ছোটগল্প- বিন্তি

ছোটগল্প- বিন্তি
ময়না পুকুর থাইকা পানি আইনা রাখ বেশি কইরা,কহন যে কুত্তার বাচ্চারা(মিলিটারি) গেরামে আইসা ঢুকবো মাবুদ জানে।(রান্না ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল ময়নার মা)
ময়নাঃ যাইতাছি মা।
ময়নার মাঃ একলা যাইস না,বিন্তিরে নিয়া যা।
ময়নাঃ আইচ্ছা মা।
ঘর থেকে দুটো কলস নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল ময়না,আর বিন্তিকে ডাকতে থাকল।বিন্তি ময়নার সই,তাদের পাশের বাসায় থাকে।ছোট থেকেই একসঙ্গে বেড়ে উঠা ওদের,যেন আপন বোন।
পুকুর ঘাটে বিন্তি আর ময়না হাসাহাসি করছে,এমন সময় শিস বাজানোর শব্দে ঘুরে তাকায় তারা,
ময়নাঃ সজীব ভাই আপনে,এইহানে কি?ও বুজছি সইয়ের লগে কতা কইতে আইছেন।
সজীব একটু লজ্জা পায়,আর বিন্তি লজ্জায় লাল হয়ে ময়নার হাতে চিমটি কাটে।
ময়নাঃ আপনেরা কতা কন,আমি কলসে পানি ভরি।তয় দেইখেন,কেউ জানি না দেখে।
বলেই সে পানি ভরতে শুরু করে আর বিন্তি সিড়ি ভেঙে উপরে আসে সজীবের কাছে।
সজীবঃ কিরম আছো বিন্তি?
বিন্তিঃ ভালানা,হুনলাম দেশের অবস্থা খারাপ,জোয়ান পোলাগোরে ধইরা নিয়া অত্যাচার কইরা মাইরা ফালায়।
সজীবঃ তোমারে কে কইছে এইসব?
বিন্তিঃ আব্বায় কয়,প্রতিদিন হাটে রেডিওতে নাকি এগুলা পড়ে।
সজীবঃ কাকায় সত্য কইছে।
বিন্তিঃ আপনে এই সময় ঘরতোন বাইর না হইলেও পারেন।
সজীবঃ ঘরতোন না বাইর হইলে তোমারে দেখমু কেমনে?
বিন্তিঃ হইছে আর কওয়া লাগবে না,যান কেউ দেখলে আব্বায় আমারে মাইরা ফালাইবো।
সজীবঃ একখান কতা কওনের আছিলো।
বিন্তিঃ তাড়াতাড়ি কন,তারপর বিদায় হন।
সজীবঃ আমি যুদ্ধে যাইতাছি বিন্তি
(বিন্তির হাসিমুখ নিমিষেই কালো হয়ে যায়)
বিন্তিঃ ও আল্লাহ,কি কন আপনে?এগুলার দরকার নাই,ঘরের মধ্যে থাকবেন।
সজীবঃ দেশটারে বাঁচান লাগবো তো,যেমনে মানুষ মারতাছে আমরা না আটকাইলে তো দেশটারে গোরস্থান বানায় দিবো।
বিন্তিঃ না,আমি যাইতে দিমুনা আপনেরে।(কান্নারত অবস্থায়)
সজীবঃ কাইন্দোনা,খবর জানোনা তুমি,মিলিটারিরা দুই গেরাম ছাইড়া পরের গেরামে আইছে,কয়দিনের মধ্যে এইহানেও হামলা দিবো।আর আমি তো এতিম,মা মানে তো আমার দেশটাই আছে।আমি কেমনে আমার মারে মরতে দেই কও?
বিন্তিঃ আমার কতা ভাববেন না?আমি কি আপনের কেউ না?
সজীবঃ আজেবাজে কতা কইয়ো না,তোমারে আমি ভালবাসি।দেশটা স্বাধীন হইলেই তোমারে বউ বানায়া ঘরে তুলমু।
বিন্তিঃ যদি কিছু হইয়া যায়?
সজীবঃ আল্লাহ আছে না?যদি কিছু হইয়া যায় তয় কানবা না,মনে করবা আমি তোমার লগেই আছি।
বিন্তিঃ যাইয়েন না,আপনার দোহায় লাগে।
সজীবঃ আমারে আটকাইয়ো না,আর তুমি ঘরতোন বাইর হইবানা।ওরা কিন্তু ভালানা,মাইয়া মানুষ তুইলা নিয়া নষ্ট (ধর্ষণ) করে।
বিন্তি কান্না করে যাচ্ছে,সজীব আল্লাহ হাফেজ বলে উলটো দিকে চলতে থাকে।
দিন পনের পরেই বিন্তিদের গ্রামে মিলিটারিরা ক্যাম্প বসায়।বাজার-ঘাট,স্কুল,হিন্দু বস্তি,মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে দেয়।আর একের পর এক মানুষ মারতে থাকে নির্বিচারে।
চোখের পলকেই যেন গ্রামটা শ্বশানে পরিণত হয়।রাস্তা-ঘাট,নদ-নদী,পুকুর সর্বোত্র লাশ পরে আছে।
গ্রামের মানুষ ভয়ে ঘর থেকে বের হয়না,যুবতী মেয়ে,বউদের লুকিয়ে রাখে কিংবা বুড়ি সাজিয়ে রাখে।চারিদিকে কেবল আতংক বিরাজ করছে।
পাঁচ মাস পর,**১৬ ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল**
বাজারের দোকানে বসে আছে গ্রামের বেশ কিছু মানুষ,রেডিওতে বাজছে বিজয়ের ধ্বনি।সবার চোখে আনন্দ অশ্রু,সবাই একসঙ্গে সস্ত্বির নিঃশ্বাস ফেলল।
গ্রামের তরুণ ছেলেরা বিভিন্ন জায়গায় স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজ পতাকা টেনে দিলো।
সারাদেশ উৎসবে মেতে উঠল,লাল-সবুজের পতাকায় নতুন রূপ পেল সারাদেশ।
সপ্তাহ খানেক পর,
বিন্তি,বিন্তি,এই বিন্তিইই,দেহো আমি আইছি, আমার কিচ্ছু হয় নাই,আল্লায় আমারে ফেরত আনছে বিন্তি।(উচ্চস্বরে বিন্তিকে ডাকছে সজীব)
কেডায় রে,কেডায় ডাহে আমার বিন্তিরে? (বলতে বলতে ঘর থেকে বের হলো বিন্তির বাবা)
সজীবঃ কাকা আমি সজীব।
বিন্তির বাবাঃ ওহ সজীব,ভালা আছো বাজান?
সজীবঃ হয় কাকা।
বিন্তির বাবাঃ তোমাগো মতো মানুষ না থাকলে দেশটা স্বাধীন হইতো না।
সজীবঃ সবই আল্লাহর ইচ্ছা কাকা,আচ্ছা কাকা বিন্তিরে দেহিনা যে?
বিন্তির কথা শুনেই তার বাবা অঝোরে কাঁদতে শুরু করল।বিন্তির বাবার কান্না দেখে,সজীবের বুকের বা’পাশে চিনচিন করে উঠে।
এই সময় পিছন থেকে ময়না ডাকে,”সজীব ভাই।”
সজীবঃ ময়না,ময়না আমার বিন্তি কই?কি হইছে বিন্তির?
ময়নাঃ আহেন আমার লগে।
ময়না এগিয়ে যাচ্ছে পুকুরের দিকে,পিছনে যাচ্ছে সজীব।দুজনেই গিয়ে থামলো একটি উচু মাটির ঢিবির সামনে,যা বাঁশের বেড়া দিয়ে বাঁধানো।
ময়নাঃ ওই যে তোমার বিন্তি,জানোয়ারগুলা ওরে বাঁচতে দেয় নাই সজীব ভাই।বাড়িত থিকা তুইলা নিয়া গেছে,সাত দিন পর বাড়ির উঠানের মইধ্যে ওরে ফালায় দিছে আর যাওনের সময় গুলি কইরা ঝাঝরা কইরা দিছে বিন্তিরে।
কবরের কাছে বসে পরে সজীব,তার চোখে পানি নেই,পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিন্তির দিকে আর বলছে,
“শহীদ হওনের কতা আছিলো আমার,তুমি কেন শহীদ হইলা?তুমি তো আমারে যুদ্ধের ময়দানে যাইতে দিতে চাও নাই কিন্তু আল্লাহ তোমারেই বড় যোদ্ধা বানাইলো।”
~সমাপ্ত~
  কালিবাড়ি,ঠাকুরগাঁও। 

