সৌর শাইন
গল্পটা ইমরান হাফিজ ও তার স্ত্রী ফাতেমার দীর্ঘ দ্বন্দ্ব নিয়ে।
অন্ধকারে থাকা চোখ হঠাৎ আলো মানিয়ে নিতে পারে না। আচমকা আলোর ঝাপ্টা সৃষ্টি করে এক ধরনের অসুবিধে। পরিবেশ প্রাণির অভ্যাস ও অনুশীলনের সাথে বিশেষ সখ্য হয়ে গড়ে তোলে নিজস্ব সেতুবন্ধন। যা হুট করে বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হলে বাধিয়ে দেয় বিরোধ। স্বভাব বিশ্লেষণ ও পারস্পরিক যোগ বিয়োগ নিয়েই যত সম্পর্ক গতিশীলতা। অভ্যাস প্রবৃত্তি জীবনের অনেকাংশ দখলে রাখে, যা সহজে হার মানতে চায় না। এই গল্প পাঠে অনেকেই ভ্রু কুঁচকে কপালে জ্যামিতিক রেখা অঙ্কন করবেন। তাতে কিচ্ছু করার নেই, বরং আপনাকে জব্দ করার জন্য যদি বলে ফেলি এরূপ নানা আসক্তি, গোপন প্রবৃত্তি আপনার ভেতরেও লুকায়িত। এ ধরনের কথা প্রত্যাশা করেননি হয়তো, মিথ্যাবাদি হলে চিৎকার করে না সূচক উচ্চারণ হানবেন, গল্পকারকে গালি দিয়ে ক্ষান্ত হবেন, আর সত্যবাদী হলে চুপচাপ সটকে যাবেন। থাক সটকে যাবার দরকার নেই, দেখুন কী ঘটে?
‘কী হলো গো বউ… সেই সকাল থেকে চেঁচামেচি শুনছি! তোমাদের যন্ত্রণায় টিকে থাকাটা মুস্কিল!’
বারান্দার ভাঙা বেড়ার ফাঁকে বেড়ালের মতো মুখ বাড়িয়ে কথাটা বলে পাশের বাড়ির ভাটাটিয়া মাজেদা খাতুন।
ইমরানের বউ ফাতেমা সাপের মতো ফোঁসে বলে,‘মুস্কিল হলে কানে তালা লাগিয়ে রাখো চাচী।’
কত বড় বেয়াদব মাগি তুই, স্বামীর হাড় চিবিয়ে খাচ্ছিস,‘প্রতিবেশীকেও শান্তিতে থাকতে দিবি না?’
‘শান্তিটা কোথায় কীভাবে ধরে রাখলাম? তোমার ছেলে মালেইক্যা বেকার সেটা কী আমার দোষ?’
‘রাখ… রাখ পোড়ামুখী আর কথা বাড়াসনে। মুখে পোকা পড়বে।’
‘ওসব পোকা আমি চিবিয়ে খেয়ে ফেলব। স্বামীর হাড় খেতে পারি, আর পোকা খেতে পারবো না, তা কি হয়?’
এবার আর বেড়ার ওপাশ থেকে সাড়া পাওয়া যায় না। মাজেদা খাতুন এভাবে প্রায়ই চিৎকার করে ঝগড়ার আরম্ভ করেন আর শেষে হেরে নিজে থেকেই চুপসে যান। মাজেদা খাতুনের নিজে থেকে ঝগড়া বাধানোর কারণটা স্পষ্ট, তা হলো ইমরান হাফিজ ও তার স্ত্রী ফাতেমার ঝগড়া। ঝগড়ায় ফাতেমার গলাটাই উঁচু লয়ে ধাবিত হয় বেশি। আর অধিকাংশ সময় চুপচাপ থাকে ইমরান। প্রায়ই মুখের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি চুলকে বলে,‘নিউটনের বউ এ রকম বদ মেজাজি ছিল। আমি তো নিউটন অপেক্ষা কম নই, তাহলে আমার বউ কেন নিউটনের বউয়ের চেয়ে কম ঘ্যান ঘ্যান করবে?’
