ছোট গল্প – বাপের বাড়ি

ছোট গল্প - বাপের বাড়ি

ডঃ গৌতম সরকার

গঙ্গার দিক থেকে একটা হাওয়া এসে চিতার আগুনটাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। এদিকটায় কোনো আলো নেই। দূরে ডোমের এক কুঠুরি ঘরটায় একটা অল্প পাওয়ারের আলো জ্বলছে। ডোম তার কাজ করে দিয়ে চলে গেছে। এখন কাঁপতে থাকা চিতার আলো কাছে- পিঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকা মানুষগুলোর মুখের ওপর দিয়ে ছিটকে ছিটকে পড়ছে। শৌর্য এতক্ষণ ওখানেই ছিল, ঈশানীকে চিতার সামনে থেকে উঠানো যাচ্ছে না। ও এক দৃষ্টিতে জ্বলন্ত চিতার দিকে চেয়ে বসে আছে, চোখ শুকনো।  

 

আরেকটু অন্ধকার খুঁজে নিয়ে একটা সিগারেট ধরালো শৌর্য। বিকেল থেকে যা যাচ্ছে, নেশার কথা ভুলেই গিয়েছিল প্রায়। অফিসে বসে যখন ফোনটা পেল তখন ঈশানী হাউ হাউ করে কাঁদছিল। ব্যাপারটা বুঝতে কিছুটা সময় লেগেছিল, তারপর সেকশন ইনচার্জ সমরদাকে বলে চটপট এখানে চলে এসেছে। কলকাতা থেকে খুব দূরে না হলেও জায়গাটা এখনও গ্রাম গ্রাম রয়ে গেছে। এখানে এখনও ইলেকট্রিক চুল্লি ঢোকে নি। মানুষ এখনও সাবেকি নিয়মে প্রিয়জনদের কাঠের চুল্লিতে দাহ করে। শ্বশুরমশাই বিভিন্ন বয়সজনোচিত অসুখে ভুগছিলেন। একটা সময় প্রত্যক্ষ ভাবেই কম্যুউনিস্ট আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। সেই কারণেই স্বভাবে সাংঘাতিক আত্মনির্ভরশীল ছিলেন, শেষ বয়সে জেদ আর একরোখামি আরোও বেড়ে গিয়েছিল। স্ত্রী মারা গেছেন বছর পাঁচেক আগে, সেই থেকে দুটো কাজের লোকের হেফাজতে একলা থাকতেন। বার বার বলা সত্বেও কলকাতায় মেয়েদের কাছে যান নি। শীর্ষের হয়ে পড়েছিল মহা ঝকমারি। শরীর একটু আধটু বিগড়োলেই তার ছুটোছুটি শুরু হয়ে যেত, না হলেই ঈশানী কেঁদে-কেটে একসাথ করতো। ওদিকে বড় মেয়ে আছেন, তার যদিও এলিট ব্যাপার। তিনি নিজে ছুটোছুটি করবেন না, কিন্তু কর্তব্যকর্মে অবহেলা হলেই নিজের বোন আর শীর্ষকে কথা শোনাতে ছাড়েন না। যদি ভুল করে ওনার নিজের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, তাহলেই শুরু হয়ে যাবে নিজেকে জাহির করার ফিরিস্তি। উনি যে কত উচ্চমানের মানুষ, চাকরি, রিসার্চ, সেমিনার-ওয়ার্কশপ নিয়ে কিভাবে ওনাকে সারাবছর দেশ-বিদেশের কোনায় কোনায় দৌঁড়ে বেড়াতে হয়, সেসব কথামালা শীর্ষ বিয়ের পর থেকে কয়েক লক্ষ বার শুনেছে। তাই সে আর বিশেষ ঘাঁটায় না। আর ওনার বোন তো ছেলেবেলা থেকেই দিদির তুলনায় নিজের ক্ষুদ্রতাকে মেনে নিতে শিখেছে। দিদির ব্যাপারে সে মুখ বুজেই থাকে। মাঝে মাঝে শীর্ষের খুব রাগ হয়। মানুষকে যে অসাধারণ হতেই হবে তার কি কোনো মানে আছে! সাধারণ হয়েও তো মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা যায়। সাধারণ হওয়া তো কোনো অপরাধ নয়! তাহলে বিয়ের এতবছর পরও দিদির কাছে প্রতি ক্ষেত্রে হেয় হয়ে বেঁচে থাকতে হবে কেন! প্রতিবাদ না করে অন্যায়কে মেনে নেওয়াও তো একধরনের অপরাধ। প্রথম প্রথম শীর্ষ ঈশানীকে এসব বোঝাতো, এখন বলা ছেড়ে দিয়েছে।

