছোট গল্প: আগন্তুক

 আশিক মাহমুদ রিয়াদ 

গাছের মগডালে হুতুম পেঁচা ডাকছে।নভেম্বার মাসের শেষ।শীত শীত লাগছে। চারদিকে নিস্তব্ধতা। নিশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। গ্রামের পথে পথে হাটছে আফজাল ডাকাত আর তার সহযোগীরা। ধানভাঙা গ্রামের কুদ্দুস মেম্বারের বাড়িতে আজকে ডাকাতি করবে। কুদ্দুস মেম্বারের ছোট ছেলে কয়েকদিন আগে বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছে৷ অনেকদিন পরে এত বড় একটা সুযোগ মিললো আফজাল ডাকাত দলের। ডাকাত দলের প্রধান আফজাল মিয়া ডাকাতি জীবন শুরু করেছে বছর বিশেক আগে থেকে। গায়ের লোক তাকে এক নামে চেনে।আফজাল ডাকাতের নাম শুনলেই মানুষ কেমন আতংকিত হয়ে ওঠে।অনেকটা পথ পেরিয়ে আফজাল মিয়া এখন কুদ্দুস মেম্বারের প্রধান দরজার সামনে । দরজার কায়দা করে খোলা হচ্ছে৷ এই কায়দা করে দরজা খোলার কাজটি করছে শানু। সে এসব কাজ ভালো ভাবে করতে পারে। দরজা খোলার পরে আস্তে আস্তে করে ডাকাত দলটা ঢুকলো ঘরের ভিতরে। সবাই ঘুমে বিভোর কেউ জেগে নেই।

তখনো জেগেছিলো বিলেত ফেরত মোকাদ্দেস। সে ফিসফিস আওয়াজ শুনতে পেলো। সাথে পা টিপে টিপে হাটার শব্দ। কৌতূহল বশত দরজাটা একটু ফাক করে দেখলো। ভড়কে গেলো কিছুটা, এ তো ডাকাত দল! মোকাদ্দেস তার বাড়ির পাশের বন্ধুকে খবর দিলো। সে পুলিশে চাকরী করে৷ ছুটিতে গ্রামে এসেছে৷ কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশের বাশির শব্দ পাওয়া গেলো।ইদ্রিস সাহেবের বাড়ি ঘিরে রেখেছে পুলিশ। আফজাল মিয়া ঠোটে কামড় দিলো। বুদ্ধি বের করতে হবে একটা। কোন ভাবেই পুলিশের হাতে ধরা খাওয়া যাবে না।ধরা খেলেই জেল খাটতে হবে,এক বছর দুই বছর কিংবা তারও বেশি। সে কায়দা করে বাড়ির পিছন থেকে বের হলো গোটা দল নিয়ে৷আফজাল মিয়ার সহযোগী ঝন্টু বলল, ‘পুলিশ তো বেশি নাই ওস্তাদ!’ লোকজন আছে বেশ কয়েকজন। আফজাল মিয়া আকাশে ফাকা গুলি ছুড়লো কয়েকটা। বাড়ি জুড়ে থম থমে অবস্থা৷ তারপর সুপাড়ি বাগান চিড়ে দৌড় দিলো আফজাল মিয়া আর তার দলবল।আফজাল মিয়া দৌড়াচ্ছে,বাকিদের কথা আপাতত না ভাবলেও চলবে। নিজে বাঁচলে বাপের নাম।

গ্রামবাসী মশাল জ্বালিয়ে ডাকাত ধরতে নেমেছে। এ যেন ডাকাত ধরার মহাৎসব।বাচ্চারাও জেগে আছে। তাদের মধ্যে আনন্দ আর কৌতূহল খেলা করছে। আফজাল মিয়া এখন বসে আছে কবরস্থানের ভিতরের একটা ঝোপে।আশেপাশে মানুষজনের আনাগোনা  নেই৷ এই ঝোপের মধ্যে সাপ-কোপ আছে নাকি কে জানে৷ তার পা’টা কেমন কুটকুট করছে৷ জোঁকে ধরেছে কি না কে জানে। পায়ের উপর দিয়ে ঠান্ডা কিছু একটা চলে গেলো। সাপ! অন্ধকারে বোঝা যায় না৷ কি সাপ! কে জানে! নড়াচড়া করা যাবে না। গাছের মগডালে কুহপাখি ডাকছে! আফজাল মিয়া বসে আছে নিরবে। সাপটা চলে গেছে তার পায়ের উপর দিয়ে৷ কেমন যেন শব্দ শোনা গেল!  বাচ্চার কান্নার আওয়াজ না? বাচ্চা কাঁদে হঁ্যা হ্যাঁ! বাচ্চার কান্নার আওয়াজ। না! না! আফজাল মিয়ার মাথা টাথা খারাপ হয়েছে৷ আশেপাশে ঘরবাড়ি ও তো নেই। তাহলে বাচ্চার কান্নার শব্দ কোত্থকে আসবে? নাকি ভূত-প্রেত। আফজাল মিয়া ভূতে ভয় পায় না। আফজাল মিয়া কবর স্থান থেকে বেরিয়ে রাস্তার কাছে এসে পূর্নিমার আলোতে দেখলো একটা ফুটফুটে নবজাতক শিশু রাস্তার পাশে পড়ে আছে। আফজাল আশপাশটা ভালো করে দেখলো! কোথাও কেউ নেই! আফজালের ভয় হলো। এ কেমন ভূতুড়ে কান্ড। আফজাল মিয়া হন হন করে হাঁটা দিলো।

