শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
ঝিলপাড়ের সরকারি জমিতে ঝোপঝাড়, আগাছার ধার ঘেঁষে গজিয়ে ওঠা অনেকগুলো এটা ওটা খুচরো দোকানের মাঝে হালে একটা লোক জুতো সারাইয়ের দোকান খুলেও বসে গেছে। পিচ রাস্তার ধার ঘেঁষে সামনে বেশ কিছুটা ঘাস রাস্তা। জমে থাকা কাদাজল ডিঙিয়ে কাঠের বাঁটওয়ালা কালো ছাতাটা নিয়ে আরএকবার কসরত করতে করতে অনিশ বাবু এগিয়ে গেলেন দোকানটার দিকে।
বড় মাপের পাকা দোকানঘর। হাত পা ছড়িয়ে চার পাঁচজন লোক কাজে নেমে পড়তে পারে। বিনা পয়সার জায়গায় ব্যবসা জমিয়ে বসে জুতো সারিয়ে, নতুন জুতো বানিয়ে কম বেশি, টুকটাক বেচাকেনা যা হোক মেইন রাস্তার ধারে একেবারে বেকার বসে থাকে না জীবন। বসে থাকে না ওরা…চাওয়ালা, সেলুনওয়ালা, খুচরো দোকানি, সাইকেল সারাইওয়ালা, ব্যাগ সেলাইওয়ালা, সস্তার দরজি…কম বেশির মধ্যে দিয়ে এক প্রকার চলে যায় সংসার…চালিয়ে নেওয়া যায়…বসে নেই জলের ধারে বেওয়ারিশ জায়গায় ঘর বাঁধা মনুষ্য জীবনও…রাতের অন্ধকারে মৎস্যজীবি ইউনিয়নের চোখকে ফাঁকি দিয়ে চোরের মতো চুপিসারে গা ঘেঁষা ঝিলের জলে ছিপ ফেলে বঁড়শির আগায় লটকানো মাছ ভোরবেলাকার বাজারে নিয়ে গিয়ে ফোড়ে সেজে ব্যবসা করার এও এক রোজগারের রাস্তা বৈকি। বসতি, দোকানগুলোকে পাশে রেখে ঝিলপার ধরে আরো এগোলে মাছ, সবজি বাজার, মুদিখানা ,হার্ডওয়ার …বড় ছোটো সাজানো দোকান.. আরো কত কি…দখলি জমির পাশে পাশে বসত করে কিছু অ-দখলিও….কোনোটা নিজের জমি, কোনোটা হাতবদল হওয়া লিজের জমি, কোনোটা সেলামী জমি…দিনের শেষে লাভের কড়ি গুনতে গুনতে কেউ স্বপ্ন দেখে ফুলে ফেঁপে ওঠা বর্তমানের দিকে তাকিয়ে, কেউ বা চেয়ে চেয়ে শুধুই ভবিষ্যতকে দ্যাখে…. দ্যাখে আর মনে মনে ভাবে একদিন এই ফুটপাতের জুতো সারাইয়ের দোকান রাজপথে টেনে নিয়ে যাবে তাকে….তখন জুতো ছেড়ে অন্য কোনো বড় ব্যবসা ধরতে আজকের মতো আর হাত কাঁপবে না….জমির জন্য আজ ক্লাবের কাছে বিক্রি না হলে এত বড় বেওয়ারিশ জায়গাটা থোড়াই জুটতো কপালে! জায়গাই ব্যবসা বাড়ায়, আবার জায়গাই স্বপ্ন দেখায়…তাই বোধহয় যে লোকটা কাল অবধি তিন মাইল দূরে স্টেশন বাজার সংলগ্ন বুড়ি বটতলার নীচে কাঠফাটা রোদে ছাতার তলায় চটি জুতো নিয়ে বসতো, আজ সে ই পাকা দোকান খুলে টেবিল পাখার হাওয়া খেতে খেতে হাত পা ছড়িয়ে মুচি গিরির পাশাপাশি নিজের হাতে জুতো তৈরির কাজে নেমে পড়েছে….আর দুদিন দেরী হলেই জায়গাটা হয়তো…ক্লাবের কাছে নিজেকে বন্ধক দিয়ে অন্য কেউ কোথা থেকে এসে ছোঁ মেরে স্বপ্নকে কিনে নিয়ে চলে যেত…দল পার্টি করে নিজের ভাইপো তার কাকুকে বাঁচিয়ে দিয়েছে…নইলে ঐ বটগাছের নীচেই একদিন হয়তো ঠা ঠা রোদে মরে পড়ে থাকতে হত…কোনো ছাতাই আর আগলাতে পারতো না।
লটারির টিকিটের মতো এমন একটা মাথা গোঁজার জায়গা যে সে কোনোদিন পেয়ে যাবে স্বপ্নেও ভাবেনি! দরকার শুধু রোজগার পাতি বাড়ানো। মাথার ওপর সংসার রয়েছে। ছেলে, মেয়ে, বৌ, বুড়ি মা….সে ই তো ওদের ছাতা। ভাইপো বলেছে,’ কালে কালে এ জায়গার দাম চরচর করে বেড়ে কোথায় যে যাবে…! কাগজপত্র নেই যদিও…একদিন সব হয়ে যাবে…।’
বেঁচে থাক ছেলেটা। আরো বেশি বেশি করে বিক্রি হোক ক্লাবের কাছে। বিক্রি নাহলে কখনো রোজগারপাতি বাড়ে! কি করেই বা মজবুত হবে দখলদারির ভিত!