 

হাওয়াটা এখন একটু বন্ধ হয়েছে। চিতার আগুন লকলক করে জ্বলছে। আগুনের লেলিহানে আস্তে আস্তে ভস্মীভূত হচ্ছে মানুষটার অস্থি-পাঁজর। আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কি রকম একটা ঘোর নেমে এলো শীর্ষর দুচোখ জুড়ে। 

রেবতী রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, পেশায় সরকারী চাকুরে, নেশায় রাজনৈতিক কর্মী। তখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি উত্তাল, সত্তরের দশক। একদল তাজা তরুণ শিক্ষিত যুবক অচলায়তন ধুলোয় মিশিয়ে নতুন দিনের স্বপ্নে, নতুন পৃথিবীর স্বপ্নে তোলপাড় তুলেছে সারা দেশ জুড়ে। শাসন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত, সরকার তার পুলিশ বাহিনী দিয়ে তাদের আটকাতে পারছে না। প্রতিদিন পুলিশ আর নকশালদের সংঘর্ষে লাশ পড়ছে শহরের অলিতে, গলিতে। সেই সময় রেবতী রঞ্জন আশ্রয় এবং প্রশ্রয় জুগিয়েছেন পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন জাগানো কিশোরদের। তখন বড় মেয়ের জন্ম হয়েছে, স্ত্রী রাজনীতির কিছু না বুঝলেও কখনও স্বামীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে যান নি। একসময় পুলিশের সন্দেহের তালিকায় তাঁর নাম নথিভুক্ত হল, এক রাতে সহসা পুলিশ হানায় বমাল ধরা পড়লেন রেবতী রঞ্জন। সরকারী চাকরি গেল, দুবছরের জেলও হল। জেল থেকে ফিরে ছোটমেয়ের মুখ দেখেছিলেন। ততদিনে উন্মাদনা কমেছে, সরকার এবং পুলিশবাহিনী নির্দয় ও নিষ্ঠুর হাতে অল্পবয়সীদের বালখিল্যতা রক্তের দামে মিটিয়ে দিয়েছেন। বহু মানুষ সন্তান হারা হলো, বোন ভাইদের হারালো, স্ত্রী স্বামী হারালো, আর সমাজ হারালো একদল তেজি, মেধাবী, তাজা তরুণ; যারা সঠিক পথে চললে একদিন সত্যিই এই সমাজটাকে বদলে দিতে পারতো।

 

কেউ একজন এসে শীর্ষকে ডাকলো, অন্ধকারে কারোর মুখই স্পষ্ট নয়। তাছাড়া এখানকার সবাই তার পরিচিত নয়। আত্মীয়-স্বজন বিশেষ কেউ আসে নি, পাড়ার কয়েকটি ছেলে তাদের সাথে এসেছে। ছেলেটির সাথে একটু এগিয়ে একটা জটলা দেখতে পেল, আর জটলার মধ্যে থেকে ইন্দ্রানীর গলার আওয়াজ পেল শীর্ষ। বেশ উত্তেজিত ভাবে কিছু বলছে। তীর্থ কাছে গেলে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এসে শীর্ষকেই এমনভাবে বলতে শুরু করলো, যেন অন্যায়টা শীর্ষই করেছে।

“কাদের তুমি নিয়ে এসেছো? এদের কোনো ফিলিংস-ই নেই…আমার বাবার এখনো দাহ কার্য সম্পূর্ণ হয় নি, আর এরা আমার কাছ থেকে মদ খাওয়ার টাকা চাইছে!” অন্ধকারের মধ্যে একটি ছেলে তেড়িয়া আসিয়া বলল, “এটা কলকাতা নয়, গ্রামে এসব হয়।”

