পার্থসারথি
স্যার, আসসালামু আলাইকুম।
কন্ঠটা বেশ পরিচিত মনে হলো। পেছন ফিরে তাকাতেই রিক্সাওয়ালা রফিক মিষ্টি হেসে জিজ্ঞ্যেস করলো- কেমন আছেন স্যার?- মুখে মাস্ক পরে থাকায় হাসির রঙটা তেমন বুঝতে পারেননি আকাশ বাবু।
উনিও যথাসাধ্য হাসি ছড়িয়ে বললেন- ভালো আছি।– মুখে মাস্ক থাকায় রফিকও উনার হাসির রঙটা সম্ভবত বুঝতে পারেনি।
আকাশ বাবু মুদিখানার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন মাসের বাজার একসাথে করবেন বলে। মাসটা জুন, করোনার প্রবল ছোবল বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। তাই কাজ ছাড়া বাসা থেকে বের হন না। কিন্তু তিন চাকা রিক্সাওয়ালা রফিকদের তো কোন গতি নেই।
রফিকের সাথে উনার পরিচয় বৎসর তিনেক হবে। প্রায় রীতিমতোই উনার বাচ্চাকে স্কুলে পৌঁছে দেয়। সবসময় হাসিমাখা মুখ। চার সন্তানের জনক। সব বাচ্চারাই লেখাপড়া করছে। ছেলেটা মাদ্রাসায় আর মেয়েগুলো স্কুলে। কথায় কথায় জানলেন রিক্সা চালিয়ে মোটামুটি ভালোই চলে যাচ্ছে রফিকের সংসার। একদিন গল্পে গল্পে জানালো, রিক্সাটার অনেক কাজ করাতে হবে। চাকা-টায়ার-রিং এসব অনেক কিছু মিলিয়ে প্রায় হাজার-দেড়েক টাকা লাগবে। তবে আকাশ বাবুর কাছে টাকা চায়নি। কিন্তু বুঝতে পেরেছেন রফিকের টাকার প্রয়োজন। ভাড়াবাবদ বিশ টাকার পরিবর্তে পাঁচশত টাকা দিয়ে আকাশ বাবু বললেন- বাকিটা জোগাড় করে রিক্সার কাজ করে নিও।
মিষ্টি হেসে রফিক বিদায় নিল। ওর গায়ের রঙ উজ্জ্বল তামাটে। রিক্সা চালাতে বেশ পরিশ্রমী হতে হয়। কিন্তু আকাশ বাবুর মনে হলো সে খুব একটা পরিশ্রমী নয় তবে ইচ্ছেটা প্রবল।
স্যার যাবেন?
মুহূর্তেই আকাশ বাবুর তন্ময় ভাবটা কেটে যায়। দোকানদারকে বাজারের লিস্টটা তাড়াতাড়ি করার তাগিদ দিয়ে বলেন- রফিক দাঁড়াও, যাবো।
রফিক হাসি মুখে রিক্সাটা একদিকে নিরাপদে সরিয়ে রাখে। আকাশ বাবুর হাতের বাজার ভর্তি দুটো ব্যাগ নিয়ে সযত্নে রিক্সায় তুলে রাখলো। মুদি দোকানের লিস্ট করা শেষ। সব মালামাল লোক দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেবে। বাকিসব বাজার করা হয়েছে। ঔষধ, মাছ-মাংস, বিস্কুট আরো কিছু টুকিটাকি সদাই ওই দুটো ব্যাগে ভর্তি। আর মায়ের জন্য পান-সুপারি-চুন-খয়ের সবই নিয়েছেন। যা’তে এক মাসের মধ্যে আর বের হতে না-হয়।
রিক্সায় উঠতে গিয়ে ভালো করে পরখ করলেন, রফিকের গায়ের উজ্জ্বল তামাটে রঙ অনেকটা পাংশুবর্ণ হয়ে গেছে। ওর স্বাস্থ্যটা তেমন ভালো গড়নের না-হলেও একেবারে ফেলনা নয়। কিন্তু এখন দেখেই বুঝা যাচ্ছে শরীরে সেই ছন্দটাই আর নেই। আকাশ বাবুর মনটা ভীষণরকম খারাপ হয়ে গেল।
একইভাবে গতমাসেও সালাম দিয়েছিল, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল, অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল, রফিক অনেকক্ষণ অপেক্ষাও করেছিল, বারবার কুশল বিনিময় হয়েছিল। কিন্তু দু’জনের মুখেই মাস্ক থাকাতে কারো মনের আকাশের দুঃখের রঙ কেউ দেখতে পায়নি।
এত ভালো একটা চাকরি করোনার জন্য হারিয়েছেন আকাশ বাবু। আবার আরেকটা জোগাড় করারও কোন উপায় নেই। তিন তিনটি কোম্পানীর সাথে ফাইনাল ইন্টারভিউ পর্যন্ত হয়ে গেছে। কিন্তু করোনার জন্য সবাই সব নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। এখন চাকরি পাবার আর কোন সুযোগ রইলো না। ভারাক্রান্ত মনের দুঃখ, আকাশ বাবু মাস্কের ভেতর ঢেকে রেখেছেন করোনা থেকে বাঁচার আশায়। সাথে মনের দুঃখের আকাশটাও ঢেকে আছে। অন্যদিকে উনার মতো অন্য সবাই বাইরে খুব একটা বের হচ্ছে না বিধায় রফিকের আয় প্রায় শূন্যের কোঠায়। যদিও রিক্সাটি নিজের কিন্তু যাত্রীর অভাবে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে তিন চাকার রিক্সায় অলস ভঙ্গীতে ত্রিকালের দুঃখ ঘোরায়।