এইভাবেই বেওয়ারিশ হয়ে পড়ে থাকা জায়গা একদিন নিজের জায়গা হয়ে যায়। পেটের টান,রুজিরোজগার,অবাঞ্ছিত বসতি… শব্দ গুলো সময়ের সাথে সাথে বদলে দেয় দখলদারির সংজ্ঞা।
ঝিলপার ভরে ওঠে ছিন্নমূল মানুষের কলরবে।
ওদিকে একটা ছাতার দোকান ছিল। সেটা আজ বন্ধ। মুচি লোকটা যদি কিছু করে দিতে পারে। বাজারে চায়ের দোকানে একটা লোক বলছিল ‘ ঐযে ঝিলপাড়ে জুতোর দোকান খুলেছে..ওকে একবার বলে দেখতে পারেন।’
সেজন্যই আসা। জুতোর জন্য নয়।
হাতুড়ি দিয়ে ঠুকেঠুকে জুতোর ক্ষয়ে যাওয়া শুকতলায় পেরেক মারছিল লোকটা।
এগিয়ে এসে বললেন অনিশ বাবু, ‘ছাতা সারাই করেন দাদা?’
কাঁচা পাকা চুলের মিশ কালো চেহারার লোকটা মুখটা তুলে পুরু লেন্সের চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে একটু হেসে বললো,’ ছাতা? না। ‘
‘ ও তাহলে তো আর…কি যে সব খবর দেয়…!’
‘ কই কিরকম ছাতা দেখি?’
আবার ডাকে কেন? যাইহোক যখন ডাকছে…।
পুরোনো কাঠের হাতলওয়ালা ছাতাটা বাজারের থলে ব্যাগে চালান করে ঐ একই ব্যাগের ভেতর থেকে ছেলের কিনে দেওয়া শিক ভাঙা ছাতাখানা বের করে লোকটার দিকে এগিয়ে দিলেন অনিশ বাবু।
‘ এ বাবা, এ তো নতুন ছাতা..! ‘
‘ একদম নতুন। কালকের ঝড়বৃষ্টিতে রাস্তা দিয়ে যেতে গিয়ে হাওয়ার তোড়ে এই অবস্থা…। ‘
‘ দুটো দিন সময় দিতে পারবেন? আমি তো এগুলো করি না। আমার ভাইপো ছাতার কাজ করে। একটু যদি সময় দেন তাহলে ওকে দেখিয়ে ঠিক করে এনে দিতে পারি৷ কাল যেরকম ঝড়জল হয়ে গেল আজ সকালে দেখি ভাইপোর দোকানে নেই নেই করে দশ বারোটা ভাঙা ছাতা জমা পড়েছে! আপনার এ ছাতার এখন শিক বদলাতে হবে, তারপর এই যে হাতলটা.. এও তো হলহল করছে…তাহলে কি দেখাবো ওকে?’