“দেখছো, দেখছো ! কি আনকালচার্ড , অশিক্ষিতের মতো কথা ! কি দরকার ছিল এদের আনার? নাও এখন তুমি সামলাও, আমি এই নোংরা ব্যাপারের মধ্যে থাকতে চাই না।” শীর্ষর যদিও ছেলেদের দাবীটা মোটেই পছন্দ হয়নি, কিন্তু ইন্দ্রানীর ভর্ৎসনার ভাষাগুলোও যথেষ্ট আপত্তিকর। বিশেষত এই পরিবেশে এবং পরিস্থিতিতে সেটা মোটেই ভালো শোনাচ্ছে না। এরা আমাদের সঙ্গে এসেছে, তাছাড়া অল্পবয়সী ছেলের দল কোন কথার কি উত্তর করবে তখন নিজেদের মান-মর্যাদা রক্ষা করাই দুষ্কর হয়ে উঠবে। এই ভদ্রমহিলার এটাই মহা দোষ, কখনোই কোনো অবস্থাতেই নিজের পজিশন ভুলতে পারেন না। আর এটাই তাদের পরিবারের সব সমস্যার মূল।

 

চাকরী চলে যাওয়ার পর রেবতী রঞ্জন ছোটখাটো একটা ব্যবসা শুরু করলেন, পাশাপাশি সন্ধ্যেবেলা টিউশনি ধরলেন। সংসার মোটামুটি ভাবে চলতে লাগলো। বড় মেয়ে বাবা ন্যাওটা, পড়াশোনাতেও শার্প। ছোট মেয়ে একটু মা ঘেঁষা, পড়াশোনার বইয়ের থেকে মায়ের পাশে থেকে হাতে হাতে সংসারের কাজে মাকে সাহায্য করতে বেশি পছন্দ করে। পরীক্ষার রেজাল্টে সেটা আরও বেশি করে প্রতিফলত হয়। বড় মেয়ে খুব ভালো রেজাল্ট  করে ক্লাসে ওঠে, ছোটো মেয়ে কোন রকমের পাশ করে। বাবা সবাইয়ের কাছেই বড় মেয়ের মেধার কথা জাহির করে বলতেন। কেউ ছোটমেয়ের কথা জিজ্ঞাসা করলে, গম্ভীর হয়ে চুপ করে যেতেন। দ্রুত অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতেন। এতে ছোট মেয়ে কিছু মনে করত না, বরঞ্চ আস্তে আস্তে মেনেই নিল দিদির চেয়ে সে সব ব্যাপারেই অনেক নিকৃষ্ট। এতে করে দিদির প্রতি তার টান, ভালোবাসা কমলো না, উল্টে যত বেশি রেজাল্টের তফাৎ হতে লাগলো, দিদিকে নিয়ে তার গর্ব বাড়তে লাগলো। একসময় সে দিদিকে পূজো করতে শুরু করলো।  

 