ঘ্যান ঘ্যান শব্দটা সহ্য করতে পারে না ফাতেমা। তখন অস্থির হয়ে ঘরে-বাইরের জিনিস পত্র ছুঁড়ে মারবে নানা দিকে। আবার মেঘ কেটে গেলে ঐ ভাঙাচুরা জিনিস পত্র জমিয়ে ঘরসংসারের আয়োজন সাজিয়ে নিবে।
এই সার্কাস চলছে আট বছর ধরে। আজো পর্যন্ত ফাতেমার কোলে কোনো সন্তান আসেনি। প্রতিবেশী ও স্বজনের কাছ থেকে নানা প্রশ্ন এসে জড়ো হয় ফাতেমার কানে। ফাতেমা হুঙ্কার ছেড়ে বলে,‘জমি চাষ না করলে কি কোনো চাষা ফসল পায়? পায় না। আগে চাষ করা তো জানতে হবে।’
শ্রোতারা স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থেকে বলে,‘ইমরান বুঝি চাষাবাদ জানে না?’
তারপর হাসির কলরোল। ফাতেমা পিছিয়ে যাওয়ার মতো নয়, সে বলে ওঠে,‘চাষ জানলেই বুঝি জমি এমন পতিত করে ফেলে রাখতো?’
হাসাহাসি কৌতুকে কথা অন্য দিকে মোড় নেয়। কিন্তু ফাতেমা ও ইমরানের মূল সমস্যাটা কারোর চোখে পড়ে না।
একদিন বিকেলে তো ফাতেমা গলা ছেড়ে বলতে থাকে,‘না গো না, আমি আর সতীনের ঘর করবো না।’
আশপাশে সবার চোখ কপালে ওঠে। মাজেদা খাতুনই প্রথম গলা বাড়ায়,‘একি কথা বলছে ইমরানের বউ। এই সহজ সরল ভালো ছেলেটার নামে অপবাদ দিচ্ছে যে। হায় খোদা, তুমি কি কিছু দেখতে পাও না?’
ফাতেমা বলে,‘সতীনের জ্বালা যে দেখেনি সে কী করে বুঝবে আমার ব্যথা?’
পাশের ঘরের দুয়েকজন ভাড়াটিয়া প্রতিবেশী এসে হাজির হয় ইমরানের ঘরের সামনে।
‘এসব কী শুনছি? তো দ্বিতীয় বিয়েটা কোথায় করলে শুনি?’
‘বউ ঘরেই আছে। বউকে জিজ্ঞেস করো না। আমাকে কেন জ্বালাচ্ছো?’ ইমরান হুটহাট উত্তর দেয়।
প্রতিবেশীরা ঘরে এসে দ্বিতীয় বউয়ের খোঁজ না পেয়ে ফাতেমাকেই জিজ্ঞেস করে,‘কি বউ, কও তো নতুন বউ কোথায়?’ ‘দেখতে কেমন? এবার বাচ্চা-কাচ্চার মুখ ঠিক দেখা যাবে।’
ফাতেমা দ্বিগুণ জ্বলে, কালবোশেখী গর্জনে বলে,‘সতীন ঘরেই আছে, ওটা তোমরা দেখবে না। খোদার ঐ নাফরমানী বান্দাদের দেখা যায় না।’
হাসির রোল জাগিয়ে প্রতিবেশীরা বলে,‘এমন ঠাট্টা না করলেও পারতে।’
‘ঠাট্টা করিনি, তোমাদের ইমরান সাধু এক পরী বিয়ে করে লুকিয়ে রেখেছে ঘরে। সেই শয়তানকে নিয়েই ঘর সংসার করে। আমার হাড় জ্বালাচ্ছে।’
প্রতিবেশীরা এক বাক্যে বলে,‘বউটার কোনো অসুখ হয়েছে নিশ্চয়ই, পাগলামি অসুখ। এই তোরা চল, এখান থেকে। এখানে থাকা ঠিক হবে না।’
প্রতিবেশীরা ঘর ছেড়ে এগিয়ে আসে বারান্দায়।
ফাতেমা স্টিলের প্লেটটা ছুঁড়ে ফেলে মেঝেতে। ঝনাৎ শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে বলে,‘ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেবো, তবু সতীন সহ্য করবো না। কোন সুন্দরী পরী এসে আমার সংসারে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে তা, আমি দেখে নেবো, বলে রাখলাম।’