মোরগ ডাকছে! সকাল হয়েছে রানু বেগম বসে আছে খাটে। কাল রাতে আফজাল মিয়া কোত্থুকে এক শিশু নিয়ে এসেছে৷ রানু বেগমকে ঘুম থেকে তুলে নবজাতককে কোলে দিয়েছে আফজাল। রানুর কোন সন্তান নেই। আফজালের ওপর মানুষের অভিশাপ লেগেছে হয়তো৷ তাই উপরওয়ালা রানুর পেটে কোন সন্তান দেন না৷ রানুকে ভীষন চিন্তিত দেখাচ্ছে৷ এতটুকু একটা নবজাতক শিশু কোত্থকে আনলো আফজাল? কার সন্তানকে কেড়ে এনেছে? আফজাল মরার মতো ঘুমাচ্ছে৷ রানু আফজালকে ডাকলো। আফজাল ঘুম থেকে উঠে হতভম্ব হয়ে গেলো। চোখ কচলাতে কচলাতে বলল,’এই বাচ্চা আইলো কই দিয়া,এইডা কার বাচ্চা? ‘ রানু বলল,’ঘুম থেইকা উইঠা বাচ্চা দেইখা মনে হয় ডরাইছেন? বাচ্চা আইলো কই দিয়া হেইডা আমি কেমনে কমু? কালকে রাইতেই না আফনা বাহির থেইকা আইয়া আমার এই বাচ্চাডারে আমার কোলে দিলেন? এর মইদ্দে ভুইলা গেলেন কেমনে?’ আফজাল চোখ কচলালো।রানু অনবরত প্রশ্ন করতে লাগলো৷ বাচ্চা কার কই দিয়া আইলো?’ আফজাল সব ঘটনা খুলে বলল। রানুকে বেশ চিন্তিত দেখা গেলো৷ এটা কার বাচ্চা? মানুষের? নাকি জিন পরি কবরস্থানে ফেলে গিয়েছে। না না  এটা কোন মানুষের কাজ হতে পারে না। একটা মানুষ কখনো একটা শিশুকে কনকনে ঠান্ডায় কবর স্থানে ফেলে যেতে পারে না। বাচ্চাটার নাক থেকে অনবরত পানি ঝরছে৷ হাতপা ঠান্ডা হয়ে যাছে৷ বাচ্চাটা কাদছে৷ রানু কান্না থামাতে পারছে না। আফজাল হাটের দিকে রওনা হলো। শানু ডাক্তারকে খবর দিতে হবে। বাচ্চাটার জন্য কিছু কাপড় কিনতে হবে। হাজার হোক তাকে কেউ ফেলে গিয়েছে,এমন একটি ফুটফুটে শিশুকে কে কবরস্থানে ফেলে গেলো? সে মানুষ নয়;অমানুষ।

৩.