সময় কাটতে লাগলো, একসময় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক’টা পরীক্ষা কৃতিত্বের সাথে পাশ করে কলকাতার এক নামি কলেজে অধ্যাপনার চাকরি পেলো ইন্দ্রানী। বাবা সীমাহীন আনন্দ পেল, তিনি আরও বেশি বড়মেয়ের কৃতিত্বে পঞ্চমুখ হয়ে উঠলেন। ছোটমেয়ে তখন কলেজ ডিঙিয়ে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে, বাবা সেভাবে ছোটমেয়ের পড়াশোনার খোঁজখবর রাখতেন না। এখন বড় মেয়ের চাকরির বদৌলতে সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে খানিক, বাড়িতে একমাত্র মা বাদ দিয়ে অন্যদের কাছে ছোটমেয়ের অবস্থান ছিল অনেকটা আশ্রিতার মতো। পদে পদে দুই মেয়ের তুলনা টানতে টানতে বাড়িতে সরাসরি দুটো দল তৈরি হয়ে গেল- মা যদিও জোর গলায় কিছু প্রতিবাদ করতে পারতেন না, তবুও দুয়েকবার বাবার আচরণের প্রতিবাদ করেছেন। তারপর রান্নাঘরে ফিরে এসে চোখের জল ফেলেছেন। ঈশানী তখন বড় হয়েছে, হীনমন্যতা আস্তে আস্তে গ্রাস করতে লাগলো, তবুও মাকে কিছু বলতে বারণ করতো। ঈশানীর বিষয় ছিল দর্শন, অন্যদিকে দিদির বিষয় অর্থনীতি। এ নিয়েও বহু অপমান সহ্য করতে হয়েছে। দিদির ইচ্ছের বিরুদ্ধে এই বিষয় বেছে নেওয়ায় বাড়িতে প্রচুর অশান্তি হয়েছে। জীবনে সেই প্রথমবার সে দিদির বিরুদ্ধে গিয়েছিল, দিদি আর বাবার দুজনেরই ইচ্ছে ছিল সে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ুক। কিন্তু ঈশানী বুঝেছিল, সে পারবে না। দিদি তো বলেই ফেলেছিল, তোর সাবজেক্টের কথা লোকের কাছে বলতে আমার লজ্জায় মাথা কাটা যাবে। ঈশানী কিছু বলে নি। গ্র্যাজুয়েশনে মোটামুটি ভাবে পাশ করে নিজের ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্সেও সুযোগ পেয়েছে। মাস্টার্স পরীক্ষার ঠিক দুমাস আগে ঈশানির সাথে শৌর্যের পরিচয় হল। 

 

ছেলেগুলোকে কিছু টাকা ধরিয়ে এগিয়ে গেল শৌর্য। দূরে ইন্দ্রানী তার কলেজের সহকর্মীদের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তেজিত হয়ে বোধহয় ছেলেগুলির অসভ্যতামির কথাই শোনাচ্ছে। দূরে চিতার পাশে ঈশানী একা বসা। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল শৌর্য। হালকা করে কাঁধটা ছুঁল, ঈশানী একবার তাকিয়ে শৌর্যের আঙুলগুলো আঁকড়ে ধরলো। শৌর্য টের পেল ঈশানির হাত থর থর করে কাঁপছে। ও পাশে বসে পড়লো। ওর হাতটা নিজের কোলের উপর রাখলো।

শৌর্যের সাথে পরিচয় হবার পর বাড়িতে ঈশানীর টিকে থাকাটা খুব মুশকিল হয়ে পড়লো। বাবা-দিদি কেউই শৌর্যের সাথে সম্পর্কটা ভালোভাবে নেয় নি। তবে দুজন সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। বাবার আপত্তি, দিদির বিয়ের আগেই বোনের এরকম এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া একধরনের অপরাধ আর দিদির মূল আপত্তি প্রেমে। তাঁর কাছে প্রেম ব্যাপারটা খুব নোংরা ব্যাপার। নিজে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেখানে বোন কি করে দিদিকে লুকিয়ে প্রেমের মত একটা অশালীন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে! ওনার ধারণা, বিয়ে মানেই পুরুষ মানুষের আধিপত্য মেনে নেওয়া, সেক্ষেত্রে ওনার মত বিদুষী মহিলাকে ডমিনেট করার মতো কোনো পুরুষের এখনও জন্ম হয় নি। আর নিজের বোন, যে ছোটবেলা থেকে সব ক্ষেত্রে সহস্র যোজন পিছিয়ে থেকেছে, সেই বোন প্রেমের ব্যাপারে বা নিজের সংসার রচনায় তাকে মেরে বেরিয়ে যাবে, সেটা সহ্য করতে পারছিলেন না। অনেক অশান্তি হয়েছে, সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার জন্য অনেক চাপ দেওয়া হয়েছে। এগুলো ঈশানীর মুখে যত শুনেছে শৌর্যের জেদ তথা প্রেম তত গাঢ় হয়েছে। একমাত্র মা ছিল ঈশানীর পক্ষে, আর জীবনে ওই একবারই মহিলা সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ছোটমেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। আর তাদের বিয়ে হওয়ার একবছরের মধ্যে মারা যান। ঈশানীর গর্ভে সন্তান আসার খবর শুনে গেলেও নাতির মুখ দেখে যেতে পারেন নি।