প্রতিবেশীদের আমোদ দিতে বাইরে দাঁড়িয়ে ইমরান হেসে বলে,‘গ্যাছে.. গ্যাছে আমার বউয়ের মাথাটা গ্যাছে। কী সৌভাগ্য কপাল আমার ভাবতেই বুক ফাটে।’
ইমরানের অতি ঢঙ দেখে প্রতিবেশীরা সুখ আনন্দ পায়। ‘বউটার মাথা ঠিক নেই বলে’, এক এক করে সবাই বেরিয়ে যায়। ইমরানও ঘর ছেড়ে বেরোয়, ফাতেমা নিশ্চুপ বসে থাকে জানালার কাছে।
দিন ফুরিয়ে পশ্চিমে সূর্য হেলে পড়ে, রক্তিম আভা জানালা পেরিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি খায়। ফাতেমার মাথার ভেতর বাজতে থাকে প্রতিবেশীদের বলে যাওয়া কথা। অস্পষ্ট স্বরে ফাতেমা বলে,‘সত্যিই আমার মাথা ঠিক নেই।’ ফাতেমার চোখের কোণে পানি জমে। যে স্ত্রী বছরের পর বছর স্বামীর সোহাগ হতে বঞ্চিত থাকে তার মাথা ঠিক থাকবে কী করে? রাতে যখন ফাতেমা ইমরানকে কাছে টানতে যায়, তখন সে নানা অজুহাত দেখিয়ে সটকে পড়ে। এই সটকে পড়াটা রোধ করতে বছরের পর বছর ফাতেমা একেকটা সূত্র প্রয়োগ করে যাচ্ছে। অথচ, ইমরানের পূর্ণ পুরুষত্ব, যা দিনে-রাতে প্রায়ই ফাতেমার চোখের সামনে ধরা পড়ে। কিন্তু কেন, কী দোষে সে ফাতেমাকে সে দূরে সরিয়ে রাখে? প্রথমে সন্দেহ হতো ইমরান অন্য নারীর প্রেমে আসক্ত। ব্যাপারটা সত্যি হলে এতো দিনে তা ঠিক ঠিক ফাতেমার চোখে ধরা পড়তো। ভিন্ন কোনো জটিলতাও ফাতেমা ইমরানের মধ্যে আবিষ্কার করতে পারেনি। অনেকের মুখে শুনেছে, বিদেশে অনেক পুরুষ নারীকে পছন্দ না করে উল্টো পুরুষদের পছন্দ করে। কিন্তু ইমরানের মধ্যে এমন কিছুও খোঁজে পায়নি ফাতেমা। ফাতেমার রোষানল কেবল মাত্র দাম্পত্য সুখ না পাওয়া নয়, বরং এতোদিনের অনুসন্ধানে সে ইমরানের ইচ্ছার দিকনিশানা খোঁজে পায়নি, এটা যেন ফাতেমার জন্য অন্যতম পরাজয়। যদি, একটা উপায়ে ইমরানের দোষটা ধরা যেত, তবে এই বিজয়ের আনন্দে ফাতেমা একাই মহামিছিলের আয়োজন করতো।
ইমরান একটা এনজিও-তে চাকুরি করে। বেতন একেবারে সামান্য নয়, সংসারের খরচ মিটিয়ে সুখ বজায় রাখার মতো বলা চলে। তবু সংসার পুড়ছে অশান্তির আগুনে। ওদের বিয়েটা হয়েছিল অভিভাবকদের সম্মতিতে। পাত্রের ভালো চাকুরি থাকাতে ফাতেমার বাবা, মেয়েকে বিয়ে দিতে এক কথায় রাজি হয়ে যায়। সুন্দরী পাত্রী দেখে ইমরানের বাবা-মা কেউ পুত্রের ইচ্ছা অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে বিয়ের আয়োজন করে ফেলে। বাবা মাকে অবজ্ঞা করার মতো ছেলে নয় ইমরান, তাই বাধ্য বালকের মতো বিয়েটা করে নিলো।
একটা অদ্ভুত বাসর রাত ওদের কেটে গেল। সে রাতের কথা মনে হলে ফাতেমার কান্না আসে এখনো। ফুলের বাসর সাজানোই রইলো, বিন্দুমাত্র নড়চড় হলো না। ঘরে ঢুকেই ইমরান দেদারছে ঘুম মগ্ন হলো। পেরিয়ে গেলো রাত। আর সকালে ওঠেই ইমরান বলে কি না,‘কেমন ঘুমালে? আমি বেশ ঘুমিয়েছি। বিয়ে করার রাতে ক্লান্তি ঝাড়তে ঘুমের বিকল্প কী আর হতে পারে? তবে কোলবালিশটা কাছে থাকলে ভালো হতো।’