রাজী হয়ে গেলেন অনীশ বাবু।
‘ যা যা গন্ডগোল আছে, সব যেন ভালো করে ঠিক করে দেয়…।’
‘ সে নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। ঘুরে আসার পর দেখবেন আপনার ছাতা একদম নতুন হয়ে গেছে…ভালো কোম্পানির ফ্যাশানের জিনিস…কি বলবো আর, একটা ঝড়েই শেষ….এখনকার মালের এই তো গ্যারান্টি.! আপনার ও ছাতা আর এ ছাতা….জমিন আসমান..! হাতলটা দেখেই বুঝেছি! জুতো সেলাই করি বলে ছাতা চিনবো না…সংসারে তাহলে আর চিনলামটা কি! ‘
ব্যাগ থেকে মুখ বের করা কাঠের হাতলওয়ালা ছাতাটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো লোকটা।
…’ সংসারে তাহলে আর… ‘ কথাটা কেন জানি না হঠাৎই কানে এসে ধাক্কা দিয়ে গেল অনীশ বাবুর…
রোদে জলে, সকাল সন্ধ্যে একদিন এই কাঠের ছাতাটা ছিল বাবার নিত্যসঙ্গী৷ বিশ বছর আগে উঠে যাওয়া কোম্পানি সেকালের ‘ কে বি দত্ত অ্যান্ড সন্স।’ হাতলের গায়ে খোদাই করে লেখা নামটা চকচক করছে এখনো। সেই ছায়ার তলাতেই চার ভাইবোনের বড় হয়ে ওঠা। বাবার অবর্তমানে বড়দাই এগিয়ে এলেন সংসারে ছাতাখানা ধরতে। দায় দায়িত্ববোধ মানুষকে বড় করে না কি বয়স…জানেন না অনীশ বাবু… যেদিন সেই ছাতাটাও সরে গেল মাথার ওপর থেকে সেদিন মনে প্রানে অনুভব করলেন তিনি, নতুন করে অভিভাবকহীন হয়ে পড়া কতটা যন্ত্রণার.! ছোট সংসার আর স্বার্থের বশবর্তী হয়ে একান্নবর্তী পরিবারের হাঁড়ি আলাদা হলো, ভাইপো ভাইঝিরা কেউ বিবাহসূত্রে, কেউ চাকরি সূত্রে, কেউ আরো ভালো ভাবে জীবন কাটানোর মোহে একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে কে কোথায় ছিটকে গেল..! ছায়াহীন, ছাদহীন বাড়িটায় আজ অনিশ বাবু নিজের পরিবার নিয়ে নিজের মতো করে একা…যেতে পারেন নি কোথাও…হয়তো হয়ে ওঠে নি,হয়তো বা মন চায়নি…তাই বোধহয় মাঝে মাঝে নিজেকে এত ছায়াহীন মনে হয়….সত্যিই তিনি জানেন না এই নড়বড়ে ছাতাখানা কতদিন আর আগলে রাখতে পারবেন…ট্রাঙ্কের ভেতর রয়ে যাওয়া বাবার এই একটাই স্মৃতি…. দাদাও ব্যবহার করেছেন কতদিন এ ছাতাখানা…এইটুকুই তো আজও পড়ে আছে থাকার মধ্যে…অব্যবহার্য মালপত্রে ঠাসা পুরোনো ট্রাঙ্কটা পরিষ্কার করতে গিয়ে হঠাৎ করে ছাতাটা যদি চোখে না পড়তো বিস্মরণের স্তূপের আড়ালে আরো কতকাল ওটা ঐভাবে পড়ে থাকতো কে জানে…!
‘ তাহলে রেখে দিলাম, কি বলেন?’
‘ খুব যত্নের ছাতা…ভালো করে কিন্তু সারাই করতে বলবেন…দু একদিনের বেশি সময় যেন না নেয়…যেভাবে ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে, ছাতা ছাড়া গতি নেই। ‘
‘ বললাম তো কোনো চিন্তা করবেন না। ও খুব জলদি কাজ করে। দু দুটো লোক লাগিয়েছে দোকানে। কাজ দেখবেন,তারপর পয়সা।’
‘ বেশ।’
ভেবেছিলেন অনীশ বাবু, দুটো ছাতা একসাথে সারাই করতে দেবেন। ভরসা পেলেন না। কাজ ভালো করে কিনা দেখে তখন দেওয়া যাবে। এ ছাতাটার ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করলে হয়তো ঠকে যেতে হবে। সেকেলে ছাতা। সেকেলে কলকব্জা। সবাই তো সব কাজ নাও জানতে পারে। যেটুকু অবশিষ্ট আছে, গেলে আর পাওয়া যাবে না। এটুকুই তো সম্বল। বাজারের মোড়ের ঐ চেনা ছাতার দোকানটা খোলা থাকলে আর চিন্তা করতে হত না..।’
‘ মাস্টারমশাই জুতো টুতো লাগলে বলবেন। বর্ষা আসছে… কম দামে ভালো সোলওয়ালা চটি, জুতো আমার এখানে পেয়ে যাবেন। দেখাবো দু একটা?’
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বেশ খানিকটা অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেন অনীশ বাবু… ‘ আমি তো বোধহয় আগে কখনো এ দোকানে আসিনি…!’