 

শ্বাশুড়ির মৃত্যুর কথা মনে পড়তেই শৌর্যের কান-মাথা আবার গরম হয়ে উঠলো। সে এমনিতে ঠান্ডা মাথার ছেলে, চট করে মানুষের সাথে ঝুট-ঝামেলায় যায় না। কিন্তু অকারণে যদি কেউ কটু কথা বলে, অপমান করে, তাহলে মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না। আর এই কাজটাই বিয়ের পর থেকে ইন্দ্রানী হিসেব কষে করে চলেছে। এমনভাবে, এমন পরিবেশে করে যে লোকলজ্জার ভয়ে কিংবা ঈশানীর মুখ চেয়ে তাকে চুপ করে থাকতে হয়। কিন্তু মনে মনে মহিলার প্রতি তীব্র অভক্তি, আর ঘৃণা জমতে জমতে পাহাড় হয়ে গেছে। বিয়ের পর থেকে ছোটবোনের স্বামীকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি, ছোটখাটো ব্যাপারে সুযোগ পেলেই শৌর্যকে অপমান করেছে। এখানে যার প্রতিবাদ করা উচিত ছিল সেই ঈশানী চুপ করে থেকেছে। শৌর্য ওকে দোষ দেয়না, ছোটবেলা থেকে নিজের দিদিকে চেনে, জানে প্রতিবাদ করলে সেটাকে ফুলিয়ে, ফাঁপিয়ে বিশাল বড় অশান্তি বানিয়ে তুলবে। তার দিদি জীবনে হারতে শেখেনি, যেকোনো তর্কে বা ঝগড়ায় সবসময় শেষ কথাটা সেই বলবে। 

 

বিয়ের পর একবার সবাই মিলে শৌর্যের দেশের বাড়িতে গেছে। এককালে শৌর্যের পূর্বপুরুষরা জমিদার ছিল। তখনকার দালান কোঠা, পুকুর, জমি এখনও কিছু অবশিষ্ট আছে। তবে সংস্কারের অভাবে সবই জরাজীর্ণ। ঈশানী কখনও এত বড় বড় পুকুর দেখেনি। শান বাঁধানো ঘাট, তবে সিঁড়ি গেছে ভেঙে। অতি উৎসাহে নেমে পড়লেও উঠতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে। ওর অবস্থা থেকে ঘাটের ওপর থেকে সবাই হাসাহাসি করছে। ঈশানি চিৎকার করছে, পড়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছে। শৌর্য ওর অবস্থা দেখে নিচে নেমে ওকে প্রায় জাগিয়েই ওপরে তুলে আনে। তারপরই শুরু হয়ে যায় ইন্দ্রানীর বাক্যবান। অতগুলো মানুষের সামনে তাদের বিরুদ্ধে নির্লজ্জ, অসভ্য, রুচিহীন, ইত্যাদি চোখা চোখা শব্দের ফোয়ারা ছোটাতে লাগলো। সেই সময় ঘাটে ঈশানীর বাবা-মা, শৌর্যের দাদা-কাকারা উপিস্থিত ছিলেন। সবাইয়ের মতো শৌর্যও বুঝতে পারেনি, নিজের বউকে ধরে তুলে আনার মধ্যে কি অপরাধ লুকিয়ে ছিল।