কথাগুলোকে ফাতেমা রসিকতা হিশেবেই নিয়েছিল। তারপর তো অনেক রাত কেটে গেল। ইমরানের দিক থেকে কোনো প্রকার আগ্রহবোধ নেই।
এই অনাগ্রহ দেখে কেটে যায় দীর্ঘদিন। ফাতেমা নিজের মধ্যে রূপের কোনো অভাব খুঁজে পায় না। ভরা লাবণ্য যৌবনে সবদিক দিয়েই সে পরিপূর্ণ। তবু কেন ইমরান আকৃষ্ট হয় না? ফাতেমা ধৈর্য ধারণ করে, আশায় বুক বাঁধে একদিন ইমরান ঠিকই তাকে কাছে টেনে সোহাগ দেবে। কিন্তু তা আর হলো কই? এদিকে দাম্পত্য জীবনের বিরূপ পরিস্থিতি ফাতেমাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। সন্তান না হওয়ার প্রসঙ্গে শুনতে হয় আত্মীয় স্বজনদের নানা কটু বাক্য। কখনো কখনো স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে যাবার জিদ মনের ভেতরে চাপলেও ফাতেমা থমকে দাঁড়ায়। কারণ হিশেবে স্বামীর ঘরে টিকে থাকা নিজের কাছে জীবনের অন্যতম চ্যালেঞ্জ ভেবে আঁকড়ে করে। ফাতেমার মনে পড়ে, অনেক প্রচেষ্টার পর দরিদ্র বাবা তাকে বিয়ে দিয়ে জীবন উদ্ধার করেছে। এখন স্বামীর ঘর ছেড়ে যদি কখনো বাপের বাড়ি চলে যেতে হয়, তা হবে বাপ-ভাইয়ের জন্য মহাবিপদ!
ফাতেমা প্রায়ই নিজেকে যে কোনো উপায়ে প্রবোধ দেওয়ার চিন্তা করে। কখনো কখনো মনে করে ইমরান ফেরেশতা বা পীর আউলিয়া। কারণ ফেরেশতাদের কখনো কামক্ষুধা থাকে না। ইমরানের মধ্যেও তেমনটি লক্ষ্যণীয়। আবার কখনো মনে করে আউলিয়া ইমরান নিশ্চয়ই কোনো পরী পুষে, সেই পরীর সাথে তার প্রেম। মনে মনে ফাতেমা বলে, হারামজাদী পরীর কারণে আমার সংসারে এই দুর্দশা, পরীটারে পাইলে সবকটা চুল ছিঁড়বে, ডানা কেটে ফেলবে। এভাবে মনের রোষ সূচক কমে যাবার পর ফাতেমা ভাবে, না, ইমরান আউলিয়া হলেও, পরীর সাথে লাইন মারবে বলে মনে হয় না। পরক্ষণে আবার ফাতেমার মনে প্রশ্ন জাগতো জগতের পীর আউলিয়াদেরও তো সন্তান হয়েছে, তবে ইমরান কেন এমন? নিশ্চয়ই ইমরানের মধ্যেও যৌন ইচ্ছা আছে, আর সেটা জাগিয়ে তুলতে হবে। ঘুমের সময় ফাতেমা সজাগ দৃষ্টি রাখে স্বামীর দেহের প্রতি, যদি কখনো দেখা পায় সে ইচ্ছের। ঘুমের মাঝে ইমরান সত্যিই কামনার শিখায় জ্বলে, ফাতেমা তা স্পষ্ট বুঝতে পারে। দুয়েক দিন হাত বাড়িয়ে উত্তপ্ত অনুভূতি স্পর্শও করেছে। কিন্তু পরক্ষণে ইমরান সজাগ হয়ে বলে,‘ঘুমের মাঝে মানুষের লজ্জ্বা স্থানে হাত দেওয়া তো ভালো না। তুমি এমন কাজ কেন করলা? কবিরা গুনা।’
দুঃখবোধে সংকুচিত হয়ে যায় ফাতেমা।
একরাতে ফাতেমা নিজেই রেগে চড়াও হয়। ইমরান তো হেসে আকুল।
‘আমাকে ঘোড়া পেলে নাকি? এমন করছো কেন?’