‘ তাতে কি?’ হাসছে লোকটা। কিছু একটা আন্দাজ করেই হাসছে বোধহয়। বার্নিশ করা কালচে মুখমন্ডলে সাইনবোর্ডের মতো ফ্যাকফ্যাক করছে দাঁতগুলো। .. ‘ মাস্টার মশাইকে চিনবো না? মানে এ রাস্তা দিয়ে যেতে আসতে তো রোজই দেখি আপনাকে। মাছ বাজারের চায়ের দোকানে এসে বসেন…মুখে মুখে মাস্টার মশাই নামটা যেদিন কানে গেল,তারপর যেদিন প্রথম দেখলাম আপনাকে সেদিন থেকে আলাদা করে আর চিনে নিতে অসুবিধে হয় নি। ‘
তা বটে। অবসরপ্রাপ্ত হাই স্কুল টিচার অনীশ সরকার এ পাড়া, এ অঞ্চলের ভূমিপুত্র। এখানে মাস্টার মশাই কিংবা সরকার মাস্টার নামেই একবাক্যে সকলের কাছে সুপরিচিত,সম্মানিত তিনি। সুতরাং এক্ষেত্রে লোকমুখে শুনে চিনে নেওয়াটা অস্বাভাবিক নয়,বরং সাধারণ ব্যাপার। সেটা ভেবেই হয়তো হেসে পাশ কাটিয়ে গেলেন অনীশ বাবু।
কথা বলতে বলতে কখন যেন ভারী মেঘে ছেয়ে যায় আকাশ। গুরগুর করে ওঠে চারিদিক। একটু আগের পড়ন্ত রোদ সরে গিয়ে ছায়া ঘন হয়ে আসে বন বনানী,মাঠঘাট,রাস্তা, গাছাগাছালির আনাচে-কানাচে জুড়ে। দোকান ঘরের জানলার ফাঁক দিয়ে দৃশ্যমান ঝিলের জল তিরতির করে কাঁপতে থাকে হাওয়ার স্রোতে তাল মিলিয়ে। দূরে ঝিলের ওপারে কলোনি বস্তি, জঙ্গলাকীর্ণ মাঠের মাথার ওপর দিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে ধেয়ে চলে আকাশ ছাওয়া জলভরা মেঘপুঞ্জ। সারসের দল উড়ে চলে যায় হাওয়ার ভারে আঁকাবাঁকা পাখনায় ভর দিয়ে। ঝিলপার থেকে উড়ে আসা ভিজে স্যাঁতসেঁতে একটা হাওয়া গায়ে এসে লাগতে শুরু করেছে। কৎ কৎ করে কোলা ব্যাঙ ডাকা শুরু হয়েছে এধার ওধারে কচুবন,আগাছায় ঢাকা ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া কর্দমাক্ত দিঘির পার, জমা জলে, নয়ানজুলির ভেতর থেকে…..
তাড়াতাড়ি করে উঠতে গিয়েও পারলেন না অনীশ বাবু। ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। ব্যস্তসমস্ত ভাবে ইতিউতি তাকিয়েও একটা টোটো বা অটো চোখে পড়লো না রাস্তায়। দু একটা বাইক,সাইকেল, অল্প কয়েকজন লোক ছাতা মাথায় হেঁটে চলেছে….
‘ আসুন না ভেতরে। এই চেয়ারে এসে বসুন। সকালেই কাগজে দেখছিলাম, নিম্নচাপ আসছে। দুতিন দিন নাকি থাকবে। ঢুকে পড়লো মনে হয়। নয়তো এখনো কম আছে বৃষ্টি…. এই মওকায় ছাতাটা খুলে বেরিয়ে পড়ুন না হয়…।’
মুচি লোকটার কথায় ওর মুখের দিকে তাকালেন অনীশ বাবু।
‘ এ ছাতা অকেজো প্রায়। কিছুটা এগিয়ে আর খুলতে চায় না। ভেবেছিলাম সারিয়ে নেবো। থাক, একটা একটা করে হোক আগে৷ কদিন পরে না হয় এটা….সে তো হল, এখন বাড়ি যাবো কি করে তাই ভাবছি…!’
‘ তাহলে খানিকক্ষণ বসেই যান। ছাতা ছাড়া যাবেনই বা কি করে?’
‘ না না যেতে আমায় হবেই। সময়ে ওষুধ খেতে হয়। শরীর বলে কথা! একটা গাড়িও চোখে পড়ছে না যে…!’
শরীরের কথাটা যেন না চাইতে অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো অনীশ বাবুর। হয়তো চাপা উত্তেজনা বশত।
‘ ও তাহলে তো..!’ ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে এসে বাইরে এদিক ওদিক তাকাতে থাকে লোকটি।
‘ মাস্টার মশাই, আর দেরী করে লাভ নেই। চলুন আমি আমার ছাতাটা নিয়ে আপনাকে পৌঁছে দিই…বৃষ্টিটা বাড়লো দেখছি…চলুন চলুন… আসুন আমার সঙ্গে..! ‘
‘ কিন্তু এভাবে দোকান খোলা রেখে..!’