আস্তে আস্তে শৌর্য বুঝেছিলো। কোনো এক বিখ্যাত মানুষ বলে গেছেন, “সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স বলে কিছু হয়না, যে সমস্ত মানুষের মধ্যে ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স থাকে তারাই মনের মধ্যে কাল্পনিক সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্সের জন্ম দেয়। একটা ইউটোপিয়ান জগৎ তৈরি করে নিজেকে নিজের এবং অন্যদের কাছে শ্রেষ্ঠ প্রমান করার মিথ্যে চেষ্টা চালিয়ে যায়”। আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়লো। একদিন অফিস ফেরত ঈশানির বাড়িতে এসেছে। তখন শাশুড়ি মা বেঁচে। সন্ধ্যেবেলা চায়ের সাথে শৌর্য আর ঈশানি একই বাটি থেকে মুড়িমাখা খাচ্ছিল। কলেজ থেকে ফিরে সেই দৃশ্য দেখে ইন্দ্রানী তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। বাড়ির সবাইয়ের সামনে চোখ-মুখ কুঁচকে বলে উঠলো, “একই ইল্লুতেপনা ! তোমাদের বাড়িতে যা করো করো, আমাদের বাড়িতে এইসব নোংরামি চলবে না।” আবার শৌর্য অবাক, আর ঈশানী চুপ। মোদ্দা কথা, বোনের সুখী বিবাহিত জীবন ইন্দ্রানীর চক্ষুশূল ছিল। তারপর থেকে খুব প্রয়োজন ছাড়া শৌর্য শ্বশুরবাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। আর শ্বাশুড়ি মায়ের মৃত্যুর দিন হসপিটালে যা ঘটলো, সেটা কোনো শিক্ষিত ভদ্রমহিলা ঘটাতে পারে সেটা চিন্তা- ভাবনার বাইরে। শাশুড়ি মা বেশ কিছুদিন ধরেই ভুগছিলেন। হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। মৃত্যুর দিন কেউই হাসপাতালে ছিলো না। খবর পেয়েই সবাই যে যার কর্মস্থল থেকে এসে পৌঁছোলো। মায়ের মৃত্যুতে দুই মেয়েই ভেঙে পড়েছে। ঈশানীকে মায়ের কাছ থেকে ওঠানো যাচ্ছে না। এদিকে হাসপাতালের ফরম্যালিটিসগুলো সারতে হবে। ইন্দ্রানী আর শৌর্য অফিসে দৌঁড়ালো।কিছু একটা ব্যাপারে সুপার একটা লিখিত চিঠি চাইলো। শৌর্য ইন্দ্রানীর দিকে তাকালো। ইন্দ্রানী জানালো সে মানসিকভাবে এতটাই বিধ্বস্ত যে চিঠি লেখার মতো অবস্থায় নেই। অগত্যা শৌর্য লিখতে শুরু করলো। অফিসে এধরণের ড্রাফটের কাজ হামেশাই করতে হয়। তাছাড়া সেও কিছু লেখাপড়া শিখেছে। চিঠিটা লিখে সুপারকে দিতে যাচ্ছে, এমন সময় ইন্দ্রানী বললো, “দেখি কি লিখেছো।” শৌর্যের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে একবার চোখ বুলিয়েই বলে উঠলো, “ইংরেজিতে অনেক ভুল আছে।” শৌর্যের সাথে একঘর অচেনা মানুষজনও যেন লজ্জায় চুপ করে গেল। পরে শৌর্য অনেকবার ভেবেছে, যে মানুষটার সদ্য মাতৃবিয়োগ ঘটেছে, যে নিজেই স্বীকার করেছে চিঠি লেখার মতো মানসিক স্থিতি সেই, সেই মানুষটাই কোন মানসিক বিকৃতিতে একঘর বাইরের লোকের সামনে নিজের বোনের স্বামীর ইংরেজিতে ভুলের কথা চাউর করতে পারে। এটা কি ধরণের আচরণ ! এটা কি বিকৃতি, না একধরনের রোগ ! কোনো উত্তর পায়নি।

 