রাশেদের সাথে সুনিতার মাত্র দু বছরের সম্পর্ক। সুনিতা অনার্সে পড়ে। রাশেদের সাথে তার পরিচয় হয় কলেজে৷ ছেলেটা ভদ্র নম্র। সুনিতার পছন্দ হয়ে যায় রাশেদকে৷ সুনিতার টানা টানা চোখ, সাদা ধবধবে মুখ। এমন রুপবতী মেয়েকে ভালোবাসা বড় ভাগ্যের ব্যাপার। রাশেদও পছন্দ করে ফেলে। তাদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরী হয় ; বুকজুড়ে আবেগের ভাসাভাসি। সুনিতা রাশেদকে শুধু ভালোবাসে না;বিশ্বাসও করে। সেই  বিশ্বাসের প্রতিদান রাশেদ দেয়নি।রাশেদের সাথে সুনিতার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। ভালোবাসার সম্পর্ক রূপ নেয় অবৈধ সম্পর্কে। সুনিতা যখন বুঝলো তার শরীরে সে ছাড়াও আরেকজন আছে তখন রাশেদকে বলেছিলো সে কথা৷ রাশেদ সোজা সাপ্টা ভাষায় বলে দিয়েছে,’সে এ ব্যাপারে কিছুই করতে পারবে না।বাচ্চাটাকে নষ্ট করে ফেলতে হবে। ‘ জীবনে কখনো কখনো সীমাবদ্ধতা চলে আসে, কিছু কিছু বেড়াজাল টপাকানোর পড়ে হাজারটা প্রশ্নের সম্মুক্ষিন হতে হয়৷বাস্তবতা কঠিন হয়ে পড়ে। ঠিক তখনই কাছের মানুষগুলো বোঝা ভাবতে শুরু করে। জীবন পরে যায় কষ্টের দোলাচলে।” সুনিতার বাবা-মা জানে,তার মেয়ে কেলেঙ্কারি বাধিয়ে ফেলেছি৷ তারা রাশেদের পরিবারের সাথে কথা বলে। রাশেদের বাবা কোন ভাবেই মেনে নেয় না সুনিতার বাবার এমন প্রস্তাবকে।  মানুষজন এ ব্যাপারে জানা জানি হয়ে গেলে মান ইজ্জত কিচ্ছু থাকবে না। থানা পুলিশের ভয়ে রাশেদের পরিবার রাজি হয়৷ কিন্তু শর্ত একটাই সুনিতার এবশন করাতে  হবে৷ কিন্তু নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হওয়ায় সেটা আর সম্ভব হয়না। যে কারনে রাশেদের পরিবারও রাজি হয়না। সুনিতা গর্ভধারন করে। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় তার মামার বাড়িতে। জন্ম নেয় একটা ফুটফুটে নবজাতক। সুনিতার বাবার কথা মতো সুনিতার মামা রাতের আধারে তাদের দুই গ্রাম পরে বাচ্চাটিকে কবর স্থানে ফেলে রেখে যায়। সুনিতা কাঁদে ;পাগলের মতো ছটফট করে। দু মাস পরে রাশেদও মারা যায় রোড এক্সিডেন্টে। সুনিতা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। তিন বছর পরে সুনিতার বিয়ে হয়ে যায়। সে ধীরে ধীরে এসব কাটিয়ে উঠতে থাকে।

৪.

বিশ বছর পরের ঘটনা, আফজাল মিয়া ডাকাতি জীবনকে বিদায় জানিয়েছেন। গ্রাম থেকে তিনি চলে এসেছেন শহরে। এখন তিনি সিএনজি চালিয়ে রোজকার করেন। তার স্ত্রী রানু মারা গিয়েছেন পাঁচ বছর আগে। আজ তার বড় আনন্দের দিন। তার ছেলে মেডিকেল থেকে পাশ করে বেড়িয়েছে। তার চোখ থেকে পানি ঝরছে। আজ যদি রানু বেঁচে থাকতো। বিশ বছর আগে তিনি ডাকাতি করতে গিয়ে কবরস্থানে পেয়েছিলেন একটি ফুলকে সেই ফুলকে তিনি বুকে টেনে নেন। বহু ঝড়ঝাপ্টা পার করে তিনি সেই ফুলকে বড় করেন তার ছেলে হিসেবে। সেদিনের সেই কুড়িয়ে পাওয়া ফুলটি আজ ডাক্তার। তার নাম ইরফান। দেখতে সুদর্শন। মাঝেমধ্যে আফজাল সাহেব অবাক হন৷ এই রাজপুত্রের মতো ছেলেটিকে বিচিত্র কারনে তিনি কবর স্থান থেকে পেয়েছিলেন। আফজাল সাহেব ইরফানকে কোন দিনও কিছু জানতে দেননি। জানতে দেবেনই বা কেন? দেওয়ার কি দরকার? ইরফান তো তারই ছেলে। আফজাল মিয়ার চোখ থেকে পানি গড়াতে থাকে। ইরফান এসে বলে,’আব্বা! আপনি কাঁদছেন কেন?’ আফজাল মিয়া বলে,’আজ বড়ই আনন্দের দিন রে বাবা! আজ যদি তোর মা বেঁচে থাকতো। ‘ ইরফান আফজাল মিয়াকে আলিঙ্গন করে। ইরফানও কাঁদে তার বাবার সাথে।

অতিবাহিত হয় আরো পাঁচ বছর,ইরফান এখন হাসপাতালের বড় ডাক্তারদের একজন।সুনিতার আর কখনোই কোন সন্তান হয়নি। সুনিতা বয়সের সাথে সাথে পাল্টে গিয়েছে। তার চোখ দুটোর নিচে কালশিটে পড়েছে। চামড়ায় পড়েছে বয়সের দাগ, মাথার চুলগুলো হয়েছে সাদা। সুনিতা এখন শুয়ে আছে হাসপাতেলের বেডে। একজন অল্প বয়সের ডাক্তার তাকে চেক-আপ করছে। সুনিতা তাকিয়ে আছে ছেলেটার দিকে৷ছেলেটার চোখে চশমা।ফর্সা মুখ জুড়ে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।ছেলেটার প্রতি মায়া হলো সুনিতার।ছেলেটার নাম ইরফান।

এই লেখাটি শেয়ার করুন
ছাইলিপির ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করা থেকে বিরত থাকুন ! বিশেষ প্রয়োজনে ইমেইল করুন [email protected]