‘একদম নড়াচড়া করবে না?’
‘কী অপরাধে এমন শাস্তি?’
‘কী অপরাধ তা কি তুমি জানো না?’
‘না বললে, জানবো কী করে? একি ব্যথা পাচ্ছি তো, ছাড়ো আমাকে।’
সমুদ্রের মতো গর্জন করে ফাতেমা।
‘না, আজ তোমাকে ছাড়বো না।’
সে রাতে ইমরান রেগে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। নিরুপায় ফাতেমা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। ঘরে বাইরে ফাতেমার বিরুদ্ধে স্বামী পেটানোর গুঞ্জন তৈরি হয়।
এরপর তো, ইমরান বাড়ি ছেড়ে ফাতেমাকে নিয়ে পৌরসভা এরিয়াতে চলে আসে। ওরা এখানে ভাড়া বাসায় ওঠে। এইভাবে আবাস পরিবর্তন মূলত চাকুরির প্রয়োজনে। বাড়ি ছেড়ে ফাতেমা ভেবে ছিলো, হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গেলো। এখানে হয়তো কেউ সন্তান না হবার কারণ নিয়ে প্রশ্ন করবে না। আর গলা চেঁচিয়ে অনায়াসে জমিয়ে ঝগড়াও করা যাবে। কিন্তু নতুন হওয়া এই পৌরসভায় গ্রাম্য প্রভাব তো রয়েছেই। স্থানীয় ও হাতে গোনা কিছু ভাড়াটিয়া ঘর, যার কারণে সবাই সবার পরিচিত। পান থেকে চুন খসা কিংবা ঘরের হাঁড়ির খবর জানাজানি হয়ে যায় অনায়াসে। ইমরান ও ফাতেমা সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠলো ওদের বিখ্যাত ঝগড়ার কারণে। এ ঝগড়া নিঃসন্দেহে প্রতিবেশীদের জন্য আমোদ উপাদান। ঘরে বাইরে সবাই টিভি সিরিয়ালের মতো উপভোগ করে। ইমরান বিবাহিত জীবনে বউয়ের এই অত্যাচারটুকু মেনে নিয়েছে। ভেবে দেখলো বউয়ের সাথে বাড়াবাড়ি করে, অনর্থ ছাড়া আর কিছুই করা হয় না। রাতে বউ বেশি জ্বালাতন করলে ইমরান মোচড় দিয়ে কোলবালিশটা মাথার নিচে চাপিয়ে ফ্লোরে শুয়ে পড়ে। আর বলে,‘নাও, একা ঘুমাও।’
ফাতেমা কখনো বেশি হৈ চৈ করলে একেবারে ঘর ছেড়ে রান্নাঘরের পাশে একটুকরো বারান্দায় চলে যায়। শীত বৃষ্টির দিনে বারান্দাতেই করা ছোট্ট স্টোর রুমে চাটাই পেতে শুয়ে পড়ে।
ঘুমের ঘোরে ইমরানের কোলবালিশ মাথার নিচ থেকে উরুর ফাঁকে চলে যায়। এতেই মিটে যায় তার ইহজনমের যত কৌতূহলী আকাঙ্ক্ষা! সেই বারো বছর বয়স থেকে এটা চলছে। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে বিয়ে করলো। তারপরও চলছে এই লীলা! ফাতেমার অজান্তে এই চলমান জীবনের গোপন প্রবৃত্তি! যা লুকায়িত হওয়ার কারণে ফাতেমার মনের ভেতর পীর আউলিয়ার আসন পর্যন্ত লাভ করেছিল ।