চিতার আগুন নিভে আসছে। ডোম লোকটি আবার ফিরে এসেছে। একটা লাঠি দিয়ে দুমদুম করে পিটে আগুন নেভাচ্ছে। যেখানে লাঠির ঘা পড়ছে, সেখানেই একটু আগে মানুষটা শুয়ে ছিল। ঈশানী দুহাত দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। ইন্দ্রানীর ডাক পড়লো, সে নাভিকুন্ড নিয়ে গঙ্গায় বিসর্জন দিতে যাবে। বড় মেয়ে হওয়ার দরুন একাজ তাকেই করতে হবে। দুয়েকজন সহকর্মী এসে ওকে সাহায্য করছে। আগুন পুরোপুরি নিভে গেছে। বাতাসে শুধু পোড়া কাঠ আর মাংসের গন্ধ। এতক্ষন কিছু না হলেও এবার গন্ধে শৌর্যের বমি আসছে। ঈশানী উঠছে না, ওরা নাভি নিয়ে গঙ্গার দিকে চলে গেছে। শৌর্য ঈশানীর হাতের উপর হাত রেখে বললো, “এবার ওঠো”। আচম্বিতে অন্ধ চরাচরকে চমকে দিয়ে উচ্চৈঃস্বরে কেঁদে উঠলো ঈশানী। আশপাশের গাছ থেকে নাম- না- জানা পাখির দল চিৎকার করতে করতে উড়ে মাথার উপর পাক খেতে লাগলো। দূরে গঙ্গায় অস্থি বিসর্জন করতে যাওয়া দলটা মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালো, পিছন ফিরে তাকালো, আবার চলতে শুরু করলো। শৌর্য ইশানীকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। তার বুকের মধ্যে গোটাতে থাকা শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। এখন আর কান্নার কোনো আওয়াজ হচ্ছে না। কিন্তু শৌর্যের শার্ট, গেঞ্জি ভিজে যাচ্ছে। এই প্রথমবার শৌর্যের চোখের কোন ভিজে গেল, সে বুঝতে পারলো মেয়েটা জীবনের মতো একটা গোটা বাপের বাড়ি হারিয়ে ফেলল।

 

 

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
বাঁশি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বাঁশি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শুনুন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা বাঁশি । কবিতাটি আবৃত্তি করেছেন কলকাতার সু-পরিচিত সাহিত্যিক মহীতোষ গায়েন। শুনুন এবং জানান আপনার মতামত-    
জোড়া কবিতা

জোড়া কবিতা

রঞ্জিত সরকার    ব্রহ্মপুত্র আদি পৃথিবীর আদি নদী এক বৈতরণী কিংবা অলকনন্দা নয় আমার প্রাণের প্রবাহ ছোঁয়ে উৎসারিত নদী ব্রহ্মপুত্র।  প্রাণের স্পন্দন তোলে ভাঙতে     ...
উজানে বহো রে

উজানে বহো রে

গৌতম সরকার  খুন দুটো শেষ পর্যন্ত হয়েই গেল, যদিও ‘প্ল্যান-এ’তে কোনও খুনের কথা ছিলনা। কিন্তু ড্রাইভার ফড়েটা এমন তিড়িংবিড়িং শুরু করল, তার ওপর তিনতলার ছাদের ...
ব্যবধান  | আশিকুর রহমান বিশ্বাস

ব্যবধান  | আশিকুর রহমান বিশ্বাস

 | আশিকুর রহমান বিশ্বাস     তখন আমন ধানের মতো ঘ্রাণ তার চুলে। শুনেছিলাম, কাকের ডাক তবু আহা কী মধুর! এলো সে ক্ষীণপদে হেঁটে যেনবা ...
কবর কবিতা | পল্লীকবি জসীমউদ্দিন | Bangla poem recitation | Sad Poem | বাংলা দুঃখের কবিতা

কবর কবিতা | পল্লীকবি জসীমউদ্দিন | Bangla poem recitation | Sad Poem | বাংলা দুঃখের কবিতা

পল্লীকবি জসীমউদ্দিনের জগদ্বিখ্যাত কবিতা “কবর”। কবিতাটি মনের মাধুরী মিশিয়ে হৃদয়ের গহীন থেকে অদ্ভুত এক সুরে পাঠ করেছেন আবৃত্তিকার মহীতোষ গায়েন। তিনি কলকাতা সিটি কলেজ এর ...
স্বর্গ নরক 

স্বর্গ নরক 

জোবায়ের রাজু  আজ বহুদিন পর সাত সকালে বড় দা’র এমন অপ্রত্যাশিত আগমন দেখে আমাদের চোখ যেন এক শ হাত উপরে উঠে গেল। একি দেখছি আমরা! ...