দু’জন দু’জনের নিজস্ব দুঃখে এমনই ভারাক্রান্ত যে, কেউ কারো কষ্টের নীলাকাশটা দেখতে পায়নি। আকাশ বাবু ব্যস্ত ছিলেন উনার সদাইপাতি কিনতে। আর রফিক প্যাডেল চালিয়ে এগিয়ে যায় যাত্রীর আশায়। দাঁড়িয়ে থাকলে তো আর চলবে না। বাসায় যে অনেকগুলো মুখ পাখির ছানার মতো হা করে প্রতীক্ষায় আছে।
পেছনে তাকিয়ে দেখেন রফিক নেই। মনটা কিছু খারাপ হলেও নিজের দুঃখের ভেতর রফিকের কষ্টের কুন্ডলী বিলীন হয়ে যায়। বাসায় এসেই কিনে আনা সব বাজার-সদাই বের করছেন, তখনই মনের আকাশে ঝমঝম করে মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। মুহূর্তেই উনার কন্ঠস্বর ভারী হয়ে এল, চোখের কোণ ভিজে গেল। ব্যাগভর্তি মাছ-মাংস বের করছেন আর কষ্টগুলো যেন বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটাচ্ছে। এমন কষ্ট আরো হয়েছিল যখন বাবা মারা গিয়েছিল, ছোট দুটি ভাই অসময়ে চলে গিয়েছিল। আকাশ বাবু নিজেকে আর সামলাতে পারছিলেন না, ভাবছেন- নিজেরা এতকিছু দিয়ে খাবেন! রফিক ওর সন্তানদের নিয়ে কিছু খেতে পারবে তো? প্রশ্নটা ক্ষণে ক্ষণে ঘুরপাক খাচ্ছিল আর সাথে সাথে কষ্টগুলো লুটোপুটি খাচ্ছিল মনের ভেতর । কেন যেন নিজেকে প্রবোধ মানাতে পারছিলেন না আকাশ বাবু। নিজের দুঃখের ভেতর ডুবে অন্যের দুঃখটাকে বুঝবার বোধটুকু লোপ হলো কেমন করে! সাথে সাথেই বের হলেন রফিককে খুঁজতে। প্রায় আধঘন্টা চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়ালেন। তারপর ব্যর্থ মনোরথে ফিরে এলেন।
স্যার ডিমের ব্যাগটা আমার হাতে দেন।
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে রফিকের হাতে ডিমের ব্যাগটা দিলেন আকাশ বাবু। রফিক তাকিয়ে তাকিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে ব্যাগভর্তি বাজার-সদাইয়ে তাকিয়ে আছে। তবে ওর দৃষ্টিতে কোন লোভ বা ক্ষোভ নেই। শুধু লেপটে আছে ওর অসহায় দৃষ্টির সীমানা। হয়তো ভাবছে তার নিজের অপারগতা। স্ত্রী-সন্তানদের হয়তো আধ-পেটা করে খাইয়েও চালাতে পারছে না।
আকাশ বাবুর দৃষ্টি সীমানাও খুব ছোট হয়ে এলো। সরাসরি ওর দিকে তাকাতে পারছিলেন না। শুধু বললেন- রফিক, সব নেয়া হয়েছে। এবার বাসার দিকে যাও।
পৌঁছে রিক্সা ভাড়া বাবদ বিশ টাকার পরিবর্তে পাঁচশত টাকার একটা নোট দিলেন। রফিক প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে আকাশ বাবুর দিকে তাকিয়ে রইলো।
পুরো টাকাটাই তোমাকে দিলাম।
জি, ঠিক আছে স্যার।
তুমি এখন সোজা বাজারে যাবে। বাজারসদাই করে বাসায় ফিরবে। চাউলটা একটু বেশি কিনবে।
জি, ঠিক আছে। তারপর সালাম জানিয়ে মিষ্টি হেসে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
আকাশ বাবু জানেন, এই পাঁচশত টাকা আজকাল কিছুই না। তবু তো একটু কিছু হলো।
উনার হাত-পা বাঁধা চলমান জীবনের কাছে। আর রফিক রফিকের কাছে।
আকাশ বাবু চিন্তায় ডুবে আছেন করোনা কোনদিন শেষ হবে। তারপর চাকরি খুঁজবেন অথবা আরো অপেক্ষা। দুঃশ্চিন্তায় মাথার ভেতর কালো মেঘের ঘনঘটা। আর রফিকও চিন্তিত অনিশ্চিত দিনের আচমকা হানায়। দিন ঘুরছে তিন চাকার রিকসায় ত্রিকালের আবর্তে। আকাশ বাবু চিন্তাক্লিষ্ট মনে ব্যাগ হাতে ঘরে প্রবেশ করেন নিশ্চিত বসবাসের জন্য। নিশ্চিত বসবাস নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে পেন্ডুলামের মতো দুলছে সেকেন্ড, মিনিট আর ঘন্টায়; অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ; তিনটি সময়ে ত্রিকালের চাকা একইভাবে অবিরাম ঘুরছে।
ঢাকা, বাংলাদেশ ।