এই মানসিক প্রবৃত্তির গঠনকাল ইমরানের শিশুবেলা থেকে। লাজুক মননের ইমরান সাড়ে চার বছর বয়সে ভর্তি হয় হাফিজিয়া মাদ্রাসায়। মাদ্রাসায় কোরআন পাঠ অসম্পূর্ণ রেখে সে পালিয়ে বাড়ি চলে আসে। গ্রামের স্কুলে ভর্তি করানো হলেও পড়াশোনায় কখনোই মনোযোগ গড়ে ওঠেনি। বেশিরভাগ সময় ঘরে থাকতে পছন্দ করতো। এক ধরনের লাজুকভাব ওর মধ্যে দেখা যেত সবসময়। অবশেষে ইমরানকে ওর নানাবাড়ি পাঠানো হলো। ওটা ছিলো জেলা শহরের ভেতরে, একটি আবাসিক এলাকা। ওখানে ওকে ক্লাস ফোরে একটা দ্বীনি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। ইমরানের নানা সরফরাজ আহমেদ ছিলেন কড়া মেজাজের ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। বাড়িতে টিভি রেডিও, গান-বাজনা এ জাতীয় কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিলো না। নারী-পুরুষের উভয়ের পর্দা প্রথা মেনে চলা বাধ্যতামূলক। মেয়েদের শরীর ঢেকে রাখা, আর পুরুষদের চোখ সবসময় সতর্কতার মাধ্যমে রাখা। কোনো নারীর প্রতি তাকানো মানে পাপ, এই জ্ঞান নিয়ে বেড়ে উঠে ইমরান। ছোটোবেলা পাপ ও দোজখের আগুনকে সে ভীষণ ভয় করতো। তাই কখনোই কোনো নারীর দিকে সে তাকাতে চাইতো না। সাহসও হতো না।
ইমরান যে রুমে থাকত সেখানে দুটো চৌকি ছিলো। একটাতে সে থাকত, অন্যটাতে থাকত ইমরানের জন্য রাখা এলম-দ্বীনঅলা জায়গীর মাস্টার। ইমরানের নানা-নানী ও জায়গীর মাস্টার ছাড়া আর কেউ ছিলো না ঐ বাড়িতে। শহুরে স্থান হওয়াতে, হারিয়ে যাবার ভয়ে তার বাইরে গিয়ে কোথাও খেলাধুলা করার অনুমতি ছিলো না। সারাক্ষণ একা থাকা, দু’তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে গ্রিল ধরে উঁকি দেওয়া, আকাশ দেখা এভাবেই দিন কাটতো। দুনিয়াবী খেলাধুলার উপরও সরফরাজ আহমেদের বিশেষ নিষেধাজ্ঞা ছিলো। ইমরানের প্রতি একটু বেশি কঠোর হওয়ার কারণ, মাদ্রাসা ছেড়ে নাতির পালিয়ে আসাটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাই স্কুল টাইমের বাইরে বন্দিদশাছাড়া ইমরানের ভাগ্যে আর কিছু জুটেনি।
এভাবে বড় হবার মাঝে একরাতে ইমরানের ঘুম ভেঙে যায় কোনো কিছুর নড়াচড়ার শব্দে। ঘরে বিড়াল ঢুকেছে ভেবে সে জায়গীর মাস্টারকে ডাকে। মাস্টার ওকে বলে,‘না ঘরে বিড়াল আসেনি, তুমি ঘুমাও।’
কিছুক্ষণ থেমে শব্দটা আবারো শুরু হয়। ইমরান বুঝতে পারে শব্দটা আসছে ঘরের দক্ষিণপাশ থেকে, যেখানে জায়গীর মাস্টারের বিছানা। ওটা আর কিছু নয়, মাস্টারের খাট খটর মটর নড়ছে। লাজুকতার কারণে সে রাতে এটা নিয়ে আর মাস্টারকে ডাকেনি ইমরান।