‘ কিচ্ছু হবে না দোকানের। এখানে আমরা সবাই সবাইকে চিনি….আপনার মতো। আর যদি কিছু খোয়াও যায় তাতেও কোনো আফসোস নেই… অন্য কাউকে নয়, আমার মাস্টার মশাইকে নিয়ে যাচ্ছি….দেখবেন সামনে গর্ত..কাদাজল… সাবধানে পা ফেলুন..!’
দু পা এগিয়েও হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়েন অনীশ বাবু।
কি যেন ভেবে মুখের তাকিয়ে থাকেন মুচিওয়ালার। খুঁজছেন কিছু একটা…. হয়তো অনেক দিনের পুরোনো হারিয়ে যাওয়া কিছু…!
ছাতা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। হাসছে মিট মিট করে…..
স্মৃতির শেষ সন্বলটুকু বগলে করে এক ছাতা থেকে আর এক ছাতার হাত ধরে এগিয়ে চলেন অনীশ বাবু….।
‘ কি যে উপকার করলি বাবা…’ শ্রীদামের হাতে হাত রেখে বললেন সরকার মাস্টার… ‘ সময়মতো ওষুধটা না খেলে…বুঝিস তো, বয়স হয়েছে…শরীরের ব্যাপার…যা বাবা যা এবার…দোকানটা খোলা পড়ে আছে…অতক্ষণ থাকলাম,কথা বললাম…সময়ে যদি পরিচয়টুকু দিতিস তাহলে আর আমায় আপনি, আজ্ঞে করতে হত না…কি কান্ড দ্যাখ দেখি একবার…!’
…’ পরিচয়’…. ছোট্ট শব্দটা যেন কোনো এক অজানা ঠিকানা থেকে ভিজে হাওয়ায় উড়ে এসে বুকের ভেতর জায়গা করে নিল শ্রীদামের। মুখ ফসকে বেরিয়েই গেল শেষমেশ। মুচির কাছ থেকে সারানো জুতো হাতে করে নিয়ে আসা যায়, জুতো সারাইয়ের সে হাত দুটো ধরতে কে ই বা চায়….এতদিনের পোষণ করা ধারণাটা যে ঠিক নাও হতে পারে, আজকের এই মূহুর্তটা না এলে হয়তো…!
‘ তাহলে আসি মাস্টার মশাই। পারলে ছাতাটা সারিয়ে নিয়েন। এখন আর খুঁজলেও এ জিনিস কোথাও…। ‘
‘ সেই জন্যই তো আসতে হবে রে…হয়তো তোর কাছেই আবার… এ বাবা..বৃষ্টির জোড়টাও তো হঠাৎ করে আরো বাড়লো দেখছি! ছাতায় মানবে না। আয় ভেতরে আয়। ভিজে যাবি যে..!’
‘ আমাদের কাছে আবার রোদ আর জল…সবই গা সওয়া.. এইটুকু রাস্তা…ও ঠিক চলে যাবো… দোকান পড়ে আছে..!’
মাস্টার মশাইয়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম জানিয়ে ছাতাটাকে শক্ত হাতে ধরে জল ভাঙতে ভাঙতে ধীরে ধীরে গন্তব্যের পথে এগিয়ে চলে শ্রীদাম।
বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে দূর থেকে তাকিয়ে দেখেন সরকার মাস্টার…. সামনে অঝোরধারায় বৃষ্টি। উথালী হাওয়া। রিমলেস চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে আসে বেলাগাম জলকনায়। কিরকম যেন ভোরের কুয়াশার মতো ঘিরে ধরে চারিদিক। কাছ থেকে দূরে অবয়ব হয়ে যায় মানুষ কোন ফাঁকে। ঝিলপারের আবছায়া পথ ধরে হেঁটে চলে যায় শুধু একটা ছাতা….শত ঝড় জলেও এ ছাতা বোধহয় অত সহজে ভাঙবার নয়।
ঘরের দিকে এগোতে এগোতে আনমনে কাঠের হাতলটা চেপে ধরে আর-একবার কসরত করেন অনীশ বাবু। আজ সকালে আচমকা হট করে খুলে গিয়েছিল ছাতাখানা। ঐ একবারই…তারপর আর…। বলা তো যায় না, যদি মানুষের মতো হঠাৎ করে নিজেই নিজেকে মেলে ধরে..!!