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
Automobile: All the Stats, Facts, and Data You'll Ever Need to Know

Automobile: All the Stats, Facts, and Data You’ll Ever Need to Know

Cursus iaculis etiam in In nullam donec sem sed consequat scelerisque nibh amet, massa egestas risus, gravida vel amet, imperdiet volutpat rutrum sociis quis velit, ...
আমার বউ

আমার বউ

জোবায়ের রাজু সুন্দরী সুরমাকে দেখে তার প্রেমে দিওয়ানা হয়ে তাকে একেবারে আমার বউ করে ঘরে নিয়ে এসেছি। সংসার করে এখন বুঝি এই বউ জন্মের কিপটে। ...
প্রতিদিন ফেব্রুয়ারির সাথে কথা বলি

প্রতিদিন ফেব্রুয়ারির সাথে কথা বলি

গোবিন্দলাল হালদার আমাদের বুকে আছে- মোছেনি. রেড অক্সাইড প্রলেপ। সোনারা মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে রাজপথে প্রতিবাদ করেছিলো সোনারা শহিদ মিনারে কংক্রিটের বুকে বুক রেখে ঘুমায় সোনারা গান ...
মঙ্গলবার বিকেলে এলো শনিবার বিকেলের ট্রেলার

মঙ্গলবার বিকেলে এলো শনিবার বিকেলের ট্রেলার

২০১৬ সালে রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনার ছায়া অবলম্বনে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তৈরি করেছেন সিনেমা ‘শনিবার বিকেল’। মুক্তির আগে পদে পদে ...
পতাকার লড়াই

পতাকার লড়াই

ইমরান খান রাজ দেশের ভূমি আর মানুষের জীবন রক্ষায়, নিজের ভাষায় প্রাণ খুলে কথা বলতে আর হলুদ সরিষার ক্ষেতে লাল-সবুজের পতাকা উড়াতে বাংলার সাহসী, বীর ...
অভিমান

অভিমান

 |রেজা করিম    অভিমান ভুলে গেলে ফিরে এসো,  ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি আজও –  সেখানেই,  যেখানে শুরু হয়েছিলো  আমাদের  ভালোলাগা ভালোবাসা খুনসুটি বিশ্বাস।  এখানেই  এসো, যুগল ...