এভাবে প্রায় রাতেই ঘুম ভেঙে যেতো ইমরানের, এই মাঝরাতে খাট নড়াচড়ার কারণ মাথায় নিয়ে সে বাড়তে থাকে। কখনো মাস্টারকে কিছু জিজ্ঞেসও করে না। কিন্তু মনোকৌতূহল ওর পিছু ছাড়ে না, একদিন সে জানলা দিয়ে আসা ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয় আবিষ্কার করে মাস্টার আসলে কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে এভাবে খাট কীর্তন করছে। ইমরান মনোযোগী সজাগ দৃষ্টিতে বুঝতে পারে, দীর্ঘক্ষণ খটর মটরেরপর মাস্টার কোলবালিশ ছেড়ে সোজা হয়ে বসেছে, উলঙ্গ গোটা শরীর! জানালার কাছে ঝুলানো টিস্যু পেপারের রোল থেকে বাম হাতে ঝটপট তিনি কয়েকখÐ টিস্যু পেপার নিয়ে অতি সাবধানে উরুর মাঝখানে চেপে ধরে ওয়াশরুমে ছুটেন। ওয়াশরুম ভেতরেই ছিলো। দু’মিনিট পর উলঙ্গ শরীরে ফিরে এসে লুঙ্গি জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েন শান্ত বালকের মতো।
এভাবে অনেকদিন পেরিয়ে গেলো। ইমরানের কাছে গভীর রাতে খাট নড়াচড়ার সঙ্গীত ও উলঙ্গ শরীরে ওয়াশরুমে ছুটে যাওয়া খুব স্বাভাবিক কিছু যেনো, যেমনটা রাতের বেলা তেলাপোকা বা ইঁদুরের উৎপাত হলে মনে হয়। একবার মাস্টার পনের দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যায়, এই সুযোগে ইমরান জায়গীর মাস্টারের কোল বালিশ দখল করে বসে। মাস্টারের মতো, খাট কীর্তন করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। বালিশ ভ্রমণে একদিন উরুর ফাঁকে পুরুষাঙ্গেও উত্তেজনা বুঝতে পারে। এটা যেন ইমরানের জীবনে এক অনন্যআবিষ্কার, একাকিত্বের জগতে আনন্দলাভের মহান উপায়। দিনের বেলা যখন মাস্টার মসজিদে, হাট-বাজারে বা অন্য কোথাও যায়, তখন ইমরান ছুটে যায় ঘরের ভেতর কোলবালিশের কাছে।
একসময় ইমরানের দেহে কৈশোরের দোলা আসে। সেই সাথে বালিশ জড়ানোর আনন্দে খুঁজে পায় বীর্য বহিঃগমনের আহ্লাদ। ক্লাসে চিরকাল ইমরান এককোণে বসতো। ওর ভীতুভাব ও লাজুকতা নিয়ে সবাই মজা করতো, তাই বন্ধুদের এড়িয়ে যেতে পারলেই যেন সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। চির বন্ধুবিহীন ইমরানের শারীরিক বিকাশে একমাত্র সঙ্গী কোলবালিশ। যে সঙ্গীকে আজো সে জীবনের সাথে জড়িয়ে রেখেছে।
এনজিওতে ইমরানের চাকুরিটা জুটিয়ে দিয়েছে তার এক আত্মীয়। অফিসের হিসাবরক্ষক। ইন্টারমিডিয়েট পাশে এর চেয়ে ভালো চাকুরি আর কী হতে পারে?
এদিকে ফাতেমার কাছ থেকে ইমরান দূরে থাকার কারণে সেই শূন্য স্থানে এসে ঠাঁই নেয় এক বেকার যুবক। সে যুবকের নাম মালেক। ফাতেমা তাকে তার শৌর্যের জন্য ডাকে মালেক পাঠান। মালেকের মা মাজেদা বেগম ফাতেমার সাথে ছেলের যাওয়া আসা একদম পছন্দ করে না। ছেলেকে বার বার বারণ করেও ব্যর্থ হয়েছে। তাই ফাতেমার প্রতি মাজেদা বেগমের ভীষণ রাগ! সে রাগের বহিঃপ্রকাশ রোজ বজ্রপাত ভরা ঝগড়া ও কথা কাটাকাটি।
সকাল থেকে বিকেল অবধি অফিস হওয়াতে ছুটির দিন ছাড়া দুপুর বেলা ইমরানকে বাড়ি পাওয়া যায় না। এই অবসর সময়টাতে পাশের বাড়ির মালেক চলে আসে ফাতেমার কাছে। শরীরের অপ্রতিরোধ্য তৃপ্তিময় ইচ্ছে পূরণের পর ঘর্মাক্ত হয়ে বেরিয়ে যায় মালেক। গত দু’বছর ধরে চলছে এই ঘূর্ণিঝড়! স্ত্রী কার সাথে কী করছে বা না করছে তাতে ইমরানের বিন্দুমাত্র ভাবনা নেই। ভাবনা কেবল ঝগড়া নিয়ে! ভয় ফাতেমার রাগের প্রতি।
একদিন দুপুরে ইমরানের অফিস জরুরি কারণে ছুটি হয়ে যায়, সে দ্রুত বাড়ি ফিরে। এসে স্ত্রীকে আশপাশে কোথাও খুঁজে পায় না। তখন ফাতেমা ও মালেক বারান্দার স্টোর রুমে কামনার আগুনে জ্বলছে। এদিকে ইমরান ভেবে নেয় ফাতেমা বাইরে কোথাও গিয়েছে। ফ্রেশ হয়ে ইমরানের মাথায় চাপে কামইচ্ছা। সে দরোজা বন্ধ করে কোলবালিশ কাছে টেনে নেয়। বালিশের কভার খোলে জড়িয়ে ধরে দু’পায়ের মাঝে।
কামনার ক্ষুধা পূরণের পর ফাতেমা মালেককে বিদায় দিয়ে এগিয়ে যায় ঘরের দিকে। দরোজা বন্ধ পেয়ে জানালার গøাসে চোখ রাখে। দেখতে পায় বিছানার উপর ইমরান লড়াই করছে ঝড়ের বেগে। গোঙানি ও শীৎকার ধ্বনিতে ঘর কাঁপছে ভুঁ ভুঁ। ফাতেমা তার জীবনের সেরা আবিষ্কারটি করতে পেরে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। তীব্র রাগে দরোজায় আঘাত করে। ইমরানের সে দিকে সামান্য মাত্র দৃষ্টি নেই। সে চলমান আনন্দে ছুটছে পাগলা ঘোড়ার মতো।
দরোজা খোলার পর ফাতেমা ইমরানকে কলার ধরে বাইরে নিয়ে আসে। চিৎকার করে বলে, এসব করার জন্য তুই আমাকে বিয়ে করেছিস হারামজাদা! দাঁড়া আজ তোকে আমি ছাড়ছি নে। বৌকে ফাঁকি দিয়ে কোলবালিশ নিয়ে মজা করিস, কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবো।
বটি হাতে নিয়ে বেরোয় ফাতেমা। স্ত্রীর রুদ্র মূর্তি দেখে ঘর ছেড়ে পালায় ইমরান।
আর ফাতেমা রেগে কোলবালিশ দা দিয়ে কুপিয়ে উঠোন জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়।
সেদিন প্রতিবেশীরা জানতে পারল ফাতেমার সতীনকে।
ফাতেমা প্রতিজ্ঞা করে স্বামীকে আর ফাঁকি দেবার সুযোগ দিবে না। রাতে অনেক কেঁদে ইমরানের কাছে সোহাগ প্রত্যাশা করে। অনেকটা ভয়ে ভয়ে রাজি হয় ইমরান, নয়তো ভয়ানক কিছু সইতে হবে। সঙ্গমে এসে বুঝতে পারে ইমরান, এই পথ তার অচেনা, অতি পিচ্ছিল! ছোঁয়া পাওয়া মাত্রই গরগর করে তার অস্তিত্ব নিঃশেষ হয়ে যায়। স্বামীকে তাড়া দিয়েও সঞ্চালিত করতে পারে না, ফাতেমা। কারণ, ইমরান কৈশোর থেকে অভ্যস্ত এক টুকরো জড়বস্তুতে, সে কি করে বুঝতে মখমলের মর্ম? বাধ্য হয়ে ইমরান নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়।
জানায়, এসব আমি পারবো না।
রেগে যায় ফাতেমা। নিরুপায় ইমরান সরে যায় অনত্র।
পরদিন সকালে, মালেক আর ফাতেমাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
কয়েকদিন পর বিভ্রান্ত পথিক ইমরান ঘরে নিয়ে আসে নতুন একটি কোলবালিশ।
[লেখাটি ছাইলিপির শারদ সংখ্যা থেকে সংগ্রহীত ,ছাইলিপির শারদ সংখ্